ফুল বা সুদৃশ্য গাছপালা উৎপাদনের জ্ঞান ফ্লোরিকালচার বা পুস্পোদ্যান বিদ্যা নামে পরিচিত। ফুল মানসিক আনন্দ দানের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কতগুলো ফুলের সৌন্দর্য মানুষ আকৃষ্ট করে। আবার কতগুলো ফুলের গন্ধ খুবই মনোমুগ্ধকর। ফুল গৃহ, স্কুল কলেজ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শোভা বর্ধনের জন্য খুবই প্রয়োজন। ফুল শুধু মানুষের মনতুষ্টির জন্যও নয় এর অর্থনৈতিক অবদান অপরিসীম।
বর্তমানে বাংলাদেশে ফুল ও সুদৃশ্য গাছ বাণিজ্যিক উৎপাদন বিশেষ ভাবে গোলাপ চোখে পড়ছে। এছাড়াও বিভিন্ন সুগন্ধি প্রস্তুতি ফুলের নির্যাস ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
গোলাপ ফুলকে ফুলের রাণী বলা হয়ে থাকে। এর কোমলতা, বর্ণ, সুগন্ধ এমন কেউ নেই যাকে আকৃষ্ট করে না। সাজ সজ্জায় কাটা ফুল হিসেবে কদর রয়েছে। এছাড়া সুগন্ধি প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়।
এই পাঠ শেষে আপনি- গোলাপ ফুলের জাতের নাম বলতে পারবেন। গোলাপের চাষ পদ্ধতি বর্ণনা করতে পারবেন। গোলাপের পোকামাকড় ও রোগ জীবাণু নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকার করতে পারবেন। গোলাপের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
(১) গোলাপের দুটি জাতের নাম
যতদূর জানা যায় ভারতীয় উপমহাদেশে সুন্দর গোলাপ এসেছে প্রায় পাঁচশ বছর আগে বসরা থেকে। মোগল সম্রাট বাবর প্রথম ‘বসরা’ নামের এক গোলাপ নিয়ে এসেছিলেন। সুগন্ধি গোলাপি রঙের এ গোলাপ এখনও বাংলাদেশে ‘বসরা’ নামে পরিচিত। কোনো কোনো পুরানো বাগানে এখনও এটির চাষ হয়। দুর্বল প্রকৃতির লম্বাটে গাছগুলিতে ডালের মাথায় থোকায় থোকায় ফুল ফোটে।
পৃথিবী জুড়ে গোলাপের অসংখ্য জাত রয়েছে। জাতগুলোর কোনোটির গাছ বড়, কোনোটি ঝোপালো, কোনোটি লতানো। জাত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী গোলাপ সাদা, লাল, হলুদ, কমলা, গোলাপী বিভিন্ন রঙের হয়ে থাকে।
গোলাপের দুটি জাতের নাম হলো, যেমন-
- রানী এলিজাবেথ = গোলাপী
- ব্ল্যাক প্রিন্স = কালো
- ইরানি = গোলাপী
- মিরিন্ডা = লাল
বাংলাদেশে চাষ হয় এমন কতকগুলো গোলাপ ফুলের জাত হলো- মিরান্ডা, পাপা মেলান্ড, ডাবল ডিলাইট, তাজমহল, প্যারাডাইস, ব্লু-মুন, মন্টেজুমা, টাটা সেন্টার, সিটি অব বেলফাষ্ট ইত্যাদি।
যাহোক গোলাপ ফুলকে অনেক শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। তবে উল্লেখযোগ্য শ্রেণিগুলো হলো-
১। হাইব্রিড (Hybrideas): ফুলগুলো বেশ বড়, সুগঠিত ও অনেক পাপড়ি বিশিষ্ট। কাটা ফুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: ক্রিমশন গোরি, পাপা মিল্যান্ড, টিপটিপ ইত্যাদি এ শ্রেণির জাত।
২। পলিয়েন্থা (Polyanha): ফুলগুলো আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট এবং বড় বড় থোকায় ধরে। যেমন: জর্জ এলগার, ক্যামিও, আইডিয়াল ইত্যাদি।
৩। ফ্লোরিবান্দা (Floribunda): ফুলগুলো আকারে ছোট এবং থোকায় ধরে। কাটা ফুলের জন্য চাষ করা হয়। যেমন: হানিমুন, সানসিল্ক ইত্যাদি।
৪। মিনিয়েচার (Miniaure): গাছ ছোট, পাতা ছোট এবং ফুল ছোট হয়। যেমন: রাজিনা, গোল্ডেন, ইয়ালো ডল ইত্যাদি।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে যে সব জাতের গোলাপ উদ্ভব হয়েছে তার মধ্যে ‘ফাতেমা ছাত্তার’, ‘শিবলী’, ‘রাহেলা হামিদ’, ‘পিয়ারী’, ‘ভাসানী’, ‘শের-এ-বাংলা’, ‘১৯৫২’, ‘জয়ন্তি’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তবে উপযুক্ত বাগান এবং উদ্যোগের অভাবে এগুলি কতদিন টিকে থাকবে তা বলা যায় না।
(২) গোলাপ ফুল কখন ফোটে?
গোলাপ ফুল কখন ফোটে: গোলাপ সার বছরই ফোটে। গোলাপ মূলত শীতকালীন ফুল। তবে বর্তমানে এর চাহিদা ও সৌন্দর্য্যের কারণে সারা বছরই গোলাপ চাষ করা হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি সারাবছর গোলাপের চাষ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন জেলাতে গোলাপের চাষ করা হচ্ছে। গোলাপের চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় গোলাপ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
সিজনে গোলাপ ফুলের সাইজ বড় হয়। অফ সিজনে গোলাপ ফুলের সাইজটা ছোট হয়। বর্ষাকালে শেষে গোলাপ ফুলের মাটি চেঞ্জ করতে হয়।
(৩) গোলাপ ফুল চাষ পদ্ধতি
ক) মাটি, জলবায়ু ও জমি নির্বাচন
- বাংলাদেশে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত গোলাপের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
- গোলাপ চাষের জন্য ৬.০-৬.৫ pH মানযুক্ত সুনিষ্কাশিত এবং উর্বর দোঁ-আশ মাটি উত্তম।
- গোলাপের জন্য রৌদ্যজ্জল, সুনিষ্কশিত ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দোআঁশ মাটি গোলাপ চাষের জন্য উত্তম।
- পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে এ ধরনের স্থান পরিত্যাগ করা উচিত।
- গোলাপ শীত ও নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের ফুল। অধিক উষ্ণ ও আর্দ্রতায় গোলাপ ভাল হয়না। ২২-৩০ ডিগ্রী সে. তাপমাত্রা, ৮৫% আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং ১০০-১২৫ সেমি গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত গোলাপ চাষের জন্য উপযোগী।
- ফুলের গুনগতমান সূর্যালোকের উপস্থিতির উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। এক্ষেত্রে বিকাল অপেক্ষা সকালের রোদ বেশি কার্যকর।
খ) জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
- প্রচুর রোদ ও খোলা বাতাসপূর্ণ উঁচু সমতল স্থানে গোলাপ চাষের জন্য নির্বাচন করা উচিত। জমিকে গভীরভাবে কুপিয়ে বা লাংগল দিয়ে এর মাটি ওলট-পালট করে দিতে হয়।
- জমি থেকে আগাছা, ইটের টুকরা ইত্যাদি বেছে ফেলে বার বার চাষ দিয়ে মাটিকে বেশ ঝুরঝুরা, নরম ও সমতল করে নিতে হয়।
- উন্নতমানের বড় বাগান করতে হলে বর্ষার ঠিক আগে মে-জুন মাসে বেড তৈরি করতে হয় যাতে বেডের খৈল ও অন্যান্য উপাদান ভালভাবে পচে অক্টোবর গাছ লাগানোর উপযোগী হয়। বেডের আশে পাশে যাতে পানি না জমে সে জন্য জল নিকাশের ব্যবস্থা রাখতে হয়।
- ছোট বাগানের জন্য গাছ রোপণের অন্তত ৩ সপ্তাহ আগে বেড তৈরি করলেই চলে। আবহাওয়া শুকনো থাকলে বেড তৈরীর পর পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিলে খৈল ও জৈব সার পচে যাবে এবং বেড গাছ লাগানোর উপযোগী হবে।
- সাধারণত রোপণের পূর্বে ২-৩ সপ্তাহ পূর্বে জমি ভালভাবে চাষ করতে হবে এবং এরপর মই দিয়ে সমান করে ৬ মিটার x ১.২ বা ১.৫ মিটার আকারের বেড তৈরি করতে হবে।
- বেড তৈরির পর চারা রোপণের জন্য বিভিন্ন জাতের জন্য বিভিন্ন দূরত্বে গর্ত করতে হয়, যেমন- ডোয়ার্ফ পলিয়েন্থা ০.৫ মিটার, ফ্লোরিবান্ডা ও চায়না ০.৬৫ মিটার, হাইব্রিড টি ১ মিটার, হাইব্রিড পারপেচুয়েল, মন ও দামাস্ক ও টি ১.৫০ মিটার, নয়সেট-২.০ মিটার ও লতা গোলাপ ২.৫০ মিটার। বিভিন্ন জাতের গাছ সারিতে লাগাতে হয়, এতে সার প্রয়োগ, পানি সেচ ও অন্যান্য পরিচর্যার কাজের সুবিধা হয়।
- বেডটি ৫০-৬০ সে.মি. গভীর করে খুড়ে উপরের ২০ সে.মি.গভীরতার মাটি ও মধ্য স্তরের ২০ সে.মি.গভীরতার মাটি গর্তের দুপাশে রাখতে হবে।
- শেষের ২০ সে.মি. গভীরতার মাটি না তুলে ভালো করে কুপিয়ে প্রতি বর্গমিটারে ২০ কেজি গোবর সার, ৫০ গ্রাম টি.এস.পি এবং ৫০ গ্রাম মিউরিয়েট অব পটাশ সার মেশাতে হয়।
- এর উপরে স্তরের মাটির সাথে প্রতি বর্গমিটার ২০ কেজি গোবর সার, ১০০ গ্রাম টি.এস.পি, ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০০০ গ্রাম এম.পি. সার মিশিয়ে গর্তে দিতে হবে।
- মধ্য স্তরের মাটির সাথে বর্গমিটারে ২০ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম সরিষার খৈল, ১০০ গ্রাম হাড়ের গুড়া, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম এম.পি সার মিশিয়ে উপরের স্তর ভরাট করতে হবে।
- বেডগুলো সমতল থেকে যেন ২০ সে.মি. উপরে হওয়া উচিত। মাদায় করলে ৬০ সে.মি. x ৬০ সে.মি. গর্ত তৈরি করে তাতে ১০ কেজি গোবর সার, ১০০ গ্রাম হাঁড়ের গুড়া, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম এম.পি সার মিশিয়ে উপরের ২০ সি.মি. স্তর ভরাট করে দিতে হবে।
- যদি বেড তৈরি দু’একদিনের মধ্যে গাছ লাগানো প্রয়োজন হয়, তাহলে কম্পোস্ট বা পচা গোবর সার বেশি করে দিয়ে গাছ লাগানো উচিত। গাছ লেগে যাবার পর খৈল ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হবে। গোবর সার বেশি ব্যবহার করলে ইউরিয়া সার না দিলেও চলবে। এ ক্ষেত্রে খৈল ৪/৫ দিন ভিজিয়ে জলের সাথে মিশিয়ে গোড়ার চারপাশে দিয়ে ৩/৪ দিন হালকা করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
গ) গোলাপের বংশ বিস্তার
বীজ, শাখা কলম, দাবা কলম এবং চোখ কলম এর মাধ্যমে গোলাপের বংশ বিস্তার করা হয়। তবে সংকর জাত উদ্ভাবনের জন্য বীজ মাধ্যমে বেছে নেয়া হয়।
সাধারণতঃ উন্নত জাতের গোলাপ এর নতুন গাছ উৎপন্নের প্রধান পদ্ধতি মাধ্যম হিসেবে বাডিং বা চোখ কলম বংশ বিস্তার করানো হয়। বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময় এ চোখ কলম করা হয়।
যে জাতটির বংশবৃদ্ধি করা হয় তার চোখ অপর একটি সুবিধামত আদিজোড় বা (rootstock) এর উপর স্থাপন করা হয়। আদিজোড় গাছের সজীবতা, উৎপাদনশীলতা, ফুলের গুনাবলী, ঝোপের স্থায়ীত্ব, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মাটি ও আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
আদিজোড়ের কাটিং সমূহ (পেন্সিল আকৃতি) গ্রীষ্মের শেষে তৈরী করা হয়ে থাকে এবং নার্সারীতে সারি করে ২৫ -৩০ সেঃ মিঃ দুরত্বে রোপন করা হয়। প্রায় ৬ মাস পর এইসব কাটিংসমূহ বাডিং এর জন্য উপযুক্ত আকৃতির কান্ড তৈরী করে থাকে। গোলাপে প্রধানতঃ T-কাডিং করা হয়।
জংলি গোলাপের কান্ডে বিভিন্ন উচ্চতায় ‘চোখ কলম’ জুড়ে দিয়ে সুন্দর সুন্দর গোলাপের ঝাড় বানানো যায় যেগুলিকে ‘স্ট্যান্ডার্ড রোজ’ বলে। বাগান সাজাতে পিছনে উঁচু, তারপর ক্রমান্বয়ে নিচু মাপের গাছ লাগালে দেখতে মানানসই হয়।
অনুকূল পরিবেশে পিঁপড়া, প্রজাপতি, মৌমাছি ইত্যাদির সাহায্যে পরাগায়িত হলে পরিণতিতে গোলাপ গাছে ফল ও বীজ উৎপন্ন হয়। এসব বীজ থেকে উৎপন্ন চারাগুলিতে প্রকারভেদ দেখা দেয়। এভাবেই গোলাপের নতুন জাত সৃষ্টি হয়। কখনও কখনও এক রঙের গোলাপ ফুলের গাছে হঠাৎ মিউটেশনের ফলে অন্য একটি ডালে ভিন্ন প্রকার ফুল ফোটে। আবার মিউটেশনের ফলে ঝাড় গোলাপের গাছ থেকে লতা গোলাপের গাছও জন্মায়। কোনোও কোনোও গোলাপ গাছের একটু পরিণত বয়সের ডালের কিছুটা অংশ কেটে মাটিতে লাগিয়ে দিলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শিকড় গজিয়ে নতুন পাতা ছাড়ে। এ পদ্ধতিতে চারা তৈরী করাকে কাটিং বা কলম বলে।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গোলাপের চারা উৎপাদনের জন্য জংলি বা বুনো গোলাপের গাছে ‘চোখ কলম’ বসিয়ে বহু চারা বানানো যায়। এক্ষেত্রে গাছের নিচের অংশে থাকে বুনো গোলাপ, উপরের অংশটি নির্বাচিত গাছের ‘চোখ’ থেকে উৎপন্ন মূল গোলাপ। এভাবে বাংলাদেশেও এখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নামিদামি গোলাপ পাওয়া যায়। যেমন- Papa Meilland, Double Delight, Dutch Gold, Queen Elizabeth, Monte Zuma ইত্যাদি। ইদানিং টিস্যু-কালচার বা মাইক্রোপ্রোপাগেশন পদ্ধতিতেও গোলাপের চারা উৎপাদনের চেষ্টা চলছে, তবে তা এখনও ততটা প্রসার লাভ করে নি।
বিদেশি গোলাপের মধ্যে তাজমহল (Tajmahal), পাপা মিলল্যান্ড (Papa Meilland) প্রভৃতি গোলাপের ডাল থেকে কাটিং করা যায়, তবে ডালের নিচে কাটা মাথায় উপযুক্ত হরমোন দিলে শিকড় গজাবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
ঘ) চারা রোপণ পদ্ধতি
- অক্টোবর থেকে র্ফেরুয়ারী মাস পর্যন্ত চারা লাগানোর উত্তম সময়, চারা লাগানোর পূর্বে শুকনো ডাল কেটে ফেলে বেডে বা টবে লাগাতে হবে।
- চারা এমনভাবে লাগাতে হবে যেন কলমের জোড়ার স্থানটি ঠিক মাটির উপর যায়।
- গোলাপের চারা লাগানোর হাইব্রিডটি এর জন্য ৭৫-১০০ সে.মি. বা খর্বাকৃতি জাত এর জন্য ৪৫-৫০ সে.মি. দূরত্ব বাঞ্ছনীয়।
- সাধারণত গোলাপের চারা পলিথিনের ব্যাগে থাকে বলে চারা রোপণের সময় ব্যাগটি ছিঁড়ে ফেলে দিতে হয়। তারপর গর্তের মধ্যে গাছটি এমনভাবে ঢুকাতে হবে যাতে চারাটির গোড়া আগে যতটুকু মাটির নীচে ছিল, গর্তে লাগানোর পরও যেন ঠিক ততটুকুই মাটির নীচে থাকে।
- চারা গাছ গর্তের মধ্যে বসানোর পর কিছু পচা গোবর ও ভিটির বালি বা দো-আঁশ মাটি ভাল করে মিশিয়ে শিকড়ের চারিপাশে ছিটিয়ে দিতে হয়। তারপর গাছের গোড়ায় মাটি দিয়ে ভাল করে চেপে দিয়ে পানি দিতে হয়।
- চারা লাগানোর পর প্রথম রোদ থেকে গাছকে রক্ষা করার জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করতে হয়।
- গাছ লেগে গেলে মাটি বুঝে পানি দিতে হয়। বেলে মাটির বেলায় ঘন ঘন আর এঁটেল মাটি বা ভারি মাটির বেলায় ২/৩ দিন পর পর পানি দেয়া দরকার। তবে কোনক্রমেই যাতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- গোলাপের শিকড়ে যদি শক্ত মাটি থাকে, তাহলে গাছ লাগানোর আগে পানি দিয়ে ভিজিয়ে মাটি নরম করে নিতে হয় যাতে শিকড় ঠিকমত বাড়তে পারে।
- যেসব চারার গোড়ায় মাটি থাকে না, সেসব চারা মাটিতে লাগানোর আগে ২/৩ ঘন্টা পানি ভিজিয়ে তারপর লাগাতে হয়।
- পুরানো গাছ জায়গা বদল করে লাগাতে হলে প্রথমত কচি ডগা, মরা ডাল ইত্যাদি ধারালো ছুরি বা সিকেচার দিয়ে ভাল করে ছেঁটে নিতে হয়। তারপর শিকড়ের চারপাশে বেশ জায়গা নিয়ে খুঁড়ে গাছটিকে এমন ভাবে উঠাতে হবে যাতে খুব কম সংখ্যক শিকড় কাটে। গাছটিকে একই পদ্ধতিতে গর্তে লাগিয়ে প্রচুর পানি দিতে হবে এবং অন্তত ২/৩ দিন ছায়া দিতে হবে। শুকনো মৌসুমে গরমের দিনে পুরানো গাছের জায়গা বদল না করাই ভাল।
ঙ) আগাছা দমন ও শাখা ছাঁটাই (প্রুনিং)
সব সময় গোলাপ এর বেড আগাছা মুক্ত রাখা হবে। উত্তম ফুল পাওয়ার জন্য সেপ্টেম্বর এর মাঝামাঝি থেকে অক্টোবর মাস এর মধ্যে প্রুনিং করতে হবে। শুকনো বা রোগাক্রান্ত ডালপালা কেটে দেয়া হয়। নতুন শাখা বের হলে ফুল ফোটা শুরু হয়।
চ) পানি সেচ
প্রুনিং এর পর গাছের গোড়ার চারদিক হতে ২০ সে.মি. মাটি সরিয়ে এক পার্শ্বে রেখে দিয়ে রৌদ্র ও বাতাসে উম্মুক্ত রাখতে হবে। এর ৮-১০ দিন পরে গাছ প্রতি ৫ কেজি গোবর সার, ১০০ গ্রাম হাড়ের গুড়া, ৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫ গ্রাম এমপি সার মিশিয়ে দিয়ে গাছের গোড়ায় ভালোভাবে সেচ দিতে হবে।
ছ) রোগ দমন
- গোলাপের শিকড় পঁচা রোগ দেখা যায়। এ রোগ হলে চারা গাছের গোড়ায় কালো দাগ পড়ে, পরিশেষে চারা মারা যায়। বীজতলার মাটি ক্যাপটান দ্বারা শোধন করলে এ রোগ অনেকটা দমন হয়।
- পাউডারি মিলডিউ রোগ গোলাপ গাছে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। এই রোগে আক্রান্ত গাছের পাতার নিচে এবং শাখায় ছাই রং এর পাউডারের প্রলেপ দেখা যায়। সাফলার জাতীয় ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করা হয়।
ছ) পোকামাকড় দমন
- গোলাপের মিলিবাগের আক্রমণ দেখা যায়। এই পোকা আক্রমণ করলে মোমের ন্যায় গুড়া লেগে থাকে। পাতার তলদেশে চুনের মত পদার্থ দেখা যায়। এরা পাতার রস শোষণ করে। ম্যালথিয়ন স্প্রে করলে মিলিবাগ ধ্বংস হয়।
- জাব পোকা গোলাপের পাতা, ফুল এর রস শোষণ করে খায়। এ পোকা দমনের জন্য ম্যালথিয়ন স্প্রে করতে হবে।
জ) ফুলসংগ্রহ
- ফুল আধা ফোটা অবস্থায় সংগ্রহ করতে হবে। তবে দুর-দুরান্তে বা কয়েকদিন পর ব্যবহারের জন্য হলে গোলাপের ফুলের কুঁড়ি যখন সম্পূর্ণ রং ধারণ করে কিন্তু ফোটেনি এমন সময় ফুল সংগ্রহ করা উচিত।
- কাট ফ্লাওয়ার বা কাটা ফুল হিসেবে ফুল লম্বা শাখা পাতাসহ ধারালো ছুরি দিয়ে কাটতে হয়।
- ফুল চয়নের কাজটি হয় খুব সকালে বা শেষ বিকেলে করা উচিত।
- ফুল সংগ্রহের পর শাখা পানিতে ডুবিয়ে নিম্নতাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়।
- ফুলদানীর পানিতে ৩% চিনি ও ৬০০ পিপি এম 8-hydroxyquinoline (HQC) এর দ্ররণে ফুল রেখে গোলাপকে তাজা রাখা বা আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করা সম্ভব।
ঝ) ফলন
- গোলাপের ফলন প্রধানতঃ আবহাওয়া ও জাতের উপর নির্ভরশীল। আদর্শ উৎপাদন পরিবেশে লম্বা কান্ডযুক্ত জাত প্রতি বছর গাছ প্রতি প্রায় ১৫ থেকে ৩০ টি ফুল উৎপন্ন করে।
- গ্রীষ্মকালীন সময়ে বিশেষ করে যখন ফুলের মান এবং বাজার দর কমে যায়, তখন কুঁড়ি ছাঁটাই করে গাছের দৈহিক গঠন ও বৃদ্ধি ঠিক রাখতে হয়।
- বাজারের চাহিদার উপর ফুলের প্যাকেজিং নির্ভরশীল। অনেক উৎপাদনকারী নিকটস্থ স্থানীয় বাজারের জন্য প্যাকেজিং ছাড়াই ফুলের আঁটি বা গোছা বাজারে সরবরাহ করে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আঁটিসমূহ খবরের কাগজ দ্বারা আবৃত থাকে।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, গোলাপ ফুলকে ফুলের রাণী বলা হয়ে থাকে। এর কোমলতা, বর্ণ, সুগন্ধ এমন কেউ নেই যাকে আকৃষ্ট করে না। সাজ সজ্জায় কাটা ফুল হিসেবে কদর রয়েছে। এছাড়া সুগন্ধি প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হয়। শাখা কলম, দাবা কলম এবং চোখ কলম এর মাধ্যমে গোলাপের বংশ বিস্তার করা হয়।
সৌন্দর্য ও ঘ্রাণের দিক দিয়ে গোলাপ অতুলনীয়। আমাদের দৈনন্দিন জিবনে গোলাপ ফুল গুরুক্তপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।গোলাপের ফেসপ্যাক ব্যবহারের ফলে ত্বক উজ্জ্বল সুন্দর হয়।তাছাড়া গোলাপের পাপড়ির গুড়া বিভিন্ন ধরণের অসুখ সারাতে সাহায্য করে। গোলাপ ফুলের পাপড়ির গুড়া দিয়ে তৈরি চা আমাদের শরীরের জন্য বেশ উপকারি।
তাই এ আর্টিকেলে আমরা গোলাপের দুটি জাতের নাম, গোলাপ ফুল কখন ফোটে, গোলাপ ফুলের চাষ পদ্ধতিসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি। আর্টিকেলটি পড়ে আপনি যদি উপকৃত হয়ে থাকেন তাহলে আর্টিকেলটি অবশ্যই আপনার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ এর সাথে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।