Skip to content

তুলা গাছ ও তুলা চাষ পদ্ধতি

তুলা গাছ ও তুলা চাষ পদ্ধতি

আলোচ্য বিষয়:

বস্ত্রের প্রধান কাঁচামাল হলো তুলা।

তুলা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ আঁশ জাতীয় ফসল, বাংলাদেশে তুলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বস্ত্রখাতে ব্যবহৃত আঁশের ৭০-৭৫% আসে তুলা থেকে। ২০২০ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পে বর্তমানে ৫৪ লাখ বেল তুলার প্রয়োজন যার মাত্র ৩% দেশে উৎপন্ন হয়। এ চাহিদা পুরণের জন্য বিদেশ থেকে তুলা আমদানি করতে হয়। তাই বাংলাদেশে তুলা উপযোগী অঞ্চলে আধুনিক পদ্ধতিতে তুলা চাষ করে তুলার চাহিদা পূরণের চেষ্টা করা প্রয়োজন।

এ পাঠটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- তুলা গাছ, তুলা চাষের জন্য উপযোগী জমি ও আবহাওয়া সম্পর্কে  অবগত হতে পারবেন; তুলা চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সার এর মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারবেন; তুলা সংগ্রহ ও তুলার প্রক্রিয়াজাতকরণের পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে পারবেন; তুলা চাষ পদ্ধতি শিখতে পারবেন।

(১) তুলা গাছ

চিত্র- তুলা গাছ
চিত্র- তুলা গাছ
চিত্র- তুলা গাছের বাহ্যিক অঙ্গসংস্থান
চিত্র- তুলা গাছের বাহ্যিক অঙ্গসংস্থান

(২) তুলা চাষ পদ্ধতি

ক) মাটি ও জলবায়ু

  • তুলা উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া পছন্দ করে। চারাগাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য ২৪-৩৩ সে. তাপমাত্রা উপযোগী তুলাগাছ অতিবৃষ্টি সহ্য করতে পারে না। বার্ষিক ১০০ সে.মি. বৃষ্টি তুলার জন্য উত্তম।
  • সবধরনের মাটিতেই তুলাগাছ জন্মে। তবে বৃষ্টি পানি জমে থাকে না এমন উঁচু জমি ভাল, দোঁআশ ও বেলে দোঁআশ মাটি তুলা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
  • মাটির পিএইচ ৬-৭.৫ হলে ভাল হয়।

খ) জমি তৈরি

তুলা চাষের জন্য জমি গভীরভাবে চাষ করতে হবে কারণ তুলা গাছের মূল মাটির অনেক গভীরে প্রবেশ করে। সেজন্য জমি ৬-৮টি গভীর চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও সমান করে নিতে হবে যেন কোথায় পানি জমতে না পারে।

গ) বীজ বপনের সময়

রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমেই বীজ বপন করা যায়।  রবি মৌসুম: মধ্য শ্রাবণ-ভাদ্র মাস, খরিফ মৌসুম: জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় মাস।

ঘ) বীজের হার

শতকরা ৮০ ভাগ বা তার অধিক অংকুরোদগম ক্ষমতা সম্পন্ন ৮-১০ কেজি/হেক্টর বীজ প্রয়োজন, বীজবাহিত রোগ দমনের জন্য ভিটাডেক্স-২০০/পেনকোজে দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে। [২-৩ গ্রাম/কেজি বীজ]

ঙ) বীজ প্রক্রিয়াজাত করণ

তুলাবীজ থেকে অতিরিক্ত তুলা (ফাজ) সরানোর কয়েকটি পদ্ধতি আছে।

  1. শারীরিক পদ্ধতি (Phsical Meltod): শুকনো গোবর অথবা ছাই দিয়ে ঘষে বীজ থেকে আঁশগুলো সেিয় ফেলা হয়। 
  2. যান্ত্রিক পদ্ধতি (Mechanical Method): বিশেষ একধরণের যন্তের সাহায্যে তুলাবীজ থেকে আঁশ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
  3. রাসায়নিক পদ্ধতি (Chemical Method): এই পদ্ধতিতে HCl, H2SO4 ব্যবহার করে তুলাবীজ আঁশ মুক্ত করা হয়। বীজ বপন পদ্ধতির তুলাবীজ সারিতে বপন করা হয়। সারি থেকে সারি দূরত্ব: ৯০-১০০ সে.মি. গাছ থেকে গাছ দূরত্ব: ৪৫-৫০ সে.মি. নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্তে ১-২ সে.মি. গভীর ৩-৪টি বীজ বপন করা হয়।

চ) তুলার জাত

তুলার বিভিন্ন জাত উদ্ভাবিত হয়ে যেমন: সিবি-১, সিবি-২, সিবি-৩, সিবি-৫, সিবি-৯, সিবি-১০, সিবি-১২, সিবি-১৩, সিবি-১৪, শুভ্র, হীরা হাইব্রিড, রূপালী-১, ডিএম-২, ৩, পাহাড়ি তুলা-১ ও পাহাড়ি তুলা-২, এই জাতগুলোর মধ্যে ৫টি জাতের কিছু বৈশিষ্ট্য নিচের সারণীতে দেওয়া হল।

জাত জীবনকাল (দিন) ফলন (টন/হেক্টর) বিশেষ বৈশিষ্ট্য
সিবি-১ (ডেল্টা পাইন-১০)১৭০-১৮০১.৮-২-১বেশি আঁশ হয় 
সিবি-৩ (ডেল্টাপাইন-৫০) ১৬০-১৭০ ২.০-২-৩ ব্লাইট রোগ প্রতিরোধী
সিবি-৫১৮০-১৯৫ ১.৮-২.০ শুয়াযুক্ত, আঁশবেশী
সিবি-৯১৮০-১৫ ২.১-২.৪ শুয়াযুক্ত, বোল সাইজ বড়
সিবি-১০ ১৫০-১৬০১.৬-১.৮আগাম ফসল তোলা যায়

ছ) সার প্রয়োগের পরিমাণ

সার প্রয়োগের অধিক ফলন পেতে হলে এবং উন্নত মানের আঁশ এর জন্য সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। নিচে তুলা চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সারের নাম ও পরিমাণ উল্লেখ করা হল।

সারের নামসারের পরিমাণ (হেক্টর প্রতি)
১। জৈব সার/গোবর৫-৬ টন
২। ইউরিয়া২০০-২৫০ কেজি
৩। টি এস পি১৫০-১৭৫ কেজি
৪। এমপি১৫-১৭৫ কেজি
৫। জিপসাম৮০-১০০ কেজি
৬। জিঙ্ক সালফেট১০-২০ কেজি
৭। বোরাক্স১০-২০ কেজি
৮। ডলোচুন [অম্লিয় মাটিতে]২-৩ টন

জ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি

জমিতে শেষ চাষ দেয়ার পর এক-চতুর্থাংশ ইউরিয়া অর্ধেক এমপি সার এবং অন্যন্য সারসমূহ সম্পূর্ণ অংশই জমিতে প্রয়োগ করতে হবে; বাকী ইউরিয়া ও এমপি সার সমান তিনভাগে ভাগ করে তুলাগাছের বয়স ২০-২৫ দিন হলে প্রথম বার, ৪০-৫০ দিন হলে দ্বিতীয় বার এবং ৬০-৭০ দিন হলে তৃতীয় বার পাশর্^ প্রয়োগ করতে হবে।

ঝ) আন্তঃপরিচর্যা

  1. চারা পাতলাকরণ: চারা গজানোর ২০ দিন পর একটি সুস্থ ও সবল চারা রেখে অবশিষ্ট চারাগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে।
  2. আগাছা দমন: প্রয়োজন অনুযায়ী ২-৩ বার আগাছা দমন করতে হবে। এসময় আগাছা দমনের সাথে সাথে গাছের গোড়া ও সারির মাঝের মাটির আলগা করে দিতে হবে।
  3. সেচ ও নিকাশ: তুলা চাষের জন্য প্রায় ৭০-৯০ সেমি পানি প্রয়োজন। তাই মাটিতে রস না থাকলে সাথে সাথে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে জলাবদ্ধতা যেন সৃষ্টি না হয় সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। পানি যেন না জমতে পারে সেজন্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখতে হবে।

ঞ) পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা

তুলা ফসলে বিভিন্ন পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়ে থাকে। নিচের তালিকায় কিছু অনিষ্টকারী পোকার নাম ও দমন ব্যবস্থা দেয়া হল।

পোকার নামকীটনাশকের নাম
ক) রস শোষণকারী পোকা: জাব পোকা, জ্যাসিড, সাদামাছি, থ্রিপস, লাল গান্ধি পোকা।সাকসেস’ ১.৫ গ্রাম/লি পানি, ‘টাকগর ৪০ ইসি’-২ মিলি/লি পানি, ‘কার্বোসালফার ২০’।
খ) চর্বনকারী পোকা: বোলওয়ার্ম, লিফ রোলার,সেমিলূপার।রিপকর্ড’, ‘সিন্বুস’, ‘ডেসিস’, ‘সুমিডাইডিন’।

ট) রোগ ব্যবস্থাপনা

প্রধান রোগ হলে অ্যানথ্রাকনোজ, ড্যাম্পিং অফ বা ঢলে পড়া রোগ ইত্যাদি। এসব রোগ দমনের জন্য ‘ভিটাভেক্স ২০০’, ‘কিউপ্রভিট/ডাইমেন এম ৪৫’, ‘টিল্ট’ ইত্যাদি ঔষধ ব্যবহার করতে হবে।

ঠ) তুলা সংগ্রহ

অধিক ফলন ও ভালমানের আঁশ পেতে হলে তুলা সংগ্রহের সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।

  • শুধুমাত্র পরিপক্ক বল থেকে তুলা সংগ্রহ করতে হবে বল ফেটে তুলা বের হলেই বল পরিপক্ক হয়েছে বুঝতে হবে। বল ফেটে তুলা বের হলেই বল পরিপক্ক হয়েছে বুঝতে হবে।
  • সাধারণ বীজ বপনের ৫-৬ মাস পর তুলা সংগ্রহ করা যায়। ফুল ফোটার ৫০-১০০ দিনের মধ্যে বল পরিপক্ক হয়। 
  • বল পরিপক্ক হলে দেরি না করে সংগ্রহ করে ফেলতে হবে তা না হলে তুলায় ময়লা লেগে তুলা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
  • তিনবার তুলা সংগ্রহ করতে হয়। যখন ৩০-৪০% বল ফেটে যায় তখনই প্রথমবারের মত তুলা সংগ্রহ করতে হবে। এরপর ১৫-২০ দিন পর পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কিস্তিতে বাকী সব তুলা সংগ্রহ করতে হবে।
  • বল সংগ্রহের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন কোন ধূলাবালি, ময়লা বা শুকনা পাতা বলের সাথে লেগে না থাকে।
  • রোগ বলা দ্বারা আক্রান্ত বল এবং ভাল তুলা আলাদা ভাবে উঠাতে হবে। তুলা ৩-৪ বার রোদে শুকিয়ে গুদাম জাত করতে হবে।
  • খারাপ ও নষ্ট বীজতুলা আলাদাভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
  • তবে ফাটা বল প্রায় এক সপ্তাহ গাছে রেখে শুকাতে পারলে আঁশ গুণগতমান আরও উন্নত হয়।

ড) তুলা সংগ্রহের সময় 

রৌদ্র উজ¦ল দিন তুলা সংগ্রহ করতে হয়। সাধারণত রবি মৌসুমে তুলা কার্ত্বিক-অগ্রাহায়ণ মাসে এবং খরিফ মৌসুমের তুলা ফাল্গুন-চৈত্র মাসে সংগ্রহ করা হয়।

ঠ) ফলন 

হেক্টর প্রতি ১.৩-১.৬ টন (Ginning and Bailing)।

(৩) তুলা চাষে জিনিং, গাট বাধা, জিওটি, কাউন্ট ও বীজ সংরক্ষণ

বীজতুলা: তুলার বল থেকে যে তুলা পাওয়া যায় তাকে বীজতুলা বলে। এখানে বীজ ও তুলা একসাথে থাকে।

জিনিং: জিনিং (Ginning) শব্দের অর্থ হলো বীজ তুলা থেকে বীজ আলাদা করা।

সাধারণত মেশিনের মাধ্যমে জিনিং করা হয়। মেশিনগুলো হল রোলার (Roller) জিনিং করা হয়। মেশিনগুলো হল (Roller) জিন এবং ‘স’ (Saw) জিন।

লিন্ট: জিনিং করার পর যে তুলা পাওয়া যায় (বাণিজ্যিক তুলা) তাকে লিন্ট (Lint) বলে।

ফাজ: বীজতুলা থেকে আঁশ হাড়িয়ে নেয়ার পরও বীজের গায়ে যে ছোট ছোট আঁশ লেগে থাকে তাকে ফাজ বলা হয়।

তুলা বীজ: জিনিং এর পর যে বীজ পাওয়া যায় তাকে তুলা বীজ বলে।

তুলার বেল বা গাঠ বাঁধা: শুষ্ক তুলার ৮% বা তার কম আর্দ্রতা থাকে। জিনিং করার পর প্রাপ্ত তুলাকে বেল প্রেসের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে বেল বা গাঠ বাঁধা হয়।

জিনিং আউট টার্ণ (Ginning out turn): জিনিং আউনট টার্ণ বলতে কোন তুলার জাতের বীজতুলার আঁশ ও বীজের অনুপাতকে বোঝায়, অন্যভাবে বলা যায়। বীজতুলায় শতকরা কতভাগ আঁশ বের করা যায় তাকেই জিনিং আউট টার্ণ বলে। বা জিওটি (GOT)। একটি তুলারজাতের GOT ৩৫% এর অর্থ হল ঐ জাতের ১০০০ কেজি বীজতুলা জিনিং করলে ৩৫ কেজি আঁশ বা লিণ্ট পাওয়া যায়।

জিওটি = (আঁশ × ১০০) ÷  বীজতুলা

কাউন্ট সংখ্যা (Count Number): ১ পাউন্ড তুলার নমুনা থেকে তৈরি করা ৮৪০ গজ ( বা ৭৬৮ মিটার) দৈর্ঘ্যরে সুতা দিয়ে যে কয়টি মোড়া (Hank) তৈরি করা যায় তার সংখ্যাকে ঐ তুলার কাউন্ট সংখ্যা বলা হয়। বাজারে একে ৪০, ৬০, ৮০, ১০০ এবং ২০০ পর্যন্ত কাউন্টের সুতা হিসাবে অভিহীত করা হয়। তুলার কাউন্ট সংখ্যা যত বেশি হবে তার থেকে তৈরি কাপড় তত বেশি মসৃণ, সিল্কের মত ও দামী হবে। মসলিন কাপড়ের সুতা এত মসৃন ও সুষ্ট ছিল যে মাত্র ৫০০ গ্রাম তুলা থেকে প্রায় ৪০০ মিটার দীর্ঘ সুতা তৈরি করা যেত।

তুলা বীজ সংরক্ষণ: তুলা গাছের মাঝের ও নিচের দিকের পরিপক্ক বল থেকে যে তুলাবীজ সংগ্রহ করা হয় তার গুণগত মান সবচেয়ে ভাল, বীজ থেকে আঁশ হাড়িয়ে নেওয়ার পর ২-৩ দিন এই বীজ ভালভাবে রোদে শুকাতে হবে যখন বীজের আদ্রতা ৭-৮% হবে তখন শুকানো বীজগুলোর ছায়ায় ঠান্ড করে বায়ুরোধক কোন পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।

(৪) তুলার ব্যবহার

তুলা একটি অতি প্রয়োজনীয় আঁশ জাতীয় ফসল। নীচে এর কিছু ব্যবহার উল্লেখ করা হলো-

  • তুলা সুতা ও বস্ত্র তৈরির ব্যবহৃত হয়।
  • তুলা বীজ থেকে তেল পাওয়া যায়।
  • তুলা বীজের তল লুব্রিকেন্ট, সাবানও পেইন্ট শিল্পে ব্যবহাত হয়। 
  • তুলা বীজের তেল ভোজ্য তেল হিসাবেও ব্যহৃত হয়।
  • বীজ থেকে তেল বের করার পর যে খৈল পাওয়া যায় তা পশুখাদ্য ও জৈবসার হিসাবে ব্যবহার করা যায়। 
  • শুকনা গাছ জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
  • তুলা দিয়ে লেপ, বালিশ, তোষক তৈরি করা হয়।

(৫) তুলা চাষে ক্ষতিকর পোকা ও তার প্রতিকার পদ্ধতি

তুলার ক্ষতিকর পোকাসমূহ হলো- জ্যাসিড পোকা জাব পোকা বোল ওয়ার্ম লাল গান্ধি পোকা তুলার সাদা মাছি প্রভৃতি।

চিত্র- তুলার ক্ষতিকর পোকাসমূহ
চিত্র- তুলার ক্ষতিকর পোকাসমূহ

ক) জ্যাসিড পোকা

ক্ষতির লক্ষণ: চারা গজানোর ২-৩ সপ্তাহ পর থেকেই এদের আক্রমণ শুরু হয়। নিম্ফ ও পূর্ণবয়ষ্ক উভয় পোকাই পাতার রস শোষণ করে যায় এবং ফলে পাতা হলদে এবং পরে লালচে হয়ে যায়।

প্রতিকার:সাকসেস’ ১.৫ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত জমিতে স্প্রে করতে হবে।

খ) জাব পোকা

ক্ষতির লক্ষণ: নিম্ফ ও পূর্ণবয়ষ্ক উভয় পোকাই গাছের কান্ড ও পাতা থেকে রস চুষে খায়। ফলে পাতা কুঁকড়ে যায় এবং ডগায় আক্রমণ করলে বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়।

দমন ব্যবস্থা:

  • পোকা প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে।
  • ভোর বেলা জমিতে ছাই ছিটিয়ে পোকা দমন করা যায়।

গ) বোল ওয়ার্ম

ক্ষতির লক্ষণ: ৫-৬ সপ্তাহ বয়সী তুলাগাছের এই পোকার লার্ভা গাছের ডগা, কুড়ি, ফুল বা বোলছিদ্র করে দেয়। এতে গাছের ডগা ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে যায়। ফুল, কুড়ি বা কচি বোল মাটিতে ঝরে পড়ে ও ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। 

দমন ব্যবস্থা:

  1. জমি গভীর চাষ দিয়ে রোদে শুকাতে হবে। এতে পোকা, লার্ভা বা শুককীট মরে যায় ও পাখিতে খেয়ে ফেলে
  2. জমির আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে হবে
  3. ঝরে পড়া কুড়ি, ফুল ও বোল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  4. আলোর ফাঁদ দিয়ে বোল ওয়ার্ম পোকার মথ ধরতে হবে।
  5. ফেনডেলারেট ২০ তরল’ ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

ঘ) লাল গান্ধি পোকা

ক্ষতির লক্ষণ: পূর্ণবয়ষ্ক পোকা গাছের পাতা, কুড়ি, ফুল ও বল থেকে রস চুষে খায়। ফলে বোলের বৃদ্ধি ব্যহত হয়, তুলার আঁশ হলদে হয়ে যায় এবং বীজ নষ্ট হয়।

প্রতিকার:

  1. ডিমের গাদা ও লার্ভা/ক্রীড়া সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে
  2. পাখি যেন পোকা খেতে পারে তাই জমির পাশে ডাল পুঁতে দিতে হবে।
  3. কার্বোসালফান ২০ তরল ২ মি.লি. ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

ঙ) তুলার সাদা মাছি

ক্ষতির ধরণ: সাদা মাছি পাতার রস শোষণ করে, এরা পাতার উপর এক ধরনর মধুকণা নি:সরণ করে, ফলে সেখানে সুটি মোল্ড ছত্রাক জন্মায়। এর আঠালো পদার্থ তুলার লিন্টের সাথে লেগে লিন্টের গুণগত মান নষ্ট হয়।

প্রতিকার:ক্লোরোপাইরিফস ২০ তরল’ ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

(৬) তুলা চাষে রোগ ও তার দমন পদ্ধতি

ক) চারা গাছের রোগ

রোগের লক্ষণ: ছত্রাকের আক্রমণে এই রোগ হয়। গজানোর পূর্বেই বীজ পঁচে যায়। অংকুরিত চারার ভূমি সংলগ্ন স্থানে পচে যায় গাছের শিকড় পচে যায় এবং অবশেষে চারার গাছ মারা যায়।

দমন ব্যবস্থা:

  1. বীজ বপনের পূর্বে প্রতি কেজি বীজ ২ গ্রাম ভিটাভেক্স ২০০ দিয়ে শোধন করে নিতে হবে।
  2. জমিতে পানি যেন না জমে সেজন্য জমি সুনিষ্কাশিত হতে হবে।
  3. আক্রান্ত জমিতে কুপ্রাভিট, ডায়থেন এম ৪৫ ইত্যাদি ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

খ) এ্যানথ্রাকনোজ রোগ

রোগের লক্ষণ: ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। চারাগাছের বীজপত্র ও পাতায় ছোট ছোট লালচে দাগ পড়ে। বয়ষ্ক গাছের কান্ডে লম্বা বাদামি দাগ পড়ে ও বাকল ফেটে যায়। কচি বোলের উপর পানি ভেজা লালচে কিনারাযুক্ত বসে যাওয়া দাগ দেখা যায়।

দমন ব্যবস্থা:

  1. আক্রান্ত গাছ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে
  2. ভিটাভেক্স’ দিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
  3. বোল গঠনের পর ‘১% বোর্দোমিক্সার’ ১-২ বার প্রয়োগ করতে হবে।

গ) ফিউজেরিয়াম উইল্ট বা ঢলে পড়া রোগ

রোগের লক্ষণ: Fusarum oxysporum বা F. vasinhectum ছত্রাক দিয়ে এই রোগ হয়। চারাগাছের পাতা প্রথমে হলুদ ও পরে বাদামি হয়ে যায় এবং চারা গাছ দ্রুত ঢলে পড়ে ও মারা যায়। আক্রান্ত অংশ কাটলে ভিতরে কালো রিং দেখতে পাওয়া যায়।

দমন ব্যবস্থা:

  1. বপনের পূর্বে বীজ শোধন করে নিতে হয়ে
  2. কু প্রাভিট-৫০’, ‘ডাইমন এম ৪৫’, ‘কপার অক্সিক্লোরাইড’ প্রয়োগ করতে হবে।

ঘ) পাতায় দাগ পড়া রোগ

রোগের লক্ষণ: ছত্রাকের দ্বারা এ রোগ হয়। পাতায় গোলাকার দাগ দেখা যা এবং আক্রান্ত স্থান খসে পড়ে। 

দমন ব্যবস্থা:

  • আক্রান্ত পাতা ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  • রোগমুক্ত বীজ বপন করতে হবে অথবা বপনের পূর্বে বীজ শোধন করে নিতে হবে।

ঙ) ব্যাকটেরিয়াল ব্লাইট

Xanthomonas Malvacearum ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এই রোগ হয়। 

রোগের লক্ষণ: প্রথম লক্ষণ দেখা যায় চারা গাছের বীজপত্রে। বীজপর্তের নিজের দিকে গোল গোল পানি ভেজা দাগ যায় এবং বীজপত্র ঝরে পড়ে। বয়স্ক গাছের পাতায়ও পানিভেজা দাগ দেখা যায়। বোল আক্রান্ত হলে তাতেও কালো বা বাদামী পানি ভেজা দাগ সৃষ্টি হয় এবং আক্রান্ত বোল ঝরে পড়ে। 

দমন ব্যবস্থা:

  • ফসল কাটার পর বাকী অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  • সালফিউরিক এসিড’ দিয়ে বীজ ডিলিলেড করতে হবে।

চ) বোল পঁচা রোগ:

রোগের লক্ষণ: বিভিন্ন ছত্রাক এ পোকার জন্য দায়ী এ রোগ তুলার রোল আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত বোল পুড়িয়ে কালো হয়ে যায় এবং রোল ফাটতে পারে না। কোন কোন ক্ষেত্রে বোল ফাটলেও তুলা কালো হয়ে যায়। 

প্রতিকার:

  • বপনের পূর্বে বীজ শোধন করে নিতে হবে।
  • আক্রান্ত জমিতে ২.৫ গ্রাম ‘ডায়থেন এম ৪৫’ ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।

প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনাটির দ্বারা আমরা তুলা গাছ; তুলা চাষ পদ্ধতি; তুলা চাষে জিনিং, গাট বাধা, জিওটি, কাউন্ট ও বীজ সংরক্ষণ; তুলার ব্যবহার; তুলা চাষে ক্ষতিকর পোকা ও তার প্রতিকার পদ্ধতি; তুলা চাষে রোগ ও তার দমন পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানলাম।

তুলা একটি গুরুত্বপূর্ণ আঁশ জাতীয় ফসল। উন্নতমানের আঁশ পেতে হলে তুলা সংগ্রহ ও তুলা প্রক্রিয়াজাতকরণ খুবই সতর্কতার সাথে সঠিক পদ্ধতিতে করতে হবে। সংগৃহীত তুলা সংরক্ষণও যথাযথভাবে করতে হবে। আমাদের বস্ত্রশিল্পের অন্যতম কাঁচামাল এই তুলার বহুবিধ ব্যবহারের জন্য এর উৎপাদন বৃদ্ধি করা আবশ্যক।

[সূত্র: ওপেন স্কুল]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts