পেয়ারা একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল। পেয়ারায় প্রচুর ভিটামিন সি রয়েছে। পেয়ারা দ্বারা জ্যাম, জেলি তৈরি হয়। বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই এই ফলের চাষ হয়ে থাকে। তবে বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, গাজীপুর, পার্বত্য অঞ্চলে বাণিজ্যিক চাষ হয়ে থাকে।
পেয়ারার পুষ্টিউপাদান নিম্নের ছকে দেখানো হলো-
উপাদান | পরিমাণ |
জলীয় অংশ | ৮১.৭ গ্রাম |
মোট খনিজ পদার্থ | ০.৭ গ্রাম |
হজমযোগ্য আঁশ | ৫.২ গ্রাম |
খাদ্যশক্তি | ৫১ কিলোক্যালরী |
আমিষ | ০.৯ গ্রাম |
চর্বি | ০.৩ গ্রাম |
শকর্রা | ১১.২ গ্রাম |
ক্যালসিয়াম | ১০ মি. গ্রাম |
লৌহ | ১.৪ মি. গ্রাম |
ক্যারোটিন | ১০০ মাইক্রোগ্রাম |
ভিটামিন বি-১ | ০.২১ মি. গ্রাম |
ভিটামিন বি-২ | ০.০৯ মি. গ্রাম |
ভিটামিন সি | ২১০ মি. গ্রাম |
এ পাঠ শেষে আপনি- পেয়ারার জাত, বংশবিস্তার সম্পর্কে অবগত পারবেন; পেয়ারার জলবায়ু ও মাটি সম্পর্কে জানতে পারবেন; পেয়ারা চাষ ও পেয়ারা গাছের পরিচর্যা শিখতে পারবেন।
নিম্নে পেয়ারা চাষ ও পেয়ারা গাছের পরিচর্যা পদ্ধতি তুলে ধরা হলো-
(১) পেয়ারার জাত
- বাংলাদেশে পেয়ারার জাতগুলো হল-বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা থেকে উদ্ভাবিত জাত কাজী পেয়ারা, বারি পেয়ারা-২।
- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাউপেয়ারা-১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভাবিত জাত-ইপসা পেয়ারা।
- এসব জাতের পাশাপাশি অন্যান্য জাতগুলো হলো- স্বরূপকাঠি, কাঞ্চনগর, থাই পেয়ারা, মুকন্দপুরী।
(২) পেয়ারা চাষে জলবায়ু ও মাটি
- যেকোনো আবহাওয়াই পেয়ারা চাষ করা যায়। তবে পেয়ারার জন্য ২৩-২৮ সে. তাপমাত্রা ভালো।
- অধিক বৃষ্টিপাতে পেয়ারার স্বাদ পানসে হয়। বার্ষিক ১০০ থেকে ১০২ সে.মি. বৃষ্টিপাত প্রয়োজন হয়।
- ফুল আসার সময় শুষ্ক আবহাওয়া উত্তম।
- পেয়ারা সব মাটিতে ভালোভাবে জন্মায় তবে জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
- সুনিষ্কাশিত উর্বর জমি পেয়ারা চাষের জন্য উত্তম।
(৩) পেয়ারা গাছের বংশবিস্তার
- পেয়ারা সাধারণত বীজ ও কলম দিয়ে বংশবিস্তার করা হয়।
- বীজ থেকে ফল আসতে দেরি হয়। বীজের গাছে গুণগত মান ঠিক থাকে না। তাই কলমের চারা লাগানোই উত্তম।
- পেয়ারার সাধারণত গুটি কলম, জোড় কলম দিয়ে চারা তৈরি করা হয়। এর মধ্যে গুটি কলমই জনপ্রিয় পদ্ধতি।
(৪) পেয়ারা চাষে জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
- জমিতে কয়েকবার চাষ দিয়ে ভালোভাবে তৈরি করতে হয়। তারপর ৫০ সে.মি. x ৫০ সে.মি x ৫০ সে.মি আকারের এবং ৫মিটার x ৫ মিটার দুরে দুরে গর্ত তৈরি করতে হবে।
- এরপর প্রতি গর্তে ২০-২৫ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২০০ গ্রাম এমপি সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
- পূর্ণ বয়ষ্ক গাছে ১০ কেজি গোবর সার, ইউরিয়া টিএসপি, এমপি ২০০ গ্রাম করে বছরে দুইবার মার্চ-এপ্রিল মাসে, বাকি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর প্রয়োগ করতে হবে।
(৫) পেয়ারা গাছের চারা রোপন
- পেয়ারার চারা সাধারণত মে থেকে জুলাই মাসে লাগানো ভালো। তবে সেচের ব্যবস্থা থাকলে যেকোনো সময় লাগানো যেতে পারে।
- গর্তের মাঝখানে চারা বসিয়ে চারদিকে মাটি চাপা দিতে হবে।
- চারার সাথে খুটি বেঁধে দিতে হবে যাতে হেলে না পড়ে।
(৬) পেয়ারা গাছের পরিচর্যা
ক) সেচ ও আন্তঃপরিচর্যা
- প্রয়োজন মাফিক ও নিয়মিত সেচ দিলে পেয়ারার ফল বড় ও ফলন ভাল হয়।
- মাটিতে রসের অভাব হলে ফুল-ফল ঝরে পরে। শুস্ক মৌসুমে হালকা সেচ দিতে হবে।
- পেয়ারা সংগ্রহের পর হালকা ছাটাই করতে হবে। গাছের গোড়া থেকে শাখা বের হয় তা ছেঁটে ফেলতে হবে। শুষ্ক, রোগাক্রান্ত ও মরা ডাল কেটে দিতে হবে।
খ) রোগদমন
- পেয়ারার এনথ্রাকনোজ রোগ: ইহা একটি ছত্রাকজনিত রোগ। পেয়ারার পাতা, কান্ড, শাখা ও ফল আক্রান্ত হয়। প্রথম দিকে পেয়ারার গায়ে ছোট ছোট বাদামি দাগ হয় তা ক্রমান্বয়ে বড় হয়ে ক্ষতের সৃষ্টি করে। ফলের শাঁস শক্ত হয় এবং ফল ফেটে যায়। গাছের নিচে আক্রান্ত পাতা ও ফল পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মি.লি. অনুপাতে মিশিয়ে ১৫দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
- পেয়ারা ঢলে পড়া রোগ: এ রোগ হলে প্রথমে পাতা হলুদ রং ধারণ করে। গাছের আগা শুকিয়ে যায় এবং মারা যায়। এ রোগ হলে গাছ গোড়াসহ তুলে ফেলতে হবে।
- ডাই ব্যাক (ডগা মরা): গাছের কচি ডাল শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত ডালে বর্দোপেষ্ট বা বর্দোমিশ্রণ (১%) স্প্রে করা যেতে পারে।
গ) পোকা দমন
- মিলি বাগ: পেয়ারা গাছে মিলি বাগ আক্রমণ বেশি দেখা যায়। এ পোকা পাতা চুষে খায়। আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- মাছি: পেয়ারার ক্ষতিকর পোকা হল মাছি পোকা। এদের কীড়া ফল ছিদ্র করে ফলে প্রবেশ করে ফলের শাঁস খেতে থাকে। এ পোকা দমনে উপর্যুক্ত ব্যবস্থা হল ব্যাগিং করা।
- নষ্ট পেয়ারা: এছাড়াও আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। ফল পাকার তিন মাস থেকে সঠিক কীটনাশক প্রয়োগ করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়।
(৭) পেয়ারা আহরণ
- পেয়ারা গাছে বছরে দুবার ফুল আসে। মার্চ এপ্রিলে একবার সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আর একবার ফুল আসে।
- ফুল বের হওয়া ,থেকে ফল আহরণের উপযুক্ত হতে সময় ৪-৫ মাস লাগে।
- ফল সবুজ থেকে হলদে সবুজ রং ধারণ করলে ফল সংগ্রহ করতে হবে।
(৮) পেয়ারার ফলন
ভালো জাত, যেমন কাজী পেয়ারার বা বারি পেয়ারা ২ গড়ে ১৩০ কেজি এবং ১০০ কেজি ফলন দিতে পারে।
উপরোক্ত আলোচনাটির দ্বারা আমরা পেয়ারা চাষ ও পেয়ারা গাছের পরিচর্যা সম্পর্কে একটা সম্পষ্ট ধারণা অর্জন করলাম।
পেয়ারা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ একটি সুস্বাদু ফল। পেয়ারার জন্য ২৩-২৮ সে. তাপমাত্রা উত্তম। সুনিষ্কাশিত উঁচু দোআঁশ মাটি উপযোগী। পেয়ারা সাধারণত: গুটি কলমের মাধ্যমে চারা তৈরি করা হয়। পেয়ারার এ্যানথ ্রাকনোজ, ঢলে পড়া, ডাইব্যাক রোগে আক্রান্ত হয়। ফলের মাছি পোকা, মিলি বাগ পোকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। ফল হলদে সবুজ রং ধারণ করলে সংগ্রহ করতে হবে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।