ধনিয়া বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় মসলা ও পাতা জাতীয় সবজি। মসলা ছাড়াও ধনিয়ার চারা গাছে পাতা সালাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ধনিয়া পাতা ভিটামিন ‘এ’ এবং ‘ক্যারোটিন’ সমৃদ্ধ।
ধনিয়া মসলা হলেও এতে অনেক ভিটামিন রয়েছে।
বাংলাদেশে ধনীয়ার জাতীয় গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ৯৪৪ কেজি। বাংলাদেশে ধনিয়ার চাষ বাড়িয়ে বিদেশে রপ্তানি করার সুযোগ রয়েছে।
(১) ধনিয়ার জাত
ক) বারি ধনিয়া-১
বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবিত এ জাতটি ১৯৯৬ সালে অনুমোদন করা হয়। পাতা সবজি ও বীজ ফসল হিসেবে বারি ধনিয়া-১ উৎপাদন করা যায়।
- পাতা বহু বিভক্ত, ফুল সাদা ও যৌগিক আম্বেল।
- গাছের উচ্চতা ৪০-৯০ সেমি।
- পাতার আকৃতি বড় ও উজ্জ্বল সবুজ রঙের।
- প্রতি গাছে পাতার সংখ্যা ১৬-১৮টি।
- বীজ ডিম্বাকার হলদে।
- প্রতি গাছে ৪০০-৫০০টি বীজ হয়।
- পাতা ফসল ৩০-৩৫ দিনে এবং বীজ ফসল ১১০-১২০ দিনে সংগ্রহ করা যায়।
- হেক্টরপ্রতি পাতার ফলন ৩.০-৪.০ টন এবং বীজের ফলন ১.৭-২ টন।
খ) বারি ধনিয়া-২
দেশ ও বিদেশ থেকে ধনিয়ার ১৭টি Germplasm সংগ্রহ করে ২০০৯ সাল হতে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২ বছর মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বগুড়ায় উক্ত Germplasm সমূহের ফলনসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করা হয়। এরপর ২০১১ থকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রথমিক ফলন পরীক্ষার মাধ্যমে COR ১৫ লাইনটি উচ্চ ফলনশীল ধনিয়ার লাইন হিসাবে বাছাই করা হয়।
পরবর্তীতে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ‘বারি ধনিয়া-১’ Check হিসাবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের লালমনিরহাট, বগুড়া, মাগুড়া, রাজশাহী, ফরিদপুর, গাজীপুর, পাহাড়তলী, চট্রগ্রামে আঞ্চলিক ফলন পরীক্ষা করা হয়। জাত হিসাবে অনুমোদনের জন্য ২০১৬ সালে জাতীয় বীজ বোর্ডে আবেদন করা হয় এবং ২০১৬ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড COR ১৫ লাইনটিকে বারি ধনিয়া-২ জাত হিসাবে অনুমোদন প্রদান করে।
জাতটির বৈশিষ্ট্য:
- গাছ উচ্চতায় ১০০-১৩৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
- প্রতি গাছে পাতার সংখ্যা ১৮-২১ টি।
- প্রতি গাছে গড় আম্বেল ৬৩ টি, প্রতি আম্বেলে আম্বেললেটের সংখ্যা প্রায় ৬ টি এবং প্রতি আম্বেললেটে বীজের সংখ্যা প্রায় ৬ টি।
- প্রতি ১০০০ বীজের গড় ওজন ১১.৫৩ গ্রাম।
- বীজগুলো হরিদ্রা বর্ণের মাঝারী আকারের।
- পাতা ও বীজ উভয়ই ব্যবহার্য।
- শুকনা বীজ এর ফলন প্রতি হেক্টরে ১.৭-২.০ টন।
- এজাতের ধনিয়া বিশেষ বৈশিষ্ট (মে থেকে আগস্ট ব্যতিত) বছরের বেশীর ভাগ সময় পাতা হিসাবে চাষ করা যায়।
- যার ফলন হেক্টর প্রতি ৩-৪ টন।
(২) ধনিয়া চাষ পদ্ধতি/ধনিয়ার পাতা চাষ পদ্ধতি
ক) মাটি ও আবহাওয়া
- প্রায় সব রকমের মাটিতেই এজাতটি চাষ করা যায়। তবে বেলে দোআঁশ থেকে এঁটেল দোআঁশ মাটি ধনিয়া চাষের জন্য উপযোগী।
- ধনিয়া জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না বিধায় জমির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- ঠান্ডা আবহাওয়া ধনিয়ার বীজ উৎপাদনের জন্য অনুকূল বলে রবি মৌসুমে এর চাষ করা হয়ে থাকে। উচ্চ তাপমাত্রায় ও খরায় ধনিয়া বীজের ফলন ভাল হয় না।
- ফুল ফোটার সময় বৃষ্টি এবং অতিরিক্ত ঠান্ডা ও কুয়াশা হলে ধনিয়ার ফলন কমে যায়। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ধনিয়া পাতার উৎপাদন ব্যহত হয়ে থাকে।
খ) বপন সময়
- কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ (মধ্য অক্টোবর-মধ্য নভেম্বর) মাস বীজ ফসলের জন্য উত্তম। তবে সবুজ পাতা ধনিয়ার জন্য (মে থেকে আগস্ট মাস ব্যতিত) যে কোন সময় বপন করা যায় এবং ভাল দাম পাওয়া যায়।
- সাথী ফসল হিসাবে শাক-সবজি, আখ, আলু, ডাল ফসলের জমিতে ধনিয়া চাষ করা যায়।
- অতিরিক্ত সূর্যালোকে বীজ বপন করলে অঙ্কুরোদগমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
- ধনিয়া বীজের জন্য বিলম্বে বীজ বপনে এর স্বাবাভিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং বিভিন্ন রোগবালাই এর আক্রমণ বেড়ে যায়।
গ) জমি তৈরি
মাটির প্রকারভেদে ৪-৬ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হবে। পরে জমিকে কয়েকটি ব্লকে ভাগ করে এবং দুই ব্লকের মাঝে পানি নিষ্কাশনের জন্য ৪০ সেমি নালা রেখে জমি তৈরি করা হয়।
ঘ) বীজের হার
সারিতে হেক্টর প্রতি ৮-১০ কেজি এবং ছিটিয়ে বোনার ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ১০-১২ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। ধনিয়া পাতার জন্য হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
ঙ) বীজ বপন
- বপনের পূর্বে বীজগুলো বস্তা বা চটের ব্যাগে নিয়ে ঘষে দু’টুকরো করে নিলে ভালো হয়।
- ধনিয়ার খোসা খুব শক্ত হওয়ায় বীজ বোনার আগে পানিতে ২৪-৪৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে বুনলে তাড়াতাড়ি অঙ্কুরোদ্গম হয়।
- মাটির ২-৩ সেন্টিমিটার গভীরে বীজ বপন করে ৩০ X ৪০ সেমি দূরত্বে বীজ বপন করতে হয়।
- বপনকৃত বীজ অঙ্কুরোদগম হতে সাধারণত ৮-২১ দিন সময় লাগে। কোন কোন ক্ষেত্রে এর চাইতেও বেশি সময় লাগতে পারে।
- জমির আর্দ্রতার উপর নির্ভর করে বীজ বপনের পর পরই হালকা সেচ দিতে হবে। তাতে অঙ্কুরোদ্গম বৃদ্ধি পাবে।
চ) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
ধনিয়া চাষে হেক্টরপ্রতি নিচের হারে সার প্রয়োগ করতে হয়।
সার | মোট পরিমাণ | শেষ চাষের সময় প্রয়োগ | পরবর্তী পরিচর্যা হিসেবে: ১ম কিস্তি | পরবর্তী পরিচর্যা হিসেবে: ২য় কিস্তি |
গোবর | ৫ টন | সব | – | – |
ইউরিয়া | ১৫০-১৮০ কেজি | – | ৭৫-৯০ কেজি | ৭৫-৯০ কেজি |
টিএসপি | ১১০-১৩০ কেজি | সব | – | – |
এমওপি | ৯০-১১০ কেজি | সব | – | – |
জিপসাম | ১১০ কেজি | সব | – | – |
জিংক সালফেট | ১২ কেজিি | সব | – | – |
বোরিক এসিড | ১০ কেজি | সব | – | – |
জমি তৈরির সময় সমস্ত গোবর, এমওপি, জিপসাম, টিএসপি, জিংক ও বোরন সার প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। চারা গজানোর ১৫ দিন পর ১ম কিস্তি এবং চারা গজানোর ৪০ দিন পর বাকি ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ছ) আন্তঃপরিচর্যা
- বীজ বপনের ১৫-২০ দিনের মধ্যে প্রথম নিড়ানী দিতে হবে। একইভাবে একইসময়ের ব্যবধানে পরবর্তীতে ২-৩টি নিড়ানী দিতে হবে।
- প্রতিবার সেচের পর জমির ’জো’ আসা মাত্র মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে।
- চারা গজানোর পর থেকে ২/৩ ধাপে ৪-৫ দিন পরপর নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চারা পাতলা করে দিতে হবে।
জ) সেচ
ধনিয়া ফসলে ৪-৫ টি হালকা সেচ প্রয়োগ করতে হবে। গজানোর সময় হালকা সেচ, ফুল আসার আগে ও দানা গঠনের সময় সেচ দেওয়া খুবই প্রয়োজন। এতে বীজ পুষ্ট ও ফলন বেশি হয়।
ঝ) ফসল সংগ্রহ
- বপনের ৪৫-৫০ দিন পর গাছে ফুল আসে এবং ১৩৫-১৪০ দিন পর ধনিয়া পাকে। পাকলে গাছ হলদে হয়ে পাতা শুকিয়ে যায়।
- সাধারণত খুব ভোরে অর্থাৎ সূর্যের আলোর প্রখরতা বৃদ্ধির পূর্বে গাছ উঠাতে হবে।
- ধনিয়ার বীজ হালকা সবুজ অবস্থায় থাকতেই গাছ তুলতে হবে। নতুবা বীজের মান ভাল হয় না।
- বীজ রোদে শুকিয়ে মাড়াই-ঝাড়াই করে পৃথক করা হয়। বীজে আর্দ্রতার পরিমাণ ১০% রেখে শুকিয়ে ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
ঞ) বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ
- ধনিয়া পর-পরাগায়িত ফসল। ইহার বীজ উৎপাদনের জন্য জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষা করতে হলে অন্য জাত থেকে ১,০০০ মিটার দূরত্বে চাষ করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোন জাতের মিশ্রণ পরিলক্ষিত হলে, তা ফুল আসার পূর্বেই তুলে ফেলতে হবে।
- বীজ আহরণের পর ৫-৭ দিন রোদে শুকিয়ে মাড়াই-ঝাড়াই করে বীজ পৃথক
করতে হবে এবং ভালভাবে শুকিয়ে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। - বীজের স্বাভাবিক রং এবং সুগন্ধ বজায় রাখার জন্য পাটের বস্তায় পলিথিনের ব্যাগে সংরক্ষণ করতে হবে।
(৩) ধনিয়া চাষে পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন ব্যবস্থা
ক) জাব পোকা
- কীটপতঙ্গের মধ্যে জাব পোকা ধনিয়ার প্রধান শত্রু। কালচে রঙের ছোট পোকা গাছের কান্ডসহ প্রায় সব জায়গাতেই ঘন হয়ে বসে গাছের রস চুষে খায়।
- আক্রমণ বেশি হলে পাতা হলদে হয়ে গাছ শুকিয়ে যায়।
- গাছে ফুল ও ফল ধরার সময় জাব পোকার আক্রমণ বেশি হয়।
দমন:
প্রতি লিটার পানিতে ১-২ মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন-১০০ ইসি বা ১ মিলিলিটার কনফিডর-২৫ ইসি ভালোভাবে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।
খ) পাউডারি মিলডিউ
- পাউডারি মিলডিউ ধনিয়ার মারাত্নক রোগ। এ রোগের আক্রমণে গাছের কান্ডসহ বিটপ অংশে সাদা পাউডারের মতো গুঁড়া দেখা যায়।
- আক্রান্ত পাতার সবুজ রং নষ্ট হয়ে যায় ও পাতা শুকিয়ে যায়। গাছে ফুল হলেও ফল ধরে না, এমনকি আগে ফল ধরলে তা পুষ্ট হয় না।
- শীতের সময় হঠাৎ মেঘ করে তাপমাত্রা কমে গেলে এ রোগ দেখা দেয়।
- নাবি ফসলে এই রোগের আক্রমণ বেশি হয়।
দমন:
প্রতি লিটার পানিতে ৩ গ্রাম থিওভিট ভালোভাবে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।
গ) কান্ড ফোলা বা গল রোগ
- কান্ড ফোলা রোগ ধনিয়ার প্রায় ৮০ ভাগ ক্ষতি করে থাকে। প্রোটোমাইসিস প্রজাতির ছত্রাকের আক্রমণে কান্ড ফোলা রোগ হয়ে থাকে।
- এটি একটি মাটি এবং বীজ বাহিত রোগ যা বীজের সাথে বা বাতাসের ধুলা বালির সাথে উড়ে এক জমি হতে অন্য জমিতে বা এক এলাকা হতে অন্য এলাকায় বিস্তার লাভ করে থাকে।
- শিকড় ব্যতিত গাছের শাখা-প্রশাখা ফুলে যায়। ধীরে ধীরে এ ফোলা বিস্তৃত হয়ে সমস্ত কান্ড, শাখা-প্রশাখা ও পুষ্পমঞ্জুরী আক্রান্ত হয়। পুষ্প মঞ্জুরীতে আক্রমণ হলে ফুল শুকিয়ে মরে যায়। বীজে আক্রমণ করলে বীজের আকার বড় হয়ে যায়।
দমন:
- বীজ বপনের পূর্বে প্রতি কেজি বীজের জন্য ২ গ্রাম হারে অটোস্টিন দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে।
- আক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় অটোস্টিন বা রিডোমিল গোল্ড (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম) ১০ দিন অন্তর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
- শেষ চাষের পূর্বে জমিতে হেক্টরপ্রতি ৭-৮ কেজি কার্বোফুরান প্রয়োগ করলে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]