এ পাঠ শেষে আপনি- সম্পূরক খাদ্য কি, মাছের সম্পূরক কাকে বলে ও সম্পূরক খাদ্যের প্রকারভেদ সম্পর্কে জানতে পারবেন। মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরি করতে পারবেন। মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির নিয়ম ও মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির ক্ষেত্রে যেসব সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় তা বুঝতে পারবেন। পুকুরে সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োগ পদ্ধতি, সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োগমাত্রা ও খাদ্যের পরিবর্তন হার সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।
(১) মাছের সম্পূরক খাদ্য কি/কাকে বলে?
জলাশয় বা পুকুরের মাটি ও পানির স্বাভাবিক উর্বরতায় পুকুরে যে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদিত হয় তা দিয়ে মাছের খাদ্য চাহিদা পূরণ হয় না। পুকুরে পরিমিত সার প্রয়োগের মাধ্যমে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করা হলে তাতেও মাছের পরিপূর্ণ পুষ্টি সাধন হয় না।
মাছের সম্পূরক খাদ্য কি/কাকে বলে: অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রাকৃতিক খাদ্য যোগানের পাশাপাশি পুকুর বা জলাশয়ের বাইরে থেকে মাছকে কিছু খাদ্য দেওয়া হয়। বাইরে থেকে দেওয়া এসব খাদ্যকে সম্পূরক খাদ্য বলে। চালের কুড়া, গমের ভূষি, সরিষার খৈল ইত্যাদি সম্পূরক খাদ্য।
(২) মাছের সম্পূরক খাদ্যের প্রকারভেদ
মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এরকম বহুসংখ্যক দ্রব্য আমাদের দেশে রয়েছে।
মাছের সম্পূরক খাদ্যের বিভিন্ন ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়ে থাকে। খাদ্য ও শক্তি এবং আমিষের পরিমাণের ভিত্তিতে সম্পূরক খাদ্যের শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। যথা-অধিক শক্তি সম্পূর্ণ খাদ্য ও কম শক্তি সম্পন্ন খাদ্য।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বিভিন্ন ধরনের শস্যদানায় অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে আমিষ থাকে, কিন্তু এগুলো অধিক পরিমাণে শক্তি উৎপাদন করে। আবার অনেক খাদ্যে উৎপাদন অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে আমিষ থাকে, যথা-টিস্যু মিল, ফিস মিল ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো তুলনামূলক কম শক্তি সরবরাহ করে।
সম্পূরক খাদ্যকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
- প্রাকৃতিক সম্পূরক খাদ্য
- কৃত্রিম সম্পূরক খাদ্য বা তৈরি খাদ্য
উৎস অনুযায়ী প্রাকৃতিক সম্পূরক খাদ্যদ্রব্যকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
- উদ্ভিদ খাদ্য
- প্রাণিজ খাদ্য
(৩) মাছের সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োগ মাত্রা
পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকলে অধিক পরিমাণে সম্পূরক খাদ্যে সরবরাহ করতে হয় এবং প্রাকৃতিক খাদ্য বেশি পরিমাণ থাকলে কম পরিমাণ সম্পূরক সম্পূরক খাদ্যে প্রয়োগ করতে হয়।
পুকুরের পানির গুণাগুণের সাথে খাবারের পরিমাণের সম্পর্ক রয়েছে। পুকুরে যেসব খাদ্য সরবরাহ করা হয় তার সবটুকু মাছ সরাসরি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। খাদ্যের কিছু অংশ পানিতে মিশে পানির গুণাগুণকে প্রভাবিত করে। এতে করে অনেক সময় পানির গুণাগুণ খারাপ হতে পারে ফলে মাছের মৃত্যুও হতে পারে। পুকুরের পানির গুণাগুণ ঠিক রাখার জন্য কোনো সুব্যবস্থা না থাকলে প্রতি একরে দৈনিক ১৫ কেজির বেশি খাবার দেয়া ঠিক নয়।
মাছের দৈহিক ওজন অনুযায়ী পুকুরে প্রতিদিন খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। সাধারণভাবে রুই জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে মজুতকৃত মাছের মোট ওজনের ৩-৫% হারে প্রতি দিন দুবার সকাল বিকাল সম্পূরক খাদ্যে প্রয়োগ করতে হয়।
(৪) মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরিকরণ
মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ও অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করার জন্য প্রাকৃতিক খাদ্য যথেষ্ট নয়। এই ঘাটতি পূরণে সম্পূরক খাদ্যের প্রয়োজন হয়। মাছের জন্য বাইরে থেকে যে খাদ্য পুকুরে দেওয়া হয় তাকে সম্পূরক খাদ্য বলে। এই খাদ্যে মাছের প্রয়োজনীয় শ্বেতসার, আমিষ, ভিটামিন খনিজ লবণ, স্নেহ ইত্যাদি সঠিক পরিমাণ থাকে।
মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য বেশকিছু প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করে নিতে হবে। যেমন-
১। ফিশমিল, ২। মাছের গুঁড়া, ৩। চালের কুঁড়া, ৪। সরিষার খৈল, ৫। গম, ৬। বালতি, ৭। ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ, ৮। চিটাগুড়, ৯। পানি, ১০। মিক্সার মেশিন ইত্যাদি।
মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য খাদ্যের উপাদানের তালিকা টেবিলের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হলো। যথা-
খাদ্যোপকরণের নাম | পরিমাণ |
১। চালের কুড়াঁ | ৩.৩০ কেজি |
২। গম | ২.০০ কেজি |
৩। সরিষার খৈল | ৩.০৫ কেজি |
৪। মাছের গুড়া | ১.০০ কেজি |
৫। চিটাগুড় | ৬০০ গ্রাম |
৬। ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ | ৫০ গ্রাম |
মোট | ১০ কেজি |
মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির কার্যপদ্ধতির বর্ণনা করা হলো। যথা-
- প্রথমে প্রয়োজনমত সরিষার খৈল একটি পাত্রের পানিতে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- ভিজা খৈল, পরিমাণ মতো চালের কুঁড়া ও চিটা গুড় একত্রে মিশিয়ে ছোট ছোট বল তৈরি করতে হবে।
- পাত্রটি পুকুরে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পানির ৩০ থেকে ৪৫ সে.মি. নিচে বাঁশের সাথে বেঁধে ডুবিয়ে রাখতে হবে।
- প্রতিদিন প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্য দু’ভাগ করে সকালে ও বিকালে পানির নিচে পাত্রে দিতে হবে।
- খাদ্য প্রদানের স্থানকে মাঝে মাঝে পরিষ্কার করে দিতে হবে।
- পোনার ক্ষেত্রে ১০-১৫% ভেজা খাদ্য মোল্ড আকারে পুকুরের চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে।
খাদ্য তৈরির সময় কিছু সাবধানতা অবলমাবন করা উচিত। যেমন-
- সকল উপকরণ সঠিক ও নির্ভুলভাবে মেপে দিতে হবে।
- খাদ্য তৈরির স্থান পরিষ্কার হতে হবে।
- খাদ্য উপকরণ যেন নষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
(৫) মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি
উপরে আমরা খাদ্য তৈরি করার নিয়ম জানলাম, চলুন এবার মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে জানি।
মাছের সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি হলো-
- প্রথমে পরিমাণমত খৈল একটি পাত্রে কম পক্ষে ১০-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। অতঃপর ভিজা খৈলের সাথে প্রয়োজনীয় পরিমাণ চালের কুড়া বা চিটাগুড়া মিশিয়ে ছোট ছোট গোলাকার বল তৈরি করতে হবে।
- পুকুর বা জলাশয়ে মজুদকৃত মাছের দৈহিক ওজন অনুযায়ী খাবার দিতে হয়। মাছ কী পরিমাণ খাবার গ্রহণ করেছে তার পরিমাণ নির্ধারণ করে সঠিক মাত্রায় খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়।
- কার্প জাতীয় মাছের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় খাদ্য গোলাকার পিন্ড আকারে এবং মাংসাশী ও রাক্ষুসে মাছের ক্ষেত্রে পিলেট আকারে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
- একই সাথে পুকুরের বিভিন্ন স্থানে খাদ্য দিতে হবে। খাদ্য দ্রব্য সরাসরি ছিটিয়ে না দিয়ে ডুবন্ত খাবার ট্রে বা পাটাতনে দিতে হবে।
- প্রতিদিন নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য দিতে হবে। প্রতি দিনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যে সম্ভব হলে ভাগ করে তিন বারে দিলে ভালো অল্প পরিমাণে ও বেশি বার খাবার প্রয়োগ কারলে খাবারের অপচয় হয় না।
- খাদ্য দিনের আলোতে দিতে হবে। সূর্যোদয়ের আগে বা সূর্যাস্তের পরে খাদ্য দেওয়া ঠিক নয়।
(৬) খাদ্যের পরিবর্তন হার
খাদ্যের পরিবর্তন হার বলতে মাছ কর্তৃক গৃহীত খাদ্যের পরিমাণ এবং উক্ত পরিমাণ খাদ্য গ্রহণের ফলে মাছের ওজনে যে বৃদ্ধি ঘটে এ দুইয়ের অনুপাতকে বুঝায়।
অর্থাৎ মাছের প্রতি একক ওজন বৃদ্ধির জন্য যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন হয় তাকেই উক্ত খাদ্যের খাদ্য পরিবর্তন হার বলা হয়। যেমন-মাছের ১ কেজি ওজন বৃদ্ধির জন্য যদি ৩ কেজি খাদ্য প্রয়োজন হয় তবে উক্ত খাদ্যর পরিবর্তন হার হবে ৩ঃ১। খাদ্যের পরিবর্তন হার একটি সংখ্যামান; এর কোন একক নাই।
সূত্রঃ খাদ্যের পরিবর্তন হার = (গৃহীত খাদ্যের পরিমাণ ÷ মাছের বর্ধিত ওজন) = {প্রয়োগকৃত খাদ্যের পরিমাণ ÷ (উৎপাদিত মাছের মোট ওজন-মজুদকৃত পোনার মোট ওজন)}।
সাধারণভাবে খাদ্যের পরিবর্তন হার নির্ণয়ের সময় মাছ কর্তৃক জলজ পরিবেশ থেকে গৃহীত প্রাকৃতিক খাদ্যকে বিবেচনা করা হয় না। খাদ্যের পরিবর্তন হার খাদ্যদ্রব্যের পুষ্টিমান ও হজমের হারের ওপর নির্ভর করে। যে খাদ্যের পরিবর্তন হার সূচক সংখ্যামান যত কম সে খাদ্যের পরিবর্তন হার তত ভালো এবং উৎপাদনশীলতাও তত বেশি।
খাদ্যের পরিবর্তন হার খাদ্যের গুণগতমান নির্দেশ করে। ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন নিয়ামক খাদ্যের পরিবর্তন হারকে প্রভাবিত করে। ব্যবস্থাপনার কৌশলের উন্নয়ন ঘটিয়ে খাদ্যের পরিবর্তন হারের সংখ্যামান হ্রাস করা যায়। অর্থাৎ সমপরিমাণ খাদ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত অধিক পরিমাণে মাছ উৎপাদন করা যায়।
প্রিয় খামারি বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনাটির মাধ্যমে আমরা মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরি ও প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে জানলাম ও শিখলাম।
অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রাকৃতিক খাদ্য যোগানোর পাশাপাশি পুকুর বা জলাশয়ের বাইরে থেকে মাছকে যে খাদ্য দেওয়া হয় তাকেই সম্পূরক খাদ্য বলে। পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকলে অধিক পরিমাণে সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়। পুকুর বা জলাশয়ের মজুতকৃত মাছের দৈহিক ওজন অনুযায়ী খাবার খাদ্য দিতে হয়। মাছের প্রতি একক ওজন বৃদ্ধির জন্য যে পরিমাণ খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন হয় তাই হলো খাদ্য পরিবর্তন হার।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।