বাংলাদেশে ডালফসল হিসেবে মসুর, মুগ, মাসকালাই, খেসারী, অড়হর, মটর, ছোলা ইত্যাদি। ডাল জাতীয় ফসল মানুষ ও গবাদিপশু, পাখির আমিষের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।
জাতীয় খাদ্য ও কৃষি সংস্থা FAO এর সুপারিশ অনুযায়ী দৈনিক ৫৮ গ্রাম ডাল শস্য খাওয়া উচিত। এসব গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এই পোষ্টটিতে ডাল ফসল কি, ডাল ফসল কাকে বলে, ডাল ফসল কোন মাটিতে ভালো হয় এবং মসুর ও মুগ ডাল চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
এ পাঠ শেষ অবধি পড়লে আপনি- ডাল ফসল কি, ডাল ফসল কাকে বলে, ডাল ফসল কোন মাটিতে ভালো হয় অর্থ্যাৎ ডাল চাষে কাঙ্খিত জলবায়ু সম্পর্কে জানতে পারবেন। মসুর ও মুগ ডাল চাষে জমি নির্বাচন করতে পারবেন। মসুর ও মুগ ডালের জাতের নাম বলতে পারবেন। মসুর ও মুগ ডাল চাষে সার প্রয়োগ সম্পর্কে জানতে জানতে। মসুর ও মুগের বপন পদ্ধতি শিখতে পারবেন। মসুর ও মুগ ডাল চাষ পদ্ধতি এবং আন্তঃপরিচর্যা সম্পর্কে অবগত পারবেন। মসুর ও মুগ ফসলের কর্তন, শুকানো ও মাড়াই সম্পর্কে ধারণা পারবেন; মসুর ও মুগ ফসলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে পারবেন।
(১) ডাল ফসল কি/কাকে বলে? ডাল ফসল কোন মাটিতে ভালো হয়?
ডাল ফসল কি/কাকে বলে: যে সমস্ত মাঠ ফসল খেলে আমিষজাতীয় খাবারের ঘাটতি পূরণ হয় তাদেরকে ডালজাতীয় ফসল (Pulse crops) বলা হয়। ডাল লিগুমিনোসী (Leguminosae) পরিবারের ফসল বিধায় এদেরকে লিগিউমজাতীয় ফসল বলা হয়।
ডাল ফসল কোন মাটিতে ভালো হয়: প্রায় সব ধরনের মাটিতেই ডাল ফসল চাষ করা যায়, তবে বেলে দোআঁশ বা দোআঁশ মাটিই এদের জন্য সবচেয়ে উত্তম।
সহজাতভাবে ডাল ফসল কম ফলনশীল এবং পর্যাপ্ত পরিচর্যায়ও তেমন সাড়া দেয় না। তাই দিন দিন এদেশে ডাল ফসলের চাষ কমে যাচ্ছে এবং ডালের চাহিদা মেটানোর জন্য তা আমদানি করতে হচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশে মোট উৎপাদিত ডাল ফসলের শতকরা ৮৩ ভাগই শীতকালীন ফসল, তবে মাসকালাই ও মুগডাল গ্রীস্মকালে চাষ হয়।
প্রতিটি মানুষের প্রতিদিন গড়ে কত কিলোক্যালরী শক্তি প্রয়োজন বিভিন্ন খাবারের সাথে আমিষও তা যোগায়। এই আমিষ সাধারণত দুটি উৎস থেকে মানুষ গ্রহণ করে একটি উদ্ভিদজাত এবং অন্যটি প্রাণীজ। প্রাণীজ আমিষ হলো মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি। এই প্রাণীজ আমিষের দাম বেশি বলে এদেশের সাধারণ গরীব মানুষ তুলনামূলকভাবে সস্তায় ডাল ক্রয় করতে পারে এবং তা খেতেও তারা স্বাচ্ছন্দবোধ করে। তাই সাধারণ মানুষ আমিষ খাবারের ঘাটতি ডাল ফসল থেকেই পূরণ করে বলে ডালকে গরীবের মাংস বলা হয়।
কোনো জমিতে ডাল ফসল চাষ করলে সেই জমিতে জৈব সার ও নাইট্রোজেন যোগ হয়ে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। প্রতি বছর ডাল ফসল হাজার হাজার টন বায়বীয় নাইট্রোজেন জমিতে যোগ করে যা অন্যান্য ফসলের ভালো ফলন পেতে সাহায্য করে। এতে কৃষকগণ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হোন।
ধান, গম বা আখের সঙ্গে ডালকে সাথী ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। এ ফসল চাষে উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে কম এবং এতে পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের উপদ্রব কম হয়।
ডালের উপজাত (যেমন-ভূষি) খুব ভালো পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এতে করে কম খরচে এদেশের গবাদিপশুর স্বাস্থ্য রক্ষার্থে ডালফসল গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে চাষ হয় এমন কয়েকটি ডালজাতীয় ফসলের বাংলা, ইংরেজি ও বৈজ্ঞানিক নাম উল্লেখ করা হলো-
বাংলা নাম | ইংরেজি নাম | বৈজ্ঞানিক নাম |
মসুর | Lentil | Lens culinaris |
মুগ | Green gram/Golden gram | Vigna radiata |
মাসকালাই | Black gram | Vigna mungo |
খেসারী | Grass pea | Lathyrus sativus |
অড়হর | Pigeon pea/Red gram | Cajanus cajan |
মটর | Field pea/Garden pea | Cajanus cajan |
ছোলা | Gram/Chick pea | Cicer arietinum |
শিম | Country bean | Dolichos lablab |
গোসীম | Cow pea/China pea | Vigna unguiculata |
বরবটি | Yard long bean | Vigna sinensis |
(২) মসুর ডাল চাষ পদ্ধতি
মসুরের ইংরেজি নাম Lentil এবং Lens culinaris হলো বৈজ্ঞানিক নাম।
মসুর অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার ও প্রিয় ডাল হিসেবে পরিচিত। এই ডালে আমিষের পরিমাণ শতকরা ২৫ ভাগ (প্রায়)। এই ডালের খোসা ও শুকনো গাছ গবাদি পশুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আমাদের দেশের মোট আবাদি জমির শতকরা ০.০৬ ভাগ জমিতে এ ডাল চাষ হয়। বাংলাদেশে মসুর মোট ডালের শতকরা প্রায় ২৬-২৮ ভাগ সরবরাহ করে। আবাদকৃত মোট জমি ও উৎপাদনের দিক থেকে এ ডাল দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের সব জেলাতেই কম বেশি মসুর ডালের চাষ হয়। তবে রাজশাহী, যশোর, পাবনা ও ফরিদপুর জেলা মসুর চাষে এগিয়ে রয়েছে।
মসুর ডাল চাষ পদ্ধতি নিম্নে বর্ণনা করা হলো।
ক) জলবায়ু
- বাংলাদেশে শীতকালে মসুরের চাষ হয়ে থাকে।
- মসুর সাধারণত: কম তাপমাত্রা (১৫- ২৮০ সে.) এবং শুষ্ক জলবায়ু পছন্দ করে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭৫-৮৫% এবং উজ্জ্বল সূর্যালোক প্রয়োজন হয়।
- সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৫ মিটার উঁচুতেও এ ফসল চাষ করা যায়।
- এ ফসল খরা সহিষ্ণু এবং অতিরিক্ত বৃষ্টি সহ্য করতে পারে না।
খ) মসুর ডাল ফসল কোন মাটিতে ভালো হয়?
- সব ধরনের মাটিতেই মসুর চাষ করা যায়। তবে সুনিষ্কাশিত বেলে দোআঁশ ও এটেল দোআঁশ মাটি মসুর চাষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী।
- মাটির পিএইচ বা অম্লমান ৬.৫-৭.৫ হলে ভালো হয়।
- চাষ করার পর জমিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হলে মসুর ভালো হয় না। তাই উঁচু জমি নির্বাচন করা উত্তম।
গ) জাত
বাংলাদেশে চাষকৃত মসুর ডালের মধ্যে বিনা মসুর ১, বিনা মসুর ২, বিনা মসুর ৩, বিনা মসুর ৪, বিনা মসুর ৫, বিনা মসুর ৬, বারি মসুর ১, বারি মসুর ২, বারি মসুর ৩, বারি মসুর ৪, বারি মসুর ৫, বারি মসুর ৬, বারি মসুর ৭, মুকদিয়া ১৫ ও জামালপুর ২ জাত উল্লেখযোগ্য। এদের জীবনকাল ৯৫-১৩৫ দিন। এরা তুলনামূলকভাবে উচ্চ ফলনশীল, বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধী ও বেশি আমিষ সমৃদ্ধ এবং এদের বীজ আকার বড় হয়।
ঘ) বপন সময়
মধ্য আক্টোবর থেকে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত বীজ বপনের উপযুক্ত সময় ধরা হয়। এর কিছুটা আগে বা পরে বীজ বপন করলে কাঙ্খিত ফলনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে।
ঙ) জমি তৈরি
- মসুর বীজ আকারে ছোট হওয়ায় সাধারণত: ৩-৪ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও সমতল করে জমি তৈরি করতে হয়।
- জমি তৈরির সময় আগাছা ও বিভিন্ন আবর্জনা পরিস্কার করতে হয় এবং সম্ভব হলে তা পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে জমিতে জৈব সার যোগ হয়।
- এ ফসল জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না বিধায় জমি তৈরির সময় এমনভাবে নালা কেটে রাখতে হবে যাতে বৃষ্টির সময় পানি সহজেই জমি থেকে বের হয়ে যেতে পারে।
চ) সার প্রয়োগ
- মসুর চাষে হেক্টর প্রতি ৪৫ কেজি ইউরিয়া, ৮৫ কেজি টিএসপি বা ডিএপি এবং ৩৫ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হয়।
- জমি তৈরির শেষ চাষের সময় ইউরিয়া ছাড়া সব সার ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়।
- ইউরিয়া সার তিনভাগ করে প্রথম ভাগ চারা গজানোর ১৫-২০ দিন পর, দ্বিতীয় ভাগ ৩০-৪০ দিন পর এবং ৩য় ভাগ ৫০-৬০ দিন পর ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হয়। তবে পচা গোবর, কম্পোস্ট, খামারজাত সার ও জীবাণু সার এদের যে কোন একটি প্রয়োগ করলে ইউরিয়া সার লাগবে না।
- জীবানু সার প্রয়োগের পূর্বে এক কেজি মসুর বীজের সাথে ৫০ গ্রাম জীবাণু সার ও ৫০ গ্রাম চিটাগুড় মিশাতে হয়।
ছ) বীজ হার
ছিটিয়ে বপন করলে হেক্টর প্রতি ৩৫-৪০ কেজি এবং সারিতে বপন করলে ৩০-৩৫ কেজি বীজ লাগে। তবে বিলম্বে বপন করলে বীজহার ৫-১০ কেজি বেশি লাগতে পারে।
জ) বীজ শোধন
প্রতি কেজি শুকনো মসুর বীজ ২ গ্রাম ‘ভিটাভেক্স-২০০’ এর সাথে বা অন্য কোন বীজ শোধকের সাথে মিশিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হয়। এতে করে মসুর ফসল বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা পায়।
ঝ) বপন পদ্ধতি
ছিটিয়ে বা সারি উভয় পদ্ধতিতে মসুর বীজ বপন করা যায়। সারিতে বীজ বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০ সে.মি. এবং সারিতে বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ১০ সে.মি. দেয়া যেতে পারে। সাধারণত: মসুর বীজ ১.৫-২.৫ সে.মি. গভীরে বপন করতে হয়। তবে বপনের এই গভীরতা মাটিতে বিদ্যমান রসের ওপর নির্ভর করে।
ঞ) আন্তঃপরিচর্যা
- আগাছা দমন: মসুরের ক্ষেতে বিভিন্ন ধরনের আগাছা যেমন- বথুয়া, চাপড়া, দূর্বা, মুথা ইত্যাদি জন্মায়। এ সমস্ত আগাছা চারা গজানোর ২০-৩০ দিন পর নিড়ানী দিয়ে দমন করতে হয়।
- সেচ ও নিকাশ: এ ফসল খরা সহিষ্ণু বিধায় খুব একটা সেচের প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া মসুর গাছ গভীরমূলী হওয়ায় মাটির নীচ থেকে পানি টেনে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। বীজ বপনের সময় মাটিতে রস না থাকলে বপনের পর হালকা সেচ দিলে চারা গজাতে সহজ হয়। এছাড়াও মসুর ফসলের বৃদ্ধির সময় হালকা সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। অতিরিক্ত বৃষ্টি বা অন্য কোন কারণে জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হয়।
- পোকা দমন: মসুর ফসলে জাব পোকা, ফলছেদক পোকা, শুসরী পোকা, থ্রিপস, পাতার উইভিল, সবুজ গান্ধী পোকা ও কাটুই পোকার আক্রমণ হয়। এগুলোর মধ্যে জাব পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে থাকে। পূর্ণ বয়স্ক জাবপোকা মসুরের কচি পাতা, কান্ড, পুষ্পমঞ্জরী ও শুটি থেকে রস শুষে খায়। ফলে গাছের পাতা কুঁকড়ে যায় ও বৃদ্ধি কম হয়। পড বা শুঁটি বের হয় না। বের হলেও সুস্থ ও সবল বীজ পাওয়া যায় না। ডিটারজেন্ট পাউডার পানির সাথে মিশিয়ে হলুদ পাত্র দিয়ে ফাঁদ তৈরি করে বা অনুমোদিত কোনো কীটনাশক স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়।
- রোগ দমন: অনেক রোগ আছে যেগুলো মসুর গাছের ক্ষতি করে থাকে। যেমন- মুল ও গোড়া পচা রোগ, মরিচা রোগ, ঢলে পড়া রোগ ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে মুল ও গোড়া পচা রোগ উল্লেখযোগ্য। এ রোগে কম বয়সেই চারা হঠাৎ নেতিয়ে পড়ে মারা যায়। নেতিয়ে পড়া চারা শুকিয়ে খড়ের মতো আকার ধারণ করে। অনেক সময় চারার গোড়ায় সূতার মতো মাইসেলিয়াম দেখা যায়। মুল আক্রান্ত হলে গাছ ছোট হয় এবং ঢলে পড়ে মারা যায়। এ রোগে আক্রান্ত গাছ জমিতে দেখা গেলে তা তুলে পুড়িয়ে ফেলাই উত্তম।
ট) ফসল কর্তন, শুকানো ও মাড়াই
- মসুর গাছের পড বা শুটি কালো এবং দানা বাদামি রং ধারণ করলে পরিপক্ক হয়েছে ধরে নিতে হয়।
- শতকরা ৮০ ভাগ পড বা ফল পরিপক্ক হলে জমি থেকে ফসল সংগ্রহ করতে হয়। বেশি পরিপক্ক বা শুকালে দানা ঝরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- হাত দিয়ে টেনে গাছ তুলতে হয়। এরপর পরিস্কার স্থানে পলিথিন শীট বিছিয়ে বা পাকা মেঝেতে গাছ ভালোভাবে শুকিয়ে নিয়ে লাঠি দ্বারা আঘাত করে গাছ থেকে দানা আলাদা করা হয় এবং কুলার সাহায্যে পরিস্কার করতে হয়।
- বীজকে রোদে এমনভাবে শুকাতে হয় যেন বীজে আর্দ্রতা ৮-১০% এর বশি না থাকে।
ঠ) ফলন
১.৮-২.২ টন/হেক্টর।
(৩) মুগ ডাল চাষ পদ্ধতি
মুগের ইংরেজি নাম Greengram এবং Vigna radiata এর বৈজ্ঞানিক নাম।
মুগ ডাল খেতে মজা হওয়ায় এটা খুবই জনপ্রিয়। এমনকি দেশের কোন কোন অঞ্চলে এ ডালকে ‘জামাই ডাল’ বলা হয়। সারাদেশেই এ ডালের সামাজিক কদর রয়েছে। অন্যান্য ডালের চেয়ে এ ডালের দাম তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। বাংলাদেশে এ ডালের আওতাধীন জমির পরিমাণ কম হলেও বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলে এর আবাদ বেশি হয়ে থাকে।
সবুজ অবস্থায় মুগ ফসল পশুখাদ্য ও সবুজ সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ ডালে ২৫% আমিষ, ৬২.৬% শর্করা, ১.১৫% স্নেহ, প্রচুর পরিমাণে রিবোফ্লোবিন ও থায়ামিন রয়েছে। অঙ্কুরিত মুগডাল ভিটামিন সি এর কার্যকরী উৎস।
মুগ ডাল চাষ পদ্ধতি নিম্নে বর্ণনা করা হলো।
ক) জলবায়ু
- মুগ চাষের জন্য কাঙ্খিত তাপমাত্রা হলো ২৫-৩০ ডিগ্রি সে.। সর্ব নিম্ন গড় তাপমাত্রা ২০-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও চাষ সম্ভব। তবে ২০০ সে. এর নিচে তাপমাত্রা হলে এ ফসলের বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
- আশানুরূপ ফলনের জন্য গড় তাপমাত্রা ২৮-৩১ ডিগ্রি সে. হলে ভালো হয়।
- বাতাসের আপেক্ষিক আদ্রতা শতকরা ৮০- ৮৫ ভাগ, হালকা বৃষ্টিপাত ও উজ্জ্বল সূর্যালোক মুগ চাষের জন্য উপযোগী।
খ) মুগ ডাল ফসল কোন মাটিতে ভালো হয়?
সুনিষ্কাশিত সব ধরনের মাটিতেই মুগ চাষ করা যায়। তবে দোআঁশ মাটি উত্তম। উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি চাষের জন্য উপযোগী। মাটির পিএইচ বা অম্লমান ৬-৭ হলে ভালো হয়।
গ) জাত
মুগের বিভিন্ন জাত রয়েছে। যেমন- বারিমুগ ১, বারিমুগ ২, বারিমুগ ৩, বারিমুগ ৪, বারিমুগ ৫, বারিমুগ ৬, বিনামুগ ১, বিনামুগ ২, বিনামুগ ৩, বিনামুগ ৪, বিনামুগ ৫, বিনামুগ ৬, বিনামুগ ৭ ও বিনামুগ ৮। এ সমস্ত জাতগুলো বিভিন্ন রোগ সহনশীল। এরা উচ্চ ফলনশীল জাত। এদের বীজ ও পডের আকার বড় হয়। অধিকাংশ জাতই সারা বছরব্যাপী চাষ করা যায়।
ঘ) বপন সময়
- মুগ ডাল সারা বছর অর্থ্যাৎ রবি, খরিফ ১ ও খরিফ ২ এই তিন মৌসুমেই চাষ করা যায়।
- রবি মৌসুমে পৌষ-মাঘ মাসে, খরিফ ১ মৌসুমে ফাল্গুন মাসে ও খরিফ ২ মৌসুমে শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে মুগ আবাদ করা যায়।
- তবে রবি মৌসুম উত্তম। কারণ এই মৌসুমে বেশি ফলন পাওয়া যায়।
- খরিফ ২ মৌসুমের চেয়ে খরিফ ১ মৌসুমে ফলন বেশি হয়।
ঙ) জমি তৈরি
- ৩-৪ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে সমান করে নিতে হয়।
- আগাছা ও ময়লা-আবর্জনা থাকলে পরিস্কার করে তা একসাথে পুড়িয়ে দিলে জমিতে জৈব সার যোগ হয়।
- মাটির উপরের স্তরে পর্যাপ্ত রস থাকলে বিনা চাষেও বা ২-১ টি চাষ দিয়েও মুগ আবাদ করা সম্ভব।
চ) সার প্রয়োগ
- প্রতি হেক্টর মুগ জমিতে ৪৫ কেজি ইউরিয়া, ১০০ কেজি টিএসপি ও ৫৮ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হয়।
- ইউরিয়া ছাড়া সব সার জমি তৈরির সময় শেষ চাষের সাথে ছিটিয়ে দিতে হয়।
- ইউরিয়া সার তিনভাগ করে ১ম ভাগ চারা গজানোর ১৫ দিন পর, ২য় ভাগ ৩০ দিন পর এবং ৩য় ভাগ ৪০ দিন পর ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হয়।
- রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া বায়ু থেকে মুক্ত নাইট্রোজেন সংযোজন করে মুগ গাছের শিকড়ে গুটি (nodule) তৈরি করে বিধায় মুগ ফসলে ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করলেও চলে।
ছ) বীজহার
বীজের আকার ও বপন পদ্ধতি অনুযায়ী বীজের পরিমাণ ভিন্ন হয়ে থাকে। ছিটিয়ে বপন করলে হেক্টর প্রতি ৪৫-৫০ কেজি এবং সারিতে বপন করলে ৩০-৩৫ কেজি বীজ লাগে।
জ) বীজ শোধন
অনেক রোগ আছে যা বীজবাহিত। এই বীজবাহিত রোগ জীবাণুকে মুক্ত করার জন্যই বীজ শোধন করতে হয়। এক কেজি মুগ বীজের সাথে ৩ গ্রাম ‘ভিটাভেক্স-২০০’ বা অন্য কোন বীজশোধক অনুমোদিত মাত্রায় বীজের সাথে মিশিয়ে বীজ শোধন করা হয়।
ঝ) বপন পদ্ধতি
- ছিটিয়ে বা সারিতে উভয় পদ্ধতিতে মুগ বীজ বপন করা যায়।
- সারিতে বপন করলে সারি থেকে সারির দূরত্ব রবি মৌসুমে ৩০ সে.মি. ও খরিফ মৌসুমে ৪৫ সে.মি. এবং সারিতে বীজ থেকে বীজের দূরত্ব ৮-১০ সে.মি. দিতে হয়।
- সারিতে বপন করলে বীজের পরিমাণ কম লাগবে এবং ফলন বেশি হবে। এছাড়াও আগাছা দমনসহ বিভিন্ন প্রকার পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।
- ৩-৫ সে.মি. মাটির নিচে বীজ বপন করতে হয়।
ঞ) আন্তঃপরিচর্যা
- আগাছা দমন: মুগ জমিতে মুথা, বথুয়া, চাপড়া, দূর্বা ইত্যাদি আগাছা জন্মাতে দেখা যায়। মুগের চারা গজানোর পর এ আগাছাগুলো নিড়ানী দিয়ে ২-৩ বার পরিষ্কার করা উচিত। এতে মুগের ফলন বেশি হয়।
- সেচ ও নিকাশ: মুগ চাষের জমিতে রস কম থাকলে বপনের সময় বীজের অঙ্কুরোদগম নিশ্চিত করার জন্য হালকা সেচ দিতে হয়। এছাড়াও গাছের দৈহিক বৃদ্ধির সময় সেচ দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। মুগ কিছুটা খরা সহিষ্ণু ফসল। কারণ গভীরমূলী হওয়ায় মাটির নিচ থেকে পানি শোষণ করে নিতে পারে। বৃষ্টি বা অন্য কোন কারণে জমিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হলে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। জলাবদ্ধতা ও অতিরিক্ত খরা উভয়ই মুগের জন্য ক্ষতিকর।
- পোকা দমন: মুগ ফসলে বিছাপোকা, ফলছেদক পোকা ও জাব পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। বিছাপোকা কচি ডগা খায় ও পাতা খেয়ে জালের মত করে ফেলে। ফলছেদক পোকা কচি ও পরিপক্ক ফল ছিদ্র করে খায়। জাবপোকা গাছের কচি অংশ থেকে রস শোষণ করে খায়। এতে করে মুগের ফলন কম হয়। বিছাপোকা দলবদ্ধভাবে পাতায় থাকে বিধায় আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে এ পোকা মেরে ফেলা উচিত। এছাড়া অনুমোদিত কীটনাশক স্প্রে করে বর্ণিত পোকাগুলো দমন করা যায়।
- রোগ দমন: অনেক রোগ দেখা যায়। এর মধ্যে হলুদ মোজাইক, পাতার দাগ রোগ ও পাউডারি মিলডিউ রোগ গুরুত্বপূর্ণ। হলুদ মোজাইক রোগে পাতার উপর গাঢ় সবুজ ও হলুদ রংয়ের মিশ্রণ দেখা যায়। ফুল ও ফল কুঁকড়ে যায়, বীজ অপুষ্ট কুকড়ানো হয় এবং গাছ খাটো হয়। পাতার দাগ রোগে পাতার উপর পানিভেজা ছোট ছোট দাগ পড়ে, দাগগুলো বাদামি বা লালচে বাদামি হয়ে আস্তে আস্তে বড় হয় এবং পাতা ঝড়ে পড়ে। পাউডারি মিলডিউ রোগে পাতার উপর সাদা পাউডারের মত ছোট ছোট দাগ পড়ে এবং পরে এই দাগগুলো কালো বা গাঢ় বাদামি রংয়ের দাগে পরিণত হয়। হলুদ মোজাইক রোগ ভাইরাস দ্বারা এবং পাতার দাগ ও পাউডারি মিলডিউ রোগ ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে। রোগ প্রতিরোধী জাত, বীজশোধক ও অনুমোদিত রোগনাশক ব্যবহার করে এ সমস্ত রোগের আক্রমণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
ট) ফসল কর্তন, শুকানো ও মাড়াই
- শুটি কালো বর্ণ ধারণ করলে ও নিচের পাতা হলুদাভ হলে মুগ পরিপক্ক হয়েছে বুঝতে হবে। এছাড়া শতকরা ৮০ ভাগ দানার বর্ণ বাদামি হলেও বুঝতে হবে মুগ পরিপক্ক হয়েছে।
- বেশি পরিপক্ক হলে বা শুকালে দানা ঝরে পড়ে। তাই কাঙ্খিত সময়ে গাছ জমি থেকে হাত দিয়ে টেনে তুলতে হয়। এরপর মাটির উপর পলিথিন শীট বা পাকা মেঝেতে গাছগুলো শুকিয়ে নিয়ে লাঠি দ্বারা আঘাত করে দানাগুলো আলাদা করা হয়। এরপর কুলা দিয়ে তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়।
- সংরক্ষণের পূর্বে দানাগুলো রোদে এমনভাবে শুকাতে হয় যাতে দানাতে ৮-১০% এর বেশি আর্দ্রতা না থাকে।
ঠ) ফলন
০.৯-২.০ টন/হেক্টর।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা আলোচ্য বিষয় ডাল ফসল কি? ডাল ফসল কাকে বলে? ডাল ফসল কোন মাটিতে ভালো হয়? মসুর ডাল চাষ পদ্ধতি এবং মুগ ডাল চাষ পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানলাম।
যে সমস্ত মাঠ ফসল খেলে আমিষজাতীয় খাবারের অভাব দূর হয়, তাদেরকে ডালজাতীয় ফসল বলা হয়। যেমন-মসুর, মুগ, মাষকালাই, খেসারী, ছোলা, মটর ইত্যাদি। এরা লিগুমিনোসী পরিবারের ফসল বিধায় এদেরকে লিগিউমজাতীয় ফসল বলা হয়। রাইজোবিয়াম ব্যাকটেরিয়া বাতাসের মুক্ত নাইট্রোজেন গ্রহণ করে এজাতীয় ফসলের মুলে নডিউল সৃষ্টি করে। এতে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।
মসুর ও মুগের ইংরেজি নাম যথাক্রমে Lentil ও Greengram এবং বৈজ্ঞানিক নাম যথাক্রমে Lens culinaris ও Vigna radiata।
মসুর সাধারণত কম তাপমাত্রা ও শুষ্ক জলবায়ু পছন্দ করে। এরা খরা সহিষ্ণু এবং বেশি বৃষ্টিপাত সহ্য করতে পারে না। বাংলাদেশে বিনা মসুর ১ থেকে ৭ বারি মসুর ১ থেকে ৭, মুকদিয়া ও জামালপুর ২ জাত উল্লেখযোগ্য। ফলে হেক্টরপ্রতি ১.৮-২.২ টন হয়ে থাকে।
অপরদিকে মুগ ২৫-৩০ সে. তাপমাত্রায় ভালো জন্মায়। হালকা বৃষ্টিপাত ও উজ্জ্বল সূর্যালোকে মুগ চাষের জন্য বেশ ভালো। এদেশে বারিমুগ ১ থেকে ৬, বিনা মুগ ১ থেকে ৮ চাষ হয়ে থাকে। বেশির ভাগ জাতই সারা বছর চাষ করা যায়। ফল প্রতি হেক্টরে ০.৯-২.০ টন হয়ে থাকে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।