বাংলাদেশের জলবায়ু অনেকটা সমভাবাপন্ন এখানে সারা বৎসরই প্রায় সমপরিমাণ উত্তাপ বিদ্যমান। জমি চাষ থেকে শুরু করে শস্যবীজ গুদামজাতকরণ পর্যন্ত প্রায় সব কাজই জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল।
এই আর্টিকেলটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো বুঝতে পারবেন। উদ্যান ও মাঠ ফসলের উপর জলবায়ুর প্রভাব জানতে পারবে। গবাদিপশু ও পাখির উপর জলবায়ুর প্রভাব ব্যাখ্যা করতে পারবেন। ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু ও পাখি পালনে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।
নিম্নে কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, যেমন- উদ্যান, মাঠ ফসল, গবাদি পশু ও পাখির উপর জলবায়ুর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
(১) উদ্যান ও মাঠ ফসলের উপর জলবায়ুর প্রভাব
ক) তাপমাত্রার প্রভাব
তাপমাত্রা শস্যের সার্বিক বৃদ্ধি সাধনে সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে। এই তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শস্যকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। গ্রীষ্মকালীন বা খরিফ শস্য এবং শীতকালীন বা রবি শস্য।
- শীতকালীন উদ্যান ফসলের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা ২০-৩০ সেলসিয়াস;
- গ্রীষ্ম ও বর্ষা কালীন উদ্যান ফসলের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা ৩০-৩৫ সেলসিয়াস;
- পাতা জাতীয় শাক সবজির দৈহিক বৃদ্ধি কম দিবসে ১২-১৭ সেলসিয়াস পছন্দ করে।
- অধিক তাপে এদের পাতায় সিক্ত শর্করার পরিমান কম হয়।
- অতিরিক্ত তাপে লেটুস ও পালংশাক দ্রুত ফুল উৎপন্ন করে।
- গোল আলু, মিষ্টি আলু, গাজর, মূলা, শাল গম ইত্যাদিতে অতিরিক্ত তাপে শর্করার সঞ্চয়ের পরিমান কম হয় বলে ফলন কম হয়।
- তাপমাত্রা কম বা বেশী হলে ক্যারোটিন কমে গাজরের রং হালকা হয়।
- বেশী তাপমাত্রায় ফুলকপি, বাধাকপি, মুলার স্বাদ কম হয়।
- আউশ ধান, পাট, সয়াবিন, জোয়ার ইত্যাদি গ্রীষ্মকালীন ফসল শস্যের জন্য অধিক তাপমাত্রার প্রয়োজন। গ্রীষ্মকালীন ফসল ২৩.৮৯-২৯.৪৬ সেলসিয়াস মাসিক গড় তাপমাত্রার সর্বাধিক ফলন দেয়।
- আমন ধান, বোরো ধান, গম, যব, সরিষা, ছোলা, মটর, মসুর, তামাক ইত্যাদি শীতকালীন ফসল। এসব ফসল মাসিক গড় তাপমাত্রা ১৬.৬৭-১৮.৩৩ সেলসিয়াস এ অধিক ফলন দেয়।
- কিছু সংখ্যক ফসল যেমন- তিল, চীনাবাদাম, তুলা, ভুট্টা প্রভৃতি উভয় মৌসুমেই চাষ করা যায়। আখ, রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমের অন্তর্গত।
- ফলের উৎপাদন তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। ফুল ও ফল ধারণের সময় উপযোগী তাপমাত্রা না হলে ফুল ও ফল কম ধরে। বেশী তাপমাত্রায় অনেক ফল গাছের ফল ধারণ ব্যাহত হয়। আম, লিচু প্রভৃতি ফল গাছের ফুল বিকাশের জন্য কম তাপামাত্রার প্রয়োজন।
- তাপমাত্রা অনেক ফল গাছের ফুল উৎপাদনের সময়কে প্রভাবিত করে। আমের পুষ্পমঞ্জুরী গঠনের সময় তাপমাত্রা কম থাকলে পুরুষ ফুল বেশি হয়।
দেশের একস্থান হতে অন্য স্থানের উষ্ণতার তেমন কোন তারতম্য না থাকলেও গ্রীষ্ম ও শীতকালীন উষ্ণতার মধ্যে বেশ পার্থক্য দেখা যায়। এজন্য প্রায় সব রকম শস্য কম বেশী দেশের সব জায়গায় জন্মানো সম্ভব হলেও শীতকালীন শস্য গ্রীষ্মকালে অথবা গ্রীষ্মকালীন শস্য শীতকালে কতগুলো (উচ্চ ফলনশীল জাত ব্যতীত) সাফল্যজনক ভাবে জন্মানো যায়না।
খ) বৃষ্টিপাত
গাছের সাবলীল বৃদ্ধি এবং অধিক ফলন পরিমিত পানি সরবরাহের উপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। এই পরিমিত পানির প্রাপ্যতা বিভিন্ন এলাকার এবং বিভিন্ন ঋতুতে শস্য বন্টনে তাপমাত্রার মতই অধিক প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
শাক সবজি ও ফলের মধ্যে ৬০-৭০ ভাগই পানি। এ পানি গাছ বৃষ্টিপাত ও মাটির নীচ হতে গ্রহন করে। বিভিন্ন শাকসবজি ও ফলের বীজ বৃষ্টিপাত ছাড়া গজায়না। মাঠ ফসলে বীজ গজানো থেকে ফসল সংগ্রহ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত প্রভাব বিস্তার করে।
- জমি ভালভাবে চাষের জন্য মাটির জো থাকা প্রয়োজন। বৃষ্টিপাত মাটিকে সে অবস্থায় এনে দেয়।
- ফসল পাকার পর বৃষ্টিপাত হলে ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- পুষ্পায়ণের সময় বৃষ্টিপাত হলে পরাগায়ণ ব্যাহত হয়।
- বৃষ্টিপাত কম বেশি হলে শাকসবজি ও ফলের ফলন ও কম বেশি হয়।
- সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড় গুলিতে ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে চা এর উৎপাদন ভাল।
- আবার তুলা চাষের জন্য মধ্যম বৃষ্টিপাত ও অধিক তাপমাত্রার প্রয়োজন।
- গ্রীষ্মকালে বোনা আউশ ও পাটের বীজ গজানোর জন্য বৃষ্টিপাত প্রয়োজন।
- শীতকালে উত্তর পূর্ব মৌসুমী বায়ু প্রবাহের ফলে বষ্টিপাত হয়না বললেই চলে। এসময় শীতকালীন সবজি লালশাক, পালংশাক, মূলা, শাল গম, ডাল জাতীয় ফসল, তেল জাতীয় ফসল, ফুলকপি-বাধাকপি জন্মে।
- কাল বৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে যে বৃষ্টিপাত হয় তা আমাদের কৃষির জন্য অপরিহার্য। কারণ, এ সময় জমি চাষ ও খরিফ শস্য বোনার সময় শুরু হয়।
- শিশির মাটিতে কিছুটা পানি যোগ করে যা ফসলের জন্য ভাল।
- কুয়াশা ও তুষার পাতে ফসল ও গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। কুয়াশা ও তুষারপাত ফসলের জন্য ক্ষতিকর। বেশি কুয়াশার কারণে ডাল জাতীয় ফসল জাবপোকা ও বিভন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।
গ) ফসলের উপর আলোর প্রভাব
সূর্যের আলো আবহাওয়া ও জলবায়ুর অন্যতম প্রধান উপাদান। শস্যের সুষ্ঠে বৃদ্ধির জন্য আলোর প্রভাব অনস্বীকার্য। পর্যাপ্ত সূর্যের আলো উদ্ভিদের সালোক-সংশ্লেষনের জন্য অপরিহার্য।
ফটো পিরিয়ডিজম: অধিকাংশ ঘাস জতীয় শস্যের বীজের অংকুরোদগমের জন্য আলোর বিশেষ প্রয়োজন। আলো অনেক উদ্ভিদের ফুল ও বীজ উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। উদ্ভিদ জীবনের বিশেষ প্রক্রিয়া, যৌন-বংশ বৃদ্ধির উপর আলোর এরূপ প্রভাব বিস্তারকে ফটো পিরিয়ডিজম বলে।
- কিছু উদ্ভিদের শীষ, ফুল ও বীজ উৎপাদনের জন্য ১২ ঘন্টার বেশী আলোর প্রয়োজন।
- আবার কিছু উদ্ভিদের ফুল, ফল ও বীজ উৎপাদনের জন্য ১২ ঘন্টার কম আলো প্রয়োজন, যেমন- পাট।
- কিছু উদ্ভিদের পুষ্পায়ণে আলোর প্রভাব পড়ে না, যেমন- তুলা, ভূট্টা, তিল, চিনাবাদাম ইত্যাদি।
(২) গবাদিপশু ও পাখির উপর জলবায়ুর প্রভাব
গবাদিপশু ও পাখি পালনে মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাব লক্ষণীয়। প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট পরিমান তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাত প্রয়োজন রয়েছে। গবাদিপশু ও পাখির ক্ষেত্রেও জলবায়ুর প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণ।
- গবাদিপশুর দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা অত্যাধিক কম বা বেশি হলে পশুর দৈহিক বৃদ্ধি খাদ্য গ্রহণ, প্রজনন, দুধ উৎপাদন ব্যাহত হয়।
- অতি বৃষ্টির কারণে দেশে বন্যার সৃষ্টি হলে গবাদিপশু পালনে যথেষ্ট বাঁধার সৃষ্টি হয়। বন্যার ফলে আবাসস্থল সহ খাদ্য সংকটও দেখা দেয়। এ সময় গবাদি পশুর নানা ধরনের রোগ বালাই দেখা দেয়।
- আর্দ্রতা ও উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন গাভীর দুধ উৎপাদন কমে যায়।
- গ্রীষ্মকালে ও বর্ষাকালে তাপমাত্রা বেড়ে গেলে পশু পাখির দেহে পানি শূন্যতা দেখা যায় এবং পশু ভারবাহী কাজ করতে পারে না।
- শীতকালে তাপমাত্রা অত্যাধিক কমে গেলে গরুর ক্ষুধামন্দাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়। যেমন- নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, তড়কা, গলাফুলা ইত্যাদি।
- আবার বর্ষা মৌসুমে পশুর ক্ষুরারোগসহ নানা ধরনের রোগ হয়। গবাদিপশু কৃমি ও বহিঃপরজীবীরা আক্রান্ত হতে পারে।
- তাপমাত্রা গৃহপালিত পাখির উপর সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ডিম উৎপাদনের পরিমাণ কমে যায় এবং ডিম ছোট হয়।
- বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা অত্যাধিক হলে মুরগি হিটস্ট্রোক করে মারা যায়।
- শীতের সময় বার্ডফ্লু, রানীক্ষেত, বসন্ত ইত্যাদি বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে।
- তাপমাত্রা কমলে বা জলবায়ু পরিবর্তন হলে ডিম উৎপাদন মারাত্মক হ্রাস পায়।
- আলো ডিম উৎপাদনে প্রভাব ফেলে।
(৩) ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু ও পাখি পালনে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব
আলোচনার এই অংশে আপনি- বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন, গবাদিপশু ও পাখি পালনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান উত্তর গোলার্ধে। বাংলাদেশের মাঝামাঝি দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গিয়েছে। তাই এদেশ ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত। বাংলাদেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রয়েছে কিছু পাহাড়িয়া অঞ্চল এবং ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়িয়া অঞ্চল। তাছাড়া পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয় অবস্থিত বাংলাদেশের উত্তরে। এদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
বাংলাদেশের ভূখন্ড উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে ক্রমশ ঢালু। এর ফলে নদ-নদীর গতিপথ উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ধরনের ভৌগোলিক অবস্থান জনিত কারণে বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি, কালবৈশখী, শিলাবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি প্রতিকূল অবস্থা দেখা যায়।
জলবায়ুগত কোন কোন উপাদানগুলো ফসল উৎপাদনের জন্য প্রতিকূল পরিবেশের সৃষ্টি করে। প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টিকারী জলবায়ুগত উপাদানগুলো মধ্যে রয়েছেঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বোস, বন্যা, খরা ইত্যাদি।
ক) ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস
বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্রোপকূল এলাকায় এর তীব্রতা বেশি। ২০২০ সালের একটি পরিসংখ্যান তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উপকূলের প্রায় ২.৮৫ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা প্রায় প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জলোচ্ছ্বাস/টর্ণেডো/হারিকেন/সাইক্লোন: সমুদ্রে যখন নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় তখন তা সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের আকারে স্থলভাগের দিকে আসে। এর ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উঁচু হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই স্থলভাগে ঢুকে পড়ে। তখন তাকে আমরা জলোচ্ছ্বাস বলি। তীব্রতা ও স্থানভেদে এই জলোচ্ছ্বাসকে কখনও বলা হয় টর্ণেডো কখনও বা হারিকেন বা সাইক্লোন।
জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা কেমন তার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন সময়ে এই নাম দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত ২.৮৫ মিলিয়ন হেক্টর এলাকার প্রায় ০.৮৩ মিলিয়ন হেক্টর বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততায় আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের মাটির লবণাক্ততার প্রধান কারণ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ভূমি প্লাবিত হওয়া।
জলোচ্ছ্বাসজনিত কারণে লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে ঢুকে পড়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং পরবর্তী কালের জন্য তা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূবর্-মধ্যা লের ফসল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক-ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূণিঝড়ের গতিবেগ ঘন্টায় এমনকি ১৫০ কিলোমিটারেরও বেশি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে প্রধানত বৈশাখ (মধ্য এপ্রিল) থেকে আরম্ভ করে আশ্বিন-কার্তিক (নভেম্বর) মাসে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হয়। বৈশাখ মাসে হলে তাকে প্রাক-খরিফ আর আশ্বিন-কার্তিক মাসে হলে তাকে প্রাক-রবি জলোচ্ছ্বাস বলা যায়। এই উভয় সময়েই কম-বেশি মাত্রায় তীব্র জোয়ারসহ জলোচ্ছ্বাসে কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
জলোচ্ছ্বাসের ফলে সাধারণত ৬-১২ ঘন্টা পর্যন্ত সমুদ্র বা নদীর অতিরিক্ত পানি জমির উপরে থাকে। তবে পানি সরে যাওয়ার পরও ক্ষতির প্রভাব থেকে যায় অনেকদিন পর্যন্ত।
সাল ২০২০ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রউপকূলবতীর্ ১৩টি জেলার প্রায় একশ থানা অর্থ্যাৎ দেশের প্রায় ১ ৫ এলাকা জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরাসরি জলোচ্ছ্বাস ছাড়াও জলোচ্ছ্বাসে সাথের ঘূর্ণিঝড়ে দেশের অভ্যন্তরে আরও সমপরিমাণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কোন এলাকা ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস কবলিত হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিনষ্ট হয়, মানুষ ও গবাদি পশু আহত হয় অথবা মারা যায়। জলোচ্ছ্বাসকবলিত এলাকার পানি দূষিত হয়, জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়ের ফলে বহু গবাদিপশু ও জীবজন্তু তাৎক্ষণিক মারা যায়, পশু খাদ্যের অভাব্ দেখা যায়, জীবিত গবাদিপশু উদরাময় এবং পেটের পীড়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ফসল ও অন্যান্য সম্পদ বিনষ্ট হয় বা ভেসে যায়, মাটিতে লোনা ধরে এবং জলাবদ্ধতার ফলে জমির ফসল ও গাছপালা মারা যেতে পারে।
কোন এলাকা জলোচ্ছ্বাস কবলিত হলে সেখানকার জন্য তাৎক্ষণিক কাজের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় চাহিদা ভিত্তিক পুনর্বাসন পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা। এক্ষেত্রে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিল্প, কর্মসংস্থান, উপকরণ সরবরাহ, যোগাযোগ সবগুলির সমন্বয়েই পুনর্বাসন পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত। তবে তাৎক্ষণিক উৎপাদনশীল করণীয়ের মধ্যে কৃষির গুরুত্ব সর্বাধিক।
খ) বন্যা
বন্যা: সাধারণভাবে নদী-নালা, খাল-বিল দিয়ে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি পানি বয়ে গেলেই বন্যা দেখা দেয়।
বন্যা বাংলাদেশে অতি স্বাভাবিক ঘটনা। কোন কোন বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আবার কোন কোন বছর বিভিন্ন সময়ে বন্যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়।
বৃষ্টি জলীয় বাষ্প সমৃদ্ধ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। এই মৌসুমী বায়ু উত্তরের পাহাড়ের গায়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। বাংলাদেশের উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে ক্রমশ ঢালু হওয়াতে বৃষ্টির পানি নদ-নদী দিয়ে প্রবাহিত হয় দক্ষিণ দিকে। কিন্তু নদীর পানি ধারণ ও অপসারণ ক্ষমতার তুলনায় পানির পরিমাণ যদি বেশি হয় তবে নদ-নদীর অববাহিকা অঞ্চলসহ দেশের সমতল ভূমির অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। এতে দেশের ন্যূনতম ৫০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়। এতে কৃষি উৎপাদন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয় ৪০-৭০%।
বাংলাদেশের বন্যা দেখা দেয় সাধারণত বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাসের মধ্যে যে কোন সময়ে।
যে কোন স্থানে বন্যা হওয়ার পর ফসল কৃষি উপকরণ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগী, মৎস্য ও অন্যান্য কৃষি সম্পদ, জমি ও মাটির প্রচুর ক্ষতি হয়। জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, দেশের অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে যায়, রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটে, গো-খাদ্য পাওয়া যায় না, পানি দূষিত হয়, পশুপাখি রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যার সৃষ্টি হয়, গবাদি পশু অপুষ্টিতে ভোগে, বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ও কৃমির আক্রমণ বৃদ্ধি পায়, ঘাসে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়, গবাদিপশু অসুস্থ হয়ে পড়ে, পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয়, অনেক পশুর মৃত্যু হয়। কোন কোন এলাকায় আগাম বন্যার ফলে সময়মত জমি চাষ ও ফসলের বীজ বপন বা চারা রোপণও ব্যাহত হয়।
প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায় যে, বন্যায় কেবলমাত্র খাদ্য শস্যের বেলাতেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০-২৫ লক্ষ টন। এর সাথে সাথে নানা ধরনের আর্থ সামাজিক সমস্যাও দেখা দেয়।
গ) খরা
খরা বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত ও মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খরার কারণে এদেশে ৩০-৭০% পর্যন্ত ফসলহানি হতে পারে।
খরা: গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য মাটিতে প্রয়োজনীয় পানির ঘাটতি হলে সেই অবস্থাকে খরা বলা হয়। যে মৌসুমে সাধারণত মাটিতে রসের এই ঘাটতি অবস্থা থাকে তাকে বলা হয় খরা মৌসুম।
খরার প্রধান প্রধান কারণগুলি হল অনাবৃষ্টি, সেচের পানির অভাব, প্রখর রৌদ্রতাপ ও বেলে বা ঢালু জমিতে কোন আচ্ছাদন না থাকা।
খরা অবস্থায় চারা গাছ খুব সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খরাকে তীব্র, মাঝারি ও সাধারণ এই তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে সকল মৌসুমেই খরা দেখা দিতে পারে।
২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বরেন্দ্র অঞ্চল ও গঙ্গা পলিমাটি এলাকার নওয়াবগঞ্জ, রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায় প্রায় ১০ লক্ষ হেক্টর জমিতে প্রতি বছর প্রচন্ড খরা দেখা দেয়। এ ছাড়াও সারাদেশে প্রায় ৫০ লক্ষ হেক্টর জমিতে মাঝারি ধরনের খরা দেখা দেয়।
গম, মসুর, সরিষা, গোল আলু, ধান, আখ, ফলমূল, শাক সবজিসহ প্রায় সকল ধরনের ফসলেই খরায় গড়ে ৩০% ফলন কম হয়। খরা ফসলি জমি, পশু সম্পদ, মাছ ও পরিবেশের উপর বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
- খরায় পানির অভাবে গাছ মারা যায়।
- ফসলের বৃদ্ধি কমে যায়, জমি প্রস্তুতিতে অসুবিধা হয়।
- বীজ বোনা যায় না ও জমিতে লবণাক্ততা বাড়ে।
- খরায় চারা গাছ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- বয়স্ক গাছে ফুল-ফল ঝরে যায়।
- খরায় উপসর্গ হিসাবে গাছের পাতা বা কচি ডগা দুপুরে সাময়িকভাবে নুয়ে পড়ে বা সরু হয়ে যায়।
- পানির অভাবে মানুষ-পশু-পাখি ও মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- কাঁচা ঘাসের অভাব হয়, পানি দূষিত হয়, গবাদিপশু ও পাখি অপুষ্টিতে ভোগে, গবাদিপশু ও পাখির বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দেয়, মাঠ ঘাটের ঘাস শুকিয়ে যায়, অধিক তাপে পশুপাখির অসহনীয় অবস্থায় সৃষ্টি করে, তাপ পীড়নে খামারে ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির মৃত্যু হয়।
- পশু-পাখির খাদ্যের অভাব এবং রোগ বালাইও বেড়ে যায়। ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যায়।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, বন্যা খরা ছাড়াও বাংলাদেশের কৃষি শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখী প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের কৃষিতে ক্ষতি হয় অপূরণীয়। প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, বাস্তব অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে শস্য বিন্যাসে প্রয়োজনীয় পুনবিন্যাস, দুর্যোগকালীন ফসল ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ এবং দুর্যোগ পরবর্তী পুনবার্সন কার্যক্রম গতিশীল ও সু-সমন্বিত করে বাংলাদেশের কৃষিতে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির মোকাবেলা করা যেতে পারে।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলেচনার মাধ্যমে আমরা কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, যেমন- উদ্যান, মাঠ ফসল, গবাদি পশু ও পাখির উপর জলবায়ুর প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারেলাম।
ফসল উৎপাদনের ক্ষেতে জমিতে চাষ থেকে শুরু করে শস্যবীজ গুদামজাতকরণ পর্যন্ত সব কাজই জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। যেমন- তাপমাত্রার প্রভাবের কারণে গ্রীষ্মকালীন শস্য শীতকালে শীতকালীন শস্য গ্রীষ্মকালে শীতকালনি শস্য গ্রীষ্মকালে জন্মানো যায় না। মাঠ ফসলের বীজ গজানো থেকে ফসল সংগ্রহ বৃষ্টিপাত প্রভাব বিস্তার করে। পুস্পায়নের সময় বৃষ্টিপাত হলে পরাগায়ন ব্যাহত হয়। প্রচুর বৃষ্টির কারনে সিলেটে চা উৎপাদন ভাল হয়। উদ্ভিদজীবনের বংশবৃদ্ধির জন্য আলোর প্রভাব বিস্তারকে ফটোপিরিয়ডিজম বলে। অন্যদিকে আর্দ্রতা উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে বা কমে গেলে পশু পাখির দৈনিক বৃদ্ধি, খাদ্য গ্রহন, ডিম উৎপাদন, প্রজনন, দুধ উৎপাদন ব্যহত হয়। বৃষ্টিপাতের উপর পশুর খাদ্য যেমন, ঘাস, ভুট্টা উৎপাদন নির্ভর করে।
ভৌগোলিক অবস্থার কারণে বাংলাদেশের প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছাস, বন্যা, খরা প্রভৃতি ফসল পশু ও পাখি পালনে প্রতিকূল পরিবেশের সৃষ্টি করে। প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, বাস্তব অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে শস্য বিন্যাসে প্রয়োজনীয় পুনবিন্যাস, দুর্যোগকালীন ফসল ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ এবং দুর্যোগ পরবর্তী পুনবার্সন কার্যক্রম গতিশীল ও সু-সমন্বিত করে বাংলাদেশের কৃষিতে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির মোকাবেলা করা যেতে পারে।
[তথ্য সূত্র: ওপেন স্কুল]