পানি সেচ হলো জমিতে ফসল ফলানোর জন্য কৃত্রিমভাবে মাটিতে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা। স্বল্প বৃষ্টি এবং অনাবৃষ্টির সময় পানির অভাবে ফসল উৎপাদন যাতে বাধাগ্রস্থ না হয় সেজন্য গাছের বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কৃত্রিমভাবে জমিতে এই পানি সরবরাহ করা হয়।
এ পাঠটি শেষ অবধি অধ্যয়ন করলে আপনি- পানি সেচ কি, পানি সেচ কাকে বলে, সেচের পানির মূল উৎস কোনটি তা জানতে পারবেন। পানি সেচের প্রয়োজনীয়তা কি তা বুঝতে পারবেন। ফসলের পানি ন্যুনতম চাহিদা সম্বন্ধে অবগত হতে পারবেন।
(১) পানি সেচ কাকে বলে?
পানি সেচ কাকে বলে: উদ্ভিদের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য কৃত্রিম উপায়ে ফসলের জমিতে পানি প্রয়োগ করাকে পানি সেচ বলে।
অপর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে বা সময়মত বৃষ্টিপাত না হলে উদ্ভিদ প্রয়োজনীয় পরিমান পানি পায় না। এর ফলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যহত হয়। এ সমস্যা মোকাবেলার জন্য জমিতে সময়মত সেচ দেয়া একান্ত প্রয়োজন।
আমাদের বাংলাদেশে শীতকালে সেচ ছাড়া ফসল উৎপাদন করা খুবই অনিশ্চিত। কারণ এ সময়ে বৃষ্টিপাত খুবই কম হয় বলে জমিতে রসের অভাব দেখা দেয় যা শীতকালীন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে।
(২) পানি সেচের প্রয়োজনীয়তা কি?
ফসলের সুষ্ঠু বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য পানি অপরিহার্য। এজন্য কৃষি কাজে পানি সেচের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
নিম্নে পানি সেচের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
- সেচের পানি মাটিতে সি ত খাদ্যোপাদানসমূহকে দ্রবীভূত করে উদ্ভিদের জন্য সহজলভ্য করে।
- গাছ তার প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান পানির সাহায্যে মাটি থেকে পরিশোষণ করে।
- সেচের পানি জৈব পদার্থের দ্রুত পচন ঘটিয়ে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।
- মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
- জমির লবনাক্ততা বা ক্ষারত্ব দূর করার জন্য সেচ প্রয়োজন।
- সেচের পানি মাটিতে উপকারী অণুজীবের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
- জমির জো অবস্থা আনতে সেচের প্রয়োজন।
- বপনকৃত বীজের জন্য পর্যাপ্ত আদ্রর্তা সরবরাহ করে বীজের অঙ্কুরোদগম ত্বরান্বিত করে।
- সেচ দিলে সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।
- সেচ দেয়ার জন্যই শুকনো মৌসুমে বোরো ধান আবাদ সম্ভব হয়।
- সেচ দেয়ার ফলে কৃষক উচ্চ মূল্যমানের ফসল যেমন সবজি, আলু, আখ ইত্যাদি উৎপাদন করতে পারে।
- মাটিতে বসবাসকারী পোকামাকড় ও রোগ জীবাণু দমনের জন্য সেচ প্রয়োজন।
- সেচের মাধ্যমে একই জমিতে বছরে একের অধিক ফসল উৎপাদন করা যায়।
- আগাছা দমন, বীজতলায় চারা উৎপাদন ও চারা উত্তোলনের জন্য সেচ প্রয়োজন।
- সর্বোপরি ফসলের ফলন বৃদ্ধিতে সেচের গুরুত্ব অপরিসীম।
(৩) সেচের পানির মূল উৎস কোনটি?
সেচের পানির মূল উৎস কোনটি: সেচের পানি প্রধানত দুটি উৎস থেকে পাওয়াা যায়, যথা-
- ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি বা মাটির উপরের পানি এবং
- ভূ-গর্ভস্থ পানি বা মাটির অভ্যন্তরের পানি।
ক) ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি: বৃষ্টিপাত, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়, পুকুর, হ্রদ, বরফ গলা পানি ইত্যাদি ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির উৎস। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়, পুকুর এসব জলাশয়ে পরিকল্পিতভাবে পানি জমা করে ফসলের জমিতে সেচ দেওয়া যায়। পাওয়ার পাম্প, সেউতি, দোন ইত্যাদি সেচ যন্ত্রের সাহায্যে ভূ-পৃষ্ঠের পানি সেচের কাজে ব্যবহার করা হয়।
খ) ভূ-গর্ভস্থ পানি: মাটির অভ্যন্তরে সংরক্ষিত পানি হচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানি। ভূ-গর্ভস্থ পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ সেচের উৎস। বৃষ্টিপাত, বরফ গলা পানি, বন্যা ও বিভিন্ন জলাশয়ের পানি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে মাটির গভীরে গিয়ে জমা হয়। এ পানি গভীর ও অগভীর নলকূপ খনন করে পাম্প দ্বারা তুলে সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে ভূ-গর্ভস্থ পানি দ্বারা চাষাবাদ করা হয়।
(৪) সেচের পানির গুণাগুণ
ফসল উৎপাদন ও মাটির উর্বরতা অনেকটা নির্ভর করে সেচের পানির গুণাগুণের উপর। ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূ-নিম্নস্থ পানির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লবণ ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য দ্রবীভূত থাকে। এসব লবণ ও রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমান বেশি হলে তা গাছের জন্য ক্ষতিকর। পানির রাসায়নিক পদার্থগুলোর মধ্যে রয়েছে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, বাইকার্বনেট, সালফেট ইত্যাদি।
- সোডিয়াম কার্বনেট যৌগ পানিতে বেশি পরিমান থাকলে ফসল তা সহ্য করতে পারে না।
- সেচের পানি ঘোলা হলে তা মাটির রন্ধ্র বন্ধ করে দেয় ফলে মাটি শক্ত করে ফেলে।
- সেচের পানিতে বিষাক্ত আর্সেনিক, ক্যালসিয়াম, সীসা থাকে যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর।
সেচকৃত পানির গুনগতমান যাচাই এর জন্য নিম্ন বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনা করা হয়। যথা-
- পানিতে দ্রবীভূত লবণের মোট ঘন মাত্রা
- সোডিয়ামের ঘনত্ব (ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম সাপেক্ষে)
- কার্বনেট ও বাই-কার্বনেটের ঘনমাত্রা
- বোরনের পরিমান।
(৫) বিভিন্ন ফসলের ন্যূনতম পানির চাহিদা
ফসলের নূন্যতম পানির চাহিদা কাকে বলে: কোন একটি ফসল তার জীবন চক্র সম্পন্ন করতে মাটি হতে মোট যে পরিমান পানি গ্রহণ করে তাকে ফসলের পানি চাহিদা বলে। অপরদিকে যে পরিমান পানি গ্রহণ করতে না পারলে কোন ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয় সেই পারিমান পানিকে ফসলের নূন্যতম পানির চাহিদা বলে।
ফসলের পানির ক্রান্তিকাল কাকে বলে: ফসলের পানির পরিমান ফসলের জীবনকাল, মাটির ধরন, বৃদ্ধি পাওয়া ও আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে। আবার গাছের জীবনচক্রে সব সময় সমান পরিমান পানি লাগে না। ফসলের যে বৃদ্ধি পর্যায়ে পানির অভাব হলে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায় তাকে ফসলের পানির ক্রান্তিকাল বলে।
নিম্নবর্ণিত সূত্রের সাহায্যে ফসলের পানি চাহিদা নির্ণয় করা যায়-
WR = (IR + ER + S)
যেখানে,
WR = মোট পানির চাহিদা
IR = সেচ পানি
ER = কার্যকরী বৃষ্টিপাত
S = মাটি থেকে সরবরাকৃত পানি
নিম্নে কিছু ফসলের ক্রান্তিকাল ও পানির পরিমান দেয়া হলো-
ফসলের নাম | ক্রান্তিকাল | সম্ভাব্য দিন (চারা রোপনের পর থেকে) | পানির পরিমান (মি.লি.) |
ধান | ১. চারা রোপন ২. কুশি উৎপাদন ৩. শীষ উৎপাদন ৪. পুস্পায়ন ৫. দুধ উৎপাদন পর্যায় | ১-৩১ ৫-১৭ ৫০-৭০ ৫৫-৭৫ ৮৫-৯৫ | ৯০০-২৫০০ |
গম | ১. মুকুট মূল উৎপাদন ২. কুশি উৎপাদন ৩. পুস্পায়ন পর্যায় ৪. দুধ উৎপাদন পর্যায় | ১৫-২০ ৩০-৩৫ ৬০-৭০ ৭৫-৮০ | ৪০০-৪৫০ |
ভূট্টা | ১. ফুল উৎপাদন ২. দানা পুষ্ট হওয়ার সময় | ৬০-৭০ ৮৫-৯৫ | ৪০০-৬০০ |
আলু | ১. শিকড় গজানোর সময় ২. টিউবার তৈরির সময় ৩. টিউবার বড় হবার সময় | ১৫-২০ ২৫-৩০ ৫০-৬০ | ৫০০-৭০০ |
সরিষা | ১. প্রাক পুস্পায়ন ২. পড তৈরি | ৪৫-৫০ ৬০-৭০ | ১৫০-৩০০ |
সূর্যমুখী | ১. প্রাক পুস্পায়ন ও পুস্পায়ন ২. বীজ পুষ্ট হবার আগে | ৩০-৫০ ৬০-৭০ | ৩৫০-৫০০ |
ফুলকপি | ফুল উৎপাদন | ৫০-৮০ | ৪০০-৫০০ |
বাঁধাকপি | হেড উৎপাদন | ৪৫-৫৫ | ৮০-৫০০ |
পিঁয়াজ | বাল্ব উৎপাদন ও প্রাক-সংগ্রহকালীন | ৪৫-৫৫ | ৫০০-৭০০ |
আখ | কুশি উৎপাদন এবং কান্ড লম্বা হওয়ার সময় | ৪০-১৮০ | ১৪০০-৩০০০ |
টমেটো | পুষ্পায়ন ও ফল ধারণ | ৫৫-৭৫ | ৬০০-৮০০ |
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা পানি সেচ কি, পানি সেচ কাকে বলে, পানি সেচের প্রয়োজনীয়তা কি, সেচের পানির মূল উৎস কোনটি, সেচের পানির গুণাগুণ, বিভিন্ন ফসলের ন্যূনতম পানির চাহিদা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলাম।
ফসলের বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য জমি বা মাটির কোন ক্ষতি সাধন না করে কৃত্রিম উপায়ে প্রয়োজনীয় পরিমান পানি ফসলের জমিতে সরবরাহ করাকে পানি সেচ বলে। সেচের পানি মাটির খাদ্য উপাদান দ্রবীভূত করে এবং গাছের জন্য সহজলভ্য করে। জমির জো অবস্থা আনতে, জমির লবনাক্ততা, ক্ষারত্ব দূর করতে, অনুজীবের কার্যাবলি বাড়াতে, সারের কার্যকারিতা বাড়াতে সেচ প্রয়োজন।
সেচের পানির দুইটি উৎস রয়েছে- ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূ-গর্ভস্থ পানি। মাটির উর্বরতা ও ফসল উৎপাদন সেচের পানির গুণাগুণের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। ফসলের পানির ন্যূনতম চাহিদা হল যে পরিমাণ পানি গ্রহণ করতে না পারলে ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত হয়। আবার ফসলের যে বৃদ্ধি পর্যায় পানির অভাব হলে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যায় তাকে ফসলের পানির ক্রান্তিকাল বলে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।