Skip to content

পেনে মাছ চাষ

পেনে মাছ চাষ

কোনো উন্মুক্ত বা আবদ্ধ জলাশয়ে এক বা একাধিক দিক বাঁশের বানা, বেড়া, জাল বা অন্য কোনো উপকরণ দিয়ে ঘিরে উক্ত জলাশয়ে মাছ মজুদ করে চাষ করাকে পেনে মাছ চাষ বলে।

দেশে মৎস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে না এমন বৃহদাকৃতির জলাশয়, সেচ খাল কিংবা রাস্তার পার্শ্বস্থ খাল ইত্যাদিতে পেন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।

পেন পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের খাল, মরা নদী, হাওর, বাঁওড়, বন্যা প্লাবিত জলাভূমিতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে মাছের উৎপাদন বাড়ানোসহ বেকরাত্ব দূর করা সম্ভব। পেনে মাছ চাষের বৈশিষ্ট্য হলো পেনের বেড়া/জাল জলাশয়ের মাটিতে প্রোথিত থাকে এবং পেনের পানির সাথে বাইরের পানির সংযোগ বা প্রবাহ বিদ্যমান থাকে।

নিম্নে পেনে মাছ চাষ পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

(১) স্থান নির্বাচন

পেনে লাভজনকভাবে মাছ চাষের জন্য স্থান নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • যেসব বৃহৎ জলাশয় সাধারণভাবে চাষের আওতায় আনা সম্ভব নয় সেসব জলাশয় পেনে মাছ চাষের জন্য নির্বাচন করা যেতে পারে।
  • তবে যে সমস্ত জলাশয়ের তলদেশ অত্যন্ত অসমান, বালি বা পাথর দ্বারা আবৃত, প্রবল স্রোত বিদ্যমান, পানি দুষণসহ ঝড়ো হাওয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে ও নৌযান চলাচল করে সে সকল স্থান বাদ দিয়ে উন্মুক্ত জলাশয়ের যে কোনো স্থানে পেন তৈরি করা যেতে পারে।
  • প্রয়োজনবোধে অল্প সময়ে পেন এক স্থান হতে অন্য স্থানে স্থানান্তর ও তৈরি করা যায়।
  • বছরে অন্তত ৬-৮ মাস পানি থাকে এমন মৌসুমি জলাশয় যেমন- সেচ প্রকল্পের খাল, সংযোগ খাল, মরা নদ-নদী এবং নদ-নদীর খাড়ি অঞ্চল পেনে মাছ চাষের জন্য উপযুক্ত।
  • দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লোনাপানিতে বৃহৎ ঘেরের জমির মালিকানা অনুযায়ী পেন তৈরি করে নিবিড়ভাবে চিংড়ি চাষ করা সম্ভব।
  • কাপ্তাই হ্রদ, এমনকি দেশের সমুদ্র উপকূলের অগভীর অঞ্চলেও পেন তৈরি করে মাছ চাষ করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

(২) পেন নির্মাণ

  • বাঁশ, গাছের ডাল, নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি বেড়া কিংবা জাল দিয়ে পেন তৈরি করা যায়।
  • সাধারণত জলাশয়ের গ্রন্থ কম হলে খালের এক পাশ থেকে আরেক পাশ পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে খুঁটি পুঁতে বেড়া দিয়ে পেন তৈরি করা যায়।
  • জাল দিয়ে বেড়া দেওয়ার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন জালের ফাঁস ১০ মি.মি. এর চেয়ে বেশি না হয়।
  • পেন তৈরির সময় টায়ার কর্ড জাল বা নটলেস পলিখিন জালও ব্যবহার করা প্রয়োজন।
  • জলাশয়ের ধরনের উপর পেনের আকার নির্ভর করে। জলাশয়ের মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির উপর নির্ভর করে ১.০ হতে ১০.০ হেক্টর আয়তনের যে কোনো আকৃতির জলাশয়ে পেন নির্মাণ করা যেতে পারে।
  • পেনের আয়তন বড় হলে কখনো ব্যবস্থাপনার অসুবিধা দেখা দেয়। ছোট আয়তনের পেন ব্যবস্থাপনার জন্য সুবিধাজনক।
  • যে এলাকায় পানিপ্রবাহ বেশি সেসব এলাকায় বাঁশ দ্বারা উঁচু বানা তৈরি করে তলদেশের মাটির মধ্যে বেশি করে বানা পুঁতে দিতে হবে।
  • মহাল, বন বাঁশের বেড়া বা বানা ও বরাক বাঁশের খুঁটি সাধারণত ১-২ বছর টিকে।
  • গিঁটবিহীন জাল ৪-৫ বছর ব্যবহার করা যায় আবার টায়ার্ড কর্ড জানের আয়ুষ্কাল ২-৩ বছর।
  • বানা তৈরির জন্য ব্যবহৃত নারিকেল করে ও সিনথেটিক রশি ১-২ বছর টিকে থাকে।
  • এছাড়া বেড়া বাঁধার জন্য ব্যবহৃত জিআই তারের আয়ুকাল ১-২ বছর।

(৩) রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ এবং আগাছা দমন

পেন তৈরির পর জাল টেনে জলাশয় হতে যতদূর সম্ভব রাক্ষুসে মাছ বোয়াল, আইড়, শোল, গজার, টাকি, চিতল, ফলি ইত্যাদি) এবং অবাঞ্চিত মাছ বেলে, পুঁটি, দারকিনা, মলা, চাপিলা, চান্দা ইত্যাদি) ও আগাছা (কচুরীপানা, টোপাপানা, কলমীলতা, হেলেঞ্চা ইত্যাদি) দমন করতে হবে।

(৪) প্রজাতি নির্বাচন

পেনে চাষের জন্য প্রজাতিভর নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বিভিন্ন প্রজাতির এমন সব মাছ ছাড়তে হবে যারা পানির সকল স্তরে খাবার খায়, যাদের খাদ্য শিকল সংক্ষিপ্ত, যাদের পোনা সহজে সংগ্র করা যায় এবং অল্প সময়ে চাষ করে বাজারে বিক্রির উপযোগী হয়। এসব দিকে বিবেচনা করে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, বিগহেড কার্প, গ্রাস কার্প, রাজপুঁটি, তেলাপিয়া, পাঙাশ প্রজাতির মাছ পেনে চাষ করার জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তাছাড়া পেনে গলদা চিংড়ি চাষ করাও সম্ভব।

(৫) পোনা মজুদের হার

অধিক ফলনের জন্য সুস্থ ও সবল পোনা নির্দিষ্ট হারে মজুদ করা প্রয়োজন।

  • পোনা মজুদের সময় পোনার আকার যেন কোনো ক্রমেই ১০ সে.মি. এর কম না হয়। কারণ ছোট পোনা পেনের বেড়া বা জালের ফাঁস দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও পেন থেকে অবাঞ্ছিত ও রাক্ষুসে মাছ সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয় না। তাই ১০ সে.মি. চেয়ে ছোট পোনা খেয়ে ফেলার আশঙ্কা থাকে।
  • পেনে হেক্টরপ্রতি ১৫ হাজার, কমপক্ষে ১০ সে.মি. আকার রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার/বিগহেড কার্প, গ্রাস কার্প, রাজপুঁটি, তেলাপিয়া, পাঙাশ মাছ যথাক্রমে ৩০৫:২০:২৫:২০ অনুপাতে মজুদ করা যেতে পারে।
  • পেনে গিফট জাতীয় তেলাপিয়া এবং পাঙাশ মাছের একক চাষও করা যেতে পারে।

(৬) পেনে খাদ্য সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনা

  • মজুদকৃত মাছের মোট ওজনের ২.৩% হারে সহজলভ্য খাদ্য যথা- খৈল, কুঁড়া, ভূমি, আটা, চিটাগুড় ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হবে। সম্পূরক খাদ্যের অনুপাত যথাক্রমে থৈল ৩৫%, কুঁড়া ৩০%, ভূমি ৩০%, আটা ৩%, চিটাগুড় ২% হলে ভালো হয়।
  • মাছের কোনো প্রকার রোগ বা দৈহিক বৃদ্ধির সমস্যা দেখা দিলে তা প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • প্রতি মাসে একবার মাছের নমুনা সংগ্রহ করে মাছের বৃদ্ধি অনুযায়ী সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ সমন্বয় করে বর্ধিত হারে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও পেনের বেড়া বা জানে কোনোরূপ ক্ষতি হয়েছে কিনা সে বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে।
  • অনেক সময় পেনের বেড়া ও জালে ময়লা আবর্জনা জমে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হলে বেড়া ও জাল পরিষ্কার করা না হলে পানির চাপে জাল ছিঁড়ে যেতে পারে ও বেড়া ভেঙে যেতে পারে। মাছ সংরক্ষণ, সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ ও পেন পরিচর্যার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে পেন সংলগ্ন এলাকায় লোক পাহারা থাকা আবশ্যক।
  • পেনে পোনা মজুদের ৬-৮ মাস পরই বিক্রিযোগ্য মাছ পাওয়া যায়। যেসব জলাশয়ে সারা বছর পানি থাকে সেসব জলাশয় হতে বাৎসরিক ভিত্তিতে মাছ আহরণ করা যেতে পারে।

(৭) পেনে সমাজভিত্তিক মাছ চাষ

পেনে মাছ চাষ বৃহৎ জলাশয়ে হয়ে থাকে বিধায় মাছ চুরির আশঙ্কা থাকে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য পেনে সমাজভিত্তিক মাছ চাষ অধিক ফলপ্রসু। এতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনগণের অংশগ্রহণের ফলে ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু হয় এবং অধিক উৎপাদন পাওয়া যায়।

গ্রামীণ বেকার যুবক/যুবতী, আনসার/ভিডিপি সদস্য, গরিব দুস্থ মহিলা, ভূমিহীন জনগণকে নিয়ে সংগঠনের মাধ্যমে একত্র করে পেনে মাছ চাষে অংশগ্রহণ করানো যায়। গ্রামের দরিদ্র মহিলারা অত্যন্ত উৎসাহ ও নিপুণতার সাথে পেন তৈরি, বাঁশের বানা ও বেড়া তৈরি, মাছ চাষ, খাবার তৈরি ও সরবরাহ, পাহারা দেওয়াসহ যাবতীয় কাজ করতে পারে। এভাবে গ্রামীণ মহিলাদেরকেও পেনে মাছ চাষে সম্পৃক্ত করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা যায়।

(৮) আহরণ ও উৎপাদন

চিত্ৰ- পেনে মাছ চাষ

উল্লিখিত পদ্ধতিতে পেনে মাছ চাষ করলে বছরে ৫-৬ টন/হে. মাছ উৎপাদন করা সম্ভব। জলাশয়ে পানির স্থায়িত্ব ও মাছের প্রজাতি অনুযায়ী বছরে ১-২ বার মাছ আহরণ করা যেতে পারে

(৯) পরামর্শ

অপরিকল্পিতভাবে পার্শ্ববর্তী কৃষিজমিতে কীটনাশকের প্রয়োগ পেনে মাছ চাষে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই খাল বা সেচ এলাকায় অপরিকল্পিত কীটনাশকের ব্যবহার রোধ করতে হবে।

পেনে চাষকৃত মাছের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ বানা, জাল ইত্যাদির অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ক্ষতিকর জলতা প্রাণী যেমন- কাঁকড়া পেনের জাল যাতে কেটে ফেলতে না পারে সেজন্য চাষের আগেই খালের কাঁকড়া অপসারণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts