লিচু (Litchi chinensis) একটি জনপ্রিয় গ্রীষ্মকালীন ফল। আকর্ষণীয় বর্ণ, স্বাদ ও উচ্চমান পুষ্টিগুণ ছাড়াও এটি গ্রীষ্মকালীন প্রচন্ড দাবদাহে মানবদেহ ঠান্ডা রাখতে অন্যতম সহায়ক।
লিচু ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফল। এছাড়া এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে অন্যান্য ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও এন্টি-অক্সিডেন্ট বিদ্যমান।
এটি একটি স্বল্পকালীন ফল এবং বাজারে বেশ উচ্চমূল্যে বিক্রয় হয় বিধায় এর চাষ খুবই লাভজনক। গ্রীষ্মকালীন ফল বিধায় এটি শুষ্ক আবহাওয়ার সময়ই চাষাবাদ করা হয়।
বাংলাদেশে ২০১১-২০১২ অর্থবছরে সর্বমোট ৫,৫৯৮.৩৮ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয় এবং উৎপাদিত লিচুর পরিমাণ ৫৬.৬৮৭ মেট্রিক টন (হাজারে), প্রতিটি গাছে উৎপাদিত লিচুর সংখ্যা প্রায় ৫০ কেজি।
(বিবিএস-২০১৩)
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট দীর্ঘদিন যাবৎ লিচু চাষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করে আসছে এবং অদ্যবধি বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চারটি জাত উদ্ভাবন করেছে যার প্রাতিষ্ঠানিক নাম বারি লিচু-১, বারি লিচু-২, বারি লিচু-৩, বারি লিচু-৪।
অত্র ইনস্টিটিউটের সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগ লিচু গাছে সেচের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছে এবং স্বল্প পানি ব্যবহারে করে বেশি ফলন পাবার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
নিম্নে আধুনিক পদ্ধতিতে লিচু চাষে সেচ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
মাটি ও আবহাওয়া:
লিচু অগ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের ফল। সংক্ষিপ্ত ঠান্ডা, শুষ্ক, বরফমুক্ত শীতকাল এবং উচ্চ বৃষ্টিপাত ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা সম্পন্ন দীর্ঘ উষ্ণ গ্রীষ্মকাল সমৃদ্ধ অঞ্চলে লিচু সবচেয়ে ভাল হয়। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১২০০ মিলিমিটার ও ৭০%- ৮০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা লিচু চাষের উপযোগী।
লিচু গাছের সন্তোষজনক বৃদ্ধির জন্য মাটিতে মাইকড়ইজা নামক ছত্রাকের উপস্থিতি প্রয়োজন।
গভীর, নিষ্কাশিত, ঊর্বর বেলে অথবা দোআঁশ মাটি লিচু চাষের জন্য উত্তম।
বাংলাদেশের সর্বত্রই কমবেশি এর চাষ হয়। তবে বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা, ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রাম জেলায় বেশি পরিমাণে লিচু উৎপন্ন হয়।
ফুল আসা পর্যায়ে দেশের অধিকাংশ এলাকার তাপমাত্রা হয় ২২-২৩ ডিগ্রি সে. এবং গুটি আসার সময় এ তাপমাত্রা হয় ২৫-২৬ ডিগ্রি সে.। পরবর্তীতে তাপমাত্রা আরও বেড়ে যায়, প্রস্বেদনের পরিমাণও বেড়ে যায়। এ সময় ভূ-গর্ভস্থ এবং ভূ-উপরিস্থ উভয় পানির প্রাপ্যতা হ্রাস পায়।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি:
গাছের যথাযথ বৃদ্ধি ও কাঙ্খিত ফলনের জন্য সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণও বাড়াতে হবে। বিভিন্ন বয়সের গাছের জন্য প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণ নিচের ছকে দেয়া হল।
গাছের বয়স (বছর) | ইউরিয়া | টিএসপি | এমওপি | জিপসাম | বরিক এসিড | গোবর (কেজি/গাছ/বছর) |
রোপণের পূর্বে | – | ৫০০ | – | ১৯৩ | – | ২০ |
০-১ | ৩০০ | – | – | – | – | ১০ |
2-4 | ৪০০ | ৫০০ | ২০০ | ১০০ | ১৫ | ১০ |
৫-৭ | ৫০০ | ৭৫০ | ৪০০ | ১০০ | ৩০ | ১৫ |
৮-১০ | ৭৫০ | ১৫০০ | ৮০০ | ১০০ | ৩০ | ২০ |
১১-১৫ | ১২০০ | ২০০০ | ১২০০ | ১৫০ | ৪৫ | ৩০ |
১৬-২০ | ১৫০০ | ২৫০০ | ১৫০০ | ২০০ | ৬০ | ৪০ |
২০ | ২০০০ | ৩৫০০ | ২০০০ | ২৫০ | ৭৫ | ৫০ |
চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে রোপণের জন্য প্রস্তুতকৃত গর্তে পরিমাণমতো গোবর, টিএসপি এবং জিপসাম ভাল করে মিশ্রিত করে প্রয়োগ করতে হবে। এ সময় সেচ প্রয়োগ করতে হবে। চারার প্রথম বছর, একই সময়ে জৈব সার এবং ইউরিয়া চারার চারদিকে প্রয়োগ করতে হবে এবং মাটির সাথে ভাল করে মিশিয়ে দিতে হবে
সার সমান তিন কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি বর্ষার শুরুতে (ফল আহরণের পর), দ্বিতীয় কিস্তি বর্ষার শেষে (আশ্বিন-কার্তিক মাসে) এবং শেষ কিস্তি গাছে ফুল আসার পর প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবার সার প্রয়োগের পর সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ প্রয়োগ/পদ্ধতি:
- গাছের গোড়া হইতে ২ থেকে ৩ মিটার দূরে রিং বেসিন পদ্ধতিতে পানি প্রয়োগ করতে হবে।
- গভীর, অগভীর বা হস্তচালিত নলকূপ হতে পলিথিন হুস পাইপের সাহায্যে রিং বেসিন পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ করাই উত্তম।
- সেচ এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে যেন শিকড়ের ৯০ সেমি গভীর পর্যন্ত মাটি ভালভাবে ভেজে।
- গাছের গোড়ায় মাটিতে পানির প্রাপ্যতা অনুযায়ী ফুল ফোটা পর্যায়ে (ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ) একবার এবং গুটি আসার সময় একবার (এপ্রিল) মোট দুইবার প্রতি গাছে প্রায় ১,৮০০ লিটার থেকে ২,৪০০ লিটার পানি প্রয়োগ করতে হবে।
- সেচের পানি সাধারণত সকালে অথবা বিকালে প্রয়োগ করতে হবে। যাতে সেচের পানি বাষ্পায়নজনিত অপচয় রোধ করা যায়।
- তাছাড়া প্রচন্ড তাপমাত্রায় রৌদ্রের সময় যাতে, লিচু গাছের গোড়ায় সেচ না দেওয়া হয় সেদিকে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
সেচের ওপর লিচুর ফলনের প্রভাব:
সেচ পর্যায় | প্রতি গাছে ফলন |
বিনাসেচে | ২৮.৪৯ কেজি লিচু পাওয়া যায় |
ফুল আসা পর্যায় ১টি সেচ প্রয়োগ করলে | ৩৯.৯০ কেজি কেজি লিচু পাওয়া যায় |
গুটি আসা পর্যায় ১টি সেচ প্রয়োগ করলে | ৩৬.৮২ কেজি কেজি লিচু পাওয়া যায় |
ফুল ও গুটি আসা উভয় পর্যায় ২টি সেচ প্রয়োগ করলে | ৪৪.৩৮ কেজি কেজি লিচু পাওয়া যায় |
গুটি আসার পর ১৫ দিন পর পর সেচ প্রয়োগ করলে | ৫২.৭৭ কেজি কেজি লিচু পাওয়া যায় |
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা ও ফল সংগ্রহ:
- গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য জমিকে আগাছামুক্ত করতে হবে।
- গাছের মরা, রোগাক্রান্ত ও অপ্রয়োজনীয় ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। কলমের চারার ক্ষেত্রে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য প্রথম ৩-৪ বছর পর্যন্ত মুকুল আসলে তা ভেঙ্গে দিতে হবে।
- লিচুতে সাধারণত ফল ছিদ্রকারী পোকা, লিচুর মাইট বা মাকড়, পাউডারী মিলডিউ ইত্যাদির আক্রমণ দেখা যায়।
- ফল ছিদ্রকারী পোকা থেকে রক্ষা পেতে হলে বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল বাগান থেকে কুড়িয়ে মাটির গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে। এ পোকা দমনের জন্য রিপকর্ড/ সিমবুশ/ সুমিসাইডিন/ ডেসিস স্প্রে করতে হবে।
- লিচুর মাইট বা মাকড় আক্রমণ দেখা দিলে ফল সংগ্রহের সময় আক্রান্ত পাতা ডালসহ ভেঙ্গে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। পোকা দমনে মাকড় নাশক ওমাইট ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
- পাউডারী মিলডিউ রোগে আক্রান্ত গাছে টিল্ট/থিওভিট ব্যবহার করা যেতে পারে।
- এছাড়া বাদুর লিচুর প্রধান শত্রু। বাদুড় তাড়ানোর জন্য রাতে পাহাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সমস্ত গাছ জালের সাহায্যে ঢেকে অথবা বাগানে গাছের উপর দিয়ে শক্ত ও চিকন সুতা টাঙ্গিয়ে রাখলে বাদুরের চলাচল বাঁধাগ্রস্থ হয়।
সেচের সুবিধাসমূহ:
- গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, গাছে ফুল আসার সময় এবং ধরার সময় ২ (দুই) বার সেচ দিলে সেচ বিহীন গাছের চাইতে ২-২.৫ গুণ ফলন বেশি হয়।
- ফলন বেশি হওয়ায় কৃষক প্রায় ২-২.৫ গুণ বেশি লাভবান হবে।
- সঠিক পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করলে লিচুর অন্তর্নিহিত গুণাগুণ বৃদ্ধি পায়। যার দরুণ বাজারে এর চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
- গবেষণায় দেখা গেছে পরিমিত পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করলে ফল ফেটে যাওয়া এবং ঝরে পড়া হ্রাস পায়।
[সূত্র: বিএআরআই]