Skip to content

কলা চাষ পদ্ধতি

কলা চাষ পদ্ধতি

উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন ফলের মধ্যে কলা একটি উৎকৃষ্ট ফল।

কলা বাংলাদেশের প্রধান ফল যা সারা বছর পাওয়া যায় এবং সকলেই খাওয়ার সুযোগ পায়। বাংলাদেশের বগুড়া, যশোর, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ প্রভৃতি এলাকায় ব্যাপকভাবে কলার চাষ হয়।

কলা বাগান
কলা বাগান

কলা ক্যালরি, খাদ্যপ্রাণ, খনিজ পদার্থ সমৃদ্ধ ও সুগন্ধী এবং পুষ্টিকর ফল। ফলন অন্যান্য ফল ও ফসল অপেক্ষা অনেক বেশি।

ধান, গম ও মিষ্টি আলুর চাষ করে প্রতি হেক্টরে যেখানে ১১.২, ৬.৬ ও ৩৯.৮ লক্ষ কিলো ক্যালরি খাদ্য-শক্তি উৎপন্ন হয় সেখানে কলা থেকে প্রায় ৫০.০ লক্ষ কিলো ক্যালরি পাওয়া যায়। কলার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য যে সারা বছরই উৎপন্ন হয়।

(১) কলার উন্নত জাত সমূহের নাম

ক) বারি কলা-১

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০০০ সালে ‘বারি কলা-১’ নামে একটি উচ্চ ফলনশীল পাকা কলার জাত উদ্ভাবন করেছে।

বারি কলা-১
বারি কলা-১
  • এ জাতের গাছ খাটো।
  • কাঁদিপ্রতি গড় ফলন ২৫ কেজি।
  • কাঁদিতে ৮-১১টি ফানা থাকে।
  • উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে এ জাতের কাঁদিতে ১৫০-২০০টি কলা পাওয়া যায়।
  • পাকা কলা উজ্জ্বল হলুদ রঙের ও খেতে মিষ্টি (টিএসএস ২৪%)।
  • ফলের গড় ওজন ১২৫ গ্রাম। গ্রীষ্মকালে উচ্চ তাপমাত্রায় পাকা কলা বেশি দিন ঘরে রাখা যায় না। আবার শীতকালে এর সংরক্ষণ ক্ষমতা বেশি।
  • রোপণের ১১-১২ মাসের মধ্যে কলা সংগ্রহের উপযুক্ত হয়।
  • জাতটি বানচি টপ ভাইরাস ও সিগাটোকা রোগের প্রতি সংবেদনশীল।
  • হেক্টরপ্রতি ফলন ৫০-৬০ টন।
  • দেশের সব এলাকায় চাষোপযোগী।

খ) বারি কলা-২

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পানামা ও সিগাটোকা রোগ প্রতিরোধী এবং উচ্চ ফলনশীল কাঁচকলার এ জাতটি ২০০০ সালে ‘বারি কলা-২’ নামে উদ্ভাবন করেছে। এটি বিদেশ থেকে সংগৃহীত একটি সংকর জাত (FHIA-03)।

বারি কলা-২
বারি কলা-২
  • গাছ বেশ মোটা, শক্ত এবং মাঝারী আকারের।
  • এ জাতের গাছে সাকারের সংখ্যা কম (২-৩টি)।
  • রোপণের পর ১১-১২ মাসের মধ্যে ফল আহরণের উপযুক্ত হয়।
  • কলার কাঁদির ওজন ১৫-২০ কেজি।
  • কাঁদিতে কলার সংখ্যা ১০০-১৫০টি।
  • কলা আকারে মাঝারী এবং গাঢ় সবুজ রঙের।
  • ফল সহজে সিদ্ধ হয় এবং খেতে সুস্বাদু।
  • হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৫-৪০ টন।
  • দেশের সব এলাকায় চাষোপযোগী।
See also  কলা চাষ পদ্ধতি

গ) বারি কলা-৩

বাংলা কলার উচ্চ ফলনশীল জাতটি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন করে সারা দেশে চাষাবাদের জন্য ২০০৫ সালে অনুমোদন দেয়া হয়।

বারি কলা-৩
বারি কলা-৩
  • প্রতি কাঁদিতে ১৪০-১৫০টি কলা হয় যার ওজন ২৩-২৫ কেজি।
  • ফল মধ্যম আকারের (১০০ গ্রাম)।
  • হেক্টরপ্রতি ফলন ৪৫-৫০ টন।
  • পাকা ফল হলুদ রঙের, সম্পূর্ণ বীজহীন, শাঁস আঠালো, মিষ্টি (টিএসএস ২৫.৫%) এবং খেতে সুস্বাদু।
  • ফল পাকার পরও ৫ দিন পর্যন্ত ঘরে রেখে খাওয়া যায়।
  • জাতটি রোগ ও পোকামাকড় সহনশীল।
  • দেশের সর্বত্র চাষোপযোগী।

ঘ) বারি কলা-৪

পার্বত্য এলাকা থেকে নির্বাচিত চাপা কলার একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। জাতটি সারা দেশে চাষাবাদের জন্য ২০০৬ সালে মুক্তায়ন করা হয়।

বারি কলা-৪
বারি কলা-৪
  • প্রতি কাঁদিতে ফলের সংখ্যা প্রায় ১৭৮টি যার ওজন প্রায় ১৯ কেজি।
  • ফল মাঝারী আকারের গড় ওজন ৯৫-১০০ গ্রাম।
  • পাকা ফল হলদে রঙের সম্পূর্ণ বীজ বিহীন এবং টক মিষ্টি (টিএসএস ২০%) স্বাদের।
  • হেক্টরপ্রতি ফলন ৪০-৪৫ টন।
  • রোগ ও পোকামাকড় সহনশীল।
  • দেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী।

ঙ) বারি কলা-৫

বারি কলা-৫
বারি কলা-৫
  • উচ্চফলনশীল কাঁচা কলার জাত।
  • গাছ বেশ মোটা, শক্ত এবং মাঝারী আকারের।
  • এ জাতের কলার কাঁদির ওজন ২০ কেজি।
  • কলা মাঝারী (৯৫ গ্রাম), গাঢ় সবুজ রঙের, সহজে সিদ্ধ হয় এবং ক্ষেতেও ভাল।
  • খাদ্যোপযোগী অংশ প্রায় ৬২%।
  • এ জাতের গাছ পানামা ও সিগাটোকা রোগ প্রতিরোধী।
  • হেক্টরপ্রতি ফলন ৫০ টন।
  • দেশের সর্বত্র চাষ উপযোগী।

(২) কলা চাষ পদ্ধতির বর্ণনা

ক) মাটি

পর্যাপ্ত রোদযুক্ত ও পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা সম্পন্ন উঁচু জমি কলা চাষের জন্য উপযুক্ত। ঊর্বর দোআঁশ মাটি কলা চাষের জন্য উত্তম।

খ) জমি তৈরি ও গর্ত খনন

জমি ভালভাবে গভীর করে চাষ করতে হয়। দেড় থেকে দুই মিটার দূরে দূরে ৬০ ⨉ ৬০ ⨉ ৬০ সেমি আকারের গর্ত খনন করতে হয়। চারা রোপণের মাসখানেক আগেই গর্ত খনন করতে হয়। গর্তে গোবর ও টিএসপি সার মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত বন্ধ করে রাখতে হবে।

গ) কলা গাছ রোপণের সময়

কলার চারা বছরে ৩ মৌসুমে রোপণ করা যায়।

See also  কলা গাছ ও কলা চাষের পদ্ধতি

প্রথম রোপণ: আশ্বিন-কার্তিক (মধ্য-সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য-নভেম্বর)।
দ্বিতীয় রোপণ: মাঘ-ফাল্গুন (মধ্য-জানুয়ারি থেকে মধ্য-মার্চ)।
তৃতীয় রোপণ: চৈত্র-বৈশাখ (মধ্য-মার্চ থেকে মধ্য-মে)।

ঘ) কলার চারা রোপণ

  • রোপণের জন্য অসি তেউড় (Sword sucker) উত্তম।
  • অসি তেউড়ের পাতা সরু, সুচালো। অনেকটা তলোয়ারের মত, গুড়ি বড় ও শক্তিশালী এবং কান্ড ক্রমশ গোড়া থেকে উপরের দিকে সরু হয়।
  • তিন মাস বয়স্ক সুস্থ সবল তেউড় রোগমুক্ত বাগান থেকে সংগ্রহ করতে হয়।
  • সাধারণত খাটো জাতের গাছের ৩৫-৪৫ সেমি ও লম্বা জাতের গাছের ৫০-৬০ সেমি দৈর্ঘ্যরে তেউড় ব্যবহার করা হয়।
  • এ ছাড়া টিস্যু কালচার চারা ব্যবহার করা হলে বাড়তি কিছু সুবিধা পাওয়া যায়।

ঙ) কলা গাছে সার প্রয়োগ

চারা রোপণের পর গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ করা আবশ্যক। বয়স ভিত্তিতে গাছ প্রতি সারের পরিমাণ নিম্নে দেখানো হলো।

সারের নামগাছ প্রতি সারের পরিমাণ
গোবর১০ কেজি
ইউরিয়া৫০০ গ্রাম
টিএসপি৪০০ গ্রাম
এমওপি৬০০ গ্রাম
জিপসাম২০০ গ্রাম
জিংক সালফেট১.৫ গ্রাম
বরিক এসিড২.০ গ্রাম

চ) প্রয়োগ পদ্ধতি

  • সম্পূর্ণ পরিমাণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট এবং বরিক এসিড এবং অর্ধেক এমওপি সার গর্ত তৈরির সময় মাটির সাথে প্রয়োগ করতে হবে।
  • ইউরিয়া ও বাকি অর্ধেক এমওপি সার চারা রোপণের ২ মাস পর থেকে ২ মাস পর পর ৩ বারে এবং ফুল আসার পর আরও একবার গাছের চর্তুদিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়।
  • সার দেয়ার সময় জমি হালকাভাবে কোপাতে হবে যাতে শিকড় কেটে না যায়।
  • জমির আর্দ্রতা কম থাকলে সার দেয়ার পর পানি সেচ দেয়া একান্ত প্রয়োজন।

ছ) কলা গাছের পরিচর্যা

  • চারা রোপণের সময় মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা না থাকলে তখনই সেচ দেওয়া উচিত। এ ছাড়া, শুষ্ক মৌসুমে ১৫-২০ দিন অন্তর সেচ দেওয়া দরকার।
  • বর্ষার সময় কলা বাগানে যাতে পানি জমতে না পারে তার জন্য নালা থাকা আবশ্যক।
  • মোচা আসার পূর্ব পর্যন্ত গাছের গোড়ায় কোন তেউড় রাখা উচিত নয়। মোচা আসার পর গাছপ্রতি মাত্র একটি তেউড় বাড়তে দেয়া ভাল।

জ) চাষকৃত কলা সংগ্রহ

  • ঋতুভেদে রোপণের ১০-১৩ মাসের মধ্যে সাধারণত সব জাতের কলাই পরিপক্ক হয়ে থাকে।
  • বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করলে কলার গায়ের শিরাগুলো তিন-চতুর্থাংশ পুরো হলেই কাটতে হয়। তাছাড়াও কলার অগ্রভাগের পুষ্পাংশ শুকিয়ে গেলে বুঝতে হবে কলা পুষ্ট হয়েছে।
  • সাধারণত মোচা আসার পর ফল পুষ্ট হতে ২১/২- ৪ মাস সময় লাগে।
  • কলা কাটানোর পর কাঁদি শক্ত জায়গায় বা মাটিতে রাখলে কলার গায়ে কালো দাগ পড়ে এবং কলা পাকার সময় দাগওয়ালা অংশ তাড়াতাড়ি পচে যায়।
See also  কলা চাষ পদ্ধতি

(৩) কলার চাষে রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা

ক) কলার পানামা রোগ ব্যবস্থাপনা

কলার পানামা রোগাক্রান্ত বাগান
কলার পানামা রোগাক্রান্ত বাগান

এটি একটি ছত্রাকজনিত মারাত্মক রোগ।

এ রোগের আক্রমণে প্রথমে বয়স্ক পাতার কিনারা হলুদ হয়ে যায় এবং পরে কচি পাতাও হলুদ রং ধারণ করে। পরবর্তী সময় পাতা বোঁটার কাছে ভেঙ্গে গাছের চতুর্দিকে ঝুলে থাকে এবং মরে যায়। কিন্তু সবচেয়ে কচি পাতাটি গাছের মাথায় খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অবশেষে গাছ মরে যায়।

কোন কোন সময় গাছ লম্বালম্বিভাবে ফেটেও যায়। অভ্যন্তরীণ লক্ষণ হিসেবে ভাসকুলার বান্ডেল হলদে-বাদামী রং ধারণ করে।

প্রতিকার:

  1. আক্রান্ত গাছ গোড়াসহ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  2. আক্রান্ত গাছের তেউড় রোপণ করা যাবে না।
  3. রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষ করতে হবে।
  4. আক্রান্ত জমিতে ৩-৪ বছর কলা চাষ করা যাবে না।

খ) কলার সিগাটোকা রোগ দমন

কলার সিগাটোকা রোগাক্রান্ত পাতা
কলার সিগাটোকা রোগাক্রান্ত পাতা

এ রোগের আক্রমণে প্রাথমিকভাবে ৩য় বা ৪র্থ পাতায় ছোট ছোট হলুদ দাগ দেখা যায়। ক্রমশ দাগগুলো বড় হয় ও বাদামী রং ধারণ করে। এভাবে একাধিক দাগ মিলে বড় দাগের সৃষ্টি করে এবং তখন পাতা পুড়ে যাওয়ার মত দেখায়।

প্রতিকার:

  1. আক্রান্ত পাতা কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  2. প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি টিল্ট ২৫০ ইসি অথবা ১ গ্রাম অটোস্টিন মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর গাছে স্প্রে করতে হবে।

গ) কলার বানচি-টপ ভাইরাস রোগ ব্যবস্থাপনা

কলার বানচি-টপ ভাইরাস রোগাক্রান্ত গাছ
কলার বানচি-টপ ভাইরাস রোগাক্রান্ত গাছ

এ রোগের আক্রমণে গাছের বৃদ্ধি হ্রাস পায় এবং পাতা গুচ্ছাকারে বের হয়। পাতা আকারে খাটো, অপ্রশস্ত এবং উপরের দিকে খাড়া থাকে। কচি পাতার কিনারা উপরের দিকে বাঁকানো এবং সামান্য হলুদ রঙের হয়।

অনেক সময় পাতার মধ্য শিরা ও বোঁটায় ঘন সবুজ দাগ দেখা যায়। পাতার শিরার মধ্যে ঘন সবুজ দাগ পড়ে।

প্রতিকার:

  1. আক্রান্ত গাছ গোড়াসহ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  2. জীবাণু বহনকারী ‘জাব পোকা’ কীটনাশক যেমন ম্যালাথিওন (২ মিলি ১ লিটার পানিতে দ্রবীভূত করে) গ্রুপের ঔষধ দ্বারা দমন করতে হবে।

ঘ) কলার পাতা ও ফলের বিটল পোকা

বিটল পোকা
বিটল পোকা
বিটল পোকা আক্রান্ত কলা
বিটল পোকা আক্রান্ত কলা

কলার পাতা ও ফলের বিটল পোকা কলার কচি পাতায় হাটাহাটি করে এবং সবুজ অংশ নষ্ট করে। ফলে সেখানে অসংখ্য দাগের সৃষ্টি হয়।

অতিরিক্ত আক্রমণে গাছ দুর্বল হয়ে যায়। কলা বের হওয়ার সময় হলে পোকা মোচার মধ্যে ঢুকে কচি কলার উপর হাঁটাহাটি করে এবং রস চুষে খায়। ফলে কলার গায়ে বসন্ত রোগের দাগের মত দাগ হয়। এসব দাগের কারণে কলার বাজার মূল্য কমে যায়।

প্রতিকার:

  1. পোকান্ডআক্রান্ত মাঠে বার বার কলা চাষ করা যাবে না।
  2. কলার মোচা বের হওয়ার সময় ছিদ্রবিশিষ্ট পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে এ পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
  3. প্রতি ১ লিটার পানিতে ১ গ্রাম সেভিন ৮৫ ডব্লিউ পি মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২ বার গাছের পাতার উপরে ছিটাতে হবে।
  4. ম্যালাথিয়ন বা ডায়াজিনন ৬০ ইসি বা লিবাসিড ৫০ ইসি ২ মিলি হারে ব্যবহার করতে হবে।

[সূত্র: বিএআরআই]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts