আলোচ্য বিষয়:
পটল বাংলাদেশের একটি প্রধান সবজি, যা গ্রীম্মকালীন সবজি চাহিদার
অনেকখানি পূরণ করে থাকে। পটলের উৎপত্তিস্থল ভারত উপমহাদেশে এবং বহুকাল থেকে এ অঞ্চলে পটলের চাষ হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে যে সব এলাকায় পটল বেশি চাষ হয় তার মধ্যে বৃহত্তর রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলা উল্লেখযোগ্য।
পটল একটি দীর্ঘ মেয়াদী ফসল, মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উৎপাদন করা যায়। ফলে তরীন্ম ও বর্ষাকালে সবজি সরবরাহে পটল গুরুতৃপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পটল ভিটামিন এ, সি এবং খনিজ পদার্থের একটি ভাল উৎস।
(১) পটলের জাতের নাম
ক) বারি পটল-১
- ফলের আকার মাঝারী, সিলিভারাকৃতি ও দু’প্রান্ত ভোতা।
- ফলের রং গাঢ় সবুজ, গায়ে ৯-১০টি হালকা সবুজ রঙের ডোরা থাকে।
- ফল ৯-১০ সেমি লম্বা এবং ব্যাস ৪-৪.৫ সেমি।
- প্রতিটি ফলের ওজন ৫০ গ্রাম।
- শাখা কলম লাগাবার ৯০ দিনের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়।
- প্রতি গাছে ৩৮০টি ফল ধরে যার ওজন প্রায় ১৪ কেজি।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ৩৮ টন।
- এ জাতটি উচ্চ ফলনশীল, রোগবালাই সহিষ্কু এবং তাড়াতাড়ি ফলন দেয়।
খ) বারি পটল-২
- ফলের আকার বড়, সিলিন্ডারাকৃতি ও দু’প্রান্ত সুচালো।
- ফলের রং হালকা সবুজ, গায়ে ১০-১১টি সাদা রঙের ডোরা থাকে।
- ফল ১১-১২ সেমি লম্বা এবং বেড় ৩.৫-৪.০ সেমি।
- প্রতিটি ফলের ওজন প্রায় ৫৫ গ্রাম।
- জমিতে শাখা-কলম লাগাবার ৯৫ দিনের মধ্যেই পটল সংগ্রহ করা যায়।
- প্রতি গাছে সর্বোচ্চ ২৪০টি ফল ধরে যার ওজন প্রায় ১০ কেজি।
- হেন্টরপ্রতি ফলন ৩০ টন।
- এ জাতটি থেকে অনেকদিন ফসল সংগ্রহ করা যায়।
(২) হাইব্রিড পটলের জাত পরিচিত
বারি হাইবিড পটল-১:
- উচ্চ ফলনশীল।
- ফলের রঙ গাঢ় সবুজাভ, সাদা ডোরা আছে।
- ফলের দৈঘ্য ১৩.০১ সে.মি.।
- প্রতিটি ফলের ওজন ৬০-৬৫ গ্রাম।
- গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ১১২.১৬।
(৩) পটল চাষ পদ্ধতি বর্ণনা
ক) চারা উৎপাদন
- বীজ, শাখা-কলম এবং কন্দমূল (শিকড়) সব পদ্ধতিতেই পটলের বংশ বিস্তার করা যায়। তবে বাণিজ্যিক চাষের জন্য কাণ্ডের শাখা-কলম ও কন্দমূল ব্যবহার করা ভাল এবং লাভজনক।
- বীজ তলায় কিংবা সরাসরি জমিতে শাখা-কলম বা কন্দমূল লাগিয়ে চারা উৎপাদন করা যায়।
- সাধারণত পটলচাষীগণ পুরো কন্দমূল মাদায় রোপণ করেন। কন্দমূল ২-৩টি চোখসহ কেটে মাদায় লাগালে কম কন্দমূল দিয়ে বেশি জমিতে পটল চাষ করা যায়।
খ) রিং পদ্ধতিতে উন্নত শাখা কলম উৎপাদন
- ভালো এক বৎসর বয়সী গাছের যে কোন শাখার মাঝামাঝী অংশ থেকে এক মিটার বা দু’হাত লম্বা শাখা দিয়ে রিং বা চুড়ি আকার তৈরি করে পিট বা মাদায় লাগাতে হবে।
- পটলের শাখা কলম ৫০ পিপিএম ইনডোল বিউটারিক এসিড IBA দ্রবণে ৫ মিনিট ডুবিয়ে রেখে মাদায় বা পিটে লাগালে তাড়াতাড়ি এবং বেশি সংখ্যক মূল গজায়।
গ) জমি তৈরি ও চারা রোপণ
- জমিতে ‘জো’ এলে ৪-৫টি আড়াআড়ি চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করতে হবে।
- বেড পদ্ধতিতে পটল চাষ করলে ফলন ভাল হয় এবং বর্ষাকালে ক্ষেত নষ্ট হয় না।
- সাধারণত একা একটি বেড ১.২৫ মিটার বা আড়াই হাত চওড়া হয়। বেডের মাঝামাঝী এক মিটার বা দু’হাত পর পর মাদায় চারা রোপণ করতে হয়।
- এক বেড থেকে আর এক বেডের মাঝে ৭৫ সে.মি. (প্রায় দেড় হাত) নালা রাখতে হবে।
- সুষ্ঠু পরাগায়ণের জন্য জমিতে অবশ্যই মোট গাছের ১০ ভাগ পুরুষ গাছ জমির সব অংশে সমানভাবে ছড়ানো থাকা প্রয়োজন, অর্থাৎ প্রতি ৯টি স্ত্রী গাছের জন্য একটি পুরুষ গাছ প্রয়োজন।
ঘ) মাদা বা পিট তৈরি
- মাদা বা পিটের আয়তন ৫০ সে.মি. * ৫০ সেমি * ৫০ সেমি (এক হাত করে) দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীর হতে হবে।
- মাদার মাটি খুড়ে এক পার্শ্বে রেখে তাতে নির্ধারিত মাত্রায় জৈব ও রাসায়নিক সার ভালভাবে মিশিয়ে আবার সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে মাদা পূরণ করতে হবে এবং ২-৩ দিন পর তাতে চারা রোপণ করতে হবে।
ঙ) মাদা প্রতি সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ মাত্রা
নিচের তালিকা অনুযায়ী জৈব ও রাসায়নিক সার পটলের জমিতে প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়-
সারের নাম | প্রতি মাদায় চারা রোপণের সময় | প্রতি মাদায় রোপণের ২০ দিন পর (১ম কিস্তি) | প্রতি মাদায় রোপণের ৬০ দিন পর (২য় কিস্তি) | প্রতি মাদায় রোপণের ৯০ দিন পর (৩য় কিস্তি) |
গোবর বা আবর্জনা সার | ৩-৪ কেজি | – | – | – |
ইউরিয়া | – | ২০-২৫ গ্রাম | ২০-২৫ গ্রাম | ২০-২৫ গ্রাম |
টিএসপি | ৫০-৬০ গ্রাম | – | – | – |
এমওপি | – | ২০-২৫ গ্রাম | ২০-২৫ গ্রাম | ২০-২৫ গ্রাম |
- গোবর বা আবর্জনা সার ভালভাবে পচানো প্রয়োজন।
- পটল দীর্ঘ মেয়াদী সবজি ফসল, এজন্য জুন মাস থেকে ফসল সংগ্রহের পর প্রতি মাসে হেক্টরপ্রতি ১৮ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি এবং ১৪ কেজি এমপি সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এতে ফলন বেশি হবে।
চ) মাচা তৈরি ও অন্যান্য পরিচর্যা
- পটল একটি লতানো উদ্ভিদ। বাশের কাঠির সাহায্যে চারা গাছকে মাচায় তুলে দেয়া হয়। এক মিটার বা দু’হাত উচ্চতার বাঁশের মাচায় পটলের ভাল ফলন পাওয়া যায়।
- প্রতিবার ফসল সংগ্রহের পর মরা পাতা ও শাখা ছাটাই করা প্রয়োজন। এতে ফলধারী নুতন শাখার সংখ্যা বেড়ে যায় এবং ফলন বেশি হয়।
- সময়মতো সেচ দিয়ে অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ ও নিড়ানী দিতে হবে।
- যদি জমিতে স্ত্রী গাছের তুলনায় পুরুষ গাছের সংখ্যা কম থাকে তাহলে হাত দিয়ে পরাগায়ণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কৃত্রিম পরাগায়ণ সকাল ৬-৭ টার মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। কারণ এ সময় পটলের ফুল পরাগায়ণের জন্য উপযোগী থাকে।
ছ) রেটুন (মুড়ি) ফসল
- যে সমস্ত ফসল একবার সংগ্রহের পর একই গাছ হতে পরবর্তী বছর পরিচর্যার মাধ্যমে ফলন পাওয়া যায়, সে সমস্ত ফসলকে মুড়ি ফসল বলে।
- পটল গাছ একাধিক বছর বেঁচে থাকে। সুতরাং একবার লাগানোর পর ২-৩ বছর যাবৎ ফসল সংগ্রহ করা যায়।
- পটল গাছে প্রথম বছর ফলন কম হয়, দ্বিতীয় বছর ফলন বাড়ে, কিন্তু তৃতীয় বছর থেকে আবার ফলন কমতে থাকে। তাই তিন/চার বছর বেশি সময় ধরে ফলন নেওয়া উচিত নয়।
- প্রথম বছর ফসল সংগ্রহের পর নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে মাটির উপরিভাগ বরাবর গাছ কেটে দিতে হবে।
- জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে সেচ প্রয়োগের পর “জো” অবস্থায় গাছের গোড়ায় মাটি কুপিয়ে অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে রেটুন ফসলে আগাম ফলন পাওয়া যায়।
জ) ফসল সংগ্রহ ও ফলন
- কচি অবস্থায় সকাল অথবা বিকালে পটল সংগ্রহ করা উচিত।
- সাধারণত জাতভেদে ফুল ফোঁটার ১০-১৫ দিনের মধ্যে পটল সংগ্রহের উপযোগী হয়।
- সপ্তাহে কমপক্ষে একবার ফল সংগ্রহ করা উচিত।
- জাতভেদে হেষ্টরপ্রতি ফলন ১০-৪০ টন।
[সূত্র: বিএআরআই]