(১) পালংশাকের জাত পরিচিতি
ক) বারি পালংশাক-১
- জাতটি উচ্চ ফলনশীল (গড়ে ৪৯ টন/হেক্টর) এ জাতটি পোকামাকড় ও লবণাক্ততা প্রতিরোধী।
- এর পাতা আকারে বড়, বোঁটা ছোট, পাতা আকর্ষণীয় গাঢ় সবুজ রঙের, পাতা নরম, খেতে সুস্বাদু এবং শাকটির পুষ্টি গুণাগুণও অত্যন্ত উচ্চমানের।
- পাতা ও কান্ডে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং ক্যারোটিন রয়েছে।
- বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর থেকে সংগ্রহ করা যায়। ফুল দেরিতে আসে।
খ) বারি পালংশাক-২
- এই পালংশাকের জাতটি উচ্চ ফলনশীল (গড়ে ৩৫ টন/হেক্টর) এ জাতটি বিলম্বে ফুল আসে এবং পোকামাকড় ও রোগ প্রতিরোধী।
- প্রতিগাছে পাতার সংখ্যা ২০-২২ টি। পাতা সংগ্রহের সময় পাতা বড় ও সবুজ রং ধারণ করে।
- গড়ে পাতার দৈর্ঘ্য ২৯-৩২ সেমি. এবং প্রস্থ ১২-১৫ সেমি.।
- সাধারণত ফুল আসতে প্রায় ৬৫-৭০ দিন সময় লাগে।
- এই জাতটি লবণাক্ত সহিঞ্চু জাত এবং ৮-১০ dS/m পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।
(২) পালংশাক চাষ পদ্ধতি বর্ণনা
ক) মাটি ও আবহাওয়া
- বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া পালংশাক একটি কষ্ট সহিঞ্চু উদ্ভিদ।
- জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ মাটিতে পালং শাক ভালো জন্মে। তাছাড়া এঁটেল, বেলে-দোআঁশ মাটিতেও চাষ করা যায়।
- গাছের দৈহিক বৃদ্ধির জন্য ১৫-২৫০ সে. তাপমাত্রা সবচেয়ে উপযোগী।
- এ উদ্ভিদ দ্বি-বর্ষজীবী, শীতের আবেশ না পেলে ফুল ধারণ করে না।
- উচ্চ তাপমাত্রায়ও পাতা ভক্ষণযোগ্য হয়। তবে উচ্চ তাপমাত্রায় জন্মানো শাক স্বাদে ভার হয় না।
- খরিপের শেষ ভাগ থেকে পুরো রবি মৌসুমব্যাপী জন্মানো যায়। আগাম হিসেবে আগষ্ট মাস থেকে বোনা যেতে পারে। তবে অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে বপন করলেও ভাল ফলন পাওয়া যায়।
খ) উৎপাদন মৌসুম
এটি শীতকালীন পাতা জাতীয় ফসল।
গ) বপনের সময়
অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে বীজ বপন করতে হয়।
ঘ) বীজ বপন
- জমি চাষ ও মই দিয়ে ভালোভাবে মাটি ঝুরঝুরা করে নিতে হবে। তারপর জমিতে বীজ বোনতে করতে হবে।
- পালং শাকের বীজ ছিটিয়ে ও সারিতে রোপণ করা যায়। তবে সারিতে বপন করা সুবিধাজনক।
- এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব ২০ সে.মি. রাখতে হবে।
- একটি বীজ থেকে আরেকটি বীজের দূরত্ব থাকবে ১০ সেমি।
- একটি কাঠির সাহায্যে ১.৫-২.০ সে.মি. গভীর লাইন টেনে সারিতে বীজ বোনার পর মাটি সমান করে দিতে হবে।
- গর্ত তৈরি করে মাদায় বীজ বপন করলে মাদা প্রতি ২-৩ টি করে বীজ বপন করতে হয়।
- বীজ বপনের পূর্বে বীজ ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়।
ঙ) বীজ বপনের হার
১১৭ গ্রাম বীজ প্রতি শতকে বা ২৫-৩০ কেজি বীজ প্রতি হেক্টরে।
চ) সারের পমিাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
সার | মোট সারের পরিমাণ (হেক্টরে) | মোট সারের পরিমাণ (শতাংশে) | জমি তৈরির সময় + শেষ চাষের সময় (হেক্টরে) | জমি তৈরির সময় + শেষ চাষের সময় (শতাংশে) | চারা রোপণের ১০ দিন পর (হেক্টরে) | চারা রোপণের ১০ দিন পর (শতাংশে) | চারা রোপণের ৩০ দিন পর (হেক্টরে) | চারা রোপণের ৩০ দিন পর (শতাংশে) | চারা রোপণের ৪৫ দিন পর (বীজের জন্য) (হেক্টরে) | চারা রোপণের ৪৫ দিন পর (বীজের জন্য) (শতাংশে) |
গোবর | ১০ টন | ৪০ কেজি | ৫+৫ টন | ২০+২০ কেজি | – | – | – | – | – | – |
ইউরিয়া | ১৮০ কেজি | ৭০০ গ্রাম | ৭৫ কেজি | ২৫০ গ্রাম | ৩৬ কেজি | ১৫০ গ্রাম | ৩৬ কেজি | ১৫০ গ্রাম | ৩৬ কেজি | ১৫০ গ্রাম |
টিএসপি | ১২৫ কেজি | ৫০০ গ্রাম | ১২৫ কেজি | ৫০০ গ্রাম | – | – | – | – | – | – |
এমওপি | ১২৫ কেজি | ৫০০ গ্রাম | ৫০ কেজি | ২০০ গ্রাম | ২৫ কেজি | ১০০ গ্রাম | ২৫ কেজি | ১০০ গ্রাম | ২৫ কেজি | ১০০ গ্রাম |
ছ) পরিচর্যা
- জমিতে আগাছা দেখা দিলেই তা তুলে ফেলতে হবে।
- সময় মতো উপরে বর্ণিত নিয়মানুযায়ী সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
- এ শাকের জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। তাই সারের উপরিপ্রয়োগের আগে মাটির ‘জো’ অবস্থা বুঝে সেচ দেওয়া প্রয়োজন। চারা রোপণের পর হালকা সেচ দেওয়া প্রয়োজন।
- কোনো স্থানের চারা মরে গেলে অথবা বীজ না গজালে সেখানে ৭-১০ দিনের মধ্যে পুনরায় চারা রোপণ করতে হয়।
- গাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য মাটিতে বেশি দিন রস ধরে রাখা এবং মাটিতে যাতে সহজে আলো বাতাস প্রবেশ করতে পারে সেজন্য প্রতিবার জল সেচের পর আল/জমির উপরের মাটি আলগা করে দিতে হয়। গাছের বৃদ্ধি দ্রুত ও ফলন ভালো হওয়ার জন্য মাটি আলগা করে দেওয়া ভালো।
- বীজ গজানোর ৮-১০ দিন পর প্রতি মাদায় ২টি করে চারা রেখে অতিরিক্ত চারা উঠিয়ে ফাঁকা জায়গায় রোপণ করতে হয়।
- জমিতে পানি জমতে দেওয়া যাবে না এত করে পালং শাকের গোড়া পচে যায়।
- ছিটিয়ে বপন করে থাকলে বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর গাছ উঠিয়ে পাতলা করে দিতে হবে।
জ) রোগ ও পোকা দমন ব্যবস্থাপনা
গোড়া পচা রোগ, পাতার দাগ রোগ, পাতা ধ্বসা রোগ, ডাউনি মিলডিউ ইত্যাদি রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত ডাল পাতা তুলে ফেলে দিতে হবে ও প্রয়োজনে সুপারিশ অনুসারে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
পালংশাকে মাঝে মাঝে পিপঁড়া, উরচুঙ্গা, উইপোকা এবং পাতাছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দেখা যায়। আক্রমণ হলে আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হয়। আক্রমণ বেশি হলে প্রয়োজনীয় বালাইনাশক ব্যবহার করতে হবে।
ঝ) ফলন
- ৩৫ টন/হেক্টর।
- পালংশাক সংগ্রহ করা যায় বীজ বপনের এক মাস পর থেকে আবার গাছে ফুল না আসা পর্যন্ত যে কোনো সময় সংগ্রহ করা যায়।
(৩) টবে পালং শাক চাষ পদ্ধতি
ভিটামিন সমৃদ্ধ শীতকালীন সবজি পালং শাক জমির পাশাপাশি ছাদ বাগানে বা টবে চাষ করা যায়।
- ছাদে প্লাস্টিকের বড় গামলা, টব বা অর্ধ ড্রামে পালং শাকের চাষ করা যায়।
- বীজ বপনের আগে প্রতিটি ড্রাম বা টবের মধ্যে দোঁ-আশ মাটি ১০-১২কেজি, পচা আবর্জনা সার ৫কেজি, পচা গোবর ৫ কেজি, ছাই ৫ কেজি, টিএসপি ও এমপি যথাক্রমে ১০০ ও ১২০গ্রাম এবং ১০০-১১০গ্রাম পরিমাণ সরিষার খৈল মেশাতে হবে।
- সার ও মাটি মেশানেরা আগে লক্ষ্য রাখতে হবে, এগুলো মাঝারি ধরনের শুকনো আছে কি-না।
- যদি ভেজা থাকে তাহলে রোদে কিছুটা শুকিয়ে নেয়া উচিত।
- অতঃপর ড্রাম বা টব সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে ভরাট করতে হবে। তারপর বীজ বোনতে হবে।
- বীজ বোনার পর হালকা পানি দেয়া প্রয়োজন।
- সকাল-বিকাল দিনে দু’বার পানি দিতে হবে।
- টবে যেন অতিরিক্ত পানি জমে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত।
- চারা গজানোর পর গোড়ায় কোনো আগাছা জন্মালে তা তুলে দিতে হবে।
- চারা গজানোর ১৫-২০দিন পর থেকে ঘন জায়গার চারা তুলে পাতলা করে দিতে হয়।
- গামলা, ড্রাম বা টব প্রতি ১০-১৫গ্রাম ইউরিয়া সার ১৫, ২৫ ও ৩৫দিন পরপর প্রয়োগ করতে হবে।
(৪) পালং শাক চাষের প্রয়োজনীয়তা
- পালং শাকে আছে উচ্চ মাত্রার ম্যাগনেসিয়াম, যা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
- এতে থাকা বেশি মাত্রার ভিটামিন এ, লিম্ফোসাইট বা রক্তের শ্বেত কণিকা দেহকে বিভিন্ন সংক্রমণ ও রোগ থেকে রক্ষা করে।
- এতে থাকা ১০টিরও বেশি ভিন্ন ধরনের ফ্ল্যাভোনয়েড ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে।
- এর উচ্চ মাত্রার বিটা ক্যারোটিন চোখের ছানি পড়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
- এর ভিটামিন ‘এ’ ত্বকের বাইরের স্তরের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- এতে ফলিক এসিড থাকায় তা হৃদ যন্ত্রের সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে সক্ষম।
- প্রাপ্ত বয়স্ক ঘন সবুজ পালং পাতায় উচ্চ মাত্রায় ক্লোরোফিল থাকায় এতে ক্যারটিনয়েড বিদ্যমান আর তা আমাদের শরীরে ব্যাথা নাশক ও ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
এককথায়, পালং শাক কমবেশি প্রায় সবারই প্রিয়। এই শাক রান্না করা ঝোল অনেকে স্যুপের মতো করে খায়। এই শাক ভাজি হিসেবে খাওয়া যায়, রান্না করেও মাছের সঙ্গে খাওয়া যায় সহজেই।
[সূত্র: বিএআরআই]