বাংলাদেশে কচু একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সবজি। এ দেশে কচু জাতীয় সবজির মধ্যে পানিকচু, মুখীকচু, ওলকচু, পঞ্চমুখী কচু, ঘটমান কচু, মানকচু, দুধকচু ইত্যাদির চাষ হয়ে থাকে। কচুতে ভিটামিন ‘এ’ এবং লৌহ প্রচুর পরিমাণে থাকে।
কচু বাংলাদেশের একটি প্রধান সবজি। এতে প্রচুর পরিমাণ শ্বেতসার, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস এবং ভিটামিন এ ও সি রয়েছে। এছাড়া এর স্টার্চ কণা ছোট বলে শিশু খাদ্য হিসেবে সহজেই ব্যবহার করা যায়। .
কচু সাধারণত খরিফ মৌসুমে চাষ করা হয়। বর্ষার শেষ ভাগে বাজারে সবজির ঘাটতি দেখা যায়। এ সময় কচুই সবজির ঘাটতি অনেকটা পূরণ করে থাকে।
বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া কচু চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
এখানে আমরা কচু চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানব।
(১) পানি কচু কী?
যে সমস্ত কচু স্বল্প পানিতে চাষ করা যায় তাকে পানি কচু বলে। আমাদের বাংলাদেশে পানি কচু একটি সুস্বাদু সবজি হিসেবে পরিচিত। পানি কচু দুই প্রকার, যথা- লতি ও কান্ড বা রাইজোম উৎপাদী।
বাংলাদেশে পানি কচুর বিভিন্ন নাম রয়েছে যেমন নারিকেল কচু, জাত কচু, বাঁশ কচু ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে কচুর চাষ করে প্রায় ২ লক্ষাধিক টন ফলন পাওয়া যায়। পানি কচু ও মুখী কচু এর মধ্যে প্রায় ৮৫% জায়গা দখল করে আছে।
(২) পানি কচুর জাতসমূহ
ক) লতিরাজ (বারি পানি কচু-১)
সারাদেশ থেকে সংগৃহীত ১০০টি পানি কচুর জার্মপ্লাজম থেকে উপযোগিতা যাচাইয়ের মাধ্যমে লতিরাজ জাতটি ১৯৮৮ সালে অনুমোদন করা হয়।
- লতিরাজ জাতের কান্ড অপেক্ষা লতির প্রাধান্য বেশি।
- এর গাছ মাঝারী, পাতা সবুজ, পাতা ও বোঁটার সংযোগস্থলের উপরিভাগ লাল রং বিশিষ্ট যা জাতটির শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য।
- জীবনকাল ১৮০-২৭০ দিন।
- লাগানোর ২ মাস পর থেকে ৭ মাস পর্যন্ত লতি হয়ে থাকে।
- সাধারণ অবস্থায় হেক্টরপ্রতি ২৫- ৩০ টন লতি এবং প্রায় ১৫- ২০ টন কান্ড উৎপন্ন হয়।
- লতি লম্বায় ৯০-১০০ সেমি, সামান্য চেপ্টা, হাল্কা পিংক রং বিশিষ্ট।
- লতি সিদ্ধ করলে সমানভাবে সিদ্ধ হয় এবং গলা চুলকানিমুক্ত অর্থাৎ এ কচুতে ক্যালসিয়াম অক্সালেট এর পরিমাণ কম থাকায় গলা চুলকায় না।
- বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই চাষ করা যায়।
খ) বারি পানি কুচু-২
দেশিয় জার্মপ্লাজম থেকে উপযোগিতা যাচাইয়ের মাধ্যমে ২০০৮ সালে এ জাতটি অবমুক্ত করা হয়।
- এ জাতের সব অঙ্গই সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। যদিও লতিই হলো এ জাতের প্রধান ভক্ষণযোগ্য অংশ।
- এ জাতটি প্রচুর উৎকৃষ্ট মানের লতি উৎপাদন করে যার প্রতিটি লতি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১ মিটার লম্বা হয়।
- লতি গোলাকার, অপেক্ষাকৃত মোটা ও গাঢ় সবুজ বর্ণের হয় এবং গলা চুলকানীমুক্ত অর্থাৎ এ কচুতে ক্যালসিয়াম অক্সালেট এর পরিমাণ কম থাকায় গলা চুলকায় না।
- সিদ্ধ করলে সমানভাবে সিদ্ধ হয়।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ২৫-৩০ টন লতি এবং প্রায় ১৮-২২ টন কান্ড উৎপন্ন হয়।
গ) বারি পানি কচু-৩
দেশিয় জার্মপ্লাজম থেকে উপযোগিতা যাচাইয়ের মাধ্যমে ২০০৮ সালে জাতটি অবমুক্ত করা হয়।
- এ জাতেরও সব অঙ্গই সবজি হিসেবে খাওয়া যায়। তবে কান্ড (রাইজোম) হলো এ জাতের প্রধান ভক্ষণযোগ্য অংশ।
- কান্ড গোলাকার, মোটা ও হালকা সবুজ বর্ণের হয় এবং গলা চুলকানীমুক্ত অর্থাৎ এ কচুতে ক্যালসিয়াম অক্সালেট এর পরিমাণ কম থাকায় গলা চুলকায় না।
- কান্ডের দৈর্ঘ্য প্রায় ১ মিটার লম্বা হয়।
- সিদ্ধ করলে সমানভাবে সিদ্ধ হয়।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ২৫-৩০ টন কান্ড এবং প্রায় ১০- ১২ টন লতি হয়।
ঘ) বারি পানি কচু-৪
দেশিয় জার্মপ্লাজম থেকে উপযোগিতা যাচাইয়ের মাধ্যমে ২০১৩ সালে এ জাতটি অবমুক্ত করা হয়েছে।
- গাছ খাড়া, কান্ড থামাকার এবং সবুজ বর্ণের।
- পাতা সবুজ ও Peltate আকৃতির।
- কান্ড মোটা এবং গোলাপী রঙের।
- পত্র ফলকের মধ্য ও অন্যান্য শিরা নিন্মপৃষ্ঠে গাঢ় গোলাপী রঙের এবং উপরের পৃষ্টে গোলাপী রঙের।
- বোঁটা এবং বোঁটা ও পত্র ফলকের সংযোগস্থল গোলাপী রঙের।
- রাইজোম গোলাপী রঙের এবং ফ্লেস হালকা গোলাপী যা অন্য জাত থেকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
- এটি মূলত রাইজোম উৎপাদিত তবে অল্প পরিসরে লতিও উৎপন্ন করে।
- গলা চুলকানীমুক্ত অর্থাৎ এ কচুতে ক্যালসিয়াম অক্সালেট এর পরিমাণ কম থাকায় গলা চুলকায় না।
- সিদ্ধ করলে সমানভাবে সিদ্ধ হয়।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৫-৪৫ টন কান্ড এবং প্রায় ৫-৮ টন লতি উৎপন্ন হয়।
- বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এর চাষ করা যায়।
ঙ) বারি পানি কচু-৫
দেশিয় জার্মপ্লাজম থেকে উপযোগিতা যাচাইয়ের মাধ্যমে ২০১৩ সাথে এ জাতটি অবমুক্ত করা হয়েছে।
- গাছ খাড়া, কান্ড থামাকার এবং সবুজ বর্ণের।
- পাতা সবুজ ও Peltate আকৃতির।
- কান্ড মোটা এবং সবুজ রঙের।
- পত্র ফলকের মধ্য ও অন্যান্য শিরা সবুজ রঙের।
- বোঁটা এবং বোঁটা ও পত্র ফলকের সংযোগস্থল সবুজ রঙের।
- রাইজোম হালকা সবুজ রঙের এবং ফ্লেস সাদাটে।
- এটি মূলত রাইজোম উৎপাদিত তবে অল্প পরিসরে লতিও উৎপন্ন করে।
- গলা চুলকানীমুক্ত অর্থাৎ এ কচুতে ক্যালসিয়াম অক্সালেট এর পরিমাণ কম থাকায় গলা চুলকায় না।
- সিদ্ধ করলে সমানভাবে সিদ্ধ হয়।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৫-৪০ টন কান্ড এবং প্রায় ৫-৮ টন লতি উৎপন্ন হয়।
- বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এর চাষ করা যায়।
চ) বারি পানি কচু-৬
- গাছ খাড়া, কান্ড থামাকার এবং সবুজ বর্ণের।
- পাতা সবুজ ও তীরাকার।
- পাতার পত্রফলকের শিরার মাঝখানে কালো রংয়ের ছোপ ছোপ দাগ থাকে।
- পত্র ফলকের মধ্য ও অন্যান্য শিরা সবুজ রংয়ের।
- পাতার উপরের ও নিচের দিকের শিরাগুলো ভাসা।
- কান্ড ১ মিটার লম্বা ও বেড় ৩০-৩৫ সেমি।
- হালকা সবুজ রংয়ের এবং শাঁস আকর্ষণীয় সাদা।
- এটি মূলতঃ কান্ড উৎপাদন করে। তবে অল্প পরিসরে লতিও উৎপন্ন করে।
- গলা চুলকানিমুক্ত, সিদ্ধ করলে সমান ভাবে সিদ্ধ হয়।
(৩) পানি কচু চাষ কীভাবে করতে হয়? কচু চাষ পদ্ধতি
ক) মাটি
পলি দোআঁশ ও এঁটেল মাটি পানি কচুু চাষের উপযোগী।
খ) রোপণের সময়
আগাম ফসলের জন্য কার্তিক (মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বর) ও নাবী ফসলের জন্য মধ্য-ফাল্গুন থেকে মধ্য-বৈশাখ (মার্চ-এপ্রিল) মাসে লাগানো যায়। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য অগ্রহায়ণ-পৌষ মাস (ডিসেম্বর থেকে মধ্য-জানুয়ারি) চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
গ) রোপণ পদ্ধতি
কচু চাষে প্রয়োজন প্রতি হেক্টরে ৩৭-৩৮ হাজার চারা।
ঘ) বীজ রোপণের দূরত্ব
উন্নত জাতের কচুর জমিতে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেমি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৪৫ সেমি রাখতে হবে।
ঙ) সারের পরিমাণ
সারের নাম | কেজি/হেক্টর | কেজি/বিঘা | কেজি/শতক |
গোবর | ১০,০০০-১৫,০০০ | ১৩৭৭-২০৬৬ | ৫.৫৯-৮.৫০ |
ইউরিয়া | ৩০০ – ৩৫০ | ৪১.৩২-৪৮.২১ | ০.১৭-০.২০ |
টিএসপি | ১৫০ – ২০০ | ২০.৬৬-২৭.৫৫ | ০.০৮-০.১১ |
এমওপি | ২৫০-৩৫০ | ৩৪.৪৪-৪৮.২১ | ০.১৪-০.২০ |
জিপসাম | ১০০ – ১৩০ | ১৩.৭৭-১৭.৯১ | ০.০৬-০.০৭ |
জিংক সালফেট* | ১০ – ১৬ | ১.৩৮-২.২ | ০.০১ |
বরিক এসিড* | ১০ – ১২ | ১.৩৮-১.৬৫ | ১০ – ১৬ |
*এলাকাভেদে প্রয়োজন হয়।
চ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি
- গোবর বা কম্পোস্ট, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট, বরিক এসিড এবং অর্ধেক এমওপি সার জমি তৈরির সময় শেষ চাষের আগে প্রয়োগ করতে হবে।
- চারা রোপণের ১.৫-২ মাস সময়ে অর্ধেক এমওপি এবং ইউরিয়ার এক ষষ্ঠাংশ ছিটিয়ে দিতে হবে।
- বাকি পাঁচ ভাগ ইউরিয়া সার সমান কিস্তিতে ১৫ দিন পর পর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
ছ) অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
- পানি কচুুর গোড়ায় দাঁড়ানো পানির গভীরতা ৮-১০ সেমি এর বেশি হলে ফলন কমে যায় এবং দাঁড়ানো পানি মাঝে মাঝে নাড়িয়ে দিতে হবে।
- বর্ষাকালে জমি থেকে ৮-১০ সেমি এর বেশি পানি সরিয়ে ফেলতে হবে।
জ) আগাছা দমন
পানি কচুুর জমি সব সময়ই আগাছামুক্ত রাখতে হবে। চারা লাগানোর পর থেকে ৩ মাস পর্যন্ত জমিতে আগাছা জন্মাতে পারে। এ সময় জমি আগাছামুক্ত রাখা খুবই প্রয়োজন।
ঝ) সেচ ও পানি নিষ্কাশন
পানি কচুু জলজ উদ্ভিদ হলেও দীর্ঘ জলাবদ্ধতার জন্য ভাল নয়। এ জন্য মাঝে মাঝে দাঁড়ানো পানি নেড়ে চেড়ে দেয়া আবশ্যক। পানি কচুুর জন্য দাঁড়ানো পানির গভীরতা ৮-১০ সেমি এর বেশি হওয়া উচিত নয়।
(৪) পানি কচুর পোকামাকড় দমন ও এর প্রতিকার
পানি কচুুতে কয়েকটি পোকা ও রোগবালাই এর আক্রমণ হতে পারে। সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচন করা হলো।
ক) লেদা পোকা বা প্রডেনিয়া ক্যাটারপিলার
- পূর্ণবয়স্ক মথের পাখার বিস্তৃতি ২.৫ সেমি।
- পূর্ণবয়স্ক মথ গাছের পাতার নিচে গুচ্ছাকারে ডিম পাড়ে।
- কীড়া প্রাথমিক পর্যায়ে সবুজ বর্ণের হয় এবং মাথার রং কালো হয়।
- একটি পূর্ণবয়স্ক কীড়া ২.৫ সেমি লম্বা হয়।
- প্রাথমিকভাবে এরা গুচ্ছাকারে প্রডেনিয়া ক্যাটারপিলার এর পূর্ণাঙ্গ পোকা থাকলেও পরবর্তীতে সারা মাঠে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতিকার:
- ডিম সংগ্রহ করে নষ্ট করা এবং হাত দ্বারা কীড়া আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে ধ্বংস করা।
- এই পোকার আক্রমণ বেশি হলে ট্রেসার ৪৫ এসসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৪ মি.লি. মিশিয়ে ২০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
- ফেরোমোন ফাঁদ পেতে পুরুষ পোকা মেরা ফেলা সম্বব। এতে করে নতুন পোকার জন্ম হতে পারে না এবং আস্তে আস্তে পোকার সংখ্যা কমে যাবে। এছাও ফেরোমন ফাঁদের সাথে বায়োপেস্টিসাইড প্রয়োগ করলে সহজে পোকা দমন করা যায়।
- আক্রমণ তীব্র হলে কুইনালফস গ্রুপের কীটনাশক (দেবীকুইন ২৫ইসি/কিনালাক্র ২৫ইসি/ করোলাক্র ২৫ইসি) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি লিটার পরিমাণ মিশিয়ে স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়।
খ) কচুর লাল মাকড়
কচুর পাতার নিচের দিকে লাল রঙের ক্ষুদ্র মাকড়ের আক্রমণ দেখা যায়। এদেরকে খালি চোখে দেখা যায় না। পূর্ণ বয়স্ক এবং নিম্ফ উভয়ই গাছের ক্ষতি করে থাকে।
প্রতিকার:
- প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ মি.লি. এবামেকটিন (ভার্র্টিমেক ১.৮ ইসি) পানির সাথে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর জমিতে প্রয়োগ করে লাল মাকড় দমন করা যায়।
- পাইরিথ্রয়েড জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। কারণ পাইরিথ্রয়েড জাতীয় কীটনাশক অতিরিক্ত ব্যবহারে জমিতে পরভোজী মাকড়ের সংখ্যা কমে যায় এবং ফলশ্রুতিতে ক্ষতিকারক মাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পায়।
গ) কচুর জাব পোকা
জাব পোকা রস শোষণ করে এবং ভাইরাস রোগ ছড়িয়ে ফসলে ক্ষতি করে। এই পোকা পাতার রস শোষণ করে এবং ক্লোরোফিলের পরিমাণ হ্রাস করে। ফলে গাছের খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায় ফলশ্রুতিতে ফলন ও কমে যায়।
প্রতিকার:
হাইডাফ্লোপ্রিড (এডমায়ার ১০০ এসপি) ০.৫ মি.লি. হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
(৫) কচুর বিভিন্ন রোগ ও তার দমন ব্যবস্থাপনা
অন্যান্য ফসলের ন্যায় কচুও নানা রোগ বালাই দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে, যার ফলে এর ফলন হ্রাস পায়। নিম্নে কচুর বিভিন্ন রোগ ও তার দমন ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হল।
ক) পাতা ঝলসানো রোগ
কচুর রোগের মধ্যে পাতা ঝলসানো রোগ অন্যতম। পৃথিবীতে এ রোগ ট্যারো লিফ ব্লাাইট, ফাইটোফথোরা লিফ ব্লাাইট ইত্যাদি নামে পরিচিত।
ধারণা করা হয় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে এ রোগ প্রথম দেখা দেয় যা পরবর্তীতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ ও ওশেনিয়া অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে আমাদের বাংলাদেশে এ রোগ, কচুর পাতা ঝলসানো রোগ নামে পরিচিত।
- আক্রান্ত বীজ ও আক্রান্ত গাছের অংশবিশেষ স্থানান্তরের মাধ্যমে এ রোগ, আক্রান্ত স্থান হতে রোগমুক্ত স্থানে বিস্তার লাভ করে।
- এ রোগের আক্রমণে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এ রোগ ফসলের পাতা, করম ও অন্যান্য দেহতাত্ত্বিক অংশে হয়ে থাকে। এ রোগের আক্রমণে পাতা ও করম পচে যায়।
- এক প্রতিবেদনে দেখা যায় এ রোগের আক্রমণে মাঠে ৩০-৪০% পর্যন্ত ফলন হ্রাস পেয়ে থাকে। এমনকি সংরক্ষিত করমে এ রোগের আক্রমণে পচন দেখা যায়।
- ফিলিপিনে এক গবেষণায় দেখা যায়, এ রোগের আক্রমণে সহনশীল জাতগুলাতে ২৪.৪% ও রোগপ্রবণ জাতে ৩৬.৫% ক্ষতি হয়।
- উচ্চ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, ঘন করে গাছ লাগানো এ রোগের আক্রমণকে ত্বরান্বিত করে। অতিরিক্ত র্আদ্র আবহাওয়ায়, আক্রান্ত পাতা অথবা কিউটিকলে প্রচুর পরিমাণে এ রোগের জীবাণু উৎপাদিত হয়। যা বৃষ্টির মাধ্যমে পুরো জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে এ রোগের আক্রমণ বেশি দেখা যায়।
- এই রোগের স্পোরাঞ্জিয়া অঙ্কুরিত হওয়া ও জুস্পোর চলাচলের জন্য মুক্ত পানির প্রয়োজন। গাছের পাতা কত সময় ভেজা থাকে, তার উপরে এ জীবাণুর আক্রমণ নির্ভর করে।
- তাপমাত্রা ২৪-২৭০ সে. এবং বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ শতকরা প্রায় ১০০ ভাগের কাছাকাছি হলে ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে জুস্পোর স্পোরাঞ্জিয়া থেকে বের হয়ে গাছের পাতায় পাতা ঝলসানো রোগ প্রারম্ভিক অবস্থা পাতা ঝলসানো রোগে মারাত্মক আক্রান্ত পাতা আক্রমণ করে থাকে।
- দিনের তাপমাত্রা ২৫-২৮০ সে. এবং রাতের তাপমাত্রা ২০-২২০ সে. ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা যথাক্রমে শতকরা ৬৫ ও ১০০ ভাগ এ রোগের বিস্তারের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
রোগের জীবাণু:
ফাইটোফথোরা কলোকোসিয়া নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে এ ছত্রাকটির মাইসেলিয়াম বর্ণহীন, শাখাযুক্ত ও প্রস্থ প্রাচীর বিহীন।
রোগের লক্ষণ:
- আক্রান্ত পাতায় প্রথমে ছোট কাল দাগ দেখা যায় যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে হলুদ প্রান্তযুক্ত বাদামী বর্ণে পরিণত হয়। আক্রান্ত স্থানে চক্রাকার জোনের সৃষ্টি হয় এবং তা হতে হলুদ বর্ণের উজ (ooze) বের হয়ে আসে, যা পরর্বতীতে শুকিয়ে গাঢ় র্পাপল বর্ণ ধারণ করে।
- কিছু কিছু রোগাক্রান্ত টিস্যু সাদা বর্ণের স্পোরাঞ্জিয়া বেষ্টিত থাকে। পরবর্তীতে দাগগুলো বৃদ্ধি পায় এবং অনেকগুলো দাগ একত্রিত হয়ে (সাধারণত পাতার প্রান্ত বরাবর) পুরো পাতায় ছড়িয়ে যায়। আক্রান্ত পাতায় অনিয়মিত আকার ও আকৃতির দাগ দেখা যায়।
- মাঝে মাঝে এ রোগের আক্রমণের ফলে পেটিউলে ছোপ ছোপ ভেজা দাগ দেখা যায়। পরবর্তীতে সম্পূর্ণ গাছ ও পাতা পুড়ে যায়। সংরক্ষিত করমে এ রোগের আক্রমণে ধুসর বাদামী হতে কালচে নীল রঙের দাগ দেখা যায়। এ দাগগুলো দ্রুুত বৃদ্ধি পেয়ে একত্রিত হয়ে সমস্ত করম পচে যায়।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনা:
- এ রোগের অন্যতম উৎস হল আক্রান্ত বীজ। বীজে সাধারণত ছত্রাকটির মাইসেলিয়াম থাকে, তাই রোগ দমনের জন্য রোগমুক্ত এলাকা থেকে সুস্থ বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
- গাছের রোগাক্রান্ত পাতা ছেটে ফেলা এবং ফসল সংগ্রহের পর জমিতে পড়ে থাকা করম ও পাতা ধ্বংস করতে হবে।
- জমিতে রোগ দেখা মাত্রই ছত্রাকনাশক যেমন- সিকিউর / ডাইথেন এম-৪৫ নামক ছত্রাকনাশক ২০ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা যায়।
খ) পাতায় দাগ পড়া বা লিফ স্পট রোগ
এটি একটি ছত্রাক জনিত রোগ। বাংলদেশে কচুর জমিতে সাধারনত এ রোগ সহজেই চোখে পড়ে।
রোগের জীবাণু:
কোলেটোট্রিকাম গনের অন্তর্ভুক্ত কোলেটোট্রিকাম ক্যাপসিসি বা কোলেটোট্রিকাম লিন্ডেমুথিয়ানাম নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণ:
- এ রোগের আক্রমণে কচু পাতায় শুকনো ছোট ও মাঝারী আকারের দাগ পড়ে।
- আক্রমণ বেশি হলে সম্পূর্ণ গাছই পুড়ে যেতে পারে, ফলে ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনা:
- রোগমুক্ত স্থান হতে সুস্থ সবল চারা/করম সংগ্রহ করা।
- কচুর জমিতে এ রোগ দেখা গেলে টিল্ট নামক ছত্রাক নাশক (০.৫ মিলি/লিটার) ২-৩ বার স্প্রে করলে এ রোগ দমন করা যায়।
- পরিষ্কার চাষাবাদ ও শস্য পর্যায় অবলম্বন করে এ রোগ কমানো যাবে।
ঘ) গোড়া পচা রোগ বা ফুট/কলার রট
স্কে্লরোশিয়াম রফসি নামক এক ধরনের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণ:
- এ রোগের আক্রমণে গাছের গোড়ায় সাদা বর্ণের মাইসোলিয়াম দেখা যায়। ভাল করে তাকালে কালচে বাদামী বর্ণের সরিষার দানার মত স্কে¬রোশিয়া গঠন দৃষ্টিগোচর হয়।
- আক্রান্ত গাছটি সম্পূর্ণ রূপে হলুদ হয়ে যায় এবং সবশেষে গাছটি কলার অঞ্চল হতে ঢলে পড়ে।
- রোগের মারাত্মক আক্রমণে, মাটির নিচের করম ক্ষতিগ্রস্থ হয় ও পুরো গাছ ঢলে পড়ে।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনা:
- রোগমুক্ত এলাকা হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
- ক্ষেতের পানি সরিয়ে বেভিস্টিন (১ গ্রাম/লিটার) নামক ছত্রাক গোড়া পচা রোগ বা ফুট / কলার রট এ আক্রান্ত ফসল নাশক দিয়ে ফসলের গোড়ার মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। তবে (গাছের গোড়াতে সাদা বর্ণের মাইসেলিয়ামের অবস্থান) ভিজিয়ে দেয়ার ১ দিন পর আবার পানি দেয়া যাবে।
- ফসল কর্তনের পর, ফসলের অবশিষ্টাংশ সরিয়ে ফেলতে হবে।
- পরিষ্কার চাষাবাদ ও শস্য পর্যায় অবলম্বন করে এ রোগ কমানো যাবে।
ঙ) রাইজম পচা বা করম রট
পিথিয়াম আফানিডারমাটাম নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণ:
- এ রোগের আক্রমণে অল্প বয়স্ক গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি গাছ মারা যেতে পারে।
- অধিক বয়স্ক গাছে, এ রোগের আক্রমণে গাছ হলুদ হয়ে গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, পরবর্তীতে পুরো গাছটি ঢলে পড়ে।
- অধিক আক্রমণে করমটি পচে যায়, এমনকি গাছ হতে কোন রকম ফলনই সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনা:
- রোগমুক্ত এলাকা হতে চারা/ করম সংগ্রহ করে লাগাতে হবে।
- পরিষ্কার চাষাবাদ, শস্যাবর্তন অনুসরণ করতে হবে।
- ফসল কর্তনের পর, ফসলের অবশিষ্টাংশ ধ্বংস করতে হবে।
- জমির পানি সরিয়ে রিডোমিল গোল্ড (২ গ্রাম/লিটার) নামক ছত্রাক নাশক দিয়ে ফসলের গোড়ার মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। তবে ভিজিয়ে দেয়ার ১ দিন পর আবার পানি দেয়া যাবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: কচুপাতায় ছত্রাকনাশক বা কীটনাশক ছিটানোর সময় ডিটারজেন্ট যেমন- সার্ফ অথবা হুইল পাউডার ২০ গ্রাম ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। তা না হলে ছিটানো ঔষুধ পাতা থেকে গড়িয়ে পড়ে যাবে।
[সূত্র: বিএআরআই]