পেঁয়াজ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত মসলা জাতীয় ফসল। সবজি ও সালাদ হিসেবে এবং আচার, কেচাপ ও সস তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। এর অনেক ওষধি গুণ রয়েছে। ক্ষত প্রতিষেধক হিসেবে এবং সদির্ -কাশি, আমাশয়, উচ্চ রক্তচাপ, পেটফাঁপা ইত্যাদি নিরাময়ে পেঁয়াজ ব্যবহৃত হয়।
এ পাঠ শেষে আপনি- পেঁয়াজের উদ্ভিদতাত্ত্বিক পরিচিতি, জাত ও বংশবিস্তার সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন। পেঁয়াজের জলবায়ুগত চাহিদা ও মাটি বিষয়ে বজানতে পারবেন। পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি শিখতে পারবেন।
নিম্নে বিনস্তারিতভাবে পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো-
(১) পেঁয়াজের উদ্ভিদতাত্ত্বিক পরিচিতি
- পেঁয়াজ একটি দ্বিবর্ষজীবী উদ্ভিদ। তবে আমাদের দেশে এর একবর্ষজীবী জাতও দেখা যায়। পেঁয়াজ এর বৈজ্ঞানিক নাম Allium cepa.
- পেঁয়াজের রূপান্তরিত কান্ড সংলগ্ন পাতার গোড়ায় খাদ্য জমাটের ফলে স্ফীত হয় এবং কান্ডের সাথে একটির পর একটি সংযোজিত হয়ে শল্ককন্দ উৎপাদন করে। এ শল্ককন্দ পেঁয়াজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ থেকে নতুন গাছ জন্মে থাকে।
- পেঁয়াজের ফুল উভলিঙ্গী ,ফল ক্যাপসুল জাতীয় এবং বীজের রং কালো।
(২) পেঁয়াজের জাত
- বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন জাতের পেঁয়াজ দেখা যায়। পেঁয়াজ আকার, আকৃতি, রং, ঝাঁঝ, বাণিজ্যিক ব্যবহার ও পরিকপক্কতার সময় অনুসারে বিভিন্ন রকম হয়।
- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি পেঁয়াজ-১, ২ এবং ৩ নামে পেঁয়াজের তিনটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। এদের মধ্যে বারি পেঁয়াজ-১ শীতকালে এবং বারি পেঁয়াজ-২ ও ৩ গ্রীষ্মকালে চাষের উপযোগী।
- পেঁয়াজের স্থানীয় জাতের মধ্যে তাহেরপুরী, ফরিদপুর ভাটি, কৈলাশনগর অন্যতম।
(৩) পেঁয়াজের বংশবিস্তার
বীজতলায় চারা উৎপাদন করে জমিতে রোপণ, সরাসরি ক্ষেতে বীজ বপন বা ছোট ছোট কন্দ রোপণ সাধারণত এ তিনটি পদ্ধতিতে পেঁয়াজের চাষ করা হয়। এদের মধ্যে চারা রোপণ পদ্ধতিতে পেঁয়াজের ফলন বেশী হয়।
(৪) পেঁয়াজ চাষের জলবায়ু ও মাটি
- সহনশীল তাপমাত্রা, পর্যাপ্ত দিনের আলো ও মাটিতে রস থাকলে পেঁয়াজের ভাল ফলন পাওয়া যায়।
- এঁটেল মাটি ছাড়া অন্য যে কোন মাটিতে পেঁয়াজের চাষ করা যায়। তবে দোঁআশ ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হালকা দোআঁশ বা পলিযুক্ত মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম।
- পেঁয়াজের ভাল ফলন পাওয়ার জন্য সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য।
- মাটির অম্লত্ব বা pH ৫.৮-৬.৫ পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য উত্তম, অধিক ক্ষার বা অম্ল মাটিতে পেঁয়াজের আকার ছোট হয় ও পুষ্ট হতে বেশী সময় লাগে।
(৫) পেঁয়াজ চাষের উৎপাদন মৌসুম
বাংলাদেশে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা ঋতুতে অর্থাৎ সারা বছরই পেঁয়াজ চাষ করা সম্ভব। শীতকালীন পেঁয়াজ অক্টোবর থেকে জানুয়ারী, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ফেব্রুয়ারী থেকে জুলাই এবং বর্ষাকালীন পেঁয়াজ জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে চাষ করা যায়।
(৬) পেঁয়াজের জীবনকাল
চারা রোপণের ৯০ থেকে ১০৫ দিন পর পেঁয়াজ তোলার উপযুক্ত হয়।
(৭) পেঁয়াজ চাষে বীজতলা তৈরি
- বীজতলা ৩ মি. ও ১ মি. মাপের এবং ১৫-২০ সেমি. উঁচু হতে হবে।
- প্রতি হেক্টর জমিতে চারা রোপণের জন্য ৩ মি. ও ১ মি. আকারের ১২০-১৩০ টি বীজতলার প্রয়োজন হয়।
- প্রখর সূর্যের তাপ এবং ভারী বৃষ্টিপাতের হাত থেকে বীজতলার বীজ ও চারা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় শেডের ব্যবস্থা করতে হয়।
- সেচ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য বীজতলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক নালার ব্যবস্থা রাখতে হয়।
(৮) পেঁয়াজের বীজ বপন
- শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষের জন্য যথাক্রমে অক্টোবর থেকে নভেম্বর, ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ এবং জুন থেকে জুলাই মাসে বীজতলায় বীজ বপন করতে হয।
- ৩ মি. x ১ মি. মাপের একটি বীজতলায় ২৫-৩০ গ্রাম বীজ লাগে।
- বীজ বপনের আগে প্রতি কেজি বীজ ২ গ্রাম ভিটাভেক্স দ্বারা শোধন করে বীজবাহিত রোগের আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।
(৯) পেঁয়াজ চাষে বীজের হার
প্রতি হেক্টর জমিতে চাষের জন্য চারা রোপণ পদ্ধতিতে ৩-৪ কেজি বীজ, সরাসরি ক্ষেতে বীজ বপন পদ্ধতিতে ৬-৭ কেজি বীজ এবং শল্ককন্দ (পেঁয়াজ) রোপণ পদ্ধতিতে কন্দের আকার অনুযায়ী প্রায় ১.২-১.৫ টন শল্ককন্দের (পেঁয়াজের) প্রয়োজন হয়।
(১০) পেঁয়াজে চাষে জমি তৈরি
৪-৫ টি গভীর চাষ ও মই দিয়ে আগাছা বেছে, মাটির ঢেলা ভেঙ্গে ও সমতল করে জমি তৈরি করতে হয়। সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধার্থে জমিতে মাঝে মাঝে ৫০ সেমি. প্রশস্ত নালা রাখতে হয়।
(১১) পেঁয়াজ চাষে সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি
সারের সঠিক মাত্রা মাটির উর্বরতার উপর নির্ভর করে।
মধ্যম উর্বর জমিতে পেঁয়াজ চাষের জন্য হেক্টর প্রতি সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি নিম্নরূপ-
সারের নাম | মোট পরিমাণ(প্রতি হেক্টরে) | জমি শেষ চাষের সময়(প্রতি হেক্টরে) | রোপণের ২৫ দিন পর | রোপণের ৫০ দিন পর |
পচা গোবর | ১০ টন | ১০ টন | – | – |
ইউরিয়া | ২৬০ কেজি | ১৩০ কেজি | ৬৫ কেজি | ৬৫ কেজি |
টিএসপি | ২০০ কেজি | ২০০ কেজি | – | – |
এমপি | ১৬০ কেজি | ৮০ কেজি | ৪০ কেজি | ৪০ কেজি |
জিপসাম | ১০০ কেজি | ১০০ কেজি | – | – |
মাটিতে প্রয়োজনীয় রস না থাকলে সারের উপরিপ্রয়োগের পর জমিতে প্রয়োজনমত সেচ দিতে হবে।
(১২) পেঁয়াজের চারা/কন্দ রোপণ
- ৪৫-৫০ দিন বয়সের পেঁয়াজের চারা ১৫ x ১০ সেমি দুরত্বে রোপণ করা হয়।
- উচ্চ ফলন পাওয়ার জন্য সুস্থ ও সবল চারা রোপণ করা উচিত।
- চারা রোপণের গভীরতা ৩-৪ সেমি এবং একটি করে চারা লাগাতে হবে।
- কন্দ রোপণ পদ্ধতিতে সমতল জমিতে অগভীর নালা করে ২০-২৫ সেমি দূরে সারি করে প্রতি সারিতে ১০-১৫ সেমি অন্তর কন্দ লাগানো হয়।
- চারা বা কন্দ রোপনের পরই সেচ দেওয়া আবশ্যক।
(১৩) পেঁয়াজ চাষে রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন
পেঁয়াজের প্রধান রোগগুলোর মধ্যে পার্পল ব্লেচ, লিফ ব্লাইট, অ্যানথ্রাকনোজ, বালব রট প্রধান। পার্পল ব্লেচ রোগ বীজবাহিত। সুতরাং বীজ বপনের পূর্বে শোধন করে নিতে হবে। পেঁয়াজের ক্ষতিকর পোকামাকড় হচ্ছে থ্রিপস, মাছি ইত্যাদি। এক্ষেত্রে ডায়াজিনন স্প্রে করতে হবে।
(১৪) পেঁয়াজ চাষে আগাছা দমন
জমি নিড়ানি দিয়ে মাটি আলগা করে আগাছামুক্ত রাখতে হবে। এতে কন্দ ভালভাবে গঠিত হয় ও ফলন বাড়ে।
(১৫) পেঁয়াজ চাষে সেচ ও নিকাশ
- মাটির রস স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে পেঁয়াজের ফলন কমতে থাকে। এজন্য পেঁয়াজের জমিতে যথেষ্ট পরিমাণ আর্দ্রতা থাকা প্রয়োজন।
- চারা মাটিতে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ৩ দিন অন্তর সেচ দেওয়া প্রয়োজন। কন্দ গঠিত হয়ে গেলে সেচ কম লাগে। পেঁয়াজ উত্তোলনের ৩ সপ্তাহ পূর্ব থেকে সেচ বন্ধ রাখতে হয় নতুবা পেঁয়াজের গুণাগুণ ও সংরক্ষণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। সেচ প্রয়োগের ৩০-৬০ মিনিট পর সেচের অতিরিক্ত পানি নালা দিয়ে বের করে দিতে হবে। পেঁয়াজের সম্পূর্ণ জীবন চক্রে ৮-১০ বার সেচের প্রয়োজন হয়।
- সেচের পর জমিতে চটা বাঁধলে তাতে গাছের মূলে বাতাস চলাচল ব্যহত হয়। এজন্য চটা ভেঙ্গে দিতে হবে।
- পেঁয়াজ মোটেই জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। এজন্য জমিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা রাখতে হবে।
(১৬) পেঁয়াজ চাষে অন্যান্য পরিচর্যা
প্রতিবার পেঁয়াজ ক্ষেতে নিড়ানির পর ঝুরঝুরা মাটি দিয়ে গাছের গোড়া ঢেকে দিতে হয়। পেঁয়াজের কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফুলের কলি বের হওয়ার সাথে সাথে ভেঙ্গে দিতে হবে।
(১৭) চাষকৃত সংগ্রহ, গ্রেডিং ও সংরক্ষণ
- পেঁয়াজ গাছ পরিপক্ক হলে এর পাতা হেলে পড়ে। যখন ৭০-৮০% পাতার অগ্রভাগ শুকিয়ে নেতিয়ে বা ভেঙ্গে পড়ে তখন পেঁয়াজ সংগ্রহের উপযুক্ত সময়।
- উজ্জ্বল রৌদ্রযুক্ত দিনে পেঁয়াজ উত্তোলন করলে সংরক্ষণ ভাল হয়।
- পেঁয়াজ উত্তোলনের পর এর পাতা ও শিকড় কেটে বায়ু চলালচল সুবিধাযুক্ত শীতল ও ছায়াময় ঘরের মেঝেতে ৮-১০ সেমি উঁচু করে ৮-১০ দিন ছড়িয়ে রেখে দিলে পেঁয়াজ শুকিয়ে যায়।
আকারের উপর ভিত্তি করে পেঁয়াজকে মোটামুটি ৩ শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। যথা-
- ৪-১০ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট বড় আকারের পেঁয়াজ
- ৩-৫ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট মাঝারী আকারের পেঁয়াজ
- ৩ সেমি এর কম ব্যাস বিশিষ্ট ছোট আকারের পেঁয়াজ
- সুস্থ ও সবল পেঁয়াজ বাছাই ও গ্রেডিং করার পর বাঁশের মাচা, ঘরের সিলিং, প্লাস্টিক বা বাঁশের তাক অথবা ঘরের পাকা মেঝেতে শুষ্ক ও বায়ু চলাচলযুক্ত স্থানে পেঁয়াজ ছড়িয়ে সংরক্ষণ করা যায়। মাঝে মাঝে পচা ও অঙ্কুরিত পেঁয়াজ বেছে সরিয়ে ফেলতে হয়।
- কোল্ড স্টোরেজে ৭-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৬২-৬৭% আর্দ্রতায় পেঁয়াজ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়। পচা ও অঙ্কুরিত পিয়াজ সরিয়ে ফেলতে হবে।
(১৮) পেঁয়াজের ফলন
আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরন করে পেঁয়াজের হেক্টরপ্রতি ১০-১৩ টন ফলন পাওয়া যায়।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বার আমার পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা অর্জন করলাম।
পেঁয়াজ একটি গুরুত্বপূর্ণ মসলা জাতীয় ফসল। এটি একটি দ্বিবর্ষজীবী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। এর শল্ককন্দ ফসল ও বীজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া পেঁয়াজের আসল বীজ থেকেও চারা উৎপাদন করে পেঁয়াজের চাষ করা হয়।
শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষের জন্য যথাক্রমে অক্টোবর থেকে নভেম্বর, ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ এবং জুন থেকে জুলাই মাসে বীজতলায় বীজ বপন করতে হয।
৪০-৫০ দিন বয়সের পেঁয়াজের চারা ১৫ x ১০ সেমি দুরত্বে রোপণ করা হয়। কন্দ রোপণ পদ্ধতিতে ২০-২৫ সেমি দূরে সারি করে প্রতি সারিতে ১০-১৫ সেমি অন্তর কন্দ লাগানো হয়।
জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। জমিতে যথেষ্ট পরিমাণ আর্দ্রতা থাকা প্রয়োজন। পেঁয়াজ উত্তোলনের ৩ সপ্তাহ পূর্ব থেকে সেচ বন্ধ রাখতে হয়। পেঁয়াজ ক্ষেতে নিড়ানির পর ঝুরঝুরা মাটি দিয়ে গাছের গোড়া ঢেকে দিতে হয়। পেঁয়াজের কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফুলের কলি দেখা যাওয়া মাত্রই ভেঙ্গে দিতে হবে।
যখন ৭০-৮০% পাতার অগ্রভাগ শুকিয়ে নেতিয়ে বা ভেঙ্গে পড়ে তখন পেঁয়াজ সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। শুষ্ক ও বায়ু চলাচলযুক্ত স্থানে পেঁয়াজ ছড়িয়ে সংরক্ষণ করা যায়। কোল্ড স্টোরেজে পেঁয়াজ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়। পেঁয়াজের হেক্টরপ্রতি ১০-১৩ টন ফলন পাওয়া যায়।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।