প্রতিটি প্রাণী ও পশু-পাখি বংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে বছরের পর বছর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। পোল্ট্রির ক্ষেত্রে ডিম হচ্ছে বংশ বৃদ্ধি তথা সংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান মাধ্যম। শুধু তাই নয় এটি ব্যবসার সফলতা অথবা ব্যর্থতা নির্ধারণ করে।
যে ডিম থেকে পরবর্তীতে বাচ্চা ফোটানো যায় তাকে হ্যাচিং ডিম বলে।
হ্যাচিং ডিম হওয়ার পূর্ব শর্ত অবশ্যই নিষিক্ত হতে হবে। নিষিক্ত না হলে কখনোই সেই ডিম থেকে বাচ্চা হবে না। হ্যাচিং ডিম নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাড়তি সর্তকতা নিতে হবে। সেই সাথে ডিম ফোটানোর পদ্ধতিও জানা প্রয়োজন। হ্যাচিং ডিম পাওয়ার জন্য কি করনীয় তাও জানা অত্যাবশ্যক। নিষিক্ত ডিম পাওয়া ও তা থেকে বাচ্চা উৎপাদন, ডিমের যত্ন ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা থাকলে একজন সফল হ্যাচারিম্যান তথা লাভজনক খামারি হওয়া সম্ভব।
এখানে ডিম অনুর্বর হয় কেন? ডিমের যত্ন ও সংরক্ষণ, বাচ্চা ফোটানোর জন্য ডিম বাছাইকরণ ও সুস্থ ডিম নির্বাচন, ডিম ফোটানোর পদ্ধতি কয়টি ও কি কি? ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর বিভিন্ন পদ্ধতি, বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
এই পাঠটি শেষ অবধি অধ্যয়ন করেলে আপনি- ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর পদ্ধতি শিখতে পারবেন, ডিম অনুর্বর হয় কেন তা জানতে পারনে। ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা পাবেন ও সুস্থ ডিম নির্বাচন করতে পারবেন।
(১) ডিম অনুর্বর হয় কেন? ডিমের যত্ন ও সংরক্ষণ
এই অংশে আমরা ডিম অর্নুবর হওয়ার কারণসমূহ জানব। ফোটানো ডিমের যত্ন সম্পর্কে অবগত হব। ডিম কিভাবে সংরক্ষণ করতে হয় তা শিখব।
ক) ডিম অনুর্বর হয় কেন?
মোরগ মুরগির মিলন ব্যতীত উৎপাদিত ডিমকে অর্নুবর ডিম বা অনিষিক্ত ডিম বলে। ডিম ফোটানোর হার ডিমের উর্বরতার সাথে সম্পর্কিত। অনুর্বর ডিম থেকে কখনও বাচ্চা ফোটে না। এ জন্য ডিম অনুর্বর হওয়ার কারণ জানা প্রয়োজন।
নিচে ডিম অনুর্বর হয় কেন তার সম্ভাব্য কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে-
- অপর্যাপ্ত পুষ্টি: মোরগের শুক্রাণু দিয়ে ডিম নিষিক্ত হয়। তাই মোরগের পুষ্টির অভাব হলে বীর্যে মৃত শুক্রাণুর সংখ্যা বেড়ে যায়। ফলে ডিম অনুর্বর হওয়ার সম্ভবনা বাড়ে।
- মোরগ ও মুরগির অনুপাত: সাধারণত হালকা জাতের ৮-১০টি মুরগির জন্য একটি মোরগ এবং ভারি জাতের ৫-৬টি মুরগির জন্য কমপক্ষে ১টি মোরগ রাখা অত্যাবশ্যক। মোরগ-মুরগির অনুপাত ঠিক না থাকলে প্রজনন হার কমে যায় এবং ডিম নিষিক্ত না হলে বাচ্চা পাওয়া যায় না। লক্ষ্য রাখতে হবে নির্বাচনকৃত মোরগের স্বাস্থ্য যেন ভালো থাকে।
- মুরগির বয়স: ডিম পাড়া শুরুর প্রথম ৬-৮ মাস ডিম ফোটানোর হার সবচেয়ে বেশি থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ডিম ফোটানোর হার কমতে থাকে। তবে মুরগির বয়স এক বছর পর্যন্ত ডিম ফোটানোর হার ভালো থাকে। মোরগের ক্ষেত্রে ১ বছর পর্যন্ত প্রজনন হার ভালো থাকে। বয়স বাড়লে ডিম অনুর্বর হওয়ার সংখ্যা বাড়ে।
- আন্তঃপ্রজনন: আন্তঃপ্রজনন বলতে বুঝায় পরিবারের অর্থাৎ খুব কাছের সম্পর্কেও মোরগ-মুরগির মধ্যে প্রজনন। আন্তঃপ্রজননের ফলে অনুর্বতার হার বাড়ে এবং প্রাপ্ত বাচ্চায় বেশির ভাগ থেকে অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যায়।
- রোগ ও শারীরিক অক্ষমতা: মোরগ-মুরগির উভয়ের ক্ষেত্রে রোগ একটি বিশেষ কারন যার ফলে ডিম অনুর্বর হতে পারে। রোগাক্রান্ত মুরগির থেকে প্রাপ্ত ডিম অনুর্বর হওয়ার সম্ভবনা থাকে। মুরগির ওজন অতিরিক্ত হলে প্রজনন অঙ্গের মাধ্যমে শুক্রাণু সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারবে না ফলে ডিম অনুর্বর হয়।
- ঋতুর প্রভাব: অতিরিক্ত গরম পড়লে সাময়িকভাবে ডিমের উর্বরতা কমে যায়। শীতকালে পাড়া ডিম গ্রীষ্মকালের ডিমের চেয়ে বেশি উর্বর হয়।
- কর্তৃত্ত্ব: ঝাঁকের মধ্যে সাধারনত মোরগ মুরগির উপর কর্তৃত্ব খাটিয়ে থাকে। যদি বিপরীত ঘটনা ঘটে তবে মিলন ঘটে না এতে অনুর্বর ডিম উৎপাদন হয়। অন্যদিকে, মোরগ আক্রমণাত্বক হলে মুরগি ভয় পায় এবং লুকিয়ে থাকে, ফলে ডিম অনুর্বর হয়।
- ভিটামিন ও খণিজপদার্থের অভাব: মোরগের উর্বরতা বাড়ানোর জন্য খাদ্যে ভিটামিন ও খণিজপদার্থের অভাব পূরণ করা বাঞ্চনীয়। বিশেষ করে খাদ্যে দীর্ঘদিন হতে ভিটামিন ই এর পর্যাপ্ততা না থাকলে মোরগ বন্ধা হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়। এতে অনুর্বর ডিম উৎপাদিত হয়।
- মোরগের বয়স: অপরিপক্ক মোরগকে প্রজনন কাজে ব্যবহার করলে অনুর্বর ডিম পাওয়া যায়।
- মুরগির বাসস্থান: প্রজননের জন্য ব্যবহৃত ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও পর্যাপ্ত আলো ও বায়ু চলাচল থাকতে হবে। বাসস্থানের উপর ডিমের উর্বরতা অনেকাংশে নির্ভর করে।
খ) ফোটনোর ডিমের যত্ন ও সংরক্ষণ
ফোটানোর ডিমের সঠিক পরিচর্চা দরকার। ডিম বসানোর পূর্ব পর্যন্ত যত্ন নিলে ডিম ভালো থাকে। ফোটানোর ডিম বেশি দিন সংরক্ষণ করা হলে ডিম ফোটার হার কমে যায়। খোসার আকারভেদে ৮,০০০-১০,০০০ ছিদ্র থাকেব। এসব ছিদ্র দিয়ে সহজেই রোগজীবাণু ডিমের ভিতর প্রবেশ করতে পারে এবং ডিম পচে যায়। ডিম সংরক্ষণ করার জন্য একটি পরিষ্কার স্থান নির্বাচন করতে হবে।
ডিম সংরক্ষণের সময় নিম্নোক্ত ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা উচিত-
- তাপমাত্রা: ডিম সংরক্ষণ জন্য খুব বেশি গরম বা ঠান্ডা কোনোটাই ভালো না। বাচ্চা ফোটানোর ডিম ৫০-৫৫ ফারেনহাইট বা ১০-১২ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হবে। বানিজ্যিকভাবে বড় বড় হ্যাচারিতে (যেখানে ডিম ফোটানো হয়) শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ডিম সংরক্ষণ করা হয়।
- আদ্রতা: বাচ্চা ফোটানোর ডিম সংরক্ষণের জন্য আপেক্ষিক আদ্রতা ৬৫-৭৫%-এ রাখতে হবে। আদ্রতা কম হলে ডিম থেকে জলীয় বাষ্পের মাধ্যমে জলীয় অংশের পরিমাণ কমে যায়, ফলে ডিম ফোটার হার কমে যায়। জলীয় অংশের পরিমাণ ১৪%-এর বেশি কমে গেলে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর হার অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়।
- ডিম নাড়াচাড়া করা: ফোটানোর ডিম বেশি দিন সংরক্ষণ করলে তা ঘুরিয়ে দিতে হবে যাতে ডিমের সবদিকে তাপমাত্রা ও আদ্রতা ঠিক থাকে। সংরক্ষণের সময় ডিমের মোটা অংশ ট্রের উপর দিকে এবং সরু অংশে নিচের দিকে করে রাখতে হবে। ফোটানোর ডিম সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হবে। অতিরিক্ত ঝাঁকানো হলে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার হার কমে যায়।
- ডিম সংগ্রহ: ফোটানোর ডিম দিনে ৩ বার সংগ্রহ করতে হবে। ডিম দীর্ঘক্ষণ ডিম পাড়ার বাক্সে রাখলে তা অতি দ্রুত জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। অনেক সময় মুরগিকে ঠোঁট দিয়ে ডিম ভেঙ্গে ফেলতে দেখা যায়। সে কারণে যত দ্রুত সম্ভব ফোটানোর ডিম ডিম পাড়ার বাক্স থেকে সরিয়ে নিতে হবে।
দলে মোরগ না থাকলে ডিম উর্বর হয় না। উর্বর ডিম পাওয়ার জন্য মোরগ ও মুরগির নির্দিষ্ট অনুপাত বজায় রাখতে হয়। উর্বর ডিম থেকে বাচ্চা নিশ্চিত পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও ডিম নাড়াচাড়া সহ কিছু বিষয়াদি ঠিক ভাবে মেনে বলতে হবে। সব কিছু ঠিক থাকলে নিষিক্ত বা উর্বর ডিম থেকে একটি সুস্থ সবল বাচ্চা পাওয়া সম্ভব।
(২) বাচ্চা ফোটানোর জন্য ডিম বাছাইকরণ ও সুস্থ ডিম নির্বাচন
আলোচনার এই অংশে আমরা নিষিক্ত বা উর্বর ডিমের গুণাগুণ ও বৈশিষ্ট্য জানব। বাচ্চা ফোটানোর জন্য ডিম বাছাইকরণ ও সুস্থ ডিম নির্বাচন করা শিখব।
ডিম থেকে সন্তোষজনক হারে স্বাস্থ্যবান ও উৎপাদনশীল বাচ্চা পাওয়ার জন্য সঠিকভাবে ডিম নির্বাচন করতে হবে।
নিচের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ডিম নির্বাচন করলে সর্বাধিক বাচ্চা পাওয়া যেতে পারে-
- নিষিক্ত ডিম: ফোটানোর জন্য ব্যবহৃত ডিম নিষিক্ত হতে হবে। আর এজন্য মুরগিকে মোরগের সংস্পর্শে থাকতে হবে ও প্রজনননে অংশ নিতে হবে।
- ডিমের আকার: ফোটানোর জন্য ডিমের আকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিমের আকার স্বাভাবিক হতে হবে। প্রজাতিভেদে ডিমের আদর্শ ওজন কেমন হয় তার ধারণা থাকতে হবে। সাধারণত মাঝারি আকারের ডিম ফোটানোর জন্য ভালো। মুরগি, হাঁস ও জাপানি কোয়েলের ডিমের আদর্শ ওজন যথাক্রমে ৫০-৫৮ গ্রাম, ৬০-৭০ গ্রাম ও ৮-১০ গ্রাম হওয়া বাঞ্ছনীয়। আদর্শ মানের চেয়ে অতিরিক্ত বড় বা ছোট ডিম ব্যবহার করলে ফোটার হার কম হবে। আবার বেশি লম্বা ও বড় আকারের ডিমে ২টি কুসুম থাকতে পারে বলে এসব ডিম থেকে কখনই বাচ্চা ফুটবে না।
- ডিমের আকৃতি: মুরগির ডিম ডিম্বাকৃতির হয়ে থাকে। অস্বাভাবিক বা বিকৃত, যেমন- লম্বাটে, গোলাকার, আঁকাবাকা ডিম ফোটানোর জন্য নিবার্ চন যোগ্য নয়।
- ডিমের খোসার পরিচ্ছন্নতা: অবশ্যই পরিষ্কার ডিম নির্বাচন করতে হবে। অপরিষ্কার ডিম জীবাণুর উৎস। অপরিষ্কার ডিম থেকে একদিকে যেমন ডিম ফোটানোর সময় অন্য ডিমে জীবাণু ছড়ায় তেমনি যন্ত্রপাতিও নোংরা হয়। এতে ডিম ফোটার হারও কমে যায়। তবে অল্প ময়লা লেগে থাকলে তা পরিষ্কার ও শুষ্ক কাপড় বা শিরিষ কাগজ দিয়ে মুছে ফোটানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে ফোটানো ডিম কখনও পানি দিয়ে ধোয়া যাবেনা।
- ডিমের খোসার রং ও গুরুত্ব: ডিমের খোসার রং পোল্ট্রির প্রজাতি ও জাতভেদে ভিন্ন হতে পারে। যে প্রজাতি বা জাতের ডিম যে রঙের সে রঙের ডিমই ব্যবহার করতে হবে। খোসা পাতলা ও অসমৃণ হলে ডিম ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়। মুরগির ডিমের ক্ষেত্রে ডিমের খোসার আদর্শ পুরত ¡ ০.৩৩ মি.মি. হলে ভালো হয়।
- ফাটা বা ভাঙ্গা ডিম: ফাটা বা ভাঙ্গা ডিম নির্বাচন করা যাবে না। আগেই বলা হয়েছে ডিমে অসংখ্য সূক্ষ্ম ছিদ্র থাকে যা বাইরে থেকে এমনিতে বোঝা যায় না। এক্ষেত্রে একটি ডিমকে অন্য আরেকটি ডিম দিয়ে আলতোভাবে আঘাত করলে সৃষ্ট শব্দ যদি নিস্তেজ হয় তাহলে বুঝতে হবে ডিম ফাটা।
- ডিমের বয়স: ডিমের বয়স বলতে সাধারণভাবে ডিম পাড়ার দিন থেকে ফোটানোর জন্য বসানোর সময় পর্যন্ত সময়টাকেই বুঝায়। বাচ্চা ফোটানোর ডিমের জন্য বয়স গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিমের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাচ্চা ফোটার হারও কমতে থাকে। শীতকালে সর্বোচ্চ ৭-১০ দিন এবং গরমকালে ৩-৪ দিনের বেশি বয়সের ডিম ফোটানোর জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
- ডিমের ভিতরের বৈশিষ্ট্য: বাইরে থেকে স্বাভাবিকভাবে ডিমের বৈশিষ্ট্য বোঝা যায় না। আলোতে পরীক্ষা করলে তা বুঝা যায়। ডিমের সাদা অংশ ও কুসুমের পরিমাণের অনুপাত হবে ২ঃ১। ডিমের মধ্যে কোনো রক্তের ছিটা, ঘোলাটে বায়ু ইত্যাদি থাকলে তা বাদ দিতে হবে।
- ভাসমান বায়ু থলি: ফোটানোর ডিম সঠিকভাবে হ্যান্ডলিং করতে হবে। ফোটানোর ডিম ঝাঁকানো যাবে না। অতিরিক্ত ঝাঁকালে ভাসমান বায়ু থলি তৈরি হয় যা ডিম ফোটানোর উপযোগী নয়। দূরবর্তী জায়গা থেকে ডিম সংগ্রহ করলে তা কিছু সময় ছায়ায় রেখে পরে ফোটানোর জন্য ব্যবহার করতে হবে।
(৩) ডিম ফোটানোর পদ্ধতি কয়টি ও কি কি? ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর বিভিন্ন পদ্ধতি
ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। সাধারণত ডিম ফোটানোর পদ্ধতি দুই ভাগে বিভক্ত। যথা-
- প্রাকৃতিক পদ্ধতি
- কৃত্রিম পদ্ধতি
কৃত্রিম পদ্ধতিকে পুনরায় ভাগ করা যায়। যথা-
- তুষ পদ্ধতি
- ইনকিউবেটর পদ্ধতি
ইনকিউবেটর পদ্ধতি আবার দু’ধরনের। যথা-
- কোরোসিন ইনকিউবেটর পদ্ধতি
- বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটর পদ্ধত
নিচে ডিম ফোটানোর পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ক) ডিম ফোটানোর প্রাকৃতিক পদ্ধতি
প্রাকৃতিক পদ্ধতি হচ্ছে সর্বাধিক প্রচলিত প্রাচীন পদ্ধতি। এ পদ্ধতির সঙ্গে কম-বেশি সবাই পরিচিত। গ্রামাঞ্চলে অল্প পরিসরে যারা হাঁস-মুরগি পালন করেন তারা এই পদ্ধতিতে ডিম ফুটিয়ে থাকেন।
- দেশি মুরগি ১০-১২টি ডিম দেওয়ার পর উমে বা তায়ে বসার প্রবণতা দেখা যায়। এই অবস্থায় মুরগিকে কুঁচে মুরগি বলে। তখন মুরগিকে একটি নীরব স্থানে বাক্সে অথবা ঝুড়িতে কিছু বিছানাপত্র, যেমন- খড়, শুকনো পাতা বা তুষ রেখে তার উপর ১০-১২টি ডিম দিয়ে বসানো হয়।
- এ সময় কুঁচে মুরগি কাছাকাছি পাত্রে খাবার ও পানি রাখতে হয় যাতে চাইলেই মুরগি খেতে পারে।
- ডিমে বাতাস চলাচল ও মুরগির স্বাস্থ্যের জন্য দিনে একবার ডিম থেকে উঠিয়ে দিতে হয়। এই সময় মুরগি খাবার ও পানি গ্রহণ করবে। খেয়াল রাখতে হবে মুরগি যাতে আধা ঘন্টার বেশি বাইরে না থাকে। এতে ডিমের সঠিক তাপমাত্রা বজায় থাকবে না।
- মুরগি তার নিজের ঠোঁট দিয়ে ডিমগুলো ঘুরিয়ে দেয়। এতে ডিমের সবদিকে তাপমাত্রা ঠিক থাকে।
- মুরগির বসার জায়গায় কোন প্যারাসাইট অর্থাৎ উকুন বা অন্য কোন রক্তচোষক আছে কি-না সেদিকে নজর রাখতে হবে।
- ডিম বসানোর পর কোন ডিম যদি ভেঙ্গে যায়, তাহলে সেটি দ্রুত সরিয়ে নিতে হবে যাতে অন্য ডিম নোংরা না হয়। ডিমে তা দেওয়ার সময় মুরগিকে কোনোভাবেই বিরক্ত করা যাবে না।
- মুরগির ঘরে যথেষ্ঠ আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং বৃষ্টির দিনে যাতে পানি না পড়ে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে মুরগির ডিম থেকে ২১ দিন পর এবং হাঁসের ডিম থেকে ২৮ দিন পর বাচ্চা পাওয়া যাবে।
- ডিম বসানোর উপযুক্ত সময় হলো রাত। রাতে ডিম বসালে ২১ দিন পর রাতে সকল বাচ্চা ফুটবে এবং বাচ্চারা সারা রাত বিশ্রাম পাবে। পরদিন সকালে বাচ্চা বাইরে বেরুরে শক্তি পাবে।
খ) কৃত্রিম ডিম ফোটানোর পদ্ধতি
প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে মুরগি যেভাবে ডিম ফোটায় সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে যা দিয়ে ডিম ফোটানো হয়, এটিকে কৃত্রিম পদ্ধতি বলে। পূর্বে বলা হয়েছে কৃত্রিম পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে- তুষ পদ্ধতি ও ইনকিউবেটর পদ্ধতি। নিচের এগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনার করা হলো।
i) তুষ পদ্ধতি
গ্রামাঞ্চলে সাধারণত প্রাকৃতিক পদ্ধতি দেখা যায়। তবে আজকাল তুষ পদ্ধতি বাংলাদেশের অনেক জায়গায় বাচ্চা ফোটানোর জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
- যেসব অঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই অথচ অনেক ডিম ফোটানো দরকার সেসব অঞ্চলে তুষ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।
- এই পদ্ধতিতে হাঁস ও মুরগির ডিম ফোটানো হয়। তবে আজকাল তুষ পদ্ধতিতে হাঁসের ডিম ফোটানো একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই পদ্ধতিতে দৈহিক পরিশ্রম হলেও খরচ খুব সামান্য।
- তুষ পদ্ধতিতে ডিম ফোটানোর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হলো- বাঁশের চাঁটাই দিয়ে তৈরি নলাকৃত ঝুড়ি, হারিকেন, কাপড়, বায়ুচলাচল শূন্য ও তাপ নিরোধক কক্ষ, বাচ্চা ফোটানোর বিছানা এবং থার্মোমিটার।
ii) ইনকিউবেটর পদ্ধতি
ডিম ফোটানোর আধুনিক পদ্ধতির নাম হচ্ছে ইনকিউবেটর পদ্ধতি। এটি প্রধানত দু’ধরনের যথা-
- কেরোসিন ইনকিউবেটর: নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এই ইনকিউবেটরের মুল জ্বালানি হচ্ছে কোরোসিন।
- বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটর: বিদ্যুতের সাহায্যে এই ইনকিউবেটর চালিত হয় বলে এর নাম বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটর।
i) কেরোসিন ইনকিউবেটর পদ্ধতি
বিদ্যুতবিহীন এলাকাগুলোতে তুষ ইনকিউবেটরের পাশাপাশি কেরোসিন ইনকিউবেটর ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে মূল জ্বালিান যেহেতু কেরোসিন তুষ ইনকিউবেটরের তুলনায় কেরোসিন ইনকিউবেটরে খরচ একটু বেশি হয়।
- কেরোসিন ইনকিউবেটরে ৫০-৫০০টি ডিম ফোটানো যায়। তবে ডিম ফোটানোর সকল পদ্ধতির মূলনীতি একই।
- কেরোসিন ইনকিউবেটরের দাম বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরের তুলনায় কম।
- সাধারণত কেরোসিন ইনকিউবেটর ডিম ফোটানোর জন্য ৩৮.০-৩৯.৪ সে. তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ii) বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটর পদ্ধতি
ডিম ফোটানোর সর্বাধুনিক পদ্ধতি এটি। বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর পদ্ধতি সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো-
- ইনকিউবেটরে একসাথে প্রায় এক লক্ষ ডিম ফোটানো যায়। তবে ধারণ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে
- ছোট, মাঝারি ও বড় আকৃতির ইনকিউবেটর পাওয়া যায় যা প্রস্তুতকারক কোম্পানির ওপর নির্ভর করে।
- ইনকিউবেটর এমন জায়গায় বসাতে হবে যেখানে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল করে।
বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর পদ্ধতি সাধারন নিয়ম হলো-
- ইনকিউবেটরে ডিম বসানোর পূর্বের ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে, সেই সাথে ইনকিউবেটর সঠিকভাবে কাজ করছে কি-না সেটাও পরীক্ষা করতে হবে।
- বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরের প্রধান দুটি অংশ হচ্ছে সেটার ও হ্যাচার। সেটার হচ্ছে যেখানে ডিম বসানো হয়। এখানে নিয়মিত বিরতিতে ডিম ঘোরানো হয়। আর হ্যাচার হচ্ছে ডিম ফোটানোর শেষ তিন দিন যে ট্রেতে ডিম রাখা হয়।
- অনেক ইনকিউবিটরে সেটার ও হ্যাচার আলাদা নাও থাকতে পারে। সেটারে ডিম বসানোর জন্য খাঁজ/খোপ করা থাকে কিন্তু হ্যাচারে কোনো খোপ থাকে না।
- ডিম বসানোর সময় ডিমের মোটা অংশ যেন উপর দিকে থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডিম ৪৫ কোন করে সেটিং ট্রেতে বসাতে হবে।
(৪) বৈদ্যুতিক ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা
সফলভাবে ইনকিউবেটরে ডিম ফোটানোর জন্য নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ গুরুত্বসহকারে পালন করা প্রয়োজন-
ক) ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর তাপমাত্রা
ডিম ফোটানোর জন্য ইনকিউবেটরে ৯৯-১০০ ফারেনহাইট তাপমাত্রা রাখতে হবে। ডিম ফোটানোর জন্য সঠিক তাপমাত্রা ইনকিউবেটরের প্রস্তুতকারক কোম্পানির নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। অতিরিক্ত বা প্রয়োজনের কম তাপমাত্রা দুটোই ক্ষতিকারক। ডিমের চারিদিকে যেন সমভাবে তাপমাত্রা লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার পূর্বের র তিন দিন তাপমাত্রা ২-৩ ফারেনহাইট কম রাখতে হবে।
খ) ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা
ডিমের ভিতরে যেহেতু ভ্রুণের জন্ম হয় ও ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে, তাই সঠিক পরিমাণে অক্সিজেন থাকা অপরিহার্য। ইনকিউবেটরের বায়ুতে স্বাভাবিক অক্সিজেনের পরিমাণ ২১% হওয়া বাঞ্ছণীয়। অন্যদিকে, কার্বন-ডাই-অক্সাইড (CO2)-এর মাত্রা ০.৫% বেশি হলে ডিম ফোটার হার কমে যায়। এজন্য সঠিক জায়গায় ইনকিউবেটর রাখতে হবে যাতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করে।
গ) ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর আর্দ্রতা
মুরগির ডিমের ক্ষেত্রে প্রথম ১৮ দিন আর্দ্রতা লাগে ৫৫-৬২% এবং শেষ তিন দিন অর্থাৎ ১৯-২১ দিন ৬৫-৭৫%। আদর্শ আপেক্ষিক আর্দ্রতার চেয়ে কম হলে ভ্রুণ ডিমের খোসার একপাশে লেগে থাকে ফলে ডিম থেকে বাচ্চা বের হতে পারে না। অনেক সময় ভ্রুণ শুকিয়ে যায়। এজন্য প্রস্তুতকারক কোম্পানির নির্দেশনা অনুযায়ী আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
গ) ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর ডিম পরীক্ষাকরণ
সাধারণত ইনকিউবেটরে ডিম বসানোর ৭-১০ দিনের মধ্যে প্রথম বার এবং ১৪-১৮ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় বার পরীক্ষা করা হয়। এজন্য এক ধরনের যন্ত্র (ক্যান্ডেলার) ব্যবহার করা হয়। একটি অন্ধকার ঘরে ক্যান্ডেলার দ্বারা ডিম পরীক্ষা করা হয়। ডিম নিষিক্ত হলে তাতে রক্তজালিকার মতো দেখা যায়। যদি রক্তজালি ডিমের মোটা অংশের দিকে থাকে তাহলে ভ্রুণটি পরবর্তীতে বড় হবে এবং সুস্থ বাচ্চার জন্ম হবে। যদি সরু অংশের দিকে অথবা ডিমের এক পাশে গায়ে থিতিয়ে পড়ে, তাহলে বুঝতে হবে ভ্রুণটি মারা গেছে এবং তার আর বৃদ্ধি হবে না। এ ধরনের ডিম বাদ দিতে হবে। অনিষিক্ত ডিমে এ ধরনের কোন রক্তজালিকা থাকবে না। কাজইে সেটি বাদ দিতে হবে। ১৪-১৮ দিনের মধ্যে দ্বিতীয় বার ক্যান্ডেলিং বা পরীক্ষা করলে জীবিত ভ্রুণসম্পন্ন ডিমটি সম্পূর্ণ কালো দেখাবে।
ঘ) ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর ডিম নাড়াচাড়া করানো
আধুনিক ডিম ফোটানোর যন্ত্র বা ইনকিউবেটরের সকল মূলনীতি তৈরি হয়েছে কুঁচে মুরগির ডিমে তা দেওয়া ও বাচ্চা ফোটানোর পদ্ধতি থেকেই। মুরগি ঠোঁট দিয়ে ডিম উল্টে-পাল্টে দেয় যাতে ডিম সবদিকে সমান তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পায়। এই নীতি অনুসরণ করে আধুনিক ইনকিউবেটর যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে যা টারনার বা ডিম নাড়ানোর যন্ত্র নামে পরিচিত। মেশিনে সেট করা নির্দেশনা অনুযায়ী ৯০ কোনে ডিম ঘোরাতে পারে। দিন-রাত মিলে মোট ৬-৮ বার ডিম ঘোরালে ভালো ফল পাওয়া যায়। এতে ডিম ফোটানোর হারও বেড়ে যায়।
ডিম সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি খাওয়ার জন্য ও অন্যটি বাচ্চা ফোটানোর জন্য। বাচ্চা ফোটানোর ডিম নিষিক্ত বা উর্বর হতে হবে। উর্বর ডিম ৫৫-৫৮ গ্রাম হলে ভালো। উর্বর ডিমের বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে ডিম নির্বাচন করলে ডিম থেকে বাচ্চা পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আদিকাল থেকেই ডিম ফোটানোর প্রাকৃতিক পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে পরিচয় ঘটেছে কৃত্রিম পদ্ধতির। কৃত্রিম পদ্ধতিতে একসাথে অনেক ডিম ফোটানো যায়। বৈদ্যুতিক ইনকিউরেটরে ডিম ফোটানোর ক্ষেত্রে কিছু বিষয়, যেমন- তাপমাত্রা, আদ্রতা, বায়ু চলাচল ও ডিম নাড়াচাড়া ইত্যাদি বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে খেয়াল রাখতে হয়।
উপরোক্ত আলোনাটির দ্বারা আমরা ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর পদ্ধতি, ডিম অনুর্বর হয় কেন? ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর বিভিন্ন পদ্ধতি ও সুস্থ ডিম নির্বাচন সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানলাম বা অবগত গেলাম।
ডিম থেকে ভালো বাচ্চা পাওয়ার জন্য উর্বর ডিম নির্বাচন জরুরী। উর্বর ডিম ছাড়া বাচ্চা উৎপাদন সম্ভব নয়।
প্রাকৃতিকভাবে মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটনোর রীতি প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। পারিবারিকভাবে অল্প সংখ্যক ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। কৃত্রিমভাবে বাণিজ্যিক ডিম ফোটনোর খামার বা হ্যাচারিতে একসঙ্গে অনেক বাচ্চা উৎপাদন হয়। ব্যবহারিক পাঠের এ অংশে গ্রামীণ পরিবেশে কিভাবে বাচ্চা উৎপাদন করা হয় তা দেখার জন্য একটি বাড়িতে যেতে হবে। তাছাড়া কৃত্রিমভাকে বাচ্চা উৎপাদন করে এমন একটি বাণিজ্যিক হ্যাচারিও পরিদর্শন করতে হবে।।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।