সুস্থসবল ও সুন্দর চারা পেতে অবশ্যই নার্সারি প্রয়োজন। এছাড়াও কৃষক নার্সারির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক উপকৃত হতে পারেন। আমাদের কৃষিপ্রধান দেশ সেহেতু গাছপালা রোপণ ও পরিচর্যার বিষয় সবার কমবেশি ধারণা আছে। তাই নার্সারিতে বিনিয়োগ একটি সহজ পদক্ষেপ বলা যেতে পারে।
এ পাঠটি শেষ অবিধ অধ্যয়ন করলে আপনি- নার্সারি কাকে বলে, নার্সারি কি/কী, তা বলতে পারবেন। নার্সারি কত প্রকার ও কি কি সেগুলো সম্পর্কে জানতে পারবেন। নার্সারির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পারবেন। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নার্সারির অবদান বিশ্লেষণ করতে পারবেন। নার্সারি করার নিয়ম ও নার্সারির বীজ ও চারা উৎপাদন কৌশল শিখতে পারবেন। নার্সারির ভালো বীজ ও চারার বৈশিষ্ট্য চিনতে পারবেন। বনজ উদ্ভিদের বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করার নিয়ম সম্পর্কে ধারণা পাবেন।
(১) নার্সারি কাকে বলে? নার্সারি কি/কী?
বাংলাদেশে কৃষির লাভজনক যে সব সেক্টর রয়েছে তার মধ্যে নার্সারি পেশা অন্যতম।
যে জায়গায় চারাগাছ উৎপন্ন করে অন্য কোথাও রোপণের আগ পর্যন্ত তা পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়, তাকে নার্সারি বলে।
আভিধানিক অর্থে বনজ নার্সারি হলো চারা গাছের আলয় বা চারালয়। আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করে একটি আদর্শ নার্সারি থেকে সুস্থসবল ও সুন্দর চারা পাওয়া সম্ভব। নার্সারিতে বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা হয়। আবার আধুনিক পদ্ধতিতে কলম থেকেও উন্নতমানের চারা উৎপাদন করা হয়।
বন নার্সারি ব্যবসার মৌসুম হলো বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত। বর্ষাকালে চারা সহজেই বাঁচে এবং দ্রুত বড় হয়। এজন্য এ সময়ে চারা বেশি বিক্রি হয়। শীতকালে চারা বড় হয় না এবং গরমের দিনে চারা শুকিয়ে মরে যায়। মূলত আষাঢ়, শ্রাবণ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ভাল বিক্রি হয়।
এ ব্যবসার মাধ্যমে অবসর সময়ে অল্প জায়গায় বেশি চারা উৎপাদন ও বিক্রির মাধ্যমে ভালো টাকা আয় করা সম্ভব।
(২) নার্সারি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা
আধুনিক কৃষিতে নার্সারির গুরুত্ব অপরিসীম। নার্সারি ছাড়া কৃষি কাজ অসম্পূর্ণই বলা চলে। এর প্রধাণ কাজ হলো চারা উৎপাদন ও চারার যত্ন নেয়া। তবে প্রকৃতপক্ষে নার্সারিতে বীজ উৎপাদন, অংগজ চারা উৎপাদন, বিভিন্ন রোপন দ্রব্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, জাত উৎপাদন, ক্ষণস্থায়ী গাছের ব্যবস্থাপনা, স্থায়ী গাছের ও বীজ উৎপাদনকারী মাতৃগাছের সঠিক পরিচর্যা করা ইত্যাদি কর্মকান্ড করা হয়।
নার্সারি কেবল উন্নতমানের বীজ ও চারার সরবরাহই নিশ্চিত করেনা জনগনের কর্মসংস্থাসহ পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করে। যে এলাকায় ভাল নার্সারি আছে সে এলাকায় গাছ-পালার সরবরাহ বেশী থাকে। ফলে মানুষের শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভাল থাকে।
নার্সারির অর্থনৈতিক গুরুত্বও অনেক। ছোট ছোট নার্সারি থেকে বছরে লাখ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। কারণ এক বর্গমিটার জায়গায় কয়েক হাজার চারা উৎপাদন করা যায়। অনেক চারা বিক্রয়ের উপযোগী করতে মাত্র ৩/৪ সপ্তাহ সময় লাগে। আগাম চারা উৎপাদন করতে পারলে লাভও কয়েকগুন বেড়ে যায়। একটি ভাল নার্সারি থেকে অল্প সময়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করা যায়।
তাই নার্সারি স্থাপন করে নিজে লাভবান হওয়া যায়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যায় এবং দেশকে সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তোলা যায়।
আরও যেসব নার্সারি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা হলো-
- বিভিন্ন বয়সের চরা বিপণন ও বিতরণে সুবিধা হয়।
- সময়মতো উন্নতমানের সুস্থসবল ও বড় চারা পাওয়া যায়।
- স্বল্পব্যয়ে অনেক চারা পাওয়া যায়।
- কম পরিশ্রম ও কম খরচে চারা উৎপাদন করা যায়।
- অনেক চারা একসাথে পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।
- এমন অনেক বীজ রয়েছে যেগুলো গাছ থেকে ঝরে পড়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রোপন করতে হয়। এসব প্রজাতির জন্য নার্সারি একান্ত অপরিহার্য। যেমন- গর্জন, শাল, রাবার, তেলসুর প্রভৃতি।
আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নার্সারির অবদান-
- নার্সারি ব্যবসা করে অনেক লোকের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে।
- নার্সারিতে উৎপাদিত চারা দিয়ে সরকারি ও বেসরকারি বনায়ন করা হয়।
- নার্সারিতে বনজ, ফলজ ও ঔষধি উদ্ভিদের চারা উৎপাদন করে জনসাধারণের নিকট বিক্রয় করা হয়। এর ফলে বৃক্ষায়ন বৃদ্ধি পায়।
- উপকূলী সবুজ বেষ্টনী তৈরিতে নার্সারিতে উৎপন্ন চারা রোপন করা হয়।
- নার্সারিতে কাজ করে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করে।
(৩) নার্সারি কত প্রকার?
নার্সারি ৪ ধরনের হয়। যেমন-
- মধ্যম ভিত্তিক নার্সারি
- স্থায়িত্ব ভিত্তিক নার্সারি
- অর্থনৈতিক ভিত্তিক
- ব্যবহার ভিত্তিক
ক) মাধ্যমভিত্তিক
মধ্যম ভিত্তিক নার্সারি আবার, দুই ধরনের-
- পলিব্যাগ নার্সারি: এ ধরনের নার্সারিতে পলিব্যাগে চারা তৈরি করা হয়। পলিব্যাগ সহজে সরানো যায় বলে চারা খরা, বৃষ্টি ও দুর্যোগ থেকে রক্ষা করা যায়। গাছ থেকে গাছে সংক্রমণ কম হয়। এ পদ্ধতিতে নিবিড়ভাবে চারার যত্ন নেওয়া যায়।
- বেড নার্সারি: নার্সারি তৈরির ও পদ্ধতিতে সরাসরি মাটিতে বেড তৈরি করে চারা উৎপাদন করা হয়। এ নার্সারিতে এক সাথে অল্প জায়গায় অধিক সংখ্যক চারা তৈরি করা যায়। ফলে বীজের অপচয় কম হয়। দ্রুত বর্ধনশীল চারা উৎপাদন ভালো হয়। কাটিং ও মোথা থেকে চারা উৎপাদন সহজ হয়। চারা উৎপাদন বেডের মাটি উর্বর হতে হয়।
খ) স্থায়িত্ব ভিত্তিক নার্সারি
স্থায়িত্ব ভিত্তিক নার্সারি দুই ধরনের, যেমন-
- স্থায়ী নার্সারি: এ ধরনের নার্সারিতে বছরের পর বছর চারা উত্তোলন করার সুযোগ থাকে। স্থায়ী নার্সারির সুবিধা হলো নার্সারির জন্য সঠিক স্থান নির্বাচন করা যায়। গ্রিন হাউজ ও বীজাগার নির্মাণ করা যায় তবে মূলধনের প্রয়োজন বেশি হয়। চারার পরিবহন খরচ বেশি হয়।
- অস্থায়ী নার্সারি: এ নার্সারিতে চাহিদা অনুযায়ী চারা উৎপাদন করা হয়। অসুবিধাটা হলো এ ধরনের নার্সারি সংরক্ষণের বেগ পেতে হয়।
গ) অর্থনৈতিক ভিত্তিতে নার্সারি দুই ধরনের, যেমন-
- গার্হস্থ্য নার্সারি: এ প্রকারের নার্সারী ব্যক্তিগত বা পারিবারিক প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে স্বল্পজায়গায় ব্যক্তি তার নিজ বাড়িতে তৈরী করে থাকে। এতে ব্যক্তি তার প্রয়োজনঅনুযায়ী ফুল, ফল বা বনজ চারা উত্তোলন করে।
- ব্যবসায়িক নার্সারি: ছোট চারা বা কলমের চারা উত্তোলন করে বিক্রয়ের জন্য যে নার্সারী স্থাপন করা তাকে ব্যবসায়িক নার্সারী বলে।
ঘ) ব্যবহার ভিত্তিক নার্সারি
উদ্ভিদের ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে এ ধরনের নার্সারি করা হয়। যেমন- মেহগনি, সেগুন, রেইনট্টি গাছের চারা উৎপাদনের জন্য তৈরি নার্সারি।
(৪) নার্সারি করার নিয়ম/পদ্ধতি
স্থায়ী ও অস্থায়ী উভয় নার্সারি তৈরির জন্যই প্রয়োজন সুষ্ঠ পরিকল্পনা ও কিছু নিয়মনীতি।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চারা উৎপাদনের জন্য স্থায়ী নার্সারি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বন বিভাগ, হর্টিকালচার, বিএডিসির উদ্যান, প্রাইভেট নার্সারি কেন্দ্রগুলো স্থায়ী নার্সারি।
স্থায়ী নার্সারি স্থাপনের বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো-
ক) স্থান নির্বাচন
আলো বাতাসপূর্ণ খোলা মেলা উঁচু ভূমি হবে। বর্ষার পানি উঠে না এবং জলাবদ্ধাতা হয় না এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে। উর্বর বেলে দোআঁশ বা দোআঁশ মাটি সম্পন্ন হবে। উন্নত যোগাযোগ ও পানির সুষ্ঠ ব্যবস্থা রাখতে হবে। পর্যাপ্ত জমি ও শ্রমিক পাওয়া যায় এমন জায়গা নির্বাচন করতে হবে।
খ) নার্সারির জায়গার পরিমাণ নির্ণয়
এক বর্গমিটার সীড বেড বা পট বেডের জায়গা নির্ণয়-
পলিব্যাগের আকার | প্রতি বর্গ মিটারে চারার সংখ্যা |
১৫ সে.মি. x ১০ সে.মি. | ৬৫ টি |
১৮ সে.মি. x ১২ সে.মি. | ৪৫ টি |
২৫ সে.মি. x ১৫ সে.মি. | ২৬ টি |
সীড বেডে শিকড় চারা হতে চারার দূরত্ব | প্রতি বর্গ মিটারে চারার সংখ্যা |
৫ সে.মি. x ৫ সে.মি. | ৪০০ টি |
১৮ সে.মি. x ১২ সে.মি. | ২০০ টি |
২৫ সে.মি. x ১৫ সে.মি. | ১০০ টি |
গ) বেড নির্মাণ
অনিষ্টকারী জীবজন্তুও পথচারীদের হাত থেকে চারা গাছ রক্ষা করার জন্য বেড়া দেওয়া দরকার।
স্থায়ী নার্সারিতে বেড়া দেওয়ার চারটি উপায়ক-
- ইটের দেয়াল: স্থায়ী নার্সারির চার দিকে উঁচু ইটের দেয়াল নির্মাণ করে বেড়া দেওয়া যায়।
- কাঁটা তারের বেড়া: স্থায়ী নার্সারিতে কাঁটা তারের বেড়া সহজে দেওয়া যায়।
- লোহার জালের বেড়া: লোহার জাল খুঁটির সাথে বেঁধে দিয়ে বেড়ার পাশ দিয়ে জীবন্ত গাছ লাগানো যেতে পারে। কাঁটা তারের বেড়ার মতো এ বেড়াতেও তিন ধরনের খুঁটি ২ মিটার অন্তর অন্তর ব্যবহার করা যায়।
- জীবন্ত গাছের বেড়া: দূরন্ত, কাঁটা মেহেদী, মেন্দী, ঢোল কলমী প্রভৃতি জীবন্ত গাছ দিয়ে নার্সারির চার দিকে স্থায়ী বেড়া দেওয়া যায়।
ঘ) ভূমি উন্নয়ন
নার্সারি স্থান নির্বাচনের পর পরই উন্নয়নের কাজ করতে হয়। নার্সারি বেড় তৈরির স্থান উত্তমরূপে পরিষ্কার করতে হবে। মাটি তৈরির সময় বৃষ্টি বা সেচের পানি যাতে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য মাটি ঢালু ও ডেন করতে হবে। ভূমির মাটি দোআঁশ বা বেলে-দোআঁশ হতে হবে।
ঙ) অফিস ও আবাসিক এলাকা
নার্সারির অফিস ঘরটি প্রধান রাস্তার পাশে মূল গেটের কাছে অবস্থিত হওয়া প্রয়োজন। অফিস ও আবাসিক এলাকা চারা উৎপাদন এলাকার বাইরে রাখতে হবে। নার্সারি এলাকার ভিতরে আবাসন ঠিক নয়।
চ) বিদ্যুতায়ন
স্থায়ী নার্সারিতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকা ভালো। এতে নার্সারি রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা হয়।
ছ) রাস্তা ও পথ
নার্সারিতে প্রবেশের জন্য একটি প্রধান রাস্তা থাকা আবশ্যক। প্রধান রাস্তাটি পরিকল্পিতভাবে নার্সারির ভিতরের পথগুলোর সাথে যুক্ত থাকবে।
জ) সেচ ব্যবস্থা
নার্সারিতে চারা উত্তোলনের জন্য পানি প্রয়োজন। সে জন্য নার্সারি স্থাপনের শুরুতেই উত্তম সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
ঝ) নর্দমা ও নালা
নার্সারিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এ কারণে প্রয়োজনীয় নর্দমা ও পার্শ্বনালার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
ঞ) নার্সারি ব্লক
নার্সারির চারা উত্তোলনের স্থানকে কয়েকটি ব্লকে ভাগ করতে হবে। প্রত্যেক ব্লককে আবার কয়েকটি সীড বেড বা পট বেডে ভাগ করতে হবে। প্রত্যেক ব্লকে ১০-১২ টি বেড থাকতে পারে। গ্রিন হাউজ সেড রাখার জায়গা, কমপোস্ট তৈরির গর্ত, মাটি রাখার স্থান ইত্যাদিও সুবিধামতোভাবে বিভিন্ন ব্লকে ভাগ করে দিতে হবে।
ট) নার্সারি বেড
বেড সাধারণত দুই রকম হতে পারে-
- সরাসরি বীজ বপন করে চারা উত্তোলনের জন্য বেড: এ জন্য জমি ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। জমির মাটির কোদাল বা লাঙ্গল দিয়ে করতে হবে। সব রকম আগাছা নুড়ি পাথর পরিষ্কার করে ভালো করে চাষ দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। অতঃপর জায়গা অনুযায়ী নির্দিষ্ট ১ মিটার ৩ মিটার ২০ সেমি আকারে বেড তৈরি করতে হবে। বেড তৈরির পর প্রয়োজনীয় গোবর বা কমপোস্ট ও রাসায়নিক সার মিশিয়ে কয়েকদিন রেখে দেওয়ার পর বীজ বপন করতে হবে।
- পলিব্যাগে চারা উত্তোলনের জন্য বেড তৈরি: এক্ষেত্রে মাটিতে চাষ করার প্রয়োজন নেই। কেবল দুটি বেডের মধ্যবর্তী স্থানের মাটি তুলে বেডকে ১০-১৫ সে.মি. উঁচু করে উপরিভাগ সমান করতে হয়। এরপর বেডের ধার তৈরি করা হয়। তবে নার্সারি স্থানের প্রযোজ্যতা অনুযায়ী বেডের আকার ছোট বড় হতে পারে।
(৪) নার্সারির বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
বীজ হলো উদ্ভিদের প্রধান বংশ বিস্তারকে উপকরণ। ভালো চারা পেতে ভালো বীজ প্রয়োজন। এ জন্য নির্দিষ্ট গুণাগুন সম্পন্ন মাতৃগাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
সংগৃহীত বীজ আহরণ থেকে রোপনের পূর্ব পর্যন্ত সঠিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে হবে। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হলে বীজ পোকা-মাকড়, ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া প্রভৃতি দিয়ে আক্রান্ত হয়। ফলে বীজের মানের অবনতি হয়। অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কমে যায়। তাছাড়া বীজ বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে এর গুণাগুণ নির্ণয় করতে হবে।
বীজকে সঠিকভাবে প্রক্রিয়া করণের পর বাজারজাতকরণ ও বিতরণ করা দরকার।
এখন আমরা বীজ নির্বাচন, বীজ সংগ্রহ, পদ্ধতি, বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি, বীজ পরীক্ষা ও বীজ বপন পূর্ববর্তী প্রক্রিয়াকরণ সম্পর্কে জানব।
ক) মাতৃগাছ নির্বাচন
মধ্য বয়সী, সুস্থসবল, রোগমুক্ত এবং অধিক ফল উৎপাদনকারি গাছকে নির্বাচন। নির্বাচিত এসব গাছ থেকে উপযুক্ত সময়ে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
আমাদের বাংলাদেশে বীজ মাতা গাছ এক বা একাধিক উৎস হতে শনাক্ত করে বীজ সংগ্রহ করা হয়। যেমন-
- নিজ ও অন্য এলাকার কৃষকের বাড়ি
- পার্ক বা বাগান এলাকা বা বনাঞ্চল
- রাস্তার পাশের বৃক্ষ
- বিভিন্ন স্থায়ী নার্সারি, প্রভৃতি ভালো চারা উৎপাদনের জন্য উত্তম গুণাগুণ সম্পন্ন মাতৃগাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা অপরিহার্য।
খ) বীজ সংগ্রহ পদ্ধতি
সাধারণত দুইভাবে গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। যথা-
- ভূমি হতে বীজ সংগ্রহ
- গাছ থেকে ফল ও বীজ সংগ্রহ
i) ভূমি হতে বীজ সংগ্রহ
- বীজ পাকার পর যখন কিছু বীজ মাটিতে পড়ে তখন বীজ সংগ্রহের উপযুক্ত সময়।
- বীজ পাকার মধ্যবর্তী সময়ে এ বীজ সংগ্রহ করতে হয়।
- যেসব গাছের ফল পেকে ফাটে না এবং বীজ ছড়িয়ে পড়ে না সেসব বীজ এ পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হয়। সেগুন, গর্জন, শাল, কদম, পিতরাজ, তেলসুর প্রভৃতি উদ্ভিদের বীজ ভূমি থেকে সংগ্রহ করা যায়।
ii) গাছ থেকে ফল ও বীজ সংগ্রহ
- এ পদ্ধতিতে বীজ সংগ্রহের ক্ষেত্রে যখন ফল পরিপক্ক হবে তখন দা বা ছুরি দিয়ে গাছের ছোট ছোট ডাল কেটে সরাসরি গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করা হয়।
- ছোট ছোট বীজ যা মাটিতে পড়লে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় ফলে মাটিতে হতে সরাসরি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। সে সব বীজ এ পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা হয়। যেমন- পড জাতীয়-বাবুল, কড়ই, ক্যাপসিউল-মেহগনি, চাম্পা, কোন-পাইন।
- গাছ থেকে ফল ও বীজ সংগ্রহের পর রোদে শুকাতে হবে। এরপর পড, ক্যাপসুল বা কোন ফাটিয়ে বীজ পৃথক করতে হবে।
গ) বীজ নিষ্কাশন
ফল সংগ্রহ করার পর বীজগুলোকে শাস, আবর্জনা, খোসা ইত্যাদি থেকে পৃথক করাই হলো বীজ নিষ্কাশন।
বীজ নিষ্কাশনের প্রধান তিনটি পদ্ধতি হলো-
- বাছাই পদ্ধতি: যে সব গাছের অঙ্কুরোদগমকাল সংক্ষিপ্ত অর্থাৎ ৪-৭ দিন, এসব ক্ষেত্রে বাছাই পদ্ধতি ব্যবহার হয়। এসব গাছের গোটা ফলই বীজ হিসাবে বপন করা হয়। যেমন-নারিকেল, গর্জন, শাল, সেগুন বীজ রৌদে শুকালে অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বাড়ে।
- শুকনো পদ্ধতি: জারুল, তুলা, ইপিল-ইপিল, মেনজিয়াম, বাবলা মেহগনি, কড়ই গাছের বীজ শুকনো পদ্ধতিতে নিষ্কাশন করা হয়। গাছ থেকে ফল পেড়ে ভালো করে রোদে শুকাতে হয়। ফল ফেটে যখন বীজ বেরিয়ে আসে, তখন মাড়াই করে বীজ নিষ্কাশন করা হয়।
- পচন পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে ফল পানিতে পচানোর পর বীজ বের করা হয়। যেমন- আম, কাঁঠাল, তেঁতুল, পেয়ারা ইত্যাদি তার পরে বাতাসে শুকাতে হয়।
ঘ) বীজ সংরক্ষণ
গাছ থেকে বীজ সংগ্রহের পর পরবর্তী বপন পর্যন্ত বীজ সংরক্ষণ করা হয়। সঠিক পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ না করলে বীজের গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বীজের মানের অবনতি হয়। যেমন- গর্জন, শাল, সেগুন, চাপালিশ, তেলসুর প্রভৃতি গাছের বীজ গুদামজাত করলে অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা হাস পায়। এসব গাছের বীজ ২৪ ঘন্টার মধ্যে অবশ্যই বপন করতে হবে।
- বীজ অপেক্ষাকৃত হালকা করে ছিটিয়ে গুদামজাত করা আবশ্যক।
- বীজ সব সময় শুকনো রাখতে হবে।
- অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা ও শুষ্ক স্থানে বীজ রাখতে হবে।
- তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বীজ খোলা অবস্থায় রাখা হয়। আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এবং রেফ্রিজারেটর এ বীজ সংরক্ষণ করা যায়।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, নার্সারি কাকে বলে? নার্সারি কি/কী? নার্সারি কত প্রকার? নার্সারি করার নিয়ম সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা অর্জন করলাম।
নার্সারি করার জন্য জমি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি দেখতে হবে সেটি হলো সুনিষ্কাশিত ও উঁচু জমি নির্বাচন করা। যাতে পানি জমে না থাকে। দোআঁশ মাটি নার্সারি বেড তৈরিতে উত্তম। প্রচুর পরিমাণে আলো বাতাস আছে এমন জমি নার্সারির জন্য বেশ উপযোগী।
নার্সারিতে ভাল চারা উৎপাদন করার জন্য প্রথমে প্রয়োজন ভাল বীজ। এক্ষেত্রে মধ্য বয়সী, সুস্থসবল, রোগমুক্ত এবং অধিক ফলনশীল মাতৃগাছ নির্বাচন করা অতীব জরুরি। পাশাপাশি উপযুক্ত উপায়ে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। গাছ থেকে বীজ সংগ্রহের পর পরবর্তী বপন পর্যন্ত বীজ সংরক্ষণ করা যায়। সঠিক পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ ব্যতীত বীজের আশানুরূপ মান পাওয়া সম্ভব নয়।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।