Skip to content

জমি প্রস্তুতি বা ভূমি কর্ষণ বা জমি চাষ

জমি প্রস্তুতি বা ভূমি কর্ষণ বা জমি চাষ করা

কৃষির যত কাজ আছে তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো জমি প্রস্তুতি।

সব ফসলের জন্য জমি প্রস্তুতি এক রকম নয়।

যেমন বোরো বা রোপা আমন ধানের ক্ষেত্রে আগে চারা উৎপাদন করতে হবে, তারপর মূল জমি প্রস্তুত করে চারা রোপণ করতে হবে।

কিন্তু বোনা আউশ বা বোনা আমনের ক্ষেত্রে চারা উৎপাদন না করে সরাসরি প্রস্তুতকৃত মূল জমিতে বীজ ছিটিয়ে দিতে হয়।

প্রায় একইরূপ গমের ক্ষেত্রেও ভালোভাবে জমি চাষ দিয়ে বীজ ছিটিয়ে বুনতে হবে।

জমি প্রস্তুতির সাথে বহুমুখী কাজ জড়িত। যথা জমি চাষ, মই দেওয়া, সার প্রয়োগ ইত্যাদি। নিচে ফসলভিত্তিক প্রত্যেকটি কাজ আলোচনা করা হলো-

(১) ধান চাষের জন্য জমির প্রস্তুতি

  • ধানের ফলন সব জমিতে ভালো হয় না। মাঝারি নিচু ও নিচু জমিতে ধানের ফলন বেশি ভালো হয়।
  • মাঝারি উঁচু জমিতেও ধান চাষ করা হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে পানি সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়।
  • এঁটেল ও পলি দোআঁশ মাটি ধান চাষের জন্য উপযোগী।
  • ধান বাংলাদেশে সারা বছর চাষ করা হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বীজতলায় চারা উৎপাদন করতে হয়।
  • কোদাল দিয়ে জমির চারদিক ছেঁটে দিতে হবে।
  • ৪-৫ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে জমি ভালোভাবে কাদাময় ও সমান করে নিতে হবে।
  • এরপর বীজতলা থেকে উৎপাদিত ধানের চারা সংগ্রহ করে জমিতে রোপন করতে হয়।
  • ধানের বীজতলা ও চারা প্রস্তুত সম্পর্কে জানতে এই পোষ্টটি পড়ুন: https://inbangla.net/krisi/ধান-চাষের-পদ্ধতি-সমস্যা-ও-সমাধান/

(২) গম চাষের জন্য জমি প্রস্তুতকরণ

  • গম রবি শস্য। বর্ষার মৌসুম শেষ হওয়ার পর মধ্য কার্তিক-মধ্য অগ্রহায়ণ পর্যন্ত গম চাষের উপযুক্ত সময়।
  • মাটির ‘জো’ দেখে জমিতে লাঙল চালনা করা হয়।
  • গমের মাটি ঝুরঝুরা করে প্রস্তুত করা প্রয়োজন। এজন্য ৩ থেকে ৪ বার আড়াআড়ি জমি চাষ দিয়ে বার কয়েক মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করতে হয়।
  • জমিতে যাতে কোনো বড় ঢেলা না থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
  • গমের জন্য দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি উপযুক্ত। এ মাটি সহজেই ঝুরঝুরা হয়।
  • পাওয়ার টিলারের সাথে রটোভেটর সংযোগ করে জমি চাষ দিলে মাটি ভালো চাষ হয় এবং একই সাথে মইও দেওয়া হয়।
  • ঝুরঝুরা মাটি গমের অঙ্কুরোদগমের জন্য খুবই উপযোগী।
See also  বাংলাদেশের কোন ধরণের অঞ্চলে কি ফসল চাষ হয়?

(৩) ডালজাতীয় শস্যের জন্য জমি প্রস্তুতি

  • বাংলাদেশে ডালজাতীয় শস্যের জন্য জমি চাষ করা হয় না। তবে মসুর ডালের জন্য জমিতে দুইএকটি চাষ দেওয়া হয়।
  • বর্ষা শেষ হলে আশ্বিন-কার্তিকে যখন নদীর চর ও নিচু এলাকা হতে পানি সরে যায় তখন নরম পলি মাটিতে বিনা চাষে বীজ বপন করা হয়। চাষ দেওয়া সম্ভব হলে দুই-একটি চাষও দেওয়া হয়।
  • চাষের পর পতিত জমিতে আবার অনেক সময় রোপা ও বোনা আমনের জমিতে ফসল থাকা অবস্থায় ডালের বীজ ছিটিয়ে দেওয়া হয়।

(৪) আলু চাষের জন্য জমি প্রস্তুতি

  • নিচু এলাকায় বর্ষার পানি নেমে গেলে বা উঁচু এলাকায় আশ্বিন মাস হতে আলু চাষের জন্য জমি প্রস্তুতির কাজ শুরু করা হয়।
  • সাধারণত দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে আলুর চাষ করা হয়। এই মাটি চাষ করা মোটামুটি সহজ।
  • আলুর জমি ৫-৬ বার চাষ ও বার কয়েক মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে জমি প্রস্তুত করা হয়।
  • আজকাল পাওয়ার টিলার দ্বারা চাষ করা হয় বলে ৩-৪ বার আড়াআড়ি চাষ দিলেই ঝুরঝুরা হয় এবং সমান করা হয়।
  • জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দেওয়ার পর জমি সমান করে বীজ বপনের জন্য জমির এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত নালা করতে হবে।
  • প্রত্যেকটি নালা প্রায় ১০-১২ সেমি গভীর করতে হবে। একটি নালা থেকে আর একটি নালার দূরত্ব হবে ৬০ সেমি।
  • অতঃপর নালার মধ্যে ১৫ সেমি দূরে দূরে বীজ বুনে দিতে হয়। আলুচাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে।

(৫) জমি প্রস্তুতির গুরুত্ব

ভূমি কর্ষণ জমি প্রস্তুতির প্রথম ধাপ। ভূমি কর্ষণের সংকীর্ণ অর্থ হলো ফসল ফলানোর উদ্দেশ্যে জমির মাটি যন্ত্রের সাহায্যে খুঁড়ে আলগা করা।

কিন্তু ভূমি কর্ষণের সাথে নানা প্রযুক্তি জড়িত।

যেমন, বীজকে অঙ্কুরোদগমের জন্য উপযুক্ত স্থানে ও সঠিক গভীরতায় স্থাপন করা, মাটিতে বায়ু চলাচলের সুবিধা সৃষ্টি করা, উপরের মাটি নিচে এবং নিচের মাটি উপরে নিয়ে আসা, মাটিতে অণুজীবের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।

এসব দিক বিবেচনা করে জমি প্রস্তুতির গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।

আর এই গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য ভূমি কর্ষণকে সংজ্ঞায়িত করা যায় যে,

“শস্যের বীজ মাটিতে সুষ্ঠুভাবে বপন ও পরবর্তী পর্যায়ে চারাগাছ বৃদ্ধির জন্য মাটিকে যে প্রক্রিয়ায় খুঁড়ে বা আঁচড়ে আগাছামুক্ত, নরম, আলগা ও ঝুরঝুরা করা হয় তাকে ভূমি কর্ষণ বলে”।

ভূমি কর্ষণ জমি প্রস্তুতির প্রাথমিক ধাপ।

আদিকাল থেকেই মানুষ ভূমি কর্ষণ তথা জমি প্রস্তুতির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাই তারা কাঠের বা পাথরের তৈরি সুচালো যন্ত্রের সাহায্যে মাটি আলগা ও নরম করে ফসলের বীজ বুনতে বা চারা রোপণ করতেন।

ফসলভেদে ভূমি কর্ষণের তারতম্য হতে পারে কিন্তু এর গুরুত্ব কখনো খাটো করে দেখার বিষয় নয়।

See also  মাটির প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে মাটি শনাক্তকরণ

জমি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে খনার বচনে উল্লেখ আছে যে,

ষোল চাষে মুলা
তার অর্ধেকে তুলা
তার অর্ধেকে ধান
বিনা চাষে পান

(খনার বচন)

অর্থাৎ মুলা চাষের জন্য ষোলটি চাষ দিতে হবে যতক্ষণ না মাটি ঝুরঝুরা বা আলগা হয়। তুলা চাষের জন্য আট চাষ দিতে হবে আর ধানের জন্য চারটি চাষই যথেষ্ট।

মজার ব্যাপার হলো পান উৎপাদনে কোনো চাষই লাগেনা। আর এই ধারণা থেকেই আজকাল বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে বিনা চাষ প্রথা প্রচলন করা হয়েছে। এখন অনেক কৃষকই বিনা চাষে ভুট্টা, ডাল ইত্যাদি ফসল উৎপাদন করেন।

(৬) ভূমি কর্ষণ তথা জমি চাষ বা প্রস্তুতকরণের উদ্দেশ্য

যে প্রক্রিয়ায় মাটিকে ঝুরঝুরা করে বীজের অঙ্কুরোদগমের অবস্থায় আনা ও ফসল জন্মানোর উপযোগী করা হয় তাকে কর্ষণ বলে।

ভূমি কর্ষণের উদ্দেশ্য থেকেই জমি প্রস্তুতকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায়। নিচে ভূমি কর্ষণের উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হলো-

ক) মাটি বীজের অঙ্কুরোদগম অবস্থায় আনয়ন

  • জমিতে বারবার চাষ দেওয়ার ফলে মাটি নরম হয়, দানাগুলো মিহি হয় আর তাতে বীজ গজানো ও ফসল জন্মানোর এক ভৌত অবস্থা সৃষ্টি হয়।
  • জমি কীভাবে কতটুকু প্রস্তুত করা হবে তা নির্ভর করে মাটির প্রকারভেদ, মাটির জৈব পদার্থ ও রস এবং ফসলের প্রকারের উপর।
  • দোআঁশ, বেলে বা বেলে দোআঁশ মাটির মতো হালকা মাটিতে ৩/৪ বার চাষ ও মই দিলে ভূমি কর্ষণ ফসল উৎপাদন উপযোগী হয়। কিন্তু কাদামাটির মতো ভারী মাটিতে ৫/৬ বার চাষের প্রয়োজন পড়ে।
  • মাটিতে রস থাকলে চাষের সময় মাটি সহজেই ঝুরঝুরা হয় আর রস না থাকলে বড় বড় ঢেলা হয়।
  • মাটিতে জৈব পদার্থ বেশি থাকলে মাটির কণা দানাদার হয় ও সংযুক্ত থাকে। আর তাতে বীজের অবস্থান ভালো থাকে এবং সহজেই অঙ্কুরোদগম হয়।

খ) মাটি সার ও জৈব পদার্থের মিশ্রকরণ

জমিতে সার এবং জৈব পদার্থ প্রয়োগ করতে হয়। ভূমি কর্ষণের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মাটির সাথে সার ও জৈব পদার্থের মিশ্রণ ঘটানো।

এ জন্যে জমি দুই একবার চাষ দেওয়া হলে গোবর বা কমপোস্ট জমিতে ছিটাতে হয়। পরবর্তী চাষের সময় এগুলো মাটিতে মিশে যায়।

অনেক সময় ধৈঞ্চার চাষ করেও সবুজ সার হিসাবে ফুল আসার আগে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মেশানো হয়। তাতে মাটির উর্বরতা বাড়ে।

গ) ভূ-অভ্যন্তরস্থ কীট-পতঙ্গ দমন

মাটির অভ্যন্তরে অনেক পোকা আছে যেগুলো ফসলের অনেক ক্ষতি করে। ভূমি কর্ষণের সময় এসব পোকা, পুত্তলি ও ডিম উন্মুক্ত হয় এবং পাখিরা এগুলো খেয়ে নিধন করে। আর সূর্যালোকও সেগুলো ধ্বংস করে।

মাটির নিচের পোকাগুলোর মধ্যে উই, উরচুঙ্গা ও পিপীলিকা প্রধান।

ঘ) মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ

ভূমি কর্ষণ মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়। অকর্ষিত ভূমি থেকে পানি তাড়াতাড়ি বাষ্প হয়ে যায় অথবা পানি গড়িয়ে অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু কর্ষিত জমিতে সার বা সেচের পানি আটকা পড়ে যা পরে মাটি শুষে নেয়।

See also  ভূমিক্ষয় কি, কাকে বলে, বলতে কি বুঝায়, কত প্রকার প্রধান কারণসমূহ ও রোধের উপায়

অর্থাৎ কর্ষিত জমির মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। এরূপ মাটিতে বীজ বুনলে ভালো অঙ্কুরোদগম হয় এবং ফসলের বৃদ্ধি ঘটে।

ঙ) মাটিস্থ জীবাণুসমূহের কার্যকারিতা বৃদ্ধি

মাটিতে অনেক জীবাণু আছে যা মাটিকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে তন্মধ্যে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া প্রধান। এসব জীবাণু মাটিতে থেকে মাটির জৈব পদার্থ পচনে সাহায্য করে।

ভালোভাবে ভূমি কর্ষণ করলে মাটিস্থ এই জীবাণুগুলোর কার্যকারীতা বৃদ্ধি পায়। গাছ সহজে পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে এবং ফলন অনেক ভালো হয়।

চ) মাটির ক্ষয়রোধ

ভূমি কর্ষণের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হলো উঁচু-নিচু জমিকে সমতল করা এবং আঁটসাঁট করা। তাতে বৃষ্টির বা সেচের পানি গড়িয়ে অন্যত্র যেতে পারে না। আর এতে একদিকে ভূমিক্ষয় নিরোধ হয় আর অন্যদিকে পানির সুব্যবহার হয়।

(৬) জমি চাষের বিবেচ্য বিষয়

জমি কীভাবে চাষ করতে হবে তা নির্ভর করে কতকগুলো বিষয়ের উপর। বিষয়গুলো হচ্ছে

  1.  ফসলের প্রকার
  2.  মাটির প্রকার
  3.  আবহাওয়া
  4.  খামারের প্রকার

ক) ফসলের প্রকার

জমি চাষ কেমন হবে তা নির্ভর করে কৃষক কী কী ফসল ফলাবেন।

যেমন ধান চাষের জন্য কয়েকবার আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে জমি কর্দমাক্ত করতে হয়। কিন্তু মুলা, মরিচ, ইত্যাদির জন্য মাটি মিহি ঝুরঝুরা করে চাষ করতে হয়।

আখ ও আলু চাষের জন্য গভীরভাবে জমি চাষ করতে হয়।

খ) মাটির প্রকার

জমি চাষ মাটির প্রকারের উপর নির্ভর করে।

কাদা মাটিতে বেশি আর্দ্রতা বা ভেজা থাকলে চাষ করা যায় না। মাটির “জো” আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

আবার হালকা মাটি যেমন দোআঁশ, পলি দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ মাটিতে আর্দ্রতা একটু বেশি থাকলেও চাষ করা যায়। এই মাটিগুলো চাষের জন্য খুব ভালো।

গ) আবহাওয়া

আবহাওয়ার প্রভাবে মাটিতে আর্দ্রতার তারতম্য ঘটে।

বৃষ্টি-বাদল কম হলে মাটিতে আর্দ্রতার অভাব ঘটে। এই অবস্থায় জমিতে গভীর চাষ দেওয়া অনুচিত। মাটিতে গভীর চাষ দিলে আর্দ্রতার অভাব দেখা দিবে।

আবার বর্ষাকালে যখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় তখন মাটিতে প্রচুর আর্দ্রতা থাকে এবং রোপা আমন চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করা সহজ হয়।

গ) খামারের প্রকার

বাড়ির আশে পাশের জমিতে নিবিড় শস্য চাষ করা হয়।

নিবিড় শস্য চাষে একটা ফসল তুলেই আর একটা ফসল লাগানো হয়। তখন জমিতে গভীর চাষের দরকার পড়ে না। জমির মাটি এমনিতেই আলগা থাকে।

তবে অনিবিড় শস্য চাষে জমিতে গভীর চাষের দরকার পড়ে।

কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts