আদা (Zingiber officinale) বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্র্ণ অর্থকরী মসলা ফসল হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
সুদূর অতীত থেকে আদা মসলা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি কাঁচা, শুকনা ও সংরক্ষিত অবস্থায় খাওয়া হয়ে থাকে। বিভিন্ন ঔষধি গুণ সম্পন্ন এই ফসল ব্যাথানাশক, প্রদাহ, বাতরোগ, ডায়াবেটিস, রক্তের কোলেষ্টরল কমানো, অন্ত্রের রোগ ও সর্দি কাশি প্রভৃতি রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য তৈরির ক্ষেত্রে আদা একটি অন্যতম উপাদান।
কাঁচা আদায় শতকরা ২.৩ ভাগ প্রোটিন, ১২.৩ ভাগ শ্বেতসার, ১.০-৩.০০ ভাগ উদ্বায়ী তেল, ২.৪ ভাগ আঁশ, ১.২ ভাগ খনিজ পদার্থ, ৮০.৮ ভাগ পানি, রেজিন ইত্যাদি উপাদান বিদ্যমান।
বাংলাদেশের কৃষক পর্যায়ে আদার গড় ফলন ৮.৩০ টন/হেক্টর। যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। দেশে প্রতি বৎসর আদার চাহিদা ২.৩৫ লক্ষ মেট্রিক টন। প্রতি বছর গড়ে ৯.৯১ হাজার হেক্টর জমিতে ৭৯.৪৪ হাজার মেট্রিক টন আদা উৎপন্ন হয়, যা চাহিদার তুলনায় কম।
(বিবিএস ২০১৭)
ফলন কম হওয়ার মূল কারণ উন্নত ফলনশীল জাত এবং উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতির অভাব। আদার ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীবৃন্দ কয়েক বৎসর যাবত গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে বাছাইকরণের মাধ্যমে ‘বারি আদা-২’ ও ‘বারি আদা-৩’ নামে ৩টি উচ্চ ফলনশীল আদার জাত উদ্ভাবন করেছেন।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উষ্ণণাঅঞ্চল আদার উৎপত্তি স্থান। বাংলাদেশের লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় আদার চাষ করা হয়। এছাড়া ভারত, চীন, বার্মা, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, জ্যামাইকা, নাইজেরিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান, সিওরালিওন, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল ইত্যাদি দেশে আদার ব্যাপক চাষ হয়।
(১) আদার জাতের নাম ও তাদের বৈশিষ্ট্য
ক) বারি আদা-১
জাতটি বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০০৮ সালে উদ্ভাবন করা হয়।
- গাছের উচ্চতা প্রায় ৮০ সেমি।
- প্রতি গোছায় পাতার সংখ্যা ২১-২৫টি এবং পাতাগুলি আংশিক খাড়া প্রাকৃতির।
- প্রতি গোছায় টিলারের সংখ্যা ১০-১২টি।
- প্রতিটি গোছায় রাইজোমের ওজন ৪০০-৪৫০ গ্রাম।
- প্রচলিত জাতগুলির চেয়ে এর ফলন তুলনামূলকভাবে বেশি।
- স্থানীয় জাতের মত ‘বারি আদা-১’ সহজে সংরক্ষণ করা যায়।
খ) বারি আদা-২
আদা বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ হলেও বর্ষজীবী হিসাবেই সাধারণত আবাদ করা হয়।
- ‘বারি আদা-২’ একটি উচ্চ ফলনশীল জাত যা ১৯ মার্চ ২০১৭ খ্রি. কৃষকের চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত হয়েছে।
- এ জাতের জীবনকাল ৩০০-৩১৫ দিন, গাছের গড় উচ্চতা ৮৮-৯০ সে.মি, গড় পাতার সংখ্যা ৪৯৫-৫০৩ টি, গড় কুশির সংখ্যা ২৯-৩০টি।
- গড় প্রাইমারী রাইজোমের ওজন ৬৭-৭০ গ্রাম, গড় সেকেন্ডারী রাইজোমের ওজন ৫৫০-৫৫৭ গ্রাম।
- জাতটির হেক্টরপ্রতি ৩৭.৯৯ টন পর্যন্ত ফলন হয় যা ‘বারি আদা-১’ থেকে শতকরা ৭৬.৫৩% বেশি।
- জাতটি কান্ডপচা রোগ সহনশীল।
গ) বারি আদা-৩
- ‘বারি আদা-৩’ একটি উচ্চ ফলনশীল জাত যা ১৯ মার্চ ২০১৭ খ্রি. কৃষকের চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত করা হয়েছে।
- এ জাতের জীবনকাল ৩০০-৩১০ দিন, গাছের গড় উচ্চতা ৭৫-৭৯ সেমি, গড় পাতার সংখ্যা ৪২৫-৪২৯ টি, গড় কুশির সংখ্যা ২৪-২৬ টি,
- গড় প্রাইমারী রাইজোমের ওজন ৫৯-৬০ গ্রাম, গড়। সেকেন্ডারী রাইজোমের ওজন ৪৪০-৪৪২ গ্রাম।
- জাতটির হেক্টর প্রতি ২৯.০৫ টন।
- জাতটি কান্ডপচা রোগ সহনশীল।
(২) আদা চাষ পদ্ধতি ও কলাকৌশল
ক) আবহাওয়া জলবায়ু
আমাদের বাংলাদেশে আদার উৎপাদনকাল সমগ্র খরিফ মৌসুমব্যাপী বিস্তৃত। আদার জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র আবহওয়া দরকার। অল্প ছায়াযুক্ত স্থানে আদা ভাল হয়।
আদা রোপণের পরপরই গজানো জন্য মাটিতে যথেষ্ট রস থাকা দরকার। তাই রোপণের পর বৃষ্টিপাত না হলে জমিতে সেচ প্রদান করতে হয়।
সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ১৫০০ মিটার উঁচু পার্বত্য অঞ্চলেও আদা চাষ করা যায়। আদার জন্য বাৎসরিক ৩,০০০ মিমি বৃষ্টিপাত প্রয়োজন।
আদা ২৮-৩৫০ সে. তাপমাত্রা চাষাবাদ করা যায় তবে তাপমাত্রায় ১০০ সে. এর নিচে নেমে গেলে আদা গাছ মারা যায়।
খ) মাটি
ঊর্বর দোআঁশ মাটি আদার চাষের জন্য সবচেয়ে ভাল। তবে বেলে দোআঁশ থেকে এঁটেল দোআঁশ মাটিতেও চাষ আদা চাষ করা যায়।
এঁটেল দোআঁশ মাটিতে চাষ করতে হলে পানি নিষ্কাশনের খুব ভাল ব্যবস্থা থাকতে হবে। জমিতে পানি বেঁধে থাকলে আদা পচে নষ্ট হয়ে যায়।
গ) বীজ রোপণ সময়
এপ্রিল মাসের প্রথম-দ্বিতীয় সপ্তাহে রোপণকৃত বারি আদা-আদা-২ ও আদা- ৩ থেকে ফলন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। আদা মে মাস পর্যন্ত রোপণ করা যায়।
গাছের দৈহিক বৃদ্ধির ৩-৪ মাস পর রাইজম উৎপন্ন হয়। তাই দেরিতে রোপণকৃত আদা গাছের বৃদ্ধি যথাযথ না হওয়ার কারণে ফলন কম হয়।
ঘ) জমি শোধন
আদা গাছে কান্ড পচা রোগের আক্রমণ সবচেয়ে বেশি। এ রোগ প্রতিরোধের জন্য মাটি শোধন করতে হয়। মাটি শোধনের কয়েকটি পদ্ধতি নিচে দেওয়া হলো।
- নিম খৈল প্রতি শতকে ২ কেজি হারে প্রয়োগ করে মাটি শোধন করা যায়।
- ফুরাডান প্রতি বিঘায় ২-২.৫ কেজি হারে প্রয়োগ করে মাটি শোধন করা যায়।
- আদা লাগানোর ১৫-২০ দিন পূর্বে জমি ভালভাবে চাষ দিয়ে মাটি আলগা করে মাটির উপরে ধানের তুষ বা কাঠের গুঁড়া স্তর আকারে বিছিয়ে তাতে আগুন দিয়ে মাটি শোধন করা যায়।
ঙ) জমি তৈরি
- মার্চ-এপ্রিল মাসে বৃষ্টি হওয়ার পর জমিতে যখন ‘জো’ আসে তখন ৬-৮ টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করা হয়।
- এরপর ১.৫ মিটার প্রস্থ এবং ৪ মিটার দৈর্ঘ্যের বা জমির আকার অনুযায়ী দৈর্ঘ্যরে বেড তৈরি করে নিয়ে চারিদিকে ১-১.৫ ফুট গভীর নালা করে নালার মাটি বেডের উপর দিয়ে বেডকে উঁচু করতে হবে।
- পানি সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধার জন্য দুটি বেডের মাঝখানে ৫০ সেমি প্রশস্ত নালা রাখতে হবে।
চ) বীজের আকার এবং হার
ফলন বীজের আকারের উপর নির্ভর করে। এজন্য ২৫-৫০ গ্রাম পর্যন্ত বীজ লাগানো যায়। তবে আর্থিক ও প্রাপ্যতা বিবেচনায় গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে যে ৪০-৪৫ গ্রাম আকারের বীজ আদা রোপণ করলে লাভজনক ফলন পাওয়া যায়। এ আকারের বীজ ব্যবহার করলে হেক্টরপ্রতি ২৮০০-৩০০০ কেজি আদার দরকার হয়।
চ) বীজ শোধন
বীজের মাধ্যমে আদা সংক্রমিত হয় বিধায় নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে আদা বীজ শোধন করতে হবে।
এ জন্য ৭৫-৮০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ বা অন্য কোন ছত্রাকনাশক ঔষধ মিশিয়ে তার মধ্যে ১০০ কেজি আদা বীজ ৩০-৪০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপর উক্ত বীজ আদা উঠিয়ে ছায়াযুক্ত জায়গায় শুকাতে হবে এবং তারপর জমিতে রোপণ/লাগাতে হবে।
আদা বীজ জমিতে লাগানোর পূর্বে ঝুড়িতে বিছিয়ে তার উপর খড়/চটের বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখলে কয়েকদিনের মধ্যে ভ্রণ বের হয়। এ রকম গাজানো আদা বীজ থেকে দ্রুত আদার গাছ জন্মায়।
ছ) বীজ রোপণ
বারি আদা-১ এর বীজ দুইভাবে রোপণ করা যায় যেমন- বহুসারি পদ্ধতি ও একক সারি পদ্ধতি।
বহুসারি পদ্ধতি আদা বীজ বেডে সারি থেকে সারি ৩০ সেমি দূরত্বে এবং রাইজম/কন্দ থেকে কন্দ ২৫ সেমি দূরত্বে রোপণ করা হয়।
একক সারি পদ্ধতিতে বীজ আদা সরু লাঙ্গল বা রো-কোদাল দিয়ে ৫০-৬০ সেমি দূরে দূরে ৫-৬ সেমি গভীর করে সারি তৈরি করে এতে ২৫-৩০ সেমি দূরত্বে বীজ আদা লাগাতে হয়।
সারিতে বীজ আদা লাগানোর সময় বীজের অঙ্কুরিত মুখ একইদিকে রাখতে হয় রোপণের ৭৫-৯০ দিন পর সারির এক পার্শ্বের মাটি সরিয়ে সহজেই পিলাই সংগ্রহ করা যায়। এভাবে পিলাই আদা সংগ্রহ করে বিক্রি করলে বীজের খরচ ৫০-৬০ ভাগ উঠে আসে।
জ) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
কৃষি পরিবেশ অঞ্চলের উপর সারের পরিমাণ নির্ভর করে। বেশি ফলন পেতে হলে আদার জমিতে প্রচুর পরিমাণ জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
বারি আদা-১, ২ ও ৩ এর জন্য প্রতি শতকে নিম্নোক্ত পরিমাণে জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
সার | মোট পরিমাণ (কেজি) | শেষ চাষের সময় দেয় (কেজি) | প্রথম কিস্তি (কেজি) | দ্বিতীয় কিস্তি (কেজি) | তৃতীয় কিস্তি (কেজি) |
গোবর | ২০ | ২০ | – | – | – |
ইউরিয়া | ১.২৩ | – | ০.৬১৫ | ০.৩০৮ | ০.৩০৮ |
টিএসপি | ১.০৮ | ১.০৮ | – | – | – |
এমওপি | ০.৯৪ | ০.৪৭ | – | ০.২৩৫ | ০.২৩৫ |
জিংক সালফেট | ৪৮ গ্রাম | ৪৮ গ্রাম | – | – | – |
জিপসাম | ০.৪৫ | ০.৪৫ | – | – | – |
প্রতি হেক্টরে সার প্রয়োগের পরিমাণ নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
সার | মোট পরিমাণ (কেজি) | শেষ চাষের সময় দেয় (কেজি) | প্রথম কিস্তি (কেজি) | দ্বিতীয় কিস্তি (কেজি) | তৃতীয় কিস্তি (কেজি) |
গোবর | ৫ টন | ৫ টন | – | – | – |
ইউরিয়া | ৩০৪ | – | ১৫২ | ৭৬ | ৭৬ |
টিএসপি | ২৬৭ | ২৬৭ | – | – | – |
এমওপি | ২৩৩ | ১১৬.৫০ | – | ৫৮.২৫ | ৫৮.২৫ |
জিংক সালফেট | ১২ | ৩ | – | – | – |
জিপসাম | ১১১ | ১১১ | – | – | – |
১ শতক = ৪০ বর্গমিটার।
সম্পূর্ণ গোবর সার, টিএসপি, জিপসাম, জিংক ও অর্ধেক এমওপি জমি তৈরির শেষ চাষের সময় মাটিতে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রথম কিস্তিতে অর্ধেক ইউরিয়া আদা লাগানোর ৫০ দিন পর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার ২য় ও ৩য় কিস্তিতে সমান দুইভাগে ভাগ করে বপনের যথাক্রমে ৮০ ও ১১০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে।
ঝ) আন্তঃপরিচর্যা
- বীজ রোপণের ২-৩ সপ্তাহ পর আদা গাছ বের হয়। আদা লাগানোর পর প্রয়োজনে জমিতে সেচ দিতে হবে।
- রোপণের ৪-৫ সপ্তাহ পর থেকে জমির আগাছা ভালভাবে পরিষ্কার করে দিতে হবে।
- এরপর প্রতিবার ইউরিয়া সার প্রয়োগ করার পূর্বে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
- সার প্রয়োগ করে গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দিতে হবে।
- এছাড়াও গাছের কান্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি, রাইজমের সঠিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধার জন্য ২-৩ বার আদার দুই সারির মাঝখান থেকে মাটি তুলে সারি বরাবর আদার গাছের গোড়ায় দিতে হবে।
ঞ) মালচিং প্রয়োগ
ধানের খড়, কচুরিপানা বা অন্য গাছের লতা পাতা দিয়ে মালচিং করে আদা চাষ করা যায়। এতে উৎপাদন খরচ যেমন কমানো যায় অন্যদিকে মাটি আর্দ্রতাও সংরক্ষণ করা যায়। ফলে বীজ আদা থেকে তাড়াতাড়ি গাছ বের হতে পারে।
ট) ছায়া প্রদান
আদা আংশিক ছায়া পছন্দকারী ফসল। সরাসরি প্রখর সূর্যালোকে আদা গাছের বৃদ্ধি ও ফলন ব্যহত হয়। এক্ষেত্রে আদার মাঠে ৩-৪ সারি পর পর এক সারি করে ধৈঞ্চার বীজ ৪-৫ ফুট দূরত্বে বপন করে ছায়ার ব্যাবস্থা করা যেতে পারে। এতে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন ভাল হয়।
ঠ) ফসল সংগ্রহ
রাইজোম রোপণের ৯-১০ মাস পর পরিপক্ক ফসলের পাতা এবং গাছ হলুদ রঙের হয়ে শুকিয়ে যায়। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে কোদাল দিয়ে মাটি আলগা করে আদা উত্তোলন করা হয়। ফসল সংগ্রহের পর শিকড় ও মাটি পরিষ্কার করে আদা গুদামজাত করা হয়।
ড) ফলন
বারি আদা-২ সাধারণত প্রতি হেক্টরে ৩৭.৯৯ টন ও বারি আদা-৩ সাধারণত প্রতি হেক্টরে ২৯.০৫ টন পর্যন্ত ফলন দেয়।
আদার সাথে সাথী ফসল চাষ: আদা প্রায় ১০-১১ মাসের ফসল। একই জমিতে আদার উপর মাচা তৈরি করে মাচায় লতা জাতীয় সবজি যেমন- লাউ, পটল, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, শিম ইত্যাদি সবজি ও মাচার নিচে আদার চাষ করে অধিক মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। এছাড়াও আদার সারির মাঝে পাতলা করে বেগুন বা মরিচ উৎপাদন করা যায়।
ঠ) সংরক্ষণ
আদা উঠানোর পর পরিষ্কার ছায়াযুক্ত স্থানে মাটিতে গর্ত করে বা ঘরের মধ্যে মেঝেতে গর্ত করে গর্তের নিচে ২ ইি পরিমাণ বালি দিয়ে পুরু করে তার উপর আদা রেখে আবার ১-২ ইি বালুর স্তর দিয়ে আদা ঢেকে রাখতে হবে। এতে করে আদা শুকিয়ে যাওয়া রোধ করা যায়।
(৩) আদা চাষে রোগবালাই দমন ব্যবস্থা
ক) রাইজোম রট বা কন্দ পচা
কন্দ পচা রোগ আদা ফসলের একটি বিনাশকারী মারাত্মক রোগ। এই রোগের আক্রমণে আদা ফসলের ক্ষেত সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ও ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। এটি মাটি ও বীজবাহিত রোগ।
Pythium sp. (P. aphanidermatum, P. debaryanum & P. gingiberasum), Fusarium sp., Pseudomonas sp. ইত্যাদি জীবাণু এবং Melodygyne sp. বা Root knot Nematodes এর সম্মিলিত আক্রমণে এ রোগের সৃষ্টি হয়।
এ রোগ বীজ আদা, মাটি, ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এবং আদা ক্ষেতে ব্যবহৃত জুতার মাধ্যমেও বিস্তার ঘটে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সংগঠিত বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট আর্দ্র আবহাওয়ায় আক্রমণের তীব্রতা এবং ছত্রাকের দ্রুত বংশ বৃদ্ধি ঘটে।
চারা বা কচি অবস্থায় গাছ এই রোগের প্রতি অধিকমাত্রায় সংবেদনশীল। গাছের কান্ড ও মাটির সঙ্গে স্থলে (কলার রিজিওন) প্রথমে আক্রমণ শুরু হয়ে ক্রমশ উপরে এবং নিচের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত স্থানে এ পানিভেজা দাগ সৃষ্টি হয়। পচা রোগ দ্রুত রাইজমের দিকে ধাবিত হয় এবং একে নরম পচা (Soft rot) রোগও বলে। পরবর্তীতে শিকড়েও এই রোগের বিস্তার ঘটে।
লক্ষণ:
বর্ষাকালে ৪-৬ সেমি দীর্ঘ গাছে এই রোগের লক্ষণ প্রথম প্রকাশ পায়। গাছের নিচের দিকের পাতার প্রান্তভাগে প্রথমে হালকা হলুদাভ লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং পর্যায়ক্রমে পত্র ফলকে (Leaf blades) রোগ বিস্তার লাভ করে।
এই রোগে আক্রমণের পাতার মধ্যভাগ সবুজ থাকলেও পাতার কিনারা ক্রমশ হলুদ হতে থাকে। গাছের উপর এবং নিচের সমস্ত পাতা হলুদ হয়ে গাছ ঝিমিয়ে পড়ে।
আদা ভূনিম্নস্থ কন্দ হওয়ায় আক্রান্ত গাছের মাটি সংলগ্ন এলাকায় পচনক্রিয়া শুরু হয় এবং ক্রমে পচন কন্দে ও শিকড়ে ছড়িয়ে পড়ে ফলে কন্দ নরম হয়ে ফুলে উঠে এবং অভ্যন্তরীণ টিস্যু সম্পূর্ণরূপে পচে যায়। মাটি সংলগ্ন পাতার ডাটা পচে ও শুকিয়ে মারা যায়। আক্রান্ত গাছ ধরে টান দিলে সহজে উঠে আসে।
দমন পদ্ধতি:
- উত্তম পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত উঁচু জমিতে এই রোগের আক্রমণ কম হয়।
- একই জমিতে পর পর ২ বছর আদা চাষ করা থেকে বিরত থাকা।
- পুষ্ট ও রোগমুক্ত বীজ আদা রোপণ করতে হবে।
- রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে রিডোমিল গোল্ড বা ১ গ্রাম হারে অটোস্টিন মিশিয়ে উক্ত দ্রবণে বীজকন্দ ৩০-৪০ মিনিট ডুবিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে রোপণ করতে হবে। একই পদ্ধতিতে বীজ কন্দ শোধন করে সংরক্ষণ করতে হবে।
- আদার মাতৃকন্দসমূহ রোপণের পূর্বে রোপণ সারিতে Coppeasan দিয়ে শোধন, ইহা শুধু রোগ দমনে সাহায্যই করে না বরং মারাত্মক রোগের আক্রমণের হাত থেকেও ফসলকে রক্ষা করে।
- প্রতি হেক্টর জমিতে নিম খৈল ২.৫ টন অথবা বাদামের খৈল ১.১ টন প্রয়োগের ফলে রাইজোম রট হ্রাস পায় ও ফলন বৃদ্ধি পায়।
- আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে যখন আক্রমণের প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ পায় তখন দ্রুত ব্লাইটক্স-৫০ বা ব্লু-কপার (কপার অক্সিক্লোরাইড ৫০% ডব্লিউ পি) প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম বা রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে মাটির সংযোগস্থলে ১৫-২০ দিন পর পর গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে।
খ) পাতার রোগ
পাতায় অনেক সময় ডিম্বাকৃতি দাগ দেখা যায়। এ দাগের মাঝখানে সাদা বা ধূসর রং ধারণ করে। পরে আক্রান্ত পাতা শুকিয়ে যায়।
প্রতিকার:
প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ মিশিয়ে ১৫দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায়।
(৪) আদা চাষে পোকামাকড় দমন ব্যবস্থা
বারি আদা-২ ও ৩ এ রাইজোম ফ্লাই ছাড়া অন্য পোকার আক্রমণ তেমন হয়না। তবে মাঝে মাঝে কান্ড বা পাতা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দেখা যায়।
ক) পাতা ছিদ্রকারী পোকা
এই পোকা পাতা ছিদ্র করে খেয়ে ফেলে। কচি পাতায় এই পোকার আক্রমণ বেশি দেখা যায়। তবে বৃষ্টিপাত শুরু হলে পোকার আক্রমণ কমে যায়।
দমন ব্যবস্থ্যাপনা:
আদার জমিতে এই পোকা দেখামাত্র হাত দিয়ে সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে তবে আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে কিনালাক্স/ রিপকর্ড ১ মিলি হারে প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে স্প্রে করে দমন করা যায়।
খ) রাইজোম ফ্লাই পোকা
রাইজোম ফ্লাই আদা চাষীদের নিকট একটি প্রধান সমস্যা এই পোকার আক্রমণে কোন কোন ক্ষেত্রে ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হতে পারে।
রাইজোম ফ্লাই দেখতে কালো রঙের চিকন ও লম্বা দেহ বিশিষ্ঠ পোকা যার পাখা আছে।
সাধারণত ছায়াযুক্ত স্থানে এবং গাছের পাতায় সকাল ৬.০-৯.০ এবং বিকাল ৬.০-৭.০ টার মধ্যে পূর্ণ বয়স্ক পোকা দেখা যায়।
স্ত্রী পোকা জুন মাস থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আদা গাছের কলার রিজিয়নে (কান্ড ও মাটির সংযোগস্থল) এবং নতুন জন্মানো রাইজোমে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার ১-২ দিনের মধ্যে ম্যাগোট বের হয় এবং কলারিজিয়নকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। ফলে গাছ হলুদ ও কলার রিজিয়ন বাদামী বর্ণ ধারণ করে।
আস্তে আস্তে ম্যাগোট রাইজোম ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে রাইজোমের ভিতরের অংশ খাওয়া শুরু করে। এপর্যায়ে ৭-৮ দিন পর পূর্ণাঙ্গ পোকা রুপে ক্ষতিগ্রস্ত রাইজোম থেকে বের হয়ে আসে।
ক্ষতির ধরন:
আদা লাগানোর ৩ মাস পর থেকে বৃষ্টিপাত শুরুর পরবর্তী অবস্থায় জমিতে কোন কোন আদার গাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করে।
গাছ টান দিলে রাইজোম থেকে সহজেই বিচ্ছিন্ন হয়ে আসে। বিচ্ছিন্ন হওয়া গাছের নিচের অংশে সাদা রঙ্গের কীড়া পাওয়া যায়।
একইভাবে আক্রান্ত গাছের আদা তুললে সেখানেও কীড়া এবং লাল রঙের পুত্তলী পাওয়া যায়। আক্রান্ত আদা হতে পচা দুর্গন্ধ বের হয়।
দমন ব্যবস্থ্যাপনা:
- সুস্থ বীজ ব্যবহার করতে হবে।
- আদার জমি থেকে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করতে হবে।
- বপনের পূর্বে বীজ রিডোমীল ২ গ্রাম/লিটার হারে মিশ্রণে ভিজিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে।
- আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র কীড়া ও পুত্তলীসহ ক্ষতিগ্রস্থ গাছ তুলে ধবংস করতে হবে।
- আক্রমণ বেশি হলে ক্লোরপারিফস ১৫জি ২ গ্রাম/ লিটার হারে মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর মোট ২বার গাছের গোড়াসহ মাটি ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]