গবাদি প্রাণি অর্থ্যাৎ গরু-ছাগলের শরীরে বাস করা অন্তঃপরজীবী কৃমি নামে পরিচিত। এরা পোষক দেহের ভিতরে অবস্থান করে। আমাদের বাংলাদেশে প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ গৃহপালিত গবাদি প্রাণি কৃমিতে আক্রান্ত হয়।
অন্তঃপরজীবী বা কৃমিকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- গোলকৃমি, ফিতাকৃমি ও পাতাকৃমি।
এখানে আমরা- গরুর/ছাগলের কৃমির ঔষধের নামসমূহ জানব। এছাড়াও গরুর/ছাগলের কৃমি রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হব।
(১) ‘গোলকৃমি’ দমনে গরুর/ছাগলের কৃমির ঔষধের নাম
গবাদি প্রাণিকে বহু ধরনের গোলকৃমি আক্রমণ করে থাকে। যেমন- ছোট বাদামি পাকস্থলীর কৃমি, ছোট চুলকৃমি, ছোট অন্ত্রনালির কৃমি, বক্রকৃমি, চিকনগলা অন্ত্রনালির কৃমি, বড় পাকস্থলির কৃমি, সুতাকৃমি, ক্ষুদ্রপিত্ত কৃমি, কেঁচোকৃমি, বা বড় গোলকৃমি, ফুসফুসের কৃমি।
রোগের লক্ষণ:
- গবাদি প্রাণি পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত হয়।
- গবাদি প্রাণির ক্ষুধামন্দা দেখা যায়।
- শরীরের ওজন কমতে থাকে।
- গায়ের লোম রুক্ষ দেখায়।
- পাতলা পায়খানা হয়।
- রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং গবাদি প্রাণি মারা যায়।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ:
- কৃমির আক্রমণে ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক কৃমিনাশক ঔষধ (যেমন ‘ফেনবেন্ডাজো’ অথবা, ‘লিভামিসোল’ অথবা, ‘মিবেল অ্যালবেন্ডাজল’) খাওয়াতে হবে।
- বাছুরের বয়স ৩ মাস হলেই নিয়মিত কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়াতে হবে।
- গোয়াল ঘরের গোবর ও আবর্জনা নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
- গোয়াল ঘর শুকনা রাখতে হবে।
- স্যাঁতস্যাঁতে কাদা পানিযুক্ত মাঠে গবাদি প্রাণিকে চড়ানো যাবে না।
(২) ‘ফিতাকৃমি’ দমনে গরুর/ছাগলের কৃমির ঔষধের নাম
এসব কৃমি সাধারণত গবাদি প্রাণির অন্ত্রনালিতে বাস করে। ফিতাকৃমি দেখতে ফিতার মত বেশ লম্বা।
রোগের লক্ষণ:
- অধিক কৃমি অন্ত্রনালিতে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে গবাদি প্রাণির মৃত্যুর কারণ হয়।
- হজমে বিঘ্ন ঘটে এবং গবাদি প্রাণির পেট ফুলা, উদরাময়, দুর্বলতা, স্বাস্থ্যগত অবস্থার অবনতি হয়ে থাকে।
- মস্তিষ্কে কৃমির শূক জলকোষের সৃষ্টি করে ফলে পশুতে গিড নামক রোগ হয়।
- গিড হলে গবাদি প্রাণি মাথা বাঁকা করে ঘুরতে থাকে।
- মস্তিষ্কে যে যায়গায় গিড হয় সে জায়গার হাড় নরম হয়ে যায়।
চিকিৎসা:
- কৃমিনাশক ঔষধ যেমন- ‘বেনাজল’, ‘হেলমেক্স’, ‘এলডাজোল’ ইত্যাদি খাওয়াতে হবে।
- গবাদি প্রাণি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
(৩) ‘পাতাকৃমি’ দমনে গরুর/ছাগলের কৃমির ঔষধের নাম
গৃহপালিত গবাদি প্রাণিতে ৩ ধরনের পাতাকৃমি হয় থাকে। যেমন- যকৃতের পাতাকৃমি, পাকস্থলীর পাতাকৃমি ও রক্তের পাতাকৃমি।
রোগের লক্ষণ:
- গবাদি প্রাণির হজমে বিঘ্ন ঘটে এবং দুর্গন্ধযুক্ত তরল মল ত্যাগ করে।
- যকৃতে পাতাকৃমি আক্রমণে যকৃৎ ও পিত্তনালী এবং বিভিন্ন অঙ্গে প্রদাহ হয়।
- গবাদি প্রাণি দুর্বল হয়ে উৎপাদনশক্তি হারিয়ে ফেলে।
- অধিক কৃমির আক্রমণে বাছুর তাড়াতাড়ি মারা যায়।
- নাক হতে শ্লেষ্মার সাথে রক্ত ঝরে।
- নাসারন্ধ্রে গোটা উঠে নাকের ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায়।
- গবাদি প্রাণির শ্বাস কষ্ট হয় এবং নাক দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ হয়।
- পাকস্থলীর পাতাকৃমির আক্রমণে হজমের ব্যাঘাত ঘটে।
- দুর্গন্ধযুক্ত রক্তমিশ্রিত তরল পায়খানা হয়।
- গবাদি প্রাণির রক্তশূন্যতা দেখা দেয় ফলে গবাদি প্রাণি দুর্বল হয় এবং গবাদি প্রাণির খাওয়া কমে যায়।
- আক্রান্ত গবাদি প্রাণির থুতনির নিচে ফুলা দেখা যায়।
- রক্তে পাতাকৃমির আক্রমণে নাকের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চিকিৎসা:
- ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক চিকিৎসা করাতে হবে।
- গবাদি প্রাণিকে কৃমিনাশক ঔষধ (যেমন- ‘ফেসিনেক্স’, ‘বেনাজল’, ‘অ্যালডাজল’, ‘হেলমেক্স’ ইত্যাদি) খাওয়াতে হবে।
(৪) গরুর/ছাগলের ‘ফ্যাসিওলিয়াসিস’ (Fascioliasis) কৃমি রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা
রোগের কারণ: কলিজা কৃমি।
রোগের লক্ষণ:
- দুর্গন্ধযুক্ত পাতলা পায়খানা হয়।
- রক্তশূন্যতা দেখা দেয়।
- গবাদি প্রাণির দৈহিক ওজন কমে যায়।
রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:
- নিচু জমি ও ড্রেনের ঘাস খাওয়ানো যাবে না।
- কৃমির মাধ্যমিক পোষক শামুকের সংখ্যা হ্রাস ও ধ্বংস করতে হবে।
- কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়াতে হবে। অথবা গবাদি প্রাণি চিকিৎসকের পরামর্শমত ব্যবস্থা নিতে হবে।
(৫) গরুর/ছাগলের ‘হ্যাম্পসোর’ (Humpsore) কৃমি রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা
রোগের কারণ: গোল কৃমি।
রোগের লক্ষণ:
- গবাদি প্রাণিরচুড়ায়, কাঁধে, কানের গোড়ায় ও শিং এর গোড়ায় ক্ষত হয়।
- ক্ষতস্থান চুলকায়। শক্ত খুঁটি বা গাছের সাথে গবাদি প্রাণি ঘা ঘষতে থাকে।
রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:
- ক্ষতস্থানে মাছি বসতে না পারে সে জন্য ক্ষতস্থান ঢেকে রাখতে হবে।
- ‘নেগুভোন’ বা ‘এসানটাল’ ক্ষতস্থান লাগাতে হবে।
(৬) গরুর/ছাগলের ‘মনিজিয়াসিস’ (Moniliasis) কৃমি রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা
রোগের কারণ: ফিতা কৃমি।
রোগের লক্ষণ:
- পেটের পীড়া দেখা দেয়।
- হজমে বিঘ্ন ঘটে এবং পেট ফুলে যায়।
- শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হ্রাস পায় ও কৃশকায় হয়।
- শরীরে পানি জমে এবং রক্তশুন্যতা দেখা দেয়।
- মলের সাথে ভাতের মত দেখতে কৃমির টুকরা অংশ বের হয়ে আসে।
রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:
- গবাদি প্রাণি চারণক্ষেত্রে চরানো যাবে না।
- ‘লেড আর্সিনেট ২০-২৫ মিলিগ্রাম’ প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য প্রয়োগ করতে হবে। অথবা, ‘নিক্লোসেমাইড ৫০-৭৫ মিলিগ্রাম’ প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য প্রয়োগ করতে হবে।
(৭) গরুর/ছাগলের ‘এন্টেরিক সিস্টোসোমিয়াসিস’ (Enteric schistosomiasis) কৃমি রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা
রোগের কারণ: পাতা কৃমি।
রোগের লক্ষণ:
- আক্রান্ত গবাদি প্রাণি পানির মতো পাতলা পায়খানা করে।
- দেহের ওজন আস্তে আস্তে কমে যাায়।
- পানিশূন্যতা ও রক্তশূন্যতা দেখা যায়।
- চোখ কোটরে ঢুকে যায় ও পিপাসা বেড়ে যায়।
রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা:
- নিচু জমি বা ড্রেনের পাশর ঘাস খাওয়ানো যাবে না।
- কৃমির মাধ্যমিক পোষক শামুকের সংখ্যা হ্রাস বা ধ্বংস করতে হবে।
- কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে।
উপরোক্ত আলোচনাতে আমরা গরুর/ছাগলের কৃমির ঔষধের নাম এবং গরুর/ছাগলের কৃমি রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে জানলাম।
যে সব ক্ষুদ্র প্রাণী বড় প্রাণীরদেহে আশ্রয় নিয়ে জীবন ধারন করে তাদেরকে পরজীবী বলে। মূলত কৃমি এক প্রকার অন্তঃপরজীবী।
গবাদি প্রাণির দেহের ভিতরে ও বাইরে দুই ধরনের পরজীবী দেখা যায়। দেহের বাইরে চামড়ার মধ্যে উঁকুন, আটালি ও মাইট হয়ে থাকে। দেহের ভিতরে গোলকৃমি, ফিতাকৃমি ও পাতাকৃমি দ্বারা গবাদিপ্রাণি বেশি আক্রান্ত হয়।
এই পরজীবীগুলো গবাদি প্রাণি কর্তৃক খাওয়া পুষ্টিকর খাদ্যে ভাগ বসায়। অনেক কৃমি গবাদি প্রাণির শরীর থেকে রক্ত চুষে নেয়। পরজীবীগুলো গবাদি প্রাণির কোনো উপকার করে না বরং অনেক ক্ষতিসাধন করে থাকে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।