বাংলাদেশের ছোট মাছগুলোর মধ্যে পাবদা ও গুলশা/টেংরা মাছ আবহমান কাল থেকে বাঙ্গালীদের খুব প্রিয় মাছ হিসেবে সমাদৃত। খেতে সুস্বাদু ও কাঁটা কম থাকার কারণে মাছ দুটি ছোটদের কাছে খুবই প্রিয়।
অতীতে বিভিন্ন প্রাকৃতিক জলাশয় যেমন: নদী- নালা, খাল-বিল, পাবনভূমি, ধানক্ষেত, হাওর, বাওড়ে পাবদা ও গুলশা মাছ প্রচুর পরিমানে পাওয়া যেত। কিন্তু নদীর উজানে চড় জেগে উঠার জন্য পানির নাব্যতা কমে যাওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মান, ধানক্ষেতে কীটনাশকের ব্যবহার, বিল-ঝিল শুকিয়ে মাছ ধরা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে এই সব মাছের প্রজনন ও চারণক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ারফলে এদের প্রাচুর্যতা ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। IUCN (২০০৩) এর সমীক্ষায় পাবদা ও গুলশা মাছকে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে।
বাজারে পাবদা ও গুলশা মাছের সরবরাহ কম এবং চাহিদা বেশী হওয়ার কারণে বাজার মুল্য রুইজাতীয় মাছের তুলনায় অনেক বেশী । ইদানিং বিপন্ন প্রজাতির এই পাবদা ও গুলশা মাছ চাষে চাষী ও উদ্যেক্তাদের মাছে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এ পাঠ শেষে আপনি- পাবদা মাছ ও গুলশা মাছ এর পরিচয় পাবেন; গুলসা মাছ ও পাবদা মাছ চাষ পদ্ধতি শিখতে পারবেন; পাবদা মাছের চাষ পদ্ধতি ও গুলশা মাছ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারবেন; একক ও মিশ্রভাবে গুলসা মাছ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে পারবেন।
(১) পাবদা ও গুলশা মাছের পরিচিতি
নদী নালা খাল বিলে সমৃদ্ধ এদেশে ছোট মাছগুলোর মধ্যে পাবদা, গুলশা/টেংরাও অন্যতম। খেতে সুস্বাদু ও কাটা কম থাকায় সবার কাছে এ মাছগুলো খুব প্রিয়। তবে কালের বিবর্তনের সাথে অনেক মাছের মত হারিয়ে যাচ্ছে এসব প্রজাতির মাছ।
পাবদা মাছের ছবি:
পাবদা মাছ ১৫-৩০ সে.মি. লম্বা হয়ে থাকে। এদের দেহ চেপ্টা এবং সামনের চেয়ে পিছনের দিকে ক্রমশ সরু। মাছের মুখ বেশ বড় এবং বাকানো। মুখের সামনের দিকে ২ জোড়া লম্বা গোঁফ আছে। দেহের রং সাধারণত উপরিভাগে ধূসর রূপালি এবং পেটের দিকে সাদা। ঘারের কাছে কানকোর পিছনে কালো ফোটা আছে।
গুলশা/টেংরা মাছের ছবি:
গুলশা মাছ দৈর্ঘ্য ১৫-২৩ সে.মি. মাছের দেহ পার্শ্বীয়ভাবে চাপা। পিছের অংশ বাকানো মুখ বেশ ছোট এবং মুখে ৪ জোড়া গোঁফ আছে। শরীরের রং জলপাই ধুষর এবং নিচের দিকে কিছুটা হালকা।
(২) পাবদা ও গুলশা মাছের বৈশিষ্ট্য
অর্থনৈতিক ও পুষ্টিমান বিবেচনায় পাবদা ও গুলশা মাছের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। অত্যন্ত সুস্বাদু বিধায় সব ধরনের ক্রেতার কাছে এ মাছ গুলোর বিশেষ কদর রযেছে। সে কারণে এ মাছের চাহিদা ও বাজার মূল্য বেশী।
নিম্নে এই মাছ ২টির বিশেষ বৈশিষ্ট দেয়া হলো-
- গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে ।
- প্রচুর পরিমানে আমিষ ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বিদ্যমান থাকে ।
- ছোট কিংবা বড় জলাশয়ে সহজ ব্যবস্থাপনায় চাষ করা যায়।
- কার্পজাতীয় মাছের সাথেও একত্রে চাষ করা যায়।
- খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতারা বড় মাছের তুলনায় এই মাছগুলো বেশী পছন্দ করে।
- বাজারে প্রচুর চাহিদা ও সরবরাহ কম থাকায় এর মূল্য অন্যান্য মাছের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী।
(৩) পাবদা ও গুলশা মাছ চাষে সুবিধাসমূহ
- গ্রামীন জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
- এদের প্রচুর পরিমাণে আমিষ ও মাইক্রোনিউট্রেন্ট বিদ্যমান থাকে।
- ছোট বা বড় জলাশয়ে সহজ ব্যবস্থাপনায় চাষ করা যায়।
- কার্পজাতীয় মাছের সাথেও মিশ্র চাষ করা যায়।
- খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতারা বড় অন্যান্য মাছের তুলনায় এই মাছ বেশি পছন্দ করে।
- বাজারে প্রচুর চাহিদা ও সরবরাহ কম থাকায় এদের মূল্য অন্যান্য মাছের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি।
(৩) পাবদা ও গুলশা মাছের চাষ পদ্ধতি
পুকুর প্রস্তুতি:
- শুকনো মৌসুমে পুকুর থেকে জলজ আগাছা পরিষ্কার ও পাড় মেরামত করতে হবে।
- পুকুর থেকে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করার জন্য মিহি ফাঁসের জাল টেনে এদের সরাতে হবে।
- রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করার পর শতাংশে ১ কেজি চুন, ৩-৪ দিনি পর ৬-৮ কেজি পঁচা গোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে।
পোনা মজুদ:
প্রতি শতাংশ ৫-৭ সে.মি. আকারের ২০০টি গুলশা, ১০০ টি পাবদা এবং ১০-১২ সে.মি. আকারের ১২টি রুই ও ২টি গ্রাস কার্প এর সুস্থ সবল পোনা মজুদ করতে হবে। পুকুরে পোনা ছাড়ার আগে পরিমাণকৃত পোনা পুকুরের পানির তাপমাত্রার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও লবণ দিয়ে শোধণ করতে হবে।
খাদ্য ও সার প্রয়োগ:
পোনা ছাড়ার পরের দিন থেকে চালের কুঁড়া ৪০%, গমের ভুষি ২৫%, সরিষার খৈল ২০% এবং ফিস মিল ১৫% হিসেবে মাছের দেহ ওজনের ৩-৮% হারে দেয়া যেতে পারে।
ব্যবস্থাপনা:
- পুকুরের তলদেশে কাদা থাকলে ক্ষতিকর গ্যাস জমে থাকতে পারে। দড়ির সাথে লোহা বা মাটির কাঠি কিংবা ইট বেঁধে হররা তৈরি করে পুকুরের তল ঘেষে আস্তে আস্তে টেনে তলার গ্যাস বের করে দিতে হবে।
- প্রতি মাসে একবার কিছু মাছ ধরে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
- নিয়মিত খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
- পুকুরের পানি কমে গেলে পানি সরবরাহ করতে হবে।
- পানি বেশি সবুজ হয়ে গেলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
আহরণ:
- রুই জাতীয় মাছ ও পাবদা গুলশার মাছের বৃদ্ধির হার সমান নয়। বেশি লাভের জন্য বড় মাছ আহরণ করে ছোট মাছগুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তাই রুই জাতীয় যে মাছগুলো ৫০০-৭০০ গ্রামের উপরে হয়ে তা আহরণ করে সমসংখ্যাক পোনা ছাড়তে হবে।
- বছর শেষে সব মাছ আহরণ করে ফেলতে হবে। বাজার দর এবং পরবর্তী ফসলের জন্য পোনা প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে চূড়ান্ত আহরণ কাল নির্ধারণ করতে হবে।
- পাবদা ও গুলশা মাছ ৮-৯ মাস চাষে যথাক্রমে ২৫-৩০ গ্রাম ও ৪৫-৫০ গ্রাম হয় এবং তা বিক্রয়ের জন্য উপযুক্ত হয়।
(৪) পাবদা ও গুলশা মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতি
সম্প্রতি বিপন্ন প্রজাতির এসব মাছের বিলুপ্তি রোধকল্পে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের গবেষণায় কৃত্রিম প্রজনন, পোনা লালন-পালন এবং চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সফল্য অর্জিত হয়েছে।
ক) পাবদা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন পদ্ধতি
পাবদা মাছের কৃত্রিম প্রজননের জন্যে নিম্নোক্ত ধাপসমূহ অনুসরণ করতে হয়। নিম্নে ধাপসমূহের বর্ণনা দেয়া হলো-
ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা:
- শীত মৌসুমে প্রাকৃতিক জলাশয় যেমন নদী, বিল, হাওড় থেকে সুস্থ-সবল ও
- রোগমুক্ত পাবদা মাছ সংগ্রহ করতে হবে।
- ব্রুড মাছের মজুদ পুকুর পরিমিত চুন, সার ও গোবর দিয়ে প্রস্তুত করতে হয় ।
- মাছ মজুদের আগে অবশ্যই ১.৫-২.০ পিপিএম পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেট বা
- লবণ জলে ধৌত করে মজুদ করতে হবে।
- পরিপক্ক ব্রুড মাছ তৈরী করতে হলে শতাংশে ৫০-৮০ গ্রাম ওজনের ৮০-
- ১০০ টি মাছ মজুদ করা যায়।
- সম্পুরক খাদ্য হিসাবে চালের কুঁড়া (২০%), সরিষার খৈল (১৫%), ফিশ মিল
- (৩০%), মিট ও বোন মিল (১০%), সয়াবিন গুড়া (২০%), আটা (৪%),
- ভিটামিন ও খনিজ লবন (১%) এর মিশ্রণ প্রতিদিন মজুদকৃত মাছের দৈহিক
- ওজনের ৭-৮% সরবরাহ করতে হবে।
- ব্রুড মাছের পুকুরে প্রতি সপ্তাহে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
- এ পদ্ধতিতে ৪-৫ মাস পালনের পর মাছ প্রজননক্ষম হয়ে থাকে।
প্রজননক্ষম মাছ সনাক্তকরণ:
প্রজনন মৌসুমে নুিলিখিত বৈশিষ্টের কারণে সহজেই স্ত্রী ও পুরুষ মাছ সনাক্ত করা যায়-
- পরিপক্ক পুরুষ পাবদা মাছের পেক্টোরাল স্পাইনের ভিতরের দিকে খাজ থাকে, অপরপক্ষে স্ত্রী মাছের পেক্টোরাল স্পাইনের ভিতরের দিকে খাঁজ থাকে না।
- তা ছাড়া প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী মাছের পেট ডিমে ভর্তি থাকে বিধায় ফোলা দেখা যায় আর পুরুষ মাছের পেট চেপ্টা থাকে।
- পুরুষ মাছ সাধারণত স্ত্রী মাছের তুলনায় আকারে ছোট হয়।
কৃত্ৰিম প্ৰজনন পদ্ধতি:
- পাবদা মাছ মে হতে জুলাই মাস পর্যন্ত প্ৰজনন করে থাকে। নিম্নবর্ণিত পদ্ধতিতে এ মাছের কৃত্রিম প্রজনন করা হয়।
- কৃত্রিম প্রজননের জন্য পরিপক্ক স্ত্রী ও পুরুষ মাছ পুকুর থেকে ধরে হ্যাচারীর ট্যাঙ্কে ৬-৭ ঘন্টা রাখা হয়ে থাকে।
- স্ত্রী ও পুরুষ উভয় মাছকে দুটি করে পিটুইটারী দ্রবণের ইনজেকশন পৃষ্ঠপাখনার নীচের মাংশে দেয়া হয়।
- ১ম ইনজেকশন মাত্রাঃ পুরুষ মাছ-৬ মিলিগ্রাম পিজি/কেজি ও স্ত্রী মাছ-৩ মিলিগ্রাম পিজি/কেজি।
- ২য় ইনজেকশন মাত্রাঃ ১ম ইনজেকশন দেয়ার ৬ ঘন্টা পর প্রতি কেজি পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে যথাক্রমে ৭-৮ ও ১৪-১৮ মিলিগ্রাম পিজি দ্রবণের ইনজেকশন দিতে হয়।
- অতপর ১ঃ১ অনুপাতে পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে হাপাতে রেখে কৃত্রিম ঝর্ণার মাধ্যমে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হবে। ২য় ইনজেকশন দেয়ার ৮-৯ ঘন্টা পর প্রাকৃতিক প্রজনন ক্রিয়ার মাধ্যমে মাছ ডিম দিয়ে থাকে।
- ডিম দেয়ার পর ব্রুড মাছগুলোকে হাপা থেকে সরিয়ে ফেলতে হয়। সাধারনতঃ ১৮-২০ ঘন্টা পর ডিম ফুটে রেণু পোনা বের হয় ।
- ডিম থেকে রেণু পোনা বের হওয়ার পর হাপাতে ২-৩ দিন রাখতে হয়। পরবর্তীতে রেণুগুলোকে ২-৩ দিন হাঁস/মুরগীর সিদ্ধ ডিমের কুসুম দিনে ৪ বার খাবার হিসাবে দিতে হবে।
পোনার নার্সারী ব্যবস্থাপনা:
- নার্সারী পুকুরের আয়তন ১০-২০ শতাংশ এবং গভীরতা ০.৮০-১.০ মিটার হলে ভাল হয় ।
- প্রস্তুতির সময় পুকুর ভাল ভাবে শুকিয়ে নিতে হয়। অতপর: প্রতি শতাংশে ১.০ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
- চুন প্রয়োগের ৩ দিন পর, পুকুর ৩-৪ ফুট বিশুদ্ধ পানি দিয়ে পূর্ণ করতে হয়।
- চুন প্রয়োগের ৩ দিন পর প্রাকৃতিক খাবার জন্মানোর জন্য শতাংশে ১৫-২০ কেজি গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে।
- গোবর দেয়ার ৫-৬ দিন পর শতাংশে ১.০-১.৫ সেন্টিমিটার আকারের ৩,০০০-৪,০০০টি পাবদার রেণু পোনা ছাড়া যায়।
- রেণু পোনা ছাড়ার পর ১ম ১০ দিন প্রতিদিন মজুদকৃত রেণু পোনার মোট ওজনের শতকরা ১০০ ভাগ নার্সারী ফিড (৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ) পানিতে গুলে খাদ্য হিসাবে সরবরাহ করতে হবে।
- ২য় ১০ দিন ৩৫% প্রোটিন সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য পোনার মোট ওজনের শতকরা ৮০ ভাগ পানিতে গুলে খাদ্য হিসাবে সরবরাহ করতে হবে।
- ৩য় ও ৪র্থ ১০ দিন এই খাদ্যের পরিমান যথামে পোনার মোট ওজনের শতকরা ৬০ ও ৪০ সরবরাহ করতে হয়।
- সার হিসাবে সপ্তাহে শতাংশ প্রতি ৫ কেজি গোবর এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি দিলে ভাল ফল পাওয়া যায় ।
- ৩০-৪০দিন পর লালনের পর পোনার ওজন যখন ২.০-২.৫ গ্রাম হয় তখন তা চাষের পুকুরে ছাড়তে হবে।
খ) গুলশা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন পদ্ধতি
ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা:
কৃত্রিম প্রজননের জন্য প্রাকৃতিক জলাশয় (নদী, হাওড়, বিল) হতে গুলশা মাছ সংগ্রহ করা যেতে পারে। এ মাছের প্রজনন কাল মে হতে আগষ্ট মাস পর্যন্ত। প্রজনন মৌসুমের পূর্বে গুলশা মাছ সংগ্রহ করে পরিচর্যার মাধ্যমে ব্রুড মাছ তৈরী করা হয়।
নিম্নে ব্রুড সংগ্রহ ও পরিচর্যা বিষয়ে বর্ণনা করা হলো-
- প্রজনন পুকুরের আয়তন ২৫-৩০ শতাংশ এবং গভীরতা ৪-৫ ফুট হতে হবে।
- চুন ও সার প্রয়োগে পুকুর প্রস্তুতির পর গুলশা মাছ এককভাবে মজুদ করতে হয়।
- প্রজনন মৌসুমের ৩-৪ মাস পূর্বে অর্থাৎ জানুয়ারী/ফেব্রুয়ারী মাসে ৪০-৫০ গ্রাম ওজনের গুলশা মাছ সংগ্রহ করে শতাংশে ৬০ -৭০ টি পুকুরে মজুদ করতে হবে।
- সম্পূরক খাবার হিসেবে সুষম খাদ্য তৈরীর লক্ষ্যে চালের কুঁড়া (৪০%), সরিষার খৈল (২০%), ফিশমিল (২৫%), মিট ও বোন মিল (১০%), আটা (৪%), ভিটামিন ও খনিজ লবন (১%) এর মিশ্রণ প্রতিদিন মাছের দেহ ওজনের ৭-৮% ব্যবহারে ভাল ব্রুড তৈরী হয়।
- প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্য শতাংশে ৪ কেজি গোবর এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি পর্যায়ক্রমে ১ সপ্তাহ পর পর পুকুরে ব্যবহার করতে হবে ।
কৃত্ৰিম প্ৰজনন পদ্ধতি:
গুলশা মাছের কৃত্রিম প্রজনন নিম্নবর্ণিত পদ্ধতিতে করা হয়ে থাকে-
- কৃত্রিম প্রজননের ৫-৬ ঘন্টা পূর্বে ব্রুড পুকুর থেকে প্রজননক্ষম গুলশা মাছ ধরে হ্যাচারীতে রাখা হয়।
- স্ত্রী ও পুরুষ উভয় মাছকে একটি করে পিটুইটারী দ্রবনের ইনজেকশন পৃষ্ট পাখনার নীচে দেয়া হয়।
- পিটুইটারী দ্রবণের মাত্রাঃ পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে যথাক্রমে ৪-৫ ও ৮-১২ মিলিগ্রাম পিজি/কেজি শারিরীক ওজনে প্রয়োগ করা হয়।
- ইনজেকশন দেয়ার পর ১:১ অনুপাতে পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে হাপাতে রেখে কৃত্রিম ঝর্ণার মাধ্যমে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করতে হয়।
- হাপায় পুরুষ ও স্ত্রী মাছ ছাড়ার ৭-৮ ঘন্টা পরেই মাছ প্রাকৃতিকভাবে ডিম দিয়ে থাকে। এই নিষিক্ত ডিম থেকে ২০-২২ ঘন্টা পর রেণু পোনা ফুটে বের হবে।
- অতপর রেণু পোনা হাপাতেই ২-৩ দিন রাখতে হয়। ডিম্বলি নিঃশোষিত হওয়ার পর ১.০লক্ষ রেণু পোনার জন্য প্রতিবার ১টি সেদ্ধ ডিমের অর্ধেক কুসুম খাবার হিসাবে প্রতিদিন ৪ বার সরবরাহ করতে হয়।
গুলশা পোনার নার্সারী ব্যবস্থাপনা/নার্সারী পুকুরে পোনা পালন:
- নার্সারী পুকুরের আয়তন ১০-২০ শতাংশ এবং গভীরতা ০.৮০-১.০ মিটার হলে ভাল হয়।
- পুকুর প্রস্তুতির সময়ে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মানোর জন্য শতাংশে ২০ কেজি হারে গোবর সার দিতে হবে।
- নার্সারী পুকুরে ৪-৫ দিন বয়সের রেণু পোনা শতাংশে ৮,০০০-১০,০০০ টি মজুদ করা।
- এ সময় নার্সারী পুকুরকে ১.০ মিটার উচু জাল দিয়ে ঘিরে দিতে হবে। ফলে ক্ষতিকর রাক্ষুসে ব্যাঙ বা সাপ পুকুরে প্রবেশ করে পোনার ক্ষতিসাধন করতে পারে না।
- প্রতি শতাংশে প্রম ৩ দিন ২টি করে ডিমের কুসুম পানিতে মিশ্রণ করে সকাল, দুপুর ও বিকেলে ছিটিয়ে দিতে হবে।
- ৪-৭ দিন: সকালে ও বিকেলে ৫০ গ্রাম হারে আটার দ্রবণ প্রতি শতাংশে সরবরাহ করতে হয়।
- ৮-১৫ দিন: সকাল, দুপুর ও বিকেলে ১০০ গ্রাম হারে প্রতি শতাংশে ৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য দিতে হবে।
- ১৬-৩০ দিন: সকাল, দুপুর ও বিকেলে ১২৫ গ্রাম হারে প্রতি শতাংশে ৪০% প্রোটিন সমৃদ্ধ নার্সারী খাদ্য দিতে হবে।
- রেণুপোনা ছাড়ার ৩০ দিন পর চারা পোনায় পরিণত হয়, যা চাষের পুকুরে মজুদের জন্য উপযোগী।
(৫) পাবদা ও গুলশা মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা
বিপন্ন প্রজাতির পাবদা ও গুলশা মাছ একক বা রুইজাতীয় মাছের সাথে মিশ্রচাষ করা যায়। নিচে এই মাছের চাষ পদ্ধতির বর্ণনা করা হলো।
ক) গুলশা মাছের একক চাষ
পুকুর প্রস্তুতি:
- সাধারনত: ১৫-২৫ শতাংশের যে কোন পুকুরে যেখানে পানির গভীরতা ১-১.৫ মিটার থাকে এমন পুকুর এই মাছের একক চাষের জন্য উপযোগী।
- পুকুরের পাড় মেরামত ও জলজ আগাছা পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ আবশ্যক।
- চুন প্রয়োগের ২-৩ দিন পর শতাংশে ৬ কেজি হারে গোবর সার প্রয়োগ করতে হবে ।
- গোবর সার প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হয়।
পোনা মজুদ:
- সার প্রয়োগের ৩-৪ দিন পর ৩-৪ গ্রাম ওজনের পোনা শতাংশে ২৫০টি হারে মজুদ করা যেতে পারে।
- পুকুরে পোনা ছাড়ার পূর্বে পানির তাপমাত্রা ও অন্যান্য গুনাবলী যাতে হঠাৎ করে তারতম্য না হয় সে জন্য পোনাকে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে পুকুরে ছাড়তে হবে।
খাদ্য ও সার প্রয়োগ:
- পোনা মজুদ করার পর দিন থেকে মাছের দেহ ওজনের শতকরা ৬-২০ ভাগ হারে সম্পুরক খাদ্য হিসাবে চালের কুঁড়া (২০%), ফিশমিল (৩০%), সরিষার খৈল (১৫%), মিট ও বোন মিল (১০%), সয়াবিন পাউডার (২০%), আটা (৪%), ভিটামিন ও খনিজ লবন (১%) এর মিশ্রণ সরবরাহ করতে হবে।
- সম্পুরক খাদ্য ২-৩ টি ডুবন্ত ট্রেতে করে দৈনিক ২ বার সরবরাহ করতে হয় ।
- সম্পুরক খাদ্যের পাশাপাশি পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্য সপ্তাহ অন্তর প্রতি শতাংশ পুকুরে ৪ কেজি হারে গোবর গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে।
চাষ ব্যবস্থাপনা:
পোনা মজুদত্তোর নিম্নলিখিত বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করতে হয়-
- ট্রেতে খাদ্য দেয়ার পূর্বে পূর্ববর্তী দিনের সরবরাহকৃত খাদ্য সম্পূর্ণভাবে ব্যবহার হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যে পরিমান খাদ্য অব্যবহৃত থাকবে তার সমপরিমান খাদ্য কম সরবরাহ করতে হবে ।
- প্রতি ১৫ দিন অন্তর জাল টেনে মাছের দৈহিক বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে খাদ্যের পরিমান বাড়াতে হবে।
- রৌদ্রজ্জল দিনে জৈব সার গোবর সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
- সপ্তাহে একবার পুকুরে হররা টানতে হবে ।
- পুকুরে পানি কমে গেলে বাহির হতে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে ।
- পানির স্বচ্ছতা ২০ সেঃমিঃ এর মধ্যে সীমিত থাকলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে ।
মাছ আহরণ ও উৎপাদন:
এই চাষ পদ্ধতিতে ৬ মাসে গুলশা মাছ ৫০-৬০ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। মাছ আহরণ কালে পুকুরের সমস্ত পানি শুকিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। আধা-নিবিড় পদ্ধতিতে গুলশা মাছ চাষ করে ৬-৭ মাসে হেক্টরে ২,২০০ থেকে ২,৫০০ কেজি মাছ উৎপাদন করা যায় ।
আয়-ব্যয়:
একক চাষ পদ্ধতিতে গুলশা মাছ চাষে ৬ মাসে হেক্টরে ২.২০ লক্ষ টাকা ব্যয় করে প্রায় ১.৫০-১.৮০ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করা সম্ভব।
খ) রুই জাতীয় মাছের সাথে পাবদা ও গুলশা মাছের মিশ্র চাষ
অর্থনৈতিক বিবেচনায় রুই জাতীয় মাছের সাথে পাবদা ও গুলশা মাছের মিশ্র চাষ করা লাভজনক। ফলে সহঅবস্থানের মাধ্যমে একই পুকুর থেকে বিপনড়ব প্রজাতির পাবদা, গুলশাসহ রুই জাতীয় মাছের উৎপাদন পাওয়া সম্ভব।
নিম্নে চাষ পদ্ধতির ধাপসমুহ বিধৃত করা হলো-
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি:
- মিশ্র চাষের জন্য ৪০-৬০ শতাংশ আয়তনের পুকুরের নির্বাচন করতে হবে, যেখানে বছরে কমপক্ষে ৮-৯ মাস ৪-৬ ফুট পানি থাকে।
- পুকুর থেকে রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ দুর করার জন্য মিহি ফাঁসের জাল বার বার টেনে এদের সরাতে হবে।
- রাক্ষুসে ও অবাঞ্চিত মাছ দুর করার পর শতাংশে ১ কেজি চুন, ৩-৪ দিন পর ৬-৮ কেজি পঁচাগোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হয়।
- সার প্রয়োগের ৩-৫ দিন পর পুকুরের পানি সবুজাভ হলে পোনা মজুদ করতে হবে।
পোনা মজুদ:
প্রতি শতাংশে ৫-৭ সে.মি. আকারের ৫০ টি পাবদা, ৮০ টি গুলশা এবং ১০-১২ সে. মি. আকারের ৮টি কাতলা, ১২ টি রুই, ১০ টি মৃগেল ও ২ টি গ্রাস কার্প এর সুস্থ পোনা মজুদ করতে হবে।
খাদ্য ও সার প্রয়োগ:
- পোনা ছাড়ার পরের দিন থেকে চালের কুঁড়া (৪০%), গমের ভূষি (২৫%), সরিষার খৈল (২০%) ও ফিশমিল (১৫%) মাছের দেহ ওজনের শতকরা ৩-৮ ভাগ হারে দেয়া যেতে পারে।
- পোনা মজুদের পর ১৫ দিন অন্তর শতাংশ প্রতি ৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৪ কেজি গোবর পর্যায়ক্রমে প্রয়োগ করতে হবে।
চাষ ব্যবস্থাপনা:
অপেক্ষাকৃত ভাল উৎপাদন পাওয়ার লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত বিষয় সমুহের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে-
- নিয়মিতভাবে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
- প্রতি সপ্তাহে একবার হররা টানতে হবে।
- পুকুরের পানি কমে গেলে বাহির হতে পানি সরবরাহ করতে হবে|
- পানির স্বচ্ছতা ২০ সে.মি. এর মধ্যে সীমিত থাকলে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
আহরণ ও উৎপাদন:
- পাবদা ও গুলশা মাছ যথাক্রমে ৪০-৫০ ও ৬০-৮০ গ্রাম ওজনের হলে বিয়ের জন্য আহরণ করা যেতে পারে ।
- পোনা মজুদের ৮-৯ মাস পর সমস্ত মাছ আহরণ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
- গুলশা মাছ ধরার জন্যে প্রমে ঝাঁকি জাল এবং পরে পুকুর শুকিয়ে ধরা যেতে পারে।
- উলেখিত চাষ পদ্ধতিতে হেক্টরে পাবদা ২৫০-৩২৫ কেজি, গুলশা ৮০০-৯০০ কেজি এবং রুই জাতীয় মাছ ৪,৫০০-৫,০০০ কেজি উৎপাদন পাওয়া যায় ।
আয়-ব্যয়:
পাবদা ও গুলশা মাছের সাথে রুইজাতীয় মাছ চাষেহেক্টর প্রায় ২.০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে ২.৫০ লক্ষ টাকা মুনাফা অর্জন করা যায়।
(৬) পোনা উৎপাদন এবং চাষ ব্যবস্থাপনায় সমস্যা ও পরামর্শ
সমস্যা:
পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনায় নিবর্ণিত সমস্যা সমুহ পরিলক্ষিত হয়-
- উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা না করলে ব্রুড মাছের প্রজনন পরিপক্কতা সঠিকভাবে হয় না।
- হ্যাচারীতে রেণু পোনা যথাপোযুক্ত পরিচর্যা না করলে পোনার মৃত্যুর হার বেশী হয়ে থাকে।
- পানির ভৌত রাসয়নিক গুনাগুণ মাছ চাষের উপযোগী না থাকলে মাছের বৃদ্ধি আশানুরুপ হয়না।
- হ্যাচারীতে রেণু পোনা বা পুকুরে মাছ রোগাক্রান্ত হতে পারে।
পরামর্শ:
- প্রজনন মৌসুমে ব্রুড পাবদা ও গুলশা মাছের নিবিড় পরিচর্যা করতে হবে।
- ব্রুড পাবদা ও গুলশা মাছকে আমিষ সমৃদ্ধ (৩৫-৪০%) সম্পুরক খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
- নিয়মিত পানির গুনাগুন পর্যবেক্ষন করতে হবে।
- ১৫ দিন অন্তর জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য ও প্রজনন পরিপক্কতা পর্যবেক্ষন করা প্রয়োজন।
- পোনা উৎপাদনে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করা আবশ্যক।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলেচনার মাধ্যমে আমরা পাবদা ও গুলশা মাছের পরিচিতি; পাবদা ও গুলশা মাছের বৈশিষ্ট্য; পাবদা ও গুলশা মাছ চাষে সুবিধাসমূহ; পাবদা ও গুলশা মাছের চাষ পদ্ধতি; পাবদা ও গুলশা মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতি; পাবদা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন পদ্ধতি; গুলশা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন পদ্ধতি; পাবদা ও গুলশা মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা; গুলশা মাছের একক চাষ; রুই জাতীয় মাছের সাথে পাবদা ও গুলশা মাছের মিশ্র চাষ; পোনা উৎপাদন এবং চাষ ব্যবস্থাপনায় সমস্যা ও পরামর্শ জানতে পারলাম।
নদীনালা খাল বিল সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ছোট মাছগুলোর মধ্যে পাবদা ও গুলশা অন্যতম। খেতে সুস্বাদু এবং কাটা কম হওয়ায় মাছগুলোর চাহিদা খুব বেশি। পাবদা ও গুলশা মাছ চাষের অনেক সুবিধা রয়েছে। সঠিক চাষ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করলে অধিক লাভবান ও হওয়া সম্ভব।
[সূত্র: ওপেন স্কুল; ইন বাংলা নেট কৃষি (inbangla.net/krisi)]