কাউন বা কাওন, যার বৈজ্ঞানিক নাম হলো Setaria italica, ইংরেজি নাম হলো Foxtail millet, কাউনের অন্য বাংলা নামগুলো হচ্ছে কাঙ্গুই বা কাঙ্গু, কোরা, কান্তি, দানা, দ্যোনদা ও শ্যামধাত।
এটি হচ্ছে পোয়াসি পরিবারের সেটারিয়া গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। গাছের দৈর্ঘ্য ৯০-১২০ সে.মি.। পুষ্পবিন্যাস স্পাইক ধরনের। ফল কেরিওপসিস। বীজ মসৃণ।
প্রতি গ্রামেই চাষ হতো কাউন ধানের। কাউন চাল ছিলো গরীবের খাবার। ছোট দানা বিশিষ্ট শস্যটির দাম এখন গরীবদের হাতের নাগালের বাইরে। কাউন এখন বিলাসী চাল। চাল বা গমের মতো এই দানায় শর্করা নেই। পুষ্টিবিদরা কাউন চালকে সুপারফুড হিসেবে পরামর্শ দেন। যার জন্য স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ খুব সহজেই কাউন চালকে বেছে নেন।
মিষ্টান্ন পায়েস, ক্ষীর ও ঝাল খাবার হিসাবে খিচুরি, পোলাও রান্নায় কাউন চাল এখন ধনীদের প্রিয় খাবার। এছাড়া সাদা ভাতও রান্না করা যায় এ চাল দিয়ে। আর এই খাবারগুলো খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি পুষ্টিগুণেও ভরপুর। পাহাড় ও সমতলের মানুষের কাছে কাউন চাল একটি সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার। অতিথি আপ্যায়নে, উৎসব-পার্বণে কাউনের পায়েসের বেশ প্রচলন আছে। বিস্কুট তৈরিতেও কাউন চাল ব্যবহৃত হয়।
কাউন বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন ধরে চাষাবাদ হয়ে আসছে। ছোট দানা বিশিষ্ট শস্যটি এ দেশে গরীবের খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশের সাধারণত চরাঞ্চলে অথবা কম উর্বর জমিতে মই চাষে কাউনের চাষ করা হয়ে থাকে। সাধারণত দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে এর চাষ হয়ে থাকে। তবে উত্তর বঙ্গের প্রায় সব জেলায় কাউনের চাষ হয়।
সাল ২০১০ এ বাংলাদেশে প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে কাউন চাষ করা হয় এবং এর মোট উৎপাদন প্রায় সাড়ে ১০ হাজার মে. টন।
আমারা আমকের এই আলোচনাটির মাধ্যমে কাউনের চালের জাত এবং কাউন চাল চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে জানব।
(১) কাউনের চালের জাত সমূহ
ক) তিতাস
জাতের নাম: তিতাস।
ভূমিকা: কাউনের এ জাতটি শিবনগর নামে ১৯৮০ সালে কুমিল্লা জেলা থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং দেশি-বিদেশি জাতের সাথে তুলনামূলক মূল্যায়নের পর ১৯৮৯ সালে তিতাস নামে অনুমোদন করা হয়।
বৈশিষ্ট্য:
- তিতাস জাতের গাছ মাঝারী লম্বা, পাতা সবুজ, কাও শক্ত।
- শীষ বেশ লম্বা, মোটা এবং রোমশ।
- বীজ মাঝারী আকারের এবং ঘিয়ে রঙের।
- হাজার বীজের ওজন ২.৩-২.৫ গ্রাম।
- জাতটি রবি মৌসুমে ১০৫-১১৫ দিনে এবং খরিফ মৌসুমে ৮৫-৯৫ দিনে পাকে।
বিশেষ গুণ:
- তিতাস জাত উচ্চ ফলনশীল, আগাম রোগ ও পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন।
- গাছ শক্ত তাই সহজে নুয়ে পড়ে না।
- তিতাস জাতটি গোড়া পচা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন।
ফলন: রবি মৌসুমে তিতাসের ফলন হেক্টরপ্রতি ২.০-২.৫ টন। খরিফ মৌসুমে এর ফলন একটু কম হয়। স্থানীয় জাতের চেয়ে ফলন প্রায় ৩০-৩৫% বেশি।
খ) বারি কাউন-২
জাতের নাম: বারি কাউন-২।
ভূমিকা: এ জাতটি কুমিল্লা জেলার পরাকান্দি থেকে সংগ্রহ করা হয়। এ জাতটি দেশি-বিদেশি জাতের সাথে তুলনামূলক মূল্যায়নের ভিত্তিতে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বারি কাউন-২ নামে অনুমোদিত হয়।
বৈশিষ্ট্য:
- গাছের উচ্চতা ১২০ সেমি।
- পাতা সবুজ, চওড়া এবং লম্বা।
- শীর্ষ ২০-২৫ সেমি লম্বা এবং ছোট শুয়োযুক্ত হয়।
- বীজ গোলাকার এবং ঘিয়ে রঙের।
- হাজার বীজের ওজন ২.৫৫ গ্রাম।
- এ জাতটির জীবন কাল ১২০-১২৫ দিন।
বিশেষ গুণ:
- কাও শক্ত ও মজবুত হওয়ায় গাছ সহজে হেলে পড়ে না।
- এ জাতটিতে রোগ-বালাই বা পোকা-মাকড়ের আক্রমণ তেমন দেখা যায় না।
ফলন: এ জাতটির ফলন হেক্টরপ্রতি ২.৫-৩.০ টন। তিতাস জাতের চেয়ে গড় ফলন প্রায় ২০% বেশি।
গ) বারি কাউন-৩
জাতের নাম: বারি কাউন-৩।
ভূমিকা: কাউনের এ জাতটি মিউটেশন ব্রিডিং পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত। দেশি-বিদেশি কাউনের জাতসমূহের সাথে এবং প্যারেন্ট-এর সাথে তুলনামূলক মূল্যায়নের ভিত্তিতে ২০০১ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বারি কাউন-৩ নামে অনুমোদিত হয়।
বৈশিষ্ট্য:
- এই জাতটি খাটো অর্থাৎ গড়ে ৪৫ সেমি লম্বা হয়।
- এই জাতটির শীর্ষ মাঝারী (গড়ে ১৭ সেমি) এবং ছোট শুয়াযুক্ত হয়।
- বীজ আকারে বড়, গোলাকার এবং ঘিয়ে রঙের।
- হাজার বীজের ওজন ২.৩৬ গ্রাম।
- জীবন কাল ১২০-১২৫ দিন।
বিশেষ গুণ:
- গাছ খাটো হওয়ায় প্রবল বাতাসে নয়ে পড়ে না। ফলে পাহাড়ের ঢালে চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী।
- পাতার অগ্রভাগ সূঁচালো হওয়ায় পাখির আক্রমণজনিত ক্ষতি অনেক কম হয়।
- এ জাতটিতে রোগবালাই বা পোকামাকড়ের আক্রমণ তেমন একটা দেখা যায় না।
ফলন: রবি মৌসুমে এ জাতটির ফলন হেক্টরপ্রতি ২.৫-২.৮৫ টন। স্থানীয় জাতের চেয়ে ফলন প্রায় ৩৫ ভাগ বেশি।
(২) কাউন চাল চাষের পদ্ধতি
ক) মাটি
প্রায় সব ধরনের মাটিতেই কাউনের চাষ করা যায়। তবে পানি দাঁড়ায় না এমন বেল দোআঁশ মাটিতে এর ফলন ভাল হয়।
খ) বপনের সময়
দেশের উত্তরাঞ্চলে অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ মাস (মধ্য-নভেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত বীজ বোনা যায়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে বীজ বোনা হয়।
গ) বীজের হার
কাউনের বীজ ছিটিয়ে ও সারিতে বোনা যায়। ছিটিয়ে বুনলে হেক্টরপ্রতি ১০ কেজি এবং সারিতে বুনলে ৮ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। বীজ সারিতে বুনলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সেমি রাখতে হবে। চারা গজানোর পর ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে সারিতে চারার দূরত্ব ৮৮ সেমি রেখে বাকি চারা তুলে ফেলতে হবে।
চিত্র- উন্নত পদ্ধতিতে চাষকৃত কাউন ফসল
ঘ) সারের পরিমাণ
কাউন চাষে সচারাচর রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয় না। তবে অনুর্বর জমিতে হেক্টরপ্রতি নিম্নরূপ সার প্রয়োগ করলে ফলন বেশি হয়।
সারের নাম | সারের পরিমাণ |
ইউরিয়া | ৯৫-১০৫ কেজি/হেক্টর |
টিএসপি | ৭০-৭৫ কেজি/হেক্টর |
এমপি | ৩০-৪০ কেজি/হেক্টর |
সেচবিহীন চাষে সবটুকু সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। সেচের ব্যবস্থা থাকলে শেষ চাষের সময় অর্ধেক ইউরিয়া এবং সবটুকু টিএসপি ও এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া বীজ বপনের ৩৫-৪০ দিন পর উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ঙ) পানি সেচ
কাউন একটি খরা সহিষ্ণু ফসল। তবে রবি মৌসুমে খরা দেখা দিলে ১-২টি হালকা সেচের ব্যবস্থা করলে ফলন ভাল হয়।
চ) ফসল সংগ্রহ
কাউনের শীষ খড়ের রং ধারণ করলে বীজ দাঁতে কাটার সময় ‘কট’ করে শব্দ হলে বুঝতে হবে কাটার সময় হয়েছে।
(৩) কাউন চালের উপকারিতা
- ছোট দানাবিশিষ্ট কাউনের চালে আছে প্রোটিন, ফাইবার, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসহ আরো অনেক পুষ্টি উপাদান।
- যেকোনো দানাদার খাদ্য উপাদানের চাইতে কাউনের চালে আঁশ অনেক বেশি থাকে। তাই কাউনের চালের যেকোনো খাবার বানিয়ে খেলে পাকস্থলী ভালো থাকে।
- পর্যাপ্ত পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, জিংক ও আয়রন থাকায় কাউনের চাল নারীদের জন্য বিশেষ উপকারী খাদ্য।
- কাউনের চালে থাকা কিছু উপকারী উপাদান আমাদের রক্তে মিশে থাকা এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
- কাউনের চালে থাকা পটাশিয়াম আমাদের শরীরে লবণের ভারসাম্য বজায় রেখে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
- কাউনের চালে পর্যাপ্ত পরিমাণ আঁশ থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
- এতে ভিটামিন সি রয়েছে। তাই নানা উপকারি খনিজ উপাদান দেহ গঠনে সাহায্য করে।
- আঁশযুক্ত খাবার খেলে পেট অনেক লম্বা সময় পর্যন্ত ভরা থাকে। ফলে ঘনঘন ক্ষুধাভাব দেখা দেয় না। এতে সহজেই ওজন কমানো সম্ভব হয়।
[সূত্র: বিএআরআই ও বিডব্লিউএমআরআই]