বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিশেষত জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে দেশের ঋতুচক্র বদলে যাচ্ছে। এর প্রধানত নেতিবাচক পড়ছে কৃষি উপর। বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলে লবনাক্ততা বৃদ্ধি, অতিবৃষ্টি, অসমায় বৃষ্টি, বন্যা, তীব্র খরা ও জলাবদ্ধতা ইত্যাদি সমস্যা প্রকট হচ্ছে। এ সবগুলোই কৃষি ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ছে।
এসব গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এই আর্টিকেলটিতে শুরুতেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব pdf ফাইলটির ডাউনলোড লিংক দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর-
- প্রথমতঃ ফসলের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
- দ্বিতীয়তঃ মাছের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং
- তৃতীয়তঃ পশুপাখির উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
পাশাপাশি উক্ত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রেক্ষাপটে ফসলের অভিযোজন কলাকৌশল, সহিষ্ণু ফসল ও ফসলের জাত সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।
(১) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব pdf ডাইনলোড লিংক
নিম্নে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব pdf ডাইনলোড লিংক প্রদান করা হলো-
(২) ফসলের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
নিম্নে ফসলের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের খতুচক্র বদলে যাচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব দেশের কৃষি উৎপাদনের ওপরে পড়তে শুরু করেছে। .
বাংলাদেশের কৃষিবিদরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম একটি নিদর্শন বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়া। আষাঢ় শ্রাবণ মাসে তেমন বৃষ্টি হয়না। আশ্বিন মাসে ৪-৫ দিন এমন পরিমাণে বৃষ্টিপাতে যে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। খরাসহ বিভিন্ন কারণে দেশে ভুগর্ভস্থ পানির স্তর দিনে দিনে নিল্লমুখী হয়ে সেচ কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। এর ফলে বিভিন্ন কৃষির উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিরূপ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশে ফসল উৎপাদন ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আবহাওয়ার অসংলগ্ন আচরণের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে কৃষি খাতকে ইতিমধ্যে ধকল পোহাতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ছাড়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের খতু বৈচিত্রের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ফলে অতিবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা, তীব্র খরা, নদীর নাব্যতা সংকট, জলাবদ্ধতা ইত্যাদি সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এর সবগুলোই কৃষি খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাবফেলছে।
ক) ফসল উৎপাদনে খরার প্রভাব
কোন এলাকায় বৃষ্টিপাতের তুলনায় বাষ্পীকরণের মাত্রা বেশি হলে সেখানে খরা দেখা দেয়। কৃষি খরা বলতে আবহাওয়ার চক্রের যেকোনো অবস্থায় পানির অভাবে জৈবিক কর্ম ব্যাহত হওয়াকে বোঝায়।
কৃষিতে খরা একটি বহুল প্রচলিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গাছের বৃদ্ধি পর্যায়ে গড় বৃষ্টিপাতের অভাবে মাটিতে পানি শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যা গাছের ক্ষতি করে।
- সাল ২০২০ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিভিন্ন মাত্রার খরায় আক্রান্ত ৮৩ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমির শতকরা ৬০ ভাগ জমিতে আমন ধান চাষ করা হয়। এছাড়াও খরা আউশ ও বোরো ধান, পাট, ডাল ও তেল ফসল, আলু, শীতকালীন সবজি এবং আখ চাষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- মাচ-এপ্রিলের খরা চাষের জন্য জমি প্রস্তুতিতে অসুবিধার সৃষ্টি করে ফলে বোনা আমন, আউশ এবং পাট চাষ যথা সময়ে করা যায় না। মার্চ-এপ্রিলের খরা চাষের জন্য জমি প্রস্তুতিতে অসুবিধার সৃষ্টি করে ফলে বোনা আমন, আউশ এবং পাট চাষ যথা সময়ে করা যায় না।
- সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের কম বৃষ্টিপাত বোনা ও রোপা আমন ধানের উৎপাদন কমিয়ে দেয় এবং ডাল ও আলু ফসলের চাষকে দেরি করিয়ে দেয়।
- কাঁঠাল, লিচু, কলা ইত্যাদি ফলের গাছ অতিরিক্ত খরায় মারা যায়।
খ) ফসল উৎপাদনে তাপমাত্রার বৃদ্ধির প্রভাব
- তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে উফশী ধানের ফলন কমে যাবে এবং গমের রোগের আক্রমণ বাড়বে। বেশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে গম চাষ সম্ভব হবেনা।
- ধান গাছের ফুল ফোটার সময় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি হলে এবং অতি নিম্ন তাপে (২০ ডিগ্র সেলসিয়াসের নিচে) শিষে ধানের সংখ্যা কমে যেতে পারে। ফুল ফোটা বা পরাগায়নের সময় যদি অতি উষ্ণ তাপ থাকে তাহলে চিটার সংখ্যা থোড় অবস্থার চেয়ে বেশি হবে।
- তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ার কারণে ধান গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ধান গাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করে, ধানের চারা দুর্বল হয় এবং ফসলের জীবনকাল বেড়ে যায়।
- বিরূপ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফলে পোকামাকড় এবং বিভিন্ন উদ্ভিদ রোগের আক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। দানা শস্যেসহ বিভিন্ন ফসলে মিলিবাগ, এফিড (শোষক পোকা) ও ব্যাকটেরিয়া (জীবাণু গঠিত রোগ) ও ছত্রাকজনিত রোগ এর আক্রমণ বেশি বেশি দেখা যাচ্ছে অতিরিক্ত তাপ এবং আর্দূতা গাছের ছত্রাক রোগ বাড়ানোয় সহায়ক ভুমিকা পালন করে এবং একই ভাবে পোকামাকড় ও বিভিন্ন রোগের বাহক পোকার সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। বেশির ভাগ রবি ফসলেরই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে ফলনের ওপর তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে।
- এছাড়া শীত মৌসুমে উষ্ণপ্রবাহ দেখা দিলে বেশি সংবেদনশীল ফসল যেমন গমের ফলন খুব কমে যায় এবং গম উৎপাদন অলাভজনক হয়। হঠাৎ তীর শৈত্য প্রবাহ হলে সরিষা, মসুর, ছোলা ইত্যাদি ফসলের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং এসব ফসলের পরাগায়ন ব্যাহত হয়ে ফলন খুব কমে যায়।
গ) ফসল উৎপাদনে লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রভাব
- বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর পানি প্রবাহ শুকনো মৌসুমে স্বাভাবিক মাত্রায় থাকেনা। ফলে নদীর পানির বিপুল চাপের কারণে সমুদের লোনা পানি যতটুকু এলাকা জুড়ে আটকে থাকার কথা ততটুকু থাকেনা, পানির প্রবাহ কম থাকার কারণে সমুদ্রের লোনা পানি স্থলভাগের কাছাকাছি চলে আসে। ফলে লবণাক্ততা বেড়ে বেড়ে যায় দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিপুল এলাকায় ৷
- লোনা পানির অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের একটি মারাত্মক সমস্যা ৷ গবেষণায় দেখা গেছে যে, একটা সময় পরে আমাদের দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলো সমুদ্রে বিলীন হয়ে যাবে এবং লবণাক্ত হয়ে পড়বে ৷
- সাল ২০২০ এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ১০ লাখ হেক্টর জমি ফসল চাষের উপযুক্ততা হারিয়েছে, ভবিষ্যতে লবণাক্ত অঞ্চলের পরিমান আরও বাড়বে।
ঘ) সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ফসল উৎপাদনে প্রভাব
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এশিয়ার দেশগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা ও পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেবে বলেই বিশিষ্ট জনের মত। প্রায়শই বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে। অধিকন্তু খতু পরিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মে বৈচিত্র্য দেখা দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও বিরূপ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে ‘টার্ন ডাউন দ্য হিট: ক্লাইমেট রিজিওনাল ইমপ্যাক্ট আ্যান্ড কেস ফর রেজিলিয়ান্থ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে উল্লেখ করেছে- প্রতি তিন থেকে পাঁচ বার পরপর বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা বন্যায় ডুবে যাবে। তাপমাত্রা আড়াই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বন্যায় প্লাবিত এলাকার পরিমাণ ২৯ শতাংশ বাড়বে। ২০৮০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উপকূলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ৬৫ সেন্টিমিটার বাড়লে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪০ শতাংশ ফসলি জমি হারিয়ে যাবে।
ঙ) ফসল উৎপাদন এবং কার্বন নিঃসরন
বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধি ফসল উৎপাদনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। যদিও ফসলের জাতভেদে কার্বনডাই অক্সাইড বৃদ্ধির প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরুপ ফসল যেমন- গম, সয়াবিন বা ক্যানোলাসহ বিভিন্ন চারণভূমি ঘাসের বৃদ্ধি অধিক মাত্রায় কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিবেশে বেশি ফলপ্রসু হয়।
অপরদিকে উদ্ভিদ বিশেষ করে ভুট্টা অধিক মাত্রায় কার্বনডাই অক্সাইড লেভেলে কম প্রতিক্রিয়াশীল হয়। যদিও তাপমাত্রা এর অধিক হলে উদ্ভিদ কার্বনডাইঅক্সাইড মেটাবলিজম অধিক হয়।
চ) জলবায়ু পরিবর্তন এবং বালাই ও আগাছার প্রাদুর্ভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে ফসলের উপর বালাই ও আগাছার প্রভাব উপকারী বা অপকারী দুই ভাবেই আসতে পারে।
- প্রথমত, নতুন শিকারী কীটপতঙ্গের প্রবর্তন এবং দ্রুত ফসল অবশিষ্টাংশের পচন কৃষিতে নতুন কিছুর সূচনা করতে পারে।
- অপর দিকে বর্ধিত পোকা এবং নতুন রোগের রোগ সংবেদনশীল বা অকার্যকর কীটনাশক বিশেষ অপকারী প্রভাব ফেলতে পারে।
(৩) মাছের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
নিম্নে মাছের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০১৬ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে আভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ ও মৎস্য চাষে ৫ম। কেননা এদেশের রয়েছে প্রায় ৪.৭ মিলিয়ন হেক্টর মুক্ত ও বন্ধ জলাশয়। সেই সাথে রয়েছে ১,৬৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার সামুদ্রিক এলাকা। এটি বাংলাদেশে সামুদ্রিক মাছের একমাত্র উৎস ও বিশ্ব জীববৈচিত্রের অন্যতম ধারক। এতে রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, বিভিন্ন প্রজাতির শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপ ও অন্যান্য অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পন্ন প্রজাতি।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে মানুষের প্রাণিজ আমিষের ৬০ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে এবং সরকারের রূপকল্প ২০২১ অনুযায়ী ২০২০-২০২১ সাল নাগাদ মৎস্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল ৪৫.৫০ মেট্টিকটন।
আধুনিক পদ্ধতিতে পরিকল্পিতভাবে মৎস্য চাষের ফলে সামুদ্রিকভাবে মৎস্য উৎপাদন মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয় বৃদ্ধি পেলেও বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রবৃদ্ধি কাঙ্খিত পর্যায়ে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, খরা, বন্যা সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদিজনিত জলবায়ু পরিবর্তন।
ক) মাছ চাষ ও পোনা উৎপাদনে প্রভাব
- পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে আমাদের দেশে মৌসুমী পুকুরগুলোতে পোনা অবমুক্তকরণ দেরিতে হয়। অন্যদিকে দ্রুত পুকুর শুকিয়ে যাওয়ায় মৎস্য চাষের সময়কাল কমে যায় এবং মাছের আকার ছোট হয়।
- তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও কম বৃষ্টিপাতের ফলে প্রজনন অনুকূল পরিবেশের অভাবে হ্যাচিরিতে মাছের কৃত্রিম প্রজনন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে পুকুরের পানির গভীরতা কমে যাওয়ায় মাছ সহজে রোগাক্রান্ত হচ্ছে এবং মাছের মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- ঘন ঘন আকস্মিক বন্যা, সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাস হওয়ার কারণে মৎস্য পুকুর ও ঘের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় মৎস্য চাষে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
- পুকুরের পানির স্বাভাবিক গভীরতা ধরে রাখার জন্য চাষীকে পুকুরে পানি সরবরাহের জন্য বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।
খ) আভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনের প্রভাব
- বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় নদ-নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে ফলে একদিকে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে এবং অন্যদিকে প্রজননক্ষম মাছ সহজে ধরা পড়ায় নদীতে মাছের উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে এবং জীব বৈচিত্র নষ্ট হচ্ছে।
- সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে উপকূলীয় এলাকার স্বাদু পানির মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র কমে যাচ্ছে।
- অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের কারণে আমাদের দেশে এপ্রিল মে মাসে আভ্যন্তরীণ জলাশয়ে দেশীয় ছোট মাছের প্রজনন ব্যহত হচ্ছে।
- বৈশাখ মাসে বাংলাদেশে প্রচন্ড গরমের পর ভারী বৃষ্টি শুরু হলে রুই জাতীয় মাছ হালদা নদীতে ডিম পাড়ে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে একদিকে ডিমের পরিপক্কতার সময় এগিয়ে আসছে অন্যদিকে বৃষ্টিপাতে দেরি হওয়ায় মাছের শরীরবৃত্তীয় অবস্থায় পরিবর্তনে মাছের ডিম পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।
গ) সামুদ্রিক মৎস্য ক্ষেত্রে প্রভাব
- গ্রীন হাউজ ইফেক্টের ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাতাসের গতি প্রকৃতি পরিবর্তন হচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাবে সমুদ্রের কোনো অংশের মাছের পরিমাণের অস্বাভাবিক হ্রাস বা বৃদ্ধি পেতে পারে।
- বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সামুদ্রিক অনেক মাছ তার অভিপ্রায়ন পথ, প্রজনন ক্ষেত্র ও বিচরণ ক্ষেত্রের পরিবর্তন করছে। দেখা যাচ্ছে মাছ উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের সাগরের দিকে সরে যাচ্ছে।
- সাগরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অম্লত্ব বৃদ্ধি, দূষণ ও স্রোতের গতি পরিবর্তনের কারণে সামুদ্রিক প্রবাল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ফলে সামুদ্রিক জীব বৈচিত্র্য বহু হুমকীর মধ্যে পড়ছে।
(৪) পশুপাখির উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
নিম্নে পশুপাখির উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও মানুষ কর্তৃক পরিবেশ ধ্বংসই জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। আমাদের বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- জলোচ্ছ্বাস, সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, প্রবল বায়ুপ্রবাহ, বন্যা ও খরা প্রভৃতি কারণে পশুপাখির ব্যাপক ক্ষতি হয়। আর জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিনিয়তই এদেশে আঘাত হানছে। ফলে খামারি বা কৃষকরা অর্থনেতিকভাবে লাভবান হতে পারছে না। এসব ক্ষতির পরিমাণ খানিকটা পুষিয়ে নিতে দুর্যোগকালীন ও দুযোর্গ পরবর্তী সময়ের জন্য কতকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের বাস্তবতা মেনে নিয়েই সামুদ্রিক ঝড়, টর্নেডো, বন্যা, খরা, পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টি ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিরোধক বা সর্তকতামূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র ভূমির শালবন, রাজশাহী অঞ্চলের পত্নীতলা ও নজীপুরের জঙ্গল সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে এসব অঞ্চলে প্রচন্ড খরা হচ্ছে। এসব বনাঞ্চল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ছাড়াও উপকূলীয় বনায়ন পরিকল্পনা, পার্বত্য চট্টগ্রামের অশ্রেণিভুক্ত বনাঞ্চলে বনায়ন সম্প্রসারণ, দেশের নদ-নদী খাল উদ্ধার ও পুনঃখনন এবং ছোট বড় পাহাড় রক্ষার পরিবেশ আইন অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।
বন সম্প্রসারণে দীর্ঘ মেয়াদী ও স্থায়ী ব্যবস্থা, যেমন- সামাজিক বনায়ন সম্প্রসারণসহ ব্যাপকভাবে গাছ লাগাতে হবে। এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হলে জলবায়ুর পরিবর্তনে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশের পশুপাখি ও বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করা যাবে। এখানে জলবায়ু পরিবর্তনে পশুপাখির সমস্যা মূল্যায়নের বিভিন্ন দিক আলোচনা করা হলো।
ক) খরাজনিত সমস্যা
খরায় যেসব সমস্যা দেখা যায় সেগুলো নিম্নরূপ-
- পানি দূষিত হয়।
- কাঁচা ঘাসের অভাব হয়।
- মাঠ-ঘাটের ঘাস শুকিয়ে যায়।
- গবাদিপশু অপুষ্টিতে ভোগে।
- গবাদিপশুর বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দেয়।
- পশুর বহিঃদেশের পরজীবীর উপদ্রব বৃদ্ধি পায়।
- অধিক তাপে পশুপাখির অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়।
- গবাদিপশুর স্বাস্থ্যের অবনতিসহ মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা যায়।
- তাপপীড়নে খামারে ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির মৃত্যু হয়।
খ) বন্যাজনিত সমস্যা
বন্যার সময় যেসব সমস্যা দেখা যায় সেগুলো নিম্নরূপ-
- দেশের অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে যায়।
- জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
- গোখাদ্য পাওয়া যায় না।
- পানি দূষিত হয়।
- পশুপাখি রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
- গবাদিপশু অপুষ্টিতে ভোগে।
- বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ও কৃমির আক্রমণ বৃদ্ধি পায়।
- ঘাসে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়, গবাদিপশু অসুস্থ হয়ে পড়ে।
- পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয় ও অনেক পশুপাখির মৃত্যু ঘটে।
গ) জলোচ্ছ্বাসজনিত সমস্যা
জলোচ্ছ্বাসের সময় যেসব সমস্যা দেখা যায় তা নিম্নরূপ-
- জলোচ্ছ্বাস কবলিত এলাকার পানি দূষিত হয়।
- জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়ের ফলে বহু গবাদিপশু ও জীবজন্তু তাৎক্ষণিকভাবে মারা যায়।
- মৃত গবাদিপশু সৎকারের অভাবেও পরিবেশ দূষিত হয়।
- পশু খাদ্যের অভাব দেখা দেয়।
- জীবিত গবাদিপশু উদরাময়, পেটের পীড়া ও পেটফাঁপাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
(৫) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রেক্ষাপটে ফসলের অভিযোজন কলাকৌশল
নিম্নে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রেক্ষাপটে ফসলের অভিযোজন কলাকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
উদ্ভিদ বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন ধরনের শরীরবৃত্তীয় ও জৈবরাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কৌশলকে অভিযোজন বলে।
জীবের অভিযোজন পরিবেশের তাপমাত্রা, আদ্রতা, বায়ুপ্রবাহ ও বায়ুর উপাদান, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ঐ স্থানের উচ্চতা এবং জীবের শারীরিক গঠন ও দৈহিক অবস্থা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। হঠাৎ জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হলে উদ্ভিদ সেই পরিবেশে নিজেকে অভিযোজন করতে পারে না। ফসলের অভিযোজন কৌশলের জ্ঞানকে কাজে লাগি কৃষি বিজ্ঞানীরা প্রতিকূল পরিবেশে চাষযোগ্য বিভিন্ন ধরনের ফসলের জাত উদ্ভাবন। এ ক্ষেত্রে খরা, বন্যা ও জলোচ্ছ্াসজনিত সমস্যা সমাধানের উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
ক) খরা অভিযোজন
খরা পীড়ন অবস্থায় দুইভাবে ফসল অভিযোজন করে থাকে, যথা খরা এড়ানো এবং খরা প্রতিরোধ।
খরা পীড়ন অবস্থায় অভিযোজনের কার্যকরি উপায় হলো খরাবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে মাটিতে রস থাকা বা মৌসুমি বৃষ্টিপাতের শুরু থেকে খরা শুরু হওয়ার মধ্যবর্তি সময়ে ফসলের জীবনকাল সম্পন্ন করার উপর জোর দেওয়া হয়। যেসব ফসলের জীবনকাল স্বল্প, খরা এড়ানোর জন্য তারা এক চমৎকার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।
অপরদিকে, খড়াপীড়ন অবস্থায় ফসলের মাঠে টিকে থাকার কৌশলকে খরা প্রতিরোধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সাধারণত খরা প্রতিরোধের জন্য ফসল তার কিছু শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন সাধন করে। ক্ষেত্র বিশেষ দেহাভ্যন্তরে স্বল্প পানি নিয়ে খরা পীড়ন টিকে থাকে এবং খরা পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিক বৃদ্ধি সাধন করে এবং জীবনচক্র সম্পন্ন করে।
সকলক্ষেত্রে মোট কোষপ্রাচীর, উদ্ভিদ কর্তৃক প্রোটিন জমাকরণ, প্রস্বেদন নিয়ন্ত্রন, সালক সংশ্লেষণ-এর দক্ষতা বৃদ্ধি, পাতা মোড়ানো ও পাতা কুি তকরণ কার্যকরী উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়।
খ) লবণাক্ত এলাকায় লবণাক্ততা-সহনশীল ফসল চাষ
লবণাক্ততা সহনশীল জাতের উন্নয়ন ও এর আবাদ এলাকা বাড়ানো, ফসলের চাষ, দ্রুত ও গভীর চাষের মাধ্যমে মাটির ক্যাপিলারি নালিকা ভেঙ্গে দিয়ে লবণাক্ততা কমানো। এজন্য পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষাবাদের এলাকা বৃদ্ধি করলে এ সুবিধা পাওয়া যাবে; আমন মৌসুমে বিআর ২৩, ব্রিধান ৪০ এবং ৪১ এর চাষ। বোরো মৌসুমে লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত ৮৫ টি ইনব্রিড ও ৬টি হাইব্রিড সহ মোট ৯১ টি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন যার মধ্যে রয়েছে ৮টি লবণাক্ততা সহনশীল, ৫টি খরাসহিষ্ণু, ২ টি জলমগ্নতা সহিষ্ণু, ধানের জাত। সাম্প্রতিক সময়ে ইরির বিজ্ঞানীদের ধানের জিন বিন্যাস উন্মোচন বা জেনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন দেশের ধান গবেষণার এই সাফল্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
গ) চাষ পদ্ধতির পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা মোকাবেলার জন্য বিকল্প এবং কৌশলগত চাষাবাদের বিভিন্ন পদ্ধতি, যেমন-
- লবণাক্ত এলাকায় ধানের পর মুগ ডালের চাষ, পাহাড়ের পাদদেশে সরিষার পর খরিপ-১ মৌসুমে বারি মুগ-৫ চাষ, রোপা আমন ধানের সাথে মসুরের সাথী ফসল চাষ করার জন্য কৃষকগণকে উৎসাহিতকরণ।
- পানি কম লাগে এমন ফসলের চাষ, মালচিং ও ড্রিপ সেচের প্রবর্তন, অল্প চাষ বা বিনাচাষে উৎপাদন পদ্ধতিকে উৎসাহিত করে উপযোগী ফসলের চাষ করতে হবে।
- খরা সহিঞ্চু স্থানীয় জাতের উন্নয়ন ও এর আবাদ এলাকা বাড়ানো। আইল উঁচু করে চাষ করা। খরার কারণে ধান লাগাতে বেশি দেরী হলে নাবি ও আলোক সংবেদনশীল বিআর ২২, ২৩ ও ব্রি-ধান ৪৬ এর চাষ করা। আউশ মৌসুমে বিআর ২৪, বিআর ২৬, বিআর ২৭, ব্রিধান ৪২ ও ব্রিধান ৪৩ আবাদ করা।
- আমন ধান কাটার পরে খরা সহনশীল ফসল যেমন- ছোলা চাষ করা যায়। তেল ফসল হিসেবে তিলের চাষ করা যায়।
- এছাড়াও মাটির গভীরে বীজ বপন, পূর্বে ভিজানো বীজ বপন, সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে খরা মোকাবেলায় কার্য্যকরী পদক্ষেপ নেয়া যায়।
ঘ) স্থানীয় ও উফশী আগাম জাতের চাষাবাদ
- বন্যাপ্রবণ এলাকায় স্থানীয় ও উফশী জাতের আগাম পাকা ও স্বল্প মেয়াদের বোরো চাষাবাদ ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কমিয়ে আনতে পারে। প্রচলিত জাতের চেয়ে আগাম পাকে এমন ফসলের জাত চাষ, যেমন ব্রিধান ২৯ এর চেয়ে ব্রিধান ২৮ পনের দিন আগে কাটা যায়।
- শিষ পাকা পর্যায়ে ব্রিধান ২৯ ও ব্রিধান ৩৬ এর জলমগ্নতা সহ্য করার ক্ষমতা আছে। এছাড়াও ব্রিধান ৪৫ চাষ করা যায় যার জীবনকাল ১৪০ থেকে ১৪৫দিন।
- গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ব্রি-ধান ২৯ এর ২০-৩০ দিন বয়সের চারা সঠিক সময়ে রোপণের মাধ্যমে এর জীবনকাল ১৫ দিন কমিয়ে আনা সম্ভব।
ঙ) বন্যা মোকাবেলা ও বন্যা পরবর্তী ফসলের অভিযোজন
- ভাসমান ধাপে ফসলের ও সবজির চাষ। বন্যা পরবর্তী সময়ে নাবী জাতের ধান যেমন- নাইজারশাইল, বিআর-২২ ও ২৩ এবং ব্রি-ধান ৪৬ চাষ করা।
- দাপোগ পদ্ধতির বীজতলা তৈরি।
- বন্যা পরবর্তী সময়ে বেশি বয়সের চারা ঘন করে লাগানো যেতে পারে।
- বন্যা মোকাবেলা সক্ষম ধানের পাশাপাশি সবজিও অন্যান্য ফসলের চাষ করা সম্ভব। শিম, মুলা, আলু, পেয়াঁজ, রসুন, মিষ্টিকুমড়া, লালশাক, করলা, চালকুমড়া, পালংশাক, পুঁইশাক, মটরশুটি এসব চাষ লাভজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
চ) ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস পরবর্তী ফসলের অভিযোজন
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ক্ষতির প্রকৃতি, এলাকার মাটি বা ভূপ্রকৃতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার আলোকে জলোচ্ছ্বাস পরবর্তী ফসল চাষে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে আউশ মৌসুমে উফশী রোপা আউশ যেমন: বিআর ১৪, বিআর ৯, বিআর ২০, বিআর ২১, বিআর ২৬, ব্রিধান ২৭, ব্রিধান ২৮, ব্রিধান ৪৫ এর ১ মাস বয়সী চারা বৈশাখ মাসের মধ্যে রোপণ করতে হবে। আমন মৌসুমে নাবী আমন জাত যেমন: বিআর ২২, বিআর ২৩ এর এক মাসের অধিক বয়সী চারা ভাদ্র আশ্বিন মাসের মধ্যে রোপণ করতে হবে।
ছ) তাপমাত্রা সহনশীল জাতের চাষ
উচ্চতাপমাত্রা অভিযোজিত হওয়ার জন্য ফসলের নিজস্ব অভিযোজন কৌশল রয়েছে, যেমন- ক্ষেত্র বিশেষ উদ্ভিদ মূলের দৈর্ঘ্য, সংখ্যা ও ঘনত্ব বাড়িয়ে অধিক পরিমান পানি আহরণের মাধ্যমে অধিক তাপমাত্রায় টিকে থাকে। মূলের গভীরতা ও ঘনত্ব একই ফসলে বিরাজমান থাকলে তার পানি আহরণের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় বলে অধিক তাপমাত্রা সহনশীল হয়।
এছাড়া উচ্চতাপ সহনশীল কিছু জাত ইতোমধ্যে কৃষি বিজ্ঞানীরা কৃষকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। যেমন-বারি আলু-১ (হীরা) তাপসহন শীল। বারি টমেটো-৪ উচ্চ তাপসহনশীল। বারি টমেটো-৬ (চৈতী), বারি টমেটো-১০ (অনুপমা) উচ্চতাপ সহনশীল এবং ব্যাক্টেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগ সহনশীল।
(৬) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রেক্ষাপটে মৎস্য ক্ষেত্রে অভিযোজন কলাকৌশল
প্রতিকূল পরিবেশে বেচে থাকার জন্য কোনো জীবের বিভিন্ন ধরনের শরীরবৃত্তীয় ও জৈব রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কৌশলকে অভিযোজন বলা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৎস্য জীব বৈচিত্র ও উৎপাদনে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা কাটিয়ে উঠার জন্য মৎস্য অভিযোজন কলাকৌশলকে কাজে লাগাতে হবে। এ উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত উদ্যোগসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে।
ক) লবণাক্ততা এড়ানোর অভিযোজন কৌশল
- উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি প্রাপ্ত এলাকার লবণাক্ততা সহনশীল মাছ যেমন-ভেটকী, ভাটা, পারসে ইত্যাদির চাষ ও পোনা উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ।
- অধিক লবণাক্ত জলাশয়ে চিংড়ি ও কাকড়া চাষ করা।
খ) বন্যাজনিত প্রভাব এড়াতে কৌশল
- বন্যা প্রবণ এলাকায় পুকুরের পাড় ঊঁচু করে বেঁধে দেওয়া বা নেট দিয়ে ঘিরে দেওয়া। এতে বন্যার পানি পুকুরে প্রবেশ করবে না এবং মাছ ভেসে যাবে না।
- বন্যাপ্রবণ এলাকায় সমাজভিত্তিক মৎস্য পোনা ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যাতে প্রয়োজনে বন্যামুক্ত সময়ে এসব পোনা পুকুরের মজুদ করা যায়।
- বন্যার সময়ে খাচায় মাছ চাষ করা।
গ) তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব এড়ানোর কৌশল
- তাপমাত্রাসহনশীল মাছ চাষ এবং এদের পোনা উৎপাদনের ব্যবস্থা গ্রহণ।
- তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত প্রভাব এড়ানোর জন্য পুকুরে কয়েকটি স্থানে বাশের ফ্রেম তৈরি করে তাতে টোপাপানা রাখা যেতে পারে। মাছ এর নিচে অবস্থান করে নিজেকে গরম থেকে রক্ষা করতে পারে।
- পুকুরের পাড়ে পানির উপর লতানো উদ্ভিদ জন্মানোর সুযোগ সৃস্টি করে দেওয়া যাতে মাছ এর নিচে ঠান্ডা পরিবেশে আশ্রয় নিতে পারে।
- পুকুরের পানির অতিরিক্ত তাপমাত্রা কমানোর জন্য প্রয়োজনে বাহির থেকে পুকুরে পানি প্রবেশ করানো।
ঘ) খরার প্রভাব এড়ানোর কৌশল
- খরা প্রবণ এলাকায় অল্প পানিতে স্বল্প সময়ে তুলনামূলকভাবে বড় আকারের পোনা চাষ করা।
- খরা অঞ্চলে খরা সহনশীল মাছ যেমন দেশি মাগুর ও কৈ চাষ করা।
সামগ্রিকভাবে উপরোক্ত কৌশলগুলো অবলম্বনের পাশাপাশি প্রতিনিয়ত লাগসই নতুন কলাকৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। একই সাথে গবেষণার আধুনিকায়ন ও সময় উপযোগী জরীপ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে সামুদ্রিক মৎস্য এলাকায় মাছের পরিবর্তিন নতুন বিচরণ ক্ষেত্র অনুসন্ধান করতে হবে।
(৭) জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পশুপাখির অভিযোজন কলাকৌশল
নিম্নে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পশুপাখির অভিযোজন কলাকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
পরিবেশের সঙ্গে কোনো একটি প্রজাতির জীবের নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার কৌশলকে অভিযোজন বলে। মনে রাখতে হবে যে, পরিবেশ ও জীবের দেহের মধ্যে অভিযোজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে। জীবের অভিযোজন পরিবেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই অভিযোজন পরিবেশের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ ও বায়ুর উপাদান, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ঐ স্থানের উচ্চতা এবং জীবের শারীরিক গঠন ও দৈহিক অবস্থা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। অভিযোজনের এসব উপাদান মোকাবেলা করেই জীব তার অবস্থানে টিকে থাকে। এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম।
কিন্তু হঠাৎ করে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন হলে মানুষ তার বুদ্ধি দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও পশুপাখি সেই পরিবেশে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে না বা অভিযোজনে সক্ষম হয় না। কারণ পশুপাখি অসহায় ও নিরীহ প্রাণী। কোনো অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তন ধীরে ধীরে হলে পশুপাখি পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজন করতে সক্ষম হয়। আর পরিবেশে অভিযোজনে অক্ষম অনেক প্রজাতির জীবের বিলুপ্তিও ঘটে।
প্রতিকূল ও বিরূপ পরিবেশে পশুপাখির অভিযোজনের জন্য মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে খরা, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসজনিত সমস্যা সমাধানের ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। এতে পশুপাখি অনেকাংশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়।
ক) খরায় পশুপাখি রক্ষার কলাকৌশল
- কাঁঠাল, ইপিল-ইপিল, বাবলাসহ বিভিন্ন গাছের চাষ বৃদ্ধি করতে হবে ও খরার সময় এসব গাছের পাতা পশুপাখিকে খাওয়াতে হবে।
- খরার সময় এদেরকে ভাতের মাড়, তরিতরকারির উচ্ছিষ্টাংশ, কুঁড়া, গমের ভুশি, ডালের ভুশি, খৈল, ঝোলাগুড় পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়াতে হবে।
- পশুপাখিকে নিয়মিত সংক্রামক রোগের টিকা দিতে হবে।
- এদেরকে কাঁচা ঘাসের সম্পূরক খাদ্য, যেমন- সবুজ অ্যালজি, খাওয়াতে হবে।
- খরা মৌসুম আসার পূর্বেই ঘাস দিয়ে সাইলেজ ও হে তৈরি করে রাখতে হবে যা খরা মৌসুমে গবাদিপশুকে খাওয়ানো যাবে।
- এদেরকে শুষ্ক খড় না খাইয়ে ইউরিয়া দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা খড় ও ইউরিয়া মোলালেস ব্লক খাওয়ানো যেতে পারে।
- পশুপাখিকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দানাদার খাদ্য খাওয়াতে হবে।
- এদেরকে বেশি করে পরিষ্কার পানি সরবরাহ করতে হবে।
- গবাদিপশুকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে।
- এদের দেহ সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে ও পরজীবির জন্য চিকিৎসা করাতে হবে।
- পশুপাখিকে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে।
- এদেরকে কখনোই প্রখর রোদে নেওয়া যাবে না।
- পশুপাখি অসুস্থ হলে প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে।
খ) বন্যাজনিত সমস্যায় পশুপাখি রক্ষার কলাকৌশল
- পশুপাখিকে যথাসম্ভব উঁচু ও শুকনো জায়গায় রাখতে হবে।
- গবাদিপশুকে পরিষ্কার পানি সরবরাহ করতে হবে, বন্যার দূষিত পানি এদেরকে পান করানো যাবে না।
- পশুপাখির মৃতদেহ গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে।
- বন্যার সময় পশুপাখিকে খাদ্য হিসেবে খড়, চালের কুঁড়া, ভুশি ও খৈল বেশি পরিমাণে খাওয়াতে হবে।
- এ সময় কচুরিপানা, দলঘাস, লতাগুল্ম এমনকি করাগাছও পশুপাখিকে খাওয়ানো যেতে পারে।
- কাঁচা ঘাসের বিকল্প হিসেবে সংরক্ষিত খাদ্য, যেমন- হে ও সাইলেজ খাওয়ানো যেতে পারে।
- বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পতিত জমিতে বিভিন্ন জাতের ঘাসের বীজ ছিটিয়ে দিতে হবে।
- পশুপাখিকে সংক্রামক রোগের টিকা দিতে হবে ও কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে।
- প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগাক্রান্ত পশুপাখির চিকিৎসা করাতে হবে।
গ) জলোচ্ছ্বাসজনিত সমস্যা মোকাবেলায় পশুপাখি রক্ষার কলাকৌশল
উপকূলীয় এলাকায় সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস একটি মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বছরের যে কোনো সময় জলোচ্ছ্বাস সমুদ্র- উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনে পশুপাখির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করতে পারে। এদেশের বিস্তৃর্ণ সমুদ্র-উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে।
তাই জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে পশুপাখিদের রক্ষা করার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে। যথা-
- উঁচুস্থানে পশুপাখির আবাসন বা বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
- জলোচ্ছ্বাস বা ঝড়ের সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদেরকে উঁচু আশ্রয়স্থলে নিয়ে বেঁধে রাখতে হবে।
- জলোচ্ছ্বাসের পর মৃত পশুপাখিদের মাটিচাপা দিতে হবে।
- এ সময় পশুপাখির জন্য ভাতের মাড় ও জাউ, শুকনো খড় ও দানাদার খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে।
- পশুপাখিকে দানাদার খাদ্য, যেমন- ভুশি, কুঁড়া, খৈল ও প্রয়োজনমতো লবণ, খাওয়াতে হবে।
- এদেরকে কাঁচা ঘাসের পরিবর্তে বিভিন্ন গাছ-পাতা খাওয়াতে হবে।
- জলোচ্ছ্বাস কবলিত এলাকায় টিম গঠন করে প্রাণী চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
- পশুপাখিকে নিয়মিত সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক টিকা দিতে হবে।
- পশুপাখি যাতে পচা ও দূষিত পানি করে রোগাক্রান্ত না হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
(৮) বিরূপ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সহিষ্ণু ফসল ও ফসলের জাত
নিম্নে বিরূপ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সহিষ্ণু ফসল ও ফসলের জাত সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল বা বিরূপ আবহাওয়া বিরাজ করে। শীতকালে অতি শৈত্য বা কম শৈত্য পড়া, গ্রীষ্মকালে অতি উচ্চ তাপমাত্রা, খরা, লবণাক্ততা, বন্যা বা জলাবদ্ধতা হলো বাংলাদেশের ফসল উৎপাদনে প্রতিকূল পরিবেশ ও বিরূপ আবহাওয়া।
পূর্বপ্রস্তুতি ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকলে এ ধরনের প্রতিকূল পরিবেশ বা বিরূপ আবহাওয়ায় ফসলের ফলন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
বিরূপ আবহাওয়া বা প্রতিকূল পরিবেশে ফসল উৎপাদনের পূর্ব শর্ত হলো উপযোগী ফসল বা ফসলের জাত নির্বাচন।
বিভিন্ন ধরনের বিরূপ আবহাওয়া বা প্রতিকূল পরিবেশ-সহিষ্ণু ফসল বা ফসলের জাত রয়েছে। বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বেশ কিছু ফসলের প্রতিকূল পরিবেশ-সহিষ্ণু নতুন জাত বের করেছেন এবং আরও জাত বের করার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আমরা এখন বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল আবহাওয়া-সহিষ্ণু ফসল বা ফসলের জাত নিয়ে আলোচনা করব।
ক) শৈত্য সহিষ্ণু ফসল
বাংলাদেশে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শীতকাল। শীতকালে দেশের চরম সর্বনিম্ন তাপমাত্রা জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে হয়ে থাকে। শীতকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার গড় ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে।
- আমাদের বাংলাদেশে শৈত্য বেশি পড়লে এবং শৈত্যতা দীর্ঘস্থায়ী হলে শীতকালীন ফসল, যেমন-গোলআলু ও গমের ফলন ভালো হয়। তবে রোপা আমন ও বোরো ধানের পরাগায়ণ ও দানা গঠনের সময় শৈত্য বেশি পড়লে অর্থাৎ তাপমাত্রা কমে গেলে চিটা হয়ে ফলন কমে যায়।
- বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশের ঠাণ্ডাপ্রবণ এলাকার জন্য ব্রি ধান ৩৬ জাতটি বের করে। বীজ বপনের সময় যে সব এলাকায় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায় সেসব এলাকার জন্য এ জাতটি খুবই উপযোগী।
- ব্রি ধান ৫৫ জাতটি মাঝারি শৈত্য সহ্য করতে পারে বলে দেশের শৈত্য-প্রবণ এলাকায় চাষ করা যায়।
খ) খরা সহিষ্ণু ফসল
অনাবৃষ্টি বা বৃষ্টিপাতের স্বল্পতার কারণে জমিতে মৃত্তিকা পানির ঘাটতি দেখা যায়। ফলে উদ্ভিদ দেহে প্রয়োজনীয় পানির ঘাটতি দেখা দেয় এ অবস্থাকে খরা কবলিত বলা হয়।
প্রতি বছর বাংলাদেশে রবি, খরিপ-১ ও খরিপ-২ মৌসুমে ৩০-৪০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রায় খরার সম্মুখীন হয়।
- সাধারণত খরা সহিষ্ণু ফসলের মূল খুব দৃঢ় ও শাখা-প্রশাখাযুক্ত এবং গভীরমূলী হয়। এ সব ফসলের পাতা ছোট, সরু, পুরু বা পেঁচানো হয়ে থাকে। খেজুর, কুল, অড়হর, তরমুজ, অনেক জাতের গম ইত্যাদি খরা সহিষ্ণু ফসল।
- ব্রি ধান ৫৬ ও ব্রিধান ৫৭ দুইটি খরা সহিষ্ণু ধানের জাত। এর মধ্যে ব্রি ধান ৫৭ প্রজনন পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৮-১৪ দিন বৃষ্টি না হলেও ফলনের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। খরা কবলিত অবস্থায় জাতটি হেক্টর প্রতি ৩.০-৩.৫ টন ফলন দিতে সক্ষম।
- ব্রি ধান ৫৬ ও ব্রি ধান ৫৭ এর জীবনকাল কম বলে এরা খরা সহ্যের পাশাপাশি খরা এড়াতেও পারে বারি গম ২০ (গৈরব) ও বারি গম ২৪ (প্রদীপ) দুইটি খরা সহিষ্ণু গমের জাত।
- ঈশ্বরদী ৩৩ ও ঈশ্বরদী ৩৫ খরা সহিষ্ণু আখের জাত।
গ) লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসল
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ততার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত সহিষ্ণু ফসল বা ফসলের জাতের আবাদ এলাকা বাড়াতে হবে।
লবণাক্ত মাটি থেকে ফসলের পানি সংগ্রহ করতে অসুবিধা হয়। লবণাক্ততার মাত্রা বেশি হলে ফসল জন্মাতে পারে না।
- উপকূলীয় লবণাক্ততা এলাকায় ধান প্রধান ফসল। ধানের কিছু স্থানীয় ও উন্নত জাত রয়েছে যারা বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। স্থানীয় জাতের মধ্যে রয়েছে-যাতা, রাজাশাইল, কাজলশাইল, বাজাইল, কালামানিক, গরচা, গাবুরা ইত্যাদি।
- বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে বেশ কিছু লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাতের ধান বের করেছে। যেমন- ব্রি ধান ৪০, ব্রি ধান ৪১, ব্রি ধান-৪৭, ব্রি ধান ৫৩, ও ব্রি ধান ৫৪।
- ২০০৪ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে লবণাক্ততা সহিষ্ণুজাতের আলু (বারি আলু ২২) বের হয়। এ জাতের আলুর আকার লম্বাটে গোল এবং লাল রঙের। জাতটির ফলন ২৫-৩০ টন/হেক্টর।
- বারি সরিষা-১০ জাতটি লবণাক্ততার পাশাপাশি খরাও সহ্য করতে পারে। এ জাতের সরিষার গাছ খাটো, উচ্চতা ৮০-১০০ সেমি, জীবনকাল ৮৫-৯০ দিন এবং ফলন ১.২-১.৪ টন/হেক্টর।
ঘ) বন্যা বা জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু ফসল
বাংলাদেশে প্রতিবছর কম-বেশি বন্যা হয়ে থাকে। বন্যাজনিত সাময়িক জলাবদ্ধতা ছাড়াও দেশের কিছু অঞ্চলে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
বন্যার কারনে বা অন্য কোনো কারনে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা, জলজ উদ্ভিদ ছাড়া বেশিরভাগ উদ্ভিদ সহ্য করতে পারে না।
- দেশের বিস্তৃত বন্যাপ্রবণ এলাকার প্রধান ফসল ধান। বন্যা সহিষ্ণু স্থানীয় জাতের গভীর পানির আমন ধানের মধ্যে রয়েছে- বাজাইল ও ফুলকড়ি। বন্যার পানির উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে এ সব জাতের ধান গাছের উচ্চতাও বাড়তে থাকে। এমনকি দিনে ২৫ সেমি পর্যন্ত বাড়তে পারে এবং ৪ মিটার গভীরতায়ও বেঁচে থাকতে পারে।
- উঁচু জাতের আমন ধানের মধ্যে আছে ব্রি ধান ৪৪। এ জাতের ধান জোয়ারভাটা অঞ্চলে ৫০ সেমি উচ্চতার প্লাবন সহ্য করতে পারে।
- বন্যাপ্রবণ এলাকার বন্যার পানি নেমে গেলে নাবী জাতের আমন ধান চাষ করে বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়। নাবী জাতের মধ্যে রয়েছে- বিআর ২২ (কিরণ) ও বিআর ২৩ (দিশারী)।
- কিরণ ও দিশারী জাত দুটো দেশের বন্যা প্রবণ এলাকায় বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর থেকে ১৫ আশ্বিন পর্যন্ত রোপণ করা যায়।
- জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে ৪০-৫০ দিনের চারাও রোপণ করা যায়। ফলে উঁচু জোয়ার থেকে ফসল বাঁচে। আমন মৌসুমে এ এলাকায় চাষাবাদের জন্য বের হওয়া জাত দুটি হলো-ব্রি ধান ৫১ ব্রি ধান ৫২।
- ঈশ্বরদী ৩২ জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু আখের জাত। বন্যা বা জলাবদ্ধতাসহিষ্ণু এ জাতটির ফলন হেক্টর প্রতি ১০৪ টন।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব pdf ফাইল ডাউনলোড করলাম এবং ফসলের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব; মাছের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব; পশুপাখির উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব; জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রেক্ষাপটে ফসলের অভিযোজন কলাকৌশল; জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রেক্ষাপটে মৎস্য ক্ষেত্রে অভিযোজন কলাকৌশল; জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পশুপাখির অভিযোজন কলাকৌশল; বিরূপ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সহিষ্ণু ফসল ও ফসলের জাত; প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলাম।
সর্বশেষে বলা যায়-
- দেশের খাদ্যভান্ডারে মজুদ বর্ধন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের শুধু মাত্র মৌসুম ভিত্তিক ফসল কিংবা অনুকূল পরিবেশে ফসল উৎপাদনের লক্ষমাত্রা নিয়ে বসে থাকলে চলবেনা। আগামীর সুনিশ্চিত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে একদিকে যেমন লবণাক্ত জমিকে চাষাবাদের আওতায় আনতে হবে, তেমনি বৈরি আবহাওয়াকে মোবাবেলার করার জন্যও শৈত্য সহিষ্ণ কিংবা খরা সহিষ্ণু নতুন ফসলের জাতের উন্নয়ন সাধন করতে হবে। আশার কথা আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে বেশ কিছু বৈরি আবহাওয়া উপযোগী ফসল কৃষকের মাঠ পর্যায়ে পৌছে গেছে। অদূর ভবিষ্যতে এ প্রচেষ্টা এক নতুন কৃষি বিল্পবের সূচনা করবে।
- আধুনিক পদ্ধতিতে পরিকল্পিতভাবে মৎস্য চাষের ফলে সামুদ্রিকভাবে মৎস্য উৎপাদন মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয় বৃদ্ধি পেলেও বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রবৃদ্ধি কাঙ্খিত পর্যায়ে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, ক্ষরা, বন্যা সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি জনিত জলবায়ু পরিবর্তন।
- তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও মানুষকর্তৃক পরিবেশ ধ্বংস জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। এদেশে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন- জলোচ্ছ্বাস, সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়, প্রবল বায়ুপ্রবাহ, বন্যা ও খরা ইত্যাদির কারণে অপুষ্টি, বিষক্রিয়া, রোগব্যাধিসহ পশুপাখির ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাছাড়া মৃত পশুপাখির কারণে পরিবেশেরও দুষণ ঘটে।
- প্রতিকুল পরিবেশে উদ্ভিদের/ফসলের অভিযোজন কৌশল বিভিন্ন নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত হয়। খরা, লবণাক্ততা বা তাপ পীড়ন প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন ফসল ভিন্ন ভিন্ন কৌশলন প্রয়োগ করে। উদ্ভিদের এ কৌশলের সাথে চাষিরাও যদি প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারে, তাহলে ফসল প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে কৃষির উৎপাদনকে সুনিশ্চিত করা যাবে।
- প্রতিকূল পরিবেশে বেচে থাকার জন্য কোনো জীবের বিভিন্ন ধরনের শরীরবৃত্তীয় ও জৈব রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কৌশলকে অভিযোজন বলা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৎস্য জীব বৈচিত্র ও উৎপাদনে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা কাটিয়ে উঠার জন্য মৎস্য অভিযোজন কলাকৌশলকে কাজে লাগাতে হবে।
- পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার কৌশলকে অভিযোজন বলে। হঠাৎ করে জলবায়ুর পরিবর্তন হলে মানুষ বুদ্ধির জোরে অভিযোজন করতে পারলেও নিরীহ পশুপাখি তা পারে না। তাই জলবায়ুর পরিবর্তন অর্থাৎ খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও ঘুর্ণিঝড় থেকে এদেরকে রক্ষার জন্য মানুষ নানা কলাকৌশল তৈরি করেছে। এগুলো ব্যবহার করে জলবায়ুর প্রভাব থেকে পশুপাখিদের রক্ষা করতে হবে।
[সূত্র: ওপেন স্কুল; ইন বাংলা নেট কৃষি (in bangla net krisi)]