Skip to content

আম গাছ লাগানোর নিয়ম ও আম চাষ পদ্ধতি

আম গাছ লাগানোর নিয়ম ও আম চাষ পদ্ধতি

গ্রীষ্মকালীন ফলের মধ্যে অন্যতম হলো আম। বাংলাদেশে আমকে ফলে রাজা বলা হয়। প্রচণ্ড গরম থাকায় মানুষ এ সময় আমের জুস, কাঁচা আম, পাকা আম, আমের কাস্টার্ড থেকে শুরু করে আমের কেক, আমের ডাল, আমের টক, আমের শরবত, আমের জুস ইত্যাদি বিভিন্নভাবে আম খেয়ে থাকেন।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় আমের জাতগুলোর নাম হলো-

  1. গোপালভোগ
  2. খিরসাপাত
  3. ল্যাংড়া
  4. ফজলী
  5. বোম্বাই
  6. আশ্বিনা 

এবার আসুন আম উৎপাদনের কৌশলগুলো জেনে নেওয়া যাক!

(১) আম গাছ লাগানোর নিয়ম ও আম চাষ পদ্ধতি

ফলসহ আমের গাছ
ফলসহ আমের গাছ

ক) মাটি

  • গভীর, সুনিষ্কাশিত, ঊর্বর দোআাঁশ মাটি আম চাষের জন্য উত্তম।
  • উঁচু ও মাঝারী উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে।

খ) জমি তৈরি

চাষ ও মই দিয়ে সমতল এবং আগাছামুক্ত করে নিতে হবে।

গ) রোপণ পদ্ধতি

  • সমতল ভূমিতে বর্গাকার বা আয়তাকার এবং পাহাড়ি ভূমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে চাষ করা যায়।
  • এক বছর বয়স্ক সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত কলমের চারা রোপণ করতে হবে।

ঘ) চারা রোপণের সময়

জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় (মধ্য-মে থেকে মধ্য-জুলাই) এবং ভাদ্র-আশ্বিন মাস (মধ্য-আগস্ট থেকে মধ্য-অক্টোবর)।

ঙ) চারা রোপণের দূরত্ব

৮ মিটার।

চ) গর্ত তৈরি

গর্তের আকার ১ মি. × ১ মি. × ১ মি.।

নিম্নে গর্তে সারের মাত্রা দেওয়া হলো-

সারের নামপ্রতি গর্তে সারের পরিমাণ
জৈব সার২০-৩০ কেজি
টিএসপি৪৫০-৫৫০ গ্রাম
এমওপি২০০-৩০০ গ্রাম
জিপসাম২০০-২৩০ গ্রাম
জিংক সালফেট৪০-৬০ গ্রাম

ছ) চারা রোপণ

  • গর্ত ভর্তির ১০-১৫ দিন পর চারার গোড়ায় মাটির বলসহ গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে লাগাতে হবে।
  • চারা রোপণের পর পানি, খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

জ) সার প্রয়োগ

চারা রোপণের পর গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। গাছ বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণও বাড়াতে হবে।

বয়স ভিত্তিতে গাছপ্রতি সারের পরিমাণ নিম্নে দেখানো হলো-

সারের নামগাছের বয়স ১-৪ (বছর)গাছের বয়স ৫-৭ (বছর)গাছের বয়স ৮-১০ (বছর)গাছের বয়স ১১-১৫ (বছর)গাছের বয়স ১৬-২০ (বছর)গাছের বয়স ২০-এর উর্দ্ধে (বছর)
গোবর (কেজি)২৬৩৫৪৪৫২৭০৮৭
ইউরিয়া (গ্রাম)৪৩৭৮৭৫১৩১২১৭৫০২৬২৫৩৫০০
টিএসপি (গ্রাম)৪৩৭৪৩৭৮৭৫৮৭৫১৩১২১৭৫০
এমওপি (গ্রাম)১৭৫৩৫০৪৩৭৭০০৮৭৫১৪০০
জিপসাম (গ্রাম)১৭৫৩৫০৪৩৭৬১২৭০০৮৭৫
জিংক সালফেট (গ্রাম)১৭১৭২৬২৬৩৫৪৪
বরিক এসিড (গ্রাম)৩৫৩৫৫২৫২৭০৮৭

ঝ) প্রয়োগ পদ্ধতি

  • বয়স ভেদে নির্ধারিত সম্পূর্ণ পরিমাণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট এবং বরিক এসিড এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক এমওপি সার সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শেষ সময়ে প্রয়োগ করতে হবে।
  • অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার সমান দুই ভাগ করে এক ভাগ মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে যখন ফল মটর দানার মতো হয় তখন এবং অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার ফল সংগ্রহের ১ মাস পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
  • এখানে উল্লেখ্য যে, গাছের চারিদিকে গোড়া থেকে কমপক্ষে ১ থেকে ১.৫ মি. দূরে হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বেশি হলে এই দূরত্ব বাড়তে পারে।
  • সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ দিতে হবে।
  • এছাড়াও ইউরিয়া ২% (প্রতি ১ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম) দ্রবণ ফলের মটরদানা আকৃতি অবস্থায় একবার এবং মার্বেল আকৃতি অবস্থায় আর একবার প্রয়োগে অধিক এবং গুণগতমানসম্পন্ন ফলন পাওয়া যায়।
See also  আমের ও জলপাই এর আচারের রেসিপি এবং আচার তৈরি করার পদ্ধতি

ঞ) সেচ প্রয়োগ

  • চারা গাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য ঘন ঘন সেচ দিতে হবে।
  • ফলন্ত গাছের বেলায় মুকুল বের হওয়ার ৩ মাস আগে থেকে সেচ প্রদান বন্ধ রাখতে হবে।
  • আমের মুকুল ফোটার শেষ পর্যায়ে ১ বার এবং ফল মটর দানার আকৃতি ধারণ পর্যায়ে আবার ১ বার বেসিন পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ করতে হবে।

ট) ডাল ছাঁটাইকরণ

  • গাছের প্রধান কান্ডটি যাতে সোজাভাবে ১ থেকে ১.৫ মিটার ওঠে সেদিকে লক্ষ্য রেখে গাছের গোড়ার অপ্রয়োজনীয় শাখা কেটে ফেলতে হবে।
  • প্রতি বছর বর্ষার শেষে মরা, রোগাক্রান্ত ও দুর্বল ডালপালা কেটে দিতে হয়।

ঠ) গাছের মুকুল ভাঙ্গন

কলম গাছের বয়স ৩ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মুকুল ভেঙ্গে দিতে হবে।

ড) ফল সংগ্রহ

গাছে কিছু সংখ্যক আমের বোঁটার নিচের ত্বক যখন সামান্য হলুদাভ রং ধারণ করে অথবা আধাপাকা আম গাছ থেকে পড়া আরম্ভ করে তখন আম সংগ্রহ করার উপযুক্ত সময়।

  • পরিপক্ব আমের খোসার রং বোটার নিচের ত্বক সামান্য হলদে।
  • আমটির শাঁসের রং হালকা হলদে হবে।
  • পানিতে ছাড়লে আম ডুবে যাবে।

গাছ ঝাকী দিয়ে আম না পেড়ে ছোট গাছের ক্ষেত্রে হাত দিয়ে এবং বড় গাছের ক্ষেত্রে জালিযুক্ত বাঁশের সাহায্যে আম সংগ্রহ করা ভালো।

আমের পরিপক্কতা শনাক্তকরণ:

গবেষণার মাধ্যমে কয়েকটি উন্নত জাতের আমের পরিপক্কতা নির্দেশক নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব নির্দেশক দেখে আম সংগ্রহ করলে আমের গুণগত মান ভাল থাকে এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। এতে পরিবহণে অপচয়ও কম হয়।

আমের পরিপক্কতার নির্দোশকসমূহ:

কতগুলো উন্নত জাতের আমের পরিপক্কতার নির্দেশক ও সংগ্রহের সময় নিচে উল্লেখ করা হল।

আমের জাতপরিপক্কতার সময়কাল (গুটি ধরার পর থেকে)পরিপক্কতা নির্দেশক/ঘনত্ব
 – –লবণের দ্রবণে  ডুবে যাবেলবণের দ্রবণে ভাসবে
গোপালভোগ৮৪-৯১ দিন১-৪%৪% এর বেশি
খিরসাপাত৮৭-৯৫ দিন১-৪%৪% এর বেশি
ল্যাংড়া৯৭-১০৫ দিন১-৩%৩% এর বেশি
ফজলী১১২-১২০ দিন১-৩%৩% এর বেশি
বোম্বাই৯৮-১০৫ দিন১-২%২% এর বেশি
আশ্বিনা১৩৯-১৪৬ দিন১-২%২% এর বেশি

(২) আম চাষে পোকা ও রোগ দমন ব্যবস্থাপনা

ক) আমের হপার পোকা ও এ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমন

এ্যানথ্রাকনোজ রোগাক্রান্ত আম
এ্যানথ্রাকনোজ রোগাক্রান্ত আম
  • শোষক পোকা (হপার) এবং এ্যানথ্রাকনোজ রোগ আমের প্রধান শত্রু।
  • বিভিন্ন পর্যায়ে এরা আমের ক্ষতি করে থাকে। তবে মুকুল অবস্থায় ক্ষতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি।
  • সঠিক দমন ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে শতভাগ ফসল বিনষ্ট হতে পারে।
  • মুকুল আসার সময় শোষক পোকা (হপার) এবং এ্যানথ্রাকনোজ রোগের আক্রমণে ফুল ঝরে যায়।

প্রতিকার:

পরাগায়ণ নিশ্চিত করতে হবে। আমের মুকুল এসেছে কিন্তু ফুল ফোঁটার পূর্বেই অর্থাৎ পুষ্পমঞ্জরী ছড়ার দৈর্ঘ্য ৫-১০ সেমি হয় তখন প্রতি লিটার পানিতে সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড/সিমবুশ/ফেনম/বাসাথ্রিন) ১০ ইসি ১ মিলি এবং টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে একবার এবং তার একমাস পর আম মটর দানার আকৃতি হলে আরেকবার গাছের পাতা, মুকুল ও ডালপালা ভালভাবে ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে।

খ) আমের ভোমরা পোকা দমন

  • আমের ভোমরা পোকার কীড়া আমের গায়ে ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে শাঁস খায়।
  • সাধারণত কচি আমে ছিদ্র করে এর ভিতরে ঢুকে এবং ফল বড় হওয়ার সাথে সাথে ছিদ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য বাইরে থেকে আমটি ভাল মনে হলেও ভিতরে কীড়া পাওয়া যায়।
  • একবার কোন গাছে এ পোকার আক্রমণ হলে প্রতি বছরই সে গাছটি আক্রান্ত হয়ে থাকে। ক্রমে ক্রমে পার্শ্ববর্তী গাছসমূহে তা ছড়িয়ে পড়ে।
  • সাধারণত কলমের আম গাছে এ পোকার আক্রমণ কম হয়।
See also  আমের জাতের নাম ও গাছের বৈশিষ্ট্য

প্রতিকার:

  1. মুকুল আসার পূর্বে পৌষ-মাঘ মাসে সম্পূর্ণ বাগান বা প্রতিটি আম গাছের চারদিকে ৪ মিটারের মধ্যে সকল আগাছা পরিষ্কার করে ভালভাবে মাটি কুপিয়ে উল্টে দিলে মাটিতে থাকা উইভিলগুলো ধ্বংস হয়।
  2. আম সংগ্রহের পর গাছের সমস্ত পরগাছা ও পরজীবী উদ্ভিদ ধ্বংস করতে হবে।
  3. ফলের মার্বেল অবস্থায় প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড/সিমবুস/ফেনম/ বাসাথ্রিন) ১০ ইসি মিশিয়ে গাছের কান্ড, ডাল ও পাতা ভালভাবে ভিজিয়ে ১০-১৫ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

(৩) আমের ফুল ও ফল ঝরা রোধে টেকসই ব্যবস্থাপনা

  • গাছের বয়স অনুসারে তিন কিস্তিতে নির্দেশিত মাত্রার সার প্রয়োগঃ প্রথম কিস্তি (সম্পূর্ণ জৈব সার, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট এবং বরিক এসিড এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও অর্ধেক এমওপি সার) ১৫-৩০ সেপ্টেম্বর এর মধ্যে প্রয়োগ করতে হবে।
  • অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার সমান দুই ভাগ করে এক ভাগ (দ্বিতীয় কিস্তি) মার্চ মাসের শেষ সময়ে যখন ফল মটর দানার মত হয় তখন এবং অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমওপি সার এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অথবা আম সংগ্রহের এক মাস পূর্বে প্রয়োগ করতে হবে।
  • এখানে উল্লেখ্য যে, গাছের চারিদিকে গোড়া থেকে কমপক্ষে ১ থেকে ১.৫ মি. দূরে হালকাভাবে কুপিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বেশী হলে এই দূরত্ব বাড়তে পারে।
  • সার প্রয়োগের পর হালকা সেচ দিতে হবে।

গাছের বয়স অনুসারে সারের মাত্রা-

সারের নামগাছের বয়স ১-৪গাছের বয়স ৫-৭গাছের বয়স ৮-১০গাছের বয়স ১১-১৫গাছের বয়স ১৬-২০গাছের বয়স ২০ এর উর্দ্ধে
গোবর (কেজি)২৬.২৫৩৫৪৩.৭৫৫২.৫০৭০৮৭.৫০
ইউরিয়া (গ্রাম)৪৩৭.৫০৮৭৫১৩১২.৫০১৭৫০২৬২৫৩৫০০
টিএসপি (গ্রাম)৪৩৭.৫০৪৩৭.৫০৮৭৫৮৭৫১৩১২.৫০১৭৫০
এমওপি(গ্রাম)১৭৫৩৫০৪৩৭.৫০৭০০৮৭৫১৪০০
জিপসাম (গ্রাম)১৭৫৩৫০৪৩৭.৫০৬১২.৫০৭০০৮৭৫
জিংকসালফেট (গ্রাম)১৭.৫০১৭.৫০২৬.২৫২৬.২৫৩৫৪৩.৭৫
বরিকএসিড (গ্রাম)৩৫৩৫৫২.৫০৫২.৫০৭০৮৭.৫০
  • গাছে সম্পূণরূপে ফুল প্রষ্ফুটিত (Full bloom) হবার পর থেকে শুরু করে, ১৫ দিন অন্তর আম গাছে ৪ বার সেচ দিতে হবে।
  • আমের হপার পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপ এর কীটনাশক; কনফিডর৭০ ডব্লিউজি, প্রতি লিটার পানিতে ০.২ গ্রাম এবং এনথ্রাকনোজ রোগ দমনের জন্য ম্যানকোজেব গ্রুপ এর ছত্রাকনাশক; ইন্ডোফিল এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম, এক সাথে মিশিয়ে, ২ বার; মুকুল বের হবার পর কিন্তু ফুল ফোটার আগে ১ বার এবং ফল মটর দানাআকৃতিতে আরেকবার প্রয়োগ করতে হবে।
  • ইউরিয়া ২% (প্রতি ১ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম) দ্রবন ফলের মটরদানা আকৃতি অবস্থায একবার এবং মার্বেল আকৃতি অবস্থায় আর একবার প্রয়োগে অধিক এবং গুণগতমানসম্পন্ন ফলন পাওয়া যায়।

(৪) অনুন্নত আম গাছকে উন্নত জাতে রূপান্তর

টপ ওয়ার্কিং এর মাধ্যমে অনুন্নত আম গাছকে সহজেই উন্নত জাতে রূপান্তরিত করা যায়।

  1. এ জন্য ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে অনুন্নত আম গাছের সমস্ত প্রশাখা কেটে দিতে হবে।
  2. জুন-জুলাই মাসে কর্তিত প্রশাখা থেকে উৎপন্ন ডালসমূহে ভিনিয়ার/ক্লেফট পদ্ধতিতে উন্নত জাতের কলম করতে হবে।
  3. কলমের নিচ থেকে কুশি বের হলে সেগুলো নিয়মিত অপসারণ করতে হবে।
  4. এভাবে ২-৩ বছরের মধ্যে অনুন্নত আম গাছটি উন্নত জাতে রূপান্তরিত হবে।
See also  আম চাষের পদ্ধতি ও আম গাছের পরিচর্যা

(৫) গরম পানিতে আম শোধন

শোধনকৃত আম ও অশোধনকৃত আম
শোধনকৃত আম ও অশোধনকৃত আম
  • গাছ থেকে আম সংগ্রহের পর পরই আম ৫২-৫৫০ সে. তাপমাত্রায় গরম পানিতে ৫-৭ মিনিট ডুবিয়ে শোধনের মাধ্যমে বোঁটা পচা ও এ্যানথ্রাকনোজ রোগ দমন করে আমের সংরক্ষণকাল অতিরিক্ত এক সপ্তাহ বাড়ানো যায় এবং সংগ্রহোত্তর অপচয় রোধ করা সম্ভব।
  • গরম পানিতে আম শোধনের একটি যন্ত্রও (হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ যন্ত্রের সাহায্যে পানির তাপমাত্রা ও শোধনের সময় ঠিক রেখে
    প্রতি ঘণ্টায় ১ টন আম শোধন করা যায়। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় প্রতি কেজি আমের শোধন খরচ ৪০-৫০ পয়সা।

(৫) রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি

গুণগত মানসম্পন্ন, নিরাপদ ও বিষমুক্ত ফল উৎপাদনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আ লিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ দীর্ঘদিন যাবৎ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় অত্র কেন্দ্র হতে উদ্ভাবন হলো ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি।

এই প্রযুক্তিটি বাংলাদেশে একটি নতুন ও সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি হিসেবে মাঠপর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। যে সময়ে আমরা চিন্তিত ও আতংকিত ছিলাম ফল বাগানে বালাইনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে এ সময়েই আম বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করলেন নতুন এই প্রযুক্তির, যা শুধু সাশ্রয়ীই নয় পরিবেশ বান্ধবও বটে।

গাছে ব্যাগিংকৃত আম
গাছে ব্যাগিংকৃত আম

প্রকৃতপক্ষে মাঠ পর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদন করতে গিয়ে চাষীদের বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রোগ, পোকামাকড় ও প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট সমস্যা। ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই সকল সমস্যাগুলোকে সমাধান করে ভালোমানের আম উৎপাদন করা যায়।

ফ্রুট ব্যাগিং বলতে ফল গাছে থাকা অবস্থায় বিশেষ ধরনের কাগজের তৈরি ব্যাগ দ্বারা ফলকে আবৃত করাকে বুঝায় এবং এর পর থেকে ফল সংগ্রহ করা পযন্ত গাছেই লাগানো থাকবে ব্যাগটি। এই ব্যাগ বিভিন্ন ফলের জন্য বিভিন্ন রং এবং আকারের হয়ে থাকে।

তবে আমের জন্য দুই ধরণের ব্যাগ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রঙিন আমের জন্য সাদা রঙের ব্যাগ এবং অন্য সকল আমের জন্য দুই আস্তরের বাদামী ব্যাগ।

বর্তমানে আমচাষীরা দুই স্তরের বাদামি ব্যাগ বাণিজ্যিকভাবে আম উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করছেন এবং লাভবান হচ্ছেন। তবে আগাম জাতসমূহে এক স্তরের সাদা রঙের ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে।

ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদিত ফলসমূহ নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও রপ্তানি উপযোগী।

ব্যাগিং করার উপযুক্ত সময় হলো-

  • আমের প্রাকৃতিকভাবে ঝরা বন্ধ হলেই ব্যাগিং শুরু করতে হবে।
  • বারি আম-১, গোপালভোগ, খিরসাপাত, ল্যাংড়া, বারি আম-২, বারি আম-৬ এবং বারি আম-৭ জাতের ক্ষেত্রে ব্যাগিং করা হয় ৪০-৫৫ দিন বয়সে। এই সময়ে আম জাতভেদে মার্বেল আকারের বা এর চেয়ে বড় হয়ে থাকে।
  • তবে বারি আম-৩, ৪, ৮, ফজলি, হাড়িভাঙ্গা, আশ্বিনা এবং গৌড়মতি আমের ক্ষেত্রে গুটির বয়স ৬৫ দিন হলেও ব্যাগিং করা যাবে।
  • ব্যাগিং করার পূর্বে অবশ্যই কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক নির্দেশিত মাত্রায় ভালভাবে মিশিয়ে শুধুমাত্র ফলে স্প্রে করতে হবে।
  • ফল ভেজা অবস্থায় ব্যাগিং করা ঠিক নয়।
  • আমের ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিনটি স্প্রে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন প্রথমবার আম গাছে মুকুল আসার আনুমানিক ১৫-২০ দিন পূর্বে, দ্বিতীয়বার মুকুল আসার পর অর্থাৎ আমের মুকুল যখন ১০-১৫ সেমি লম্বা হবে কিন্তু ফুল ফুটবেনা এবং আম যখন মটর দানারমতো হবে তখন তৃতীয়বার। সুতরাং এর পরপরই আমে স্প্রে করে ব্যাগিং করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
  • ব্যাগিং করার পূর্বেই মরা মুকুল বা পুষ্মমুঞ্জুরীর অংশবিশেষ, পত্র, উপপত্র অথবা এমন কিছু যা ফলের ক্ষতি করতে পারে সেগুলো ছিড়ে ফেলতে হবে।

যে সকল এলাকায় আম বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয় না বা শুধুমাত্র পারিবারিক চাহিদা পূরণে আম গাছ লাগানো হয়েছে এবং এই সমস্ত গাছে সময়মত স্প্রে করা হয় না বা সেই ধরনের প্রচলন এখনও এলাকায় চালু হয়নি ফলে প্রতি বছরই তাদের গাছে আম ধরে কিন্তু পোকা ও রোগের কারণে অধিকাংশ আম নষ্ট হয়ে যায়। এসব আমগাছে এই প্রযুক্তিটি সবচেয়ে কার্যকর।

ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে শতভাগ রোগ ও পোকামাকড় দমন করা যায়
ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে শতভাগ রোগ ও পোকামাকড় দমন করা যায়

এছাড়াও যে সকল এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হয় এবং আম দেরিতে পাকে সে সকল আমের জাতগুলো বিবর্ণ বা কারো রং ধারণ করতে দেখা যায় এবং মাছি পোকার আক্রমণ দেখা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় নাবীজাত আশ্বিনাতে ১০০ ভাগ আমের মাছি পোকার আক্রমণে নষ্ট হয়ে যায়। যে সমস্ত বাগানে ঘন করে আম লাগানো হয়েছে এবং বর্তমানে গাছের ভিতরে সূর্যের আলো পৌছায়না সে সকল গাছে আমের মাছি পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে।

আমের এই ব্যাগিং প্রযুক্তি দ্বারা সবচেয়ে কম পরিমাণে বালাইনাশক ব্যবহার করে ১০০% রোগ ও পোকামাকড় মুক্ত আম উৎপাদন করা সম্ভব।

এছাড়াও ব্যাগিং করা আম সংগ্রহের পর ১০-১৪ দিন পর্যন্ত ঘরে রেখে খাওয়া যায়। সেই সাথে রঙিন, ভাল মানসম্পন্ন নিরাপদ আমও পাওয়া যায়।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মাছি পোকা দমনের জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বা প্রচলিত আছে কোনটিতেই এই মাছি পোকাকে শতভাগ দমন করা সম্ভব নয় বরং আক্রমণের হার কিছুটা কমিয়ে রাখা যায়। ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির মাধ্যমে শতভাগ রোগ ও পোকামাকড় দমন করা যায়।

আম রপ্তানির জন্য ভাল মানসম্পন্ন, রঙিন ও রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ মুক্ত আম প্রয়োজন। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে এই তিন বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ঘটানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন আম রপ্তানিকার দেশে বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত পদ্ধতি হচ্ছে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি।

ব্যাগিং প্রযুক্তি হতে ভাল ফলাফল পাওয়ার জন্য কয়েকটি বিষয়ের প্রতি অবশ্যই নজর দিতে হবে-

  • নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাগিং করতে হবে।
  • ব্যাগিং করার পূর্বে আমগুলিকে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক একত্রে মিশিয়ে শুধুমাত্র ফলে স্প্রে করতে হবে।
  • ব্যাগিং করার কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা পূর্বে স্প্রে করতে হবে। তবে স্প্রে করার পরের দিনও ব্যাগিং করা যাবে যদি বৃষ্টিপাত না হয়।
  • ফল ভেজা অবস্থায় ব্যাগিং করা উচিৎ নয়।

সঠিক নিয়মকানুন ও পদ্ধতি অনুসরণ করে যে সকল চাষী ব্যাগিং করছেন তারা বেশ ভালো অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

নিরাপদ, বিষমুক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি
নিরাপদ, বিষমুক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি

নিরাপদ, বিষমুক্ত, স্বাস্থ্যসম্মত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তিটি একটি সহজ, সাশ্রয়ী ও লাভজনক প্রযুক্তি হিসেবে মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।

[সূত্র: বিএআরআই]

Tags:

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts