গুলশা/ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের ছোট মাছগুলোর মধ্যে গুলশা মাছ আবহমান কাল থেকে বাঙ্গালীদের খুব প্রিয় মাছ হিসেবে সমাদৃত। মাছটি খেতে খুব সুস্বাদু এবং বাজার মূল্যও অনেক বেশী।
এক সময় এদেশের নদ-নদী, ধান ক্ষেতে, হাওড়, বাওড় ও খাল-বিলে এ মাছ প্রচুর পাওয়া যেত কিন্তু নদ-নদীর উজানে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, ধান ক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার, বিল সেচে শুকিয়ে মাছ ধরা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে প্রজনন ক্ষেত্রে ধ্বংস হওয়ায় এ মাছের প্রাপ্যতা দারুণভাবে হৃাস পায়। পরবর্তীতে মাছটির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট একটি প্রকল্পের মাধ্যমে দীর্ঘ গবেষণায় এ মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন ও চাষ কৌশল উদ্ভাবনে সফলকাম হয়।
ট্যাংরা মাছে প্রজাতিটির সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্র, সৈয়দপুরে গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে মাছটির কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও পোনা প্রতিপালন কলাকৌশল উদ্ভাবনে সাফলতা লাভ করেছেন।
খরা প্রবণ রংপুর অঞ্চলে বেশিরভাগ জলাশয়ে ৫-৬ মাস পানি থাকে এবং এ অঞ্চলে মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ট্যাংরা মাছের পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে মৌসুমী জলাশয়ে চাষের আওতায় অন্যান্য মাছের বিকল্প হিসেবে মজুদ করতে পারলে এ অঞ্চলে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো সম্ভব হবে।
নিম্নে গুলশা/ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতি তুলে ধরা হলো-
(১) ট্যাংরা মাছের বৈশিষ্ট্য
- এ মাছে প্রচুর পরিমানে আমিষ ও অণুপুষ্টি বিদ্যমান থাকে।
- গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
- ছোট কিংবা বড় জলাশয়ে সহজ ব্যবস্থাপনায় চাষ করা যায়।
- কার্পজাতীয় মাছের সাথেও একত্রে চাষ করা যায়।
- গুলশা মাছ খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতারা বড় মাছের তুলনায় এ মাছগুলো বেশী পছন্দ করে।
- বাজারে প্রচুর চাহিদা ও সরবরাহ কম থাকায় এর মূল্য অন্যান্য মাছের তুলনায় অপেক্ষা-কৃত বেশী।
(২) ট্যাংরা মাছ চাষের গুরুত্ব
অর্থনৈতিক, সুস্বাদু ও পুষ্টিমান বিবেচনায় ট্যাংরা মাছের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। নিম্নে এই মাছের চাষের গুরুত্ব দেয়া হলো-
- হ্যাচারী ও পুকুর মালিকদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
- মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় আমিষ ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বিদ্যমান থাকে।
- ছোট এবং মৌসুমী জলাশয়ে সহজ ব্যবস্থাপনায় চাষ করা যায়।
- খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতারা বড় মাছের তুলনায় এই মাছগুলো বেশী পছন্দ করে।
- বাজারে প্রচুর চাহিদা ও সরবরাহ কম থাকায় এর মূল্য অন্যান্য মাছের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী।
(৩) ট্যাংরা পোনা উৎপাদনের জন্য ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা
কৃত্রিম প্রজননের জন্য প্রাকৃতিক জলাশয় (নদী, হাওড়, বিল) হতে গুলশা মাছ সংগ্রহ করা যেতে পারে। এ মাছের প্রজনন কাল যে হতে আগস্ট মাস পর্যন্ত। প্রজনন মৌসুমের পূর্বে গুলশা মাছ সংগ্রহ করে পরিচর্যার মাধ্যমে ব্রুড মাছ তৈরী করা হয়।
নিম্নে ব্রুড সংগ্রহ ও পরিচর্যা বিষয়ে বর্ণনা করা হলো-
- প্রজনন পুকুরের আয়তন ২৫-৩০ শতাংশ এবং গভীরতা ৪-৫ ফুট হতে হবে।
- চুন ও সার প্রয়োগে পুকুর প্রস্তুতির পর গুলশা মাছ এককভাবে মজুদ করতে হবে।
- প্রজনন মৌসুমের ৩-৪ মাস পূর্বে অর্থাৎ জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মাসে ৪০-৫০ গ্রাম ওজনের গুলশা মাছ সংগ্রহ করে শতাংশে ৬০-৭০টি পুকুরে মজুদ করতে হবে।
- সম্পূরক খাবার হিসেবে সুষম খাদ্য তৈরীর লক্ষ্যে চালের কুঁড়া (৪০%), সরিষার খৈল (২০%), ফিশমিল (২৫%), মিট ও বোন মিল (১০%), আটা (৪%), ভিটামিন ও খনিজ লবণ (১%) এর মিশ্রণ প্রতিদিন মাছের দেহ ওজনের ৭-৮% ব্যবহারে ভাল ব্রুড তৈরী হয়।
- প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্য শতাংশে ৪ কেজি গোবর এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি পুকুরে ব্যবহার করতে হবে।
(৪) ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদনে কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি
গুলশা মাছের কৃত্রিম প্রজনন নিম্নবর্ণিত পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে-
- কৃত্রিম প্রজননের ৫-৬ ঘন্টা পূর্বে ব্রুড পুকুর থেকে প্রজনন ক্ষম গুলশা মাছ ধরে হ্যাচারীতে রাখতে হবে।
- ৩ স্ত্রী ও পুরুষ উভয় মাছকে একটি করে পিটুইটারী দ্রবণের ইনজেকশন পৃষ্ঠ পাখনার নীচে দেয়া হয়।
- পিটুইটারী দ্রবণের মাত্রাঃ পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে যথাক্রমে ৪-৫ ও ৮-১২ মিলিগ্রাম পিজি/কেজি শারিরীক ওজনে প্রয়োগ করা হয়।
- ইনজেকশন দেয়ার পর ১ঃ১ অনুপাতে পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে হাপাতে রেখে কৃত্রিম ঝর্ণার মাধ্যমে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
- হাপায় পুরুষ ও স্ত্রী মাছ ছাড়ার ৭-৮ ঘন্টা পরেই মাছ প্রাকৃতিক ভাবে ডিম দিয়ে থাকে।
- এই নিষিক্ত ডিম থেকে ২০-২২ ঘন্টা পর রেণু পোনা ফুটে বের হবে।
- অতপর রেণু পোনা হাপাতেই ২-৩ দিন রাখতে হয়। ডিম্বথলি নিঃশোষিত হওয়ার পর ১.০ লক্ষ রেণু পোনার জন্য প্রতিবার ১টি সেদ্ধ ডিমের অর্ধেক কুসুম খাবার হিসাবে প্রতিদিন ৪ বার সরবরাহ করতে হবে।
(৫) ট্যাংরা মাছের ব্রুড প্রতিপালন, কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন
ট্যাংরা মাছের ব্রুড প্রতিপালন, কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশলের জন্য নিম্নের পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করতে হয়।
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি:
- ব্রুড প্রতিপালন পুকুরের আয়তন ৮-১০ শতাংশ ও গড় গভীরতা ১.০ মিটার রাখা হয়।
- ব্রুড মাছ ছাড়ার আগে পুকুর শুকিয়ে প্রথমে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগের ৫ দিন পর শতাংশে ইউরিয়া ১০০ গ্রাম, টিএসপি ৭৫ গ্রাম ও গোবর ৪ কেজি ব্যবহার করা হয়।
- ব্রুড প্রতিপালন পুকুরের চারপাশে জালের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা দিতে হবে।
ট্যাংরা মাছের ব্রুড মজুদ:
- বছরের এপ্রিল থেকে আগষ্ট মাস পর্যন্ত ট্যাংরা মাছের প্রজননকাল হিসেবে স্বীকৃত।
- প্রজনন মৌসুমের পূর্বেই অর্থাৎ জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী মাসে প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত ৮-১০ গ্রাম ওজনের ট্যাংরা মাছ সংগ্রহ করার পর প্রস্তুতকৃত পুকুরে প্রতি শতাংশে ৮০-১০০টি ট্যাংরা মজুদ করে কৃত্রিম প্রজননের জন্য ব্রুড তৈরী করা হয়।
খাদ্য প্রয়োগ ও পরিচর্যা:
- ব্রুড মাছের পরিপক্বতার জন্য প্রতিদিন দুই বার করে খাবার হিসেবে চালের কুঁড়া ২৫%, ফিসমিল ৩০%, সরিষার খৈল ২০%, মিট এন্ড বোন মিল ২৫% হারে মিশিয়ে প্রয়োগ করা হয়।
- মাছের দৈহিক ওজনের ৮-৫% হারে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
- মজুদের ২ মাস পর থেকে প্রতি ১৫ দিন পর পর জাল টেনে ব্রুড মাছের দেহের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষন করা হয়।
- নিয়মিত পানির গুণাগুণ যেমন তাপমাত্রা, পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া ও মোট ক্ষারত্বের পরিমাণ পর্যবেক্ষন করতে হবে।
কৃত্রিম প্রজনন কৌশল:
- প্রজনন মৌসুমের পূর্বে পরিপক্ব পুরুষ ও স্ত্রী ব্রুডের প্রতিপালন পুকুর থেকে সিস্টার্নে স্থানান্তর করা হয়।
- পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে যথাক্রমে ২ঃ১ অনুপাতে মসৃন জর্জেট হাপায় স্থানান্তর করা হয়।
- সিস্টার্নে অক্সিজেন নিশ্চিত করতে কৃত্রিম ঝর্ণা ব্যবহার করা হয়। ট্যাংরার স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে পিটুইটারী গ্ল্যান্ড (পিজি) অথবা ওভাটাইডের দ্রবণ বক্ষ পাখনার নিচে ইনজেকশন হিসেবে প্রয়োগ করা হয়।
পিজি অথবা ওভাটাইড হরমোন প্রয়োগের মাত্রা:
ট্যাংরা মাছের কৃত্রিম প্রজননে একক মাত্রার পিজি অথবা ওভাটাইড হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগের মাত্রা নিম্নরূপ-
হরমোনের ধরন | প্রয়োগ মাত্রা | প্রয়োগ মাত্রা |
– | পুরুষ ট্যাংরা মাছ | স্ত্রী ট্যাংরা মাছ |
পিজি (মি.গ্রা/কেজি) | ২০ | ৪০ |
ওভাটাইড (মি.গ্রা/কেজি) | ১.৫ | ১.৫ |
- হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করার ৮-৯ ঘন্টা পর স্ত্রী ট্যাংরা ডিম ছাড়ে।
- ডিম আঠালো অবস্থায় হাপার চারপাশে লেগে যায়। ডিম দেয়ার পর হাপা থেকে ক্রডগুলো সরিয়ে নিতে হয়।
- ডিম ছাড়ার ২০ থেকে ২২ ঘন্টা পর ডিম ফুটে রেণু বের হয়।
- রেনুর ডিম্বথলি নিঃশোষিত হওয়ার পর রেণুকে খাবার দিতে হবে।
- রেণু পোনাকে সিদ্ধ ডিমের কুসুমের দ্রবণ দিনে ৬ ঘন্টা পর পর ৪ বার দেয়া হয়।
- হাপাতে রেণু পোনাকে এভাবে সপ্তাহব্যাপী রাখার পর নার্সারী পুকুরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
(৬) ট্যাংরা মাছের পোনার নার্সারী ব্যবস্থাপনা
ট্যাংরা মাছের নার্সারী নিম্নোক্ত পদ্ধতি অনুসরণে করা হয়-
নার্সারী পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি:
- পোনা প্রতিপালন পুকুরের আয়তন ৪-৮ শতাংশ, গড় গভীরতা ১.০ মিটার রাখা হয়।
- পুকুর প্রস্তুতির জন্য পুকুর শুকিয়ে প্রতি শতকে ১ কেজি চুন দেওয়া হয়।
- এরপর শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৭৫ গ্রাম টিএসপি ও ৬-৮ কেজি গোবর সার ব্যবহার করা হয়।
- পুকুরের চারপাশে নাইলন নেট দিয়ে ঘিরে দিতে হবে।
পোনা সংগ্রহ ও নার্সারী পুকুরে মজুদ:
- হ্যাচারীতে উৎপাদিত ৭ দিন বয়সের রেণু পোনা প্রতি শতাংশে ৮,০০০-১২,০০০টি হারে মজুদ করা যায়।
- নাসারী পুকুরে মজুদের সময় পোনাকে পুকুরের পানির তাপমাত্রার সঙ্গে ভালভাবে খাপ খাওয়ানোর পর ছাড়তে হবে।
নার্সারী পুকুরে খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা:
হ্যাচারীতে উৎপাদিত ৭ দিন বয়সের রেণু পোনা নার্সারী পুকুরে মজুদের পর প্রতি ১০,০০০টি পোনার জন্য খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা নিম্নরূপ-
পোনার বয়স (দিন) | খাদ্যের প্রকার | প্রয়োগের হার | প্রয়োগ মাত্রা/দিন |
১-৩ | সেদ্ধ ডিমের কুসুম | ২ টি | ৩ বার |
৪-৭ | ময়দার দ্রবণ | ৫০ গ্রাম | ৩ বার |
৮-১৫ | নার্সারী খাদ্য (৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ) | ১০০ গ্রাম | ৩ বার |
১৬-২৩ | নার্সারী খাদ্য (৩২-৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ) | ১৫০ গ্রাম | ৩ বার |
২৪-৩০ | নার্সারী খাদ্য (৩২-৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ) | ৩০০ গ্রাম | ৩ বার |
৩১-৪৫ | নার্সারী খাদ্য (৩২-৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ) | ৪৫০ গ্রাম | ৩ বার |
৪৬-৬০ | নার্সারী খাদ্য (৩০-৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ) | ৬০০ গ্রাম | ৩ বার |
রেনু পোনা ছাড়ার ৫৫-৬০ দিন পর আঙ্গুলে পোনায় পরিণত হয়, যা চাষের পুকুরে মজুদের জন্য উপযোগী এবং বাঁচার হার শতকরা ৫৫-৬০%।
ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা:
- পোণা মজুদের ১৫ দিন পর থেকে প্রতি ১৫ দিন পর পর জাল টেনে মাছের দেহের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
- নিয়মিত পানির গুণাগুণ যেমন তাপমাত্রা, পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া ও মোট ক্ষারত্বের পরিমান নির্ণয় করতে হবে।
নার্সারী পুকুরে ট্যাংরা মাছের পোনা পালন:
- নার্সারী পুকুরের আয়তন ১০-২০ শতাংশ এবং গভীরতা ০.৮০-১.০ মিটার হলে ভাল হয়।
- পুকুর প্রস্তুতির সময়ে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মানোর জন্য শতাংশে ২০ কেজি হারে গোবর সার দিতে হবে।
- নার্সারী পুকুরে ৪-৫ দিন বয়সের রেণু পোনা শতাংশে ৮,০০০-১০,০০০ টি মজুদ করা যায়।
- এ সময় নার্সারী পুকুরকে ১.০ মিটার উঁচু জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে। ফলে ক্ষতিকর রাক্ষুসে ব্যাঙ বা সাপ পুকুরে প্রবেশ করে পোনার ক্ষতিসাধন করতে পারে না।
- প্রথম ৩ দিন: প্রতি শতাংশে ২টি করে ডিমের কুসুম পানিতে মিশ্রণ করে সকাল, দুপুর ও বিকেলে ছিটিয়ে দিতে হবে।
- ৪-৭ দিন: সকালে ও বিকেলে ৫০ গ্রাম হারে আটার দ্রবণ প্রতি শতাংশে সরবরাহ করতে হবে।
- ৮-১৫ দিন: সকাল, দুপুর ও বিকেলে ১০০ গ্রাম হারে প্রতি শতাংশে ৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য দিতে হবে।
- ১৬-৩০ দিন: সকাল, দুপুর ও বিকেলে ১২৫ গ্রাম হারে প্রতি শতাংশে ৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য দিতে হবে।
- রেণু পোনা ছাড়ার ৩০ দিন পর: চারা পোনায় পরিণত হয়, যা চাষের পুকুরে মজুদের জন্য উপযোগী।
(৭) ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদনে সমস্যা ও পরামর্শ
ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনায় সমস্যা:
- উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা না করলে ব্রুড মাছের প্রজনন পরিপক্কতা সঠিকভাবে হয় না।
- হ্যাচারীতে রেণু পোনা যথাপোযুক্ত পরিচর্যা না করলে পোনার মৃত্যুর হার বেশী হয়ে থাকে।
- হ্যাচারিতে রেণু পোনা বা পুকুরে মাছ রোগাক্রান্ত হতে পারে।
- পানির ভৌত রাসায়নিক গুনাগুণ মাছ চাষের উপযোগী না থাকলে মাছের বৃদ্ধি আশানুরূপ হয় না।
ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনায় পরামর্শ:
- প্রজনন মৌসুমে ব্রুড গুলশা মাছের নিবিড় পরিচর্যা করতে হবে।
- ব্রুড গুলশা মাছকে আমিষ সমৃদ্ধ (৩৫-৪০%) সম্পুরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
- নিয়মিত পানির গুনাগুণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
- ১৫ দিন অন্তর জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য ও প্রজনন পরিপক্কতা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।
- পোনা উৎপাদনে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করা আবশ্যক।
(৮) ট্যাংরা মাছের পোনা আহরণ
উল্লেখিত পদ্ধতি অনুসরন করে নার্সারী পুকুরে পোনা মজুদের ৫৫-৬০ দিন পর পুকুর সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে ৫-৬ সে.মি. আকারের ট্যাংরা মাছের পোনা পাওয়া যায়।
(৯) ট্যাংরা মাছ চাষ পদ্ধতি
ট্যাংরা মাছ একক বা রুই জাতীয় মাছের সাথে মিশ্রচাষ করা যায়।
এই আর্রিকেলটিতে→ টেংরা মাছের চাষ পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা গুলশা/ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় যেমন- ট্যাংরা মাছের বৈশিষ্ট্য; ট্যাংরা মাছ চাষের গুরুত্ব; ট্যাংরা পোনা উৎপাদনের জন্য ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা; ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদনে কৃত্রিম প্রজনন পদ্ধতি; ট্যাংরা মাছের ব্রুড প্রতিপালন; কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন; ট্যাংরা মাছের পোনার নার্সারী ব্যবস্থাপনা; ট্যাংরা মাছের পোনা উৎপাদনে সমস্যা ও পরামর্শ; ট্যাংরা মাছের পোনা আহরণ; ট্যাংরা মাছ চাষ পদ্ধতি; প্রভৃতি বিষয় সমূহ জানতে পারলাম।
মিঠা পানির জলাশয়ে বিশেষ করে পুকুর, নদী-নালা, খাল-বিল ইত্যাদিতে যে মাছগুলো পাওয়া যায় তাদের মধ্যে ট্যাংরা অন্যতম। মাছটি খুবই সুস্বাদু, মানব দেহের জন্য উপকারী অণুপুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এবং কাটা কম বিধায় সকলের নিকট প্রিয়।
বর্তমান সময়ে অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে ট্যাংরা মাছটি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া সম্ভব হয়না। কারণ শস্য ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা, বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বাসস্থান ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ায় এ মাছের প্রাচুর্যতা ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। এমতাবস্থায় প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ট্যাংরার কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারী ব্যবস্থাপনা ও চাষের কলাকৌশল উদ্ভাবন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন মৎস্য ইনস্টিটিউট কর্তৃক গবেষণালব্ধ কৌশলসমূহ অনুসরণ করলে ব্যাক্তি মালিকানাধীন ও সরকারি মৎস্য হ্যাচারীসমূহে ট্যাংরা মাছের পোনা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ট্যাংরা মাছের কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণ করা গেলে চাষের মাধ্যমে এতদাঞ্চল তথা দেশে প্রজাতিটির উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে এবং বিপদাপন্ন অবস্থা থেকে এ প্রজাতির উত্তরণ ঘটবে বলে আশা করা যায়।
[সূত্র: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর (FLID); ইন বাংলা নেট কৃষি (inbangla.net/krisi)]