চিংড়ি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি অতি গুরুত্পূর্ণ মৎস্য সম্পদ। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্যের রপ্তানি আয়ের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ আসে হিমায়িত চিংড়ি থেকে।
বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পোশাক শিল্পের পরেই চিংড়ির স্থান। চিৎড়ি শিল্পের কাঁচামাল যেমন- চিংড়ির পোনা এ দেশের প্রাকৃতিক উৎস ও হ্যাচারি থেকে সহজেই পাওয়া যায়। তাই এ শিল্পে স্বল্প ব্যয়ে অধিক মুনাফা অর্জন করা যায়। চিংড়ি চাষ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব।
বাংলাদেশের মিঠা ও লোনা পানিতে প্রায় ৬৭ প্রজাতির চিখড়ি পাওয়া যায়। এদের সবগুলোই লাভজনকভাবে চাষোপযোগী নয় ৷ আমাদের বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে গুরুতুপূর্ণ চাষোপযোগী মিঠাপানির চিতড়ি প্রজাতিটি হচ্ছে গলদা চিংড়ি এবং লোনাপানির প্রজাতিটি হচ্ছে বাগদা চিংড়ি।
গলদা ও বাগদা চিংড়ির পার্থক্য:
গলদা চিংড়ির বৈশিষ্ট্য হলো এর মাথা ও দেহ প্রায় সমান। পুরুষ গলদার ২য় জোড়া পা বেশ বড়। অপরদিকে বাগদা চিংড়ির মাথা দেহের থেকে ছোট হয়।
এখানে আমরা মিঠা পানিতে গলদা চিংড়ি চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানব। গলদা একক চাষ ছাড়াও কার্প জাতীয় মাছের সাথে মিশ্রচাষ করা যায়।
(১) চিংড়ি চাষের জন্য পুকুর নির্বাচন ও প্রস্ততি
ছোট বড় সব পুকুরেই গলদা চিংড়ি চাষ করা যায়। তবে বড় পুকুর গলদা চিংড়ি চাষের জন্য সুবিধাজনক।
ক) পুকুর নির্বাচন
গলদা চাষের জন্য নির্বাচিত পুকুরে নিমললিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা প্রয়োজন-
- পুকুরটি খোলামেলা হবে যেন পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পায়।
- পুকুরের মাটি এঁটেল, দৌ-আশ বা বেলে দৌ-আশ হলে ভালো হয়।
- পুকুরের পানির গভীরতা ১-১.২ মিটার হওয়া দরকার।
- পুকুরে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- পুকুর বন্যাযুক্ত হতে হবে।
- পুকুরের পানি দূষণমুক্ত হতে হবে।
খ) পুকুর প্রস্তুতি
পূর্বেই আমরা একাধিকবার মাছ চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতি সম্পর্কে জেনেছি ও আলোচনা করেছি, তাই আর নতুন করে আবার এখানে বর্ণনা করা হলো না, কারণ মিঠা পানিতে চিংড়ি চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতিও প্রায় অনুরূপ।
নিচে সংক্ষেপে চিংড়ি চাষের জন্য পুকুর প্রস্তুতির বিভিন্ন ধাপ উলেখ করা হলো-
- পুকুরের পাড় ভাঙা থাকলে তা মেরামত করতে হবে এবং তলদেশের অতিরিক্ত কাদা তুলে ফেলতে হবে।
- রাক্ষুসে ও অচাষযোগ্য মাছ থাকলে পুকুর শুকিয়ে অথবা রোটেনন ব্যবহার করে তা অপসারণ করতে হবে।
- পুকুরের ভাসমান ও অন্যান্য জলজ আগাছা দূর করতে হবে।
- পুকুরে শতকে ১-২ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হবে। চুন মাটি ও পানির অস্গতা দূর করে, পানির ঘোলাত্ব দূর করে ও সারের কার্যকারিতা বাড়ায়।
- চুন দেওয়ার ৭-১০ দিন পর পুকুরে সার প্রয়োগ করতে হবে। পুকুর প্রস্ততিকালীন সারের পরিমাণ সম্পর্কে ইতিমধ্যেই আমরা আগের অধ্যায়ে জেনেছি।
(২) চিংড়ির পোনা মজুদ ও মজুদ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা
ক) পোনা মজুদ
- সার দেওয়ার ৩-৫ দিন পর পুকুরের পানির রং হালকা সবুজ হলে পোনা মজুদ করতে হবে।
- পোনা মজুদের একদিন আগে গলদা চিংড়ির জন্য আশ্রয়স্থল স্থাপন করতে হবে। কারণ চিংড়ি একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর খোলস বদলায়।
- খোলস ছাড়ার মাধ্যমেই চিড়ির বৃদ্ধি ঘটে। খোলস বদলের সময় চিংড়ি দুর্বল থাকে। এ সময় চিংড়ি নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে চায়। এ জন্য নারিকেল, তাল, খেজুর গাছের শুকানো পাতা, ডালপালা ও বাঁশের টুকরো পুকুরের তলদেশে স্থাপন করতে হয় যা চিতড়ির আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে।
- প্রাকৃতিক উৎস বা হ্যাচারি হতে সংগৃহীত ১০-১৫ সে.মি. আকারের পোনা পানির সাথে খাপ খাইয়ে সাবধানে পুকুরে ছাড়তে হবে।
- অত্যধিক রোদ বা বৃষ্টির মধ্যে পোনা মজুদ করা উচিত নয়।
- একক চাষের ক্ষেত্রে প্রতি শতকে ৪০-১২০টি চিংড়ির পোনা ছাড়া যায়। মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে শতক প্রতি চিতড়ি ৪৮টি, সিলভার কার্প ৬টি, রুই ৭টি, কাতলা ৭টি, গ্রাস কার্প ১টি ও সরপুটি ৯টি ছাড়া ঘায়।
খ) পানির অবস্থা পর্যবেক্ষণ
পুকুরে পোনা মজুদের পর নিয়মিত পানির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। দুই-তিন মাস পর পুকুরের পানি বেশি সবুজ হলে অথবা চিংড়ির অস্বাভাবিক আচরণ দেখা গেলে পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা করতে হবে।
গ) সার প্রয়োগ
প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য পুকুরে সার দেওয়া দরকার। এ জন্য পুকুরে প্রতিদিন শতক প্রতি গোবর ১৫০-২০০ গ্রাম, ইউরিয়া ৩-৫ গ্রাম, টিএসপি ১-২গ্রাম ও এমওপি ০.৫-১ গ্রাম দেওয়া যেতে পারে।
সকালে সূর্যের আলো পড়ার পর সার প্রয়োগ করতে হবে। পানির রং অতিরিক্ত সবুজ হলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
ঘ) খাদ্য ব্যবস্থাপনা
- চিংড়ির ভালো উৎপাদন পাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার দেওয়া দরকার।
- সুষম সম্পূরক খাদ্য তৈরির জন্য চালের কুঁড়া বা গমের ভুসি, খৈল, ফিশমিল, শামুক বা ঝিনুকের খোলসের গুঁড়া, লবণ ও ভিটামিন মিশ্রণ একসাথে মিশিয়ে বল তৈরি করে পুকুরে দেওয়া যায়।
- পুকুরে বিদ্যমান চিংড়ির মোট ওজনের ৩-৫ ভাগ হারে প্রতিদিন খাদ্য দিতে হবে। এ ছাড়া শামুক বা ঝিনুকের মাংস কুচি কুচি করে কেটে প্রতিদিন একবার করে দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
- বল আকারে তৈরি ভেজা খাদ্য পুকুরের নির্দিষ্ট স্থানে খাদ্যদানিতে করে দিতে হবে। প্রতিদিনের খাবারকে দুইভাগ করে সকালে ও সন্ধ্যায় পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে।
ঙ) চিড়ির সম্পূরক খাদ্য তালিকা
খাদ্য উপকরণ | পরিমাণ (%) |
চালের কুঁড়া বা গমের ভুসি | ৪০-৬০ |
খৈল | ১০-২০ |
ফিশমিল | ২০-৩০ |
শামুক বা ঝিনুকের খোলসের গুড়া | ৯.৫ |
লবণ | ০.২৫ |
ভিটামিন মিশ্রণ | ০.২৫ |
চ) রোগ প্রতিরোধ
- দুষিত পরিবেশ, রোগাক্রান্ত পোনা মজুদ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে চিংড়িতে রোগ হতে পারে। তবে রোগবালাইয়ের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থাই উত্তম।
- সুস্থ,সবল পোনা মজুদ ও ভালো ব্যবস্থাপনা করা গেলে রোগের সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
- চাষকালীন চিংড়ির কয়েকটি সাধারণ রোগ হচ্ছে খোলস, লেজ ও ফুলকায় কালো দাগ রোগ, খোলস নরম রোগ, চিংড়ির গায়ে শেওলা সমস্যা, পেশি সাদা ও হলদে হয়ে যাওয়া।
- চিংড়িতে রোগ দেখা দিলে প্রথমেই দ্রুত পানি পরিবর্তন করে নতুন পানি দিতে হবে। পুকুরের পানিতে শতকে ১ কেজি পরিমাণ পাথুরে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।