উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধিতে প্রযুক্তির অবদান অনেক। প্রযুক্তি প্রচীন হোক কিংবা আধুনিক হোক, চালু প্রযুক্তির কোনোটির অবদানই অধীকার করা যায় না। নিচে উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধিতে গাছে কলম করার পদ্ধতি/ছবিসহ আধুনিক কলম পদ্ধতির বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
(১) অঙ্গজ চারা উৎপাদন
প্রায় সব গাছই বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। তবে বীজ ছাড়াও গাছের বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে চারা উৎপাদন এবং বংশবিস্তার করা সম্ভব। অঙ্গজ চারার ব্যবহার কৃষিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে এবং এ থেকে কৃষকেরা অনেক লাভবান হচ্ছেন।
অঙ্গজ চারা উৎপাদন প্রযুক্তির মধ্যে কর্তন বা ছেন কলম, দাবা কলম, গুটি কলম, জোড় কলম এবং চোখ কলম প্রধান। অঙ্গজ চারার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এ থেকে জন্মানো গাছে মাতৃগাছের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ থাকে।
নিচে অঙ্গজ চারা উৎপাদনের কয়েকটি পদ্ধতি দেওয়া হলো। আর চারা গাছ থেকে তাড়াতাড়ি ফল পেতে হলে অকাজ চারা উৎপাদন পদ্ধতির জুড়ি নেই।
ক) গাছে ‘কর্তন বা ছেল কলম’ করার পদ্ধতি
- এই পদ্ধতিতে শাখা, মূল, পাতা ইত্যাদি মাতৃগাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ছায়াযুক্ত স্থানে টবে বা নার্সারির বেডে রোপণ করতে হয়।
- ১৫ দিনের মধ্যে তা থেকে নতুন চারা উৎপন্ন হয়।
- অতঃপর চারটি অন্যর মূল জমিতে রোপণ করা হয়।
- এ প্রক্রিয়ায় বলে কিস্তার খুবই সহজ। গোলাপ, লেবু ইত্যাদি ফুল ও ফল গাছের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
খ) গাছে ‘দাবা কলম’ করার পদ্ধতি
- প্রথমে মাতৃগাছের মাটির নিকটে অবস্থিত শাখা নিচে নামিয়ে দুই গিঁটের মাঝখানের বাকল কাটতে হবে।
- বাকলের নিচের সবুজ অংশে ছুরির ভোতা পাশ দিয়ে চেছে ফেলতে হবে।
- অতঃপর কাটা অংশ মাটিতে চাপা দিতে হবে। কিছু দিন পর কাটা অংশ থেকে শিকড় গজাবে এবং নতুন চারা হবে।
- গজানো অংশ কেটে ২-৩ সপ্তাহ পর সাবধানে মাটিসহ উঠিয়ে অন্যত্র রোপণ করতে হয়।
- লেবু, পেয়ারা, গোলাপ, ইত্যাদি গাছে দাবা কলম করা হয়।
গ) গাছে ‘জোড় কলম’ করার পদ্ধতি
জোড় কলমের দুটি অংশ-
- রুটস্টক ও
- সায়ন।
- অনুন্নত যে গাছের সঙ্গে জোড়া লাগানো হবে সে গাছটিকে রুট স্টক বলে। উন্নত জাতের গাছের যে অঙ্গ স্টকের সঙ্গে লাগানো হবে তাকে বলা হয় সায়ন। রুট স্টক ও সায়নের জোড়া লাগানো পদ্ধতিকে জোড় কলম বলে।
- জোড়কলম প্রধানত দু’ধরনের হয়। যেমন-যুক্ত জোড় কলম ও বিযুক্ত জোড় কলম।
- জোড় কলমের মাধ্যমে বর্তমানে আম, তেজপাতা, সফেদা প্রভৃতি গাছের বংশবিস্তার করা হচ্ছে।
(২) কাণ্ড থেকে নতুন চারা তৈরি পদ্ধতি
উদ্ভিদের কান্ড থেকে নতুন চারা তৈরির পদ্ধতি এক ধরনের কৃত্রিম অঙ্গজ প্রজনন পদ্ধতি। পূর্ববর্তীেএকটি পোষ্টের আলোচনায় আমরা এ বিষয়ে জানতে পেরেছি। এ পোষ্টটিতে আমরা আরও কয়েকটি কৃত্রিম অঙ্গজ প্রজনন পদ্ধতি সম্বন্ধে বিস্তারিত জানব।
ক) গাছে ‘শাখা কলম বা কাটিং’ করার পদ্ধতি
- যখন উদ্ভিদের শাখা থেকে কর্তন বা হেল কলম তৈরি করা হয় তখন তাকে শাখা কলম বা কাটিং বলে।
- এ পদ্ধতিতে একটি বৃক্ষের শাখা কেটে ভেজা মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে শাখাটি তাািবে বড় হয়ে নতুন গাছে পরিণত হয়। যেমন- গোলাপ, পিফুল, মাজার ইত্যাদি।
খ) গাছে ‘গুটি কলম’ করার পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে ভালো জাতের মাতৃগাছ থেকে কলম করে নতুন গাছ তৈরি করা হয়। গুটি কলম খুবেই জনপ্রিয় ও সহজ পদ্ধতি। লেবু, পেয়ারা, সফেদা, লিচু, রঙ্গন প্রভৃতি গাছে এ পদ্ধতিতে কলম করা হয়।
- গুটি কলম তৈরির জন্য এক বছর বয়সের সতেজ গাছ নির্বাচন করতে হবে।
- এবার তিন ভাগ দোঁআশ পাটির সাথে এক ভাগ পঁচা গবর সার মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করতে হবে।
- চিত্রে মত করে ধারালো ছুরি দিয়ে নির্বাচিত কান্ডের অগ্রভাগে থেকে অন্তত ৬০ সেমি অংশের বাকল স্লোপ করে ছাড়িয়ে নিতে হবে।
- বাকলমুক্ত অংশ প্রথমে ছুরির ভোতা পাশ দিয়ে একটু করে সবুজাভ পিচ্ছিল্ল অংশ তুলে নিতে হবে।
- এবার বাকলযুক্ত অংশে চিত্রের মত করে পেস্ট পলিথিনে মিুড়ে দুই পাশের মুখ তুতা দিয়ে বাঁধতে হবে।
- ৩-৪ সম্পাহের মধ্য বাকলহীন অংশে সাদা শিকড় পলিথিনের বাহিরে থেকে দেখা যাবে।
- শিকড় ভালে করে গজালে এবং বাদামী রঙের হলে, ডাল দিকে কেটে টবে লোগিয়ে কয়েকদিন ছায়াতে রাখতে হবে।
- মাঝে মাঝৈ টবের মাটিতে পানি দিতে হবে। রোদে রাখলে কয়েকদিন পর নতুন পাতা গজাবে।
গ) বিযুক্ত জোড় কলম
এ কলমের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ ক্লেফ্ট গ্রাফটিং।
বিযুক্ত জোড় কলমের মধ্যে ভিনিয়ার গ্রাফটিং ও ক্লেফট গ্রাফটিং অন্যতম। তবে বর্তমানে ক্লেফ্ট গ্রাফটিং বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। কারণ পদ্ধতিটি সহজ এবং সফলতার হার বেশি। আম, কাঁঠাল, কামরাঙ্গা, জলপাই, কদবেল, সফেদা, গোলাপজাম, জাম ইত্যাদির ক্লেফট গ্রাফটিং এর মাধ্যমে বংশবিস্তার করা যায়। আমরা আমের ক্লেফট গ্রাফটিং পদ্ধতিতে উন্নত জাতের চারা তৈরি সম্পর্কে জানব।
ঘ) আম গাছে ‘ক্লেফট গ্রাফটিং’ কলম করার পদ্ধতি
আমরা জানি, জোড় কলমে আটির চারা গাছকে রুটস্টক এবং উন্নতজাতের গাছের শাখাকে সায়ন বলে।
- আমের ক্লেফট গ্রাফটিং বছরে দুবার করা যায়। বর্ষার আগে মার্চ থেকে মে মাস এবং বর্ষার পরে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। ৩-১৫ মাস বয়সের রুটস্টক উত্তম।
- সায়ন হিসেবে এমন শাখা নির্বাচন করতে হবে যার শীর্ষ কুঁড়ি সজীব ও অল্প কিছুদিনের মধ্যে ফুটবে।
- ১০-১৫ সেমি লম্বা সায়ন যার পাতা গাঢ় সবুজ হয়ে উঠেছে, এমন শাখা নির্বাচন করতে হবে।
- এবার ধারালো ছুরির সাহায্যে সায়ন থেকে পাতা ছাড়াতে হবে।
- এবার সায়নের নিচের দিকে তেরছাভাবে ‘ভি’ আকৃতি করে ৩-৫ সেমি পরিমাণ কাটতে হবে।
- অতঃপর রুটস্টকের গোড়া থেকে ৪০-৪৫ সেমি উপরে কাঙটি গোল করে কাটতে হবে। কাটা অংশের নিচে যেন ৩-৪ টি পাতা থাকে।
- এবার ধারাল ছুরির সাহায্যে কাটা অংশের মাঝ বরাবর উপর থেকে নিচের দিকে ৩-৫ সেমি ফাড়তে হবে।
- ঐ ফাটলে সায়নটি প্রবেশ করিয়ে পলিথিনের ফিতা দিয়ে নিচ থেকে সায়নের প্রায় কুঁড়ি পর্যন্ত শক্ত করে পেঁচিয়ে বেঁধে দিতে হবে। তার সমব্যাসের না হলে সায়নের যেকোনো এক পাশ রুটস্টকের এক পাশের সাথে মিলিয়ে বেঁধে দিতে হবে।
- এরপর খেয়াল রাখতে হবে রুটস্টকের কান্ড থেকে কোনো শাখা প্রশাখা যেন বের না হয়। বের হলে তা ভেঙ্গে দিতে হবে।
- ১২ মাস থেকে ৩ মাসের মধ্যে কলম জোড়া লেগে যায়। ভালোভাবে জোড়া লেগে গেলে পলিথিনের বাঁধন কেটে ছাড়িয়ে নিতে হবে। না কাটলে পলিথিন সায়নের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং সায়ন ভেঙে যায়।
প্রিয় প্রকৃতি ও বৃক্ষ প্রেমী পাঠকগণ, আজকের এই গাছে কলম করার পদ্ধতি/ আধুনিক কলম পদ্ধতি বিষয়ক আলোচনাটি এখানেই সমাপ্ত হলো। পোষ্টটি পড়ে এটি দ্বার যদি আপনি যদি কোন উপকৃত হয়ে থাকেন তবে কেমন্ট বক্সে আপনার মূল্যয়ন জানিয়ে আমাদের উৎসাহিত করবেন। আবার দেখা কথা অন্য কোন আলোচনায়। কৃষি বিষয়ক যেকোন তথ্যর জন্য আমাদের ওয়েবসাইটটি নিয়মিট ভিজিট করুন। ধন্যবাদ।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।
ভালো আলোচনা। কাজে লাগবে। ধন্যবাদ।