(১) প্যাশন ফল বাংলাদেশ
প্যাশন ফল বাংলাদেশে একটি অপ্রচলিত বা স্বল্প পরিচিত ফল। অনেকের কাছে এটি ট্যাং ফল নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চল, সিলেট, টাঙ্গাইল এবং রাজশাহী অঞ্চলে ইহা কম বেশি দেখা যায়। তবে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আদিবাসীদের বসতবাড়িতে স্বল্পপরিসরে অনেকটা অযত্নে ও অবহেলায় ফলটির আবাদ লক্ষ্য করা যায়।
ঝুমকো লতার সমগোত্রীয় প্যাশন ফলের গাছ দীর্ঘ প্রসারী এবং বহুবর্ষজীবী। ফলের ভিতর গাত্রে অসংখ্য হলুদাভ, রসপূর্ণ থলে (Juice sac) থাকে, এগুলি ভক্ষণযোগ্য অংশ।
টাটকা ফল হিসেবে খাওয়ার চেয়ে প্যাশন ফলের তৈরি শরবত বেশি উপাদেয়।
বাংলাদেশের পাহাড়ী এলাকায় এবং সিলেট ও টাঙ্গাইল অঞ্চলে প্যাশন ফল চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে।
(২) প্যাশন ফলের জাত পরিচিতি
বারি প্যাশন ফল-১:
বিদেশ থেকে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম মূল্যায়ন শেষে ‘বারি প্যাশন ফল-১’ নামে উন্নত জাতটি ২০০৩ সালে মুক্তায়ন করা হয়।
- নিয়মিত ফলদানকারী উচ্চ ফলনশীল জাত।
- গাছ দীর্ঘ প্রসারী, বহুবর্ষজীবী এবং কাষ্ঠল লতা জাতীয়।
- পাকা ফল দেখতে হলুদ রঙের এবং গাত্র খুবই মসৃণ।
- ফল উপবৃত্তাকার, আকার ৬.৮ ⨉ ৬.৩ সেমি।
- ফলের গড় ওজন ৬৮ গ্রাম এবং প্রতি ফল থেকে ৩০ গ্রাম জুস আহরণ করা যায়।
- জুসের রং হলুদ, টক-মিষ্টি স্বাদের (টিএসএস ১৪%)।
- এ জাতটি পার্বত্য জেলাসমূহে চাষাবাদের উপযোগী।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ৫-৬ টন।
- জাতটি ফিউজেরিয়াম উইল্ট ও নেমাটোড রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন।
(৩) প্যাশন ফল চাষ পদ্ধতির বর্ণনা
ক) জলবায়ু ও মাটি
- সাধারণভাবে প্যাশন ফলকে উষ্ণ ও অব-উষ্ণ অঞ্চলের ফল হিসেবে গণ্য করা হয়। অধিক উষ্ণতা ও শৈত্য কোনটাই এ ফলের জন্য ভাল নয়।
- বৃষ্টিপাত ফুলের পরাগায়ণে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।
- যে কোন ধরনের সুনিষ্কাশিত মাটিতে প্যাশন ফলের চাষ করা যায়। তবে ঊর্বর, সুনিষ্কাশিত দোআঁশ মাটি উত্তম।
- প্যাশন ফল জলাবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না।
- মাটির ক্ষারত্ব (pH) ৫.৫-৭.৫ উত্তম। ক্ষারত্ব ৫.৫ এর নিচে হলে চুন প্রয়োগ করা অত্যাবশ্যক।
- প্যাশন ফল লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না।
খ) বংশ বিস্তার
- বীজ দ্বারা সহজেই প্যাশন ফলের বংশ বিস্তার করা যায়। তবে বীজ থেকে উৎপাদিত চারায় মাতৃ গাছের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ থাকে না বিধায় অঙ্গজ পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করা উত্তম।
- স্টেম কাটিং বা শাখা কর্তনের মাধ্যমে প্যাশন ফলের অঙ্গজ বংশ বিস্তার করা যায়।
- এক থেকে দেড় বছর বয়সী শাখা নির্বাচন করে তা থেকে ২০-৩০ সেমি লম্বা করে কেটে একেকটি শাখা কলম তৈরি করা হয় যাতে অস্তত ২-৩টি পর্বসন্ধি (নোড) থাকে।
- কাটিং এর নিচের পর্ব হতে ১-২ সেমি নিচে তেরসা কাট দিয়ে এর নিচের পর্বসহ একেকটি কাটিং পৃথক পৃথক পলিব্যাগের মাটিতে ৪৫০ কোণ করে পুঁতে চারা তৈরি করা হয়।
- কাটিং দ্বারা চারা তৈরির উপযুক্ত সময় হচ্ছে জুন-আগস্ট মাস।
গ) জমি তৈরি
- সুনিষ্কাশিত উঁচু জমিতে যেখানে কখনই পানি দাঁড়ায় না প্যাশন ফলের জন্য এরকম জমি উত্তম।
- জমি গভীরভাবে চাষ দিয়ে আগাছা ভালভাবে পরিষ্কার করে জমি তৈরি করতে হয়।
- চারা রোপণ করার জন্য ৪৫ ⨉ ৪৫ ⨉ ৪৫ সেমি গর্ত করে প্রতি গর্তে ১০ কেজি জৈব সার, ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি সার মিশ্রিত করে ১৫/২০ দিন রেখে দিয়ে তারপর চারা লাগাতে হবে।
ঘ) চারা/কলম রোপণ ও পরিচর্যা
- বাণিজ্যিকভাবে প্যাশন ফল সারি করে লাগাতে হয়।
- সাধারণত জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যস্ত চারা লাগানোর উত্তম সময় তবে যদি সেচ সুবিধা থাকে তাহলে সারা বছর চারা লাগানো যায়।
- সারি থেকে সারি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৪ মিটার। এই হিসেবে প্রতিহেক্টর জমিতে ৬২৫টি চারা/কলম দরকার হয়।
- মাদা তৈরির ১৫-২০ দিন পর চারা বা কলম গর্তের ঠিক মাঝখানে লাগাতে হয়।
- রোপণের পর হাত দিয়ে আলতোভাবে মাটি চারার গোড়ার চারদিকে বসিয়ে দিতে হবে। তারপর খুঁটি দিয়ে চারাটি খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে যাতে হেলে না পড়ে।
- চারা লাগানোর পরপরই চারার গোড়ায় পানি দিতে হবে এবং বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ঙ) সার প্রয়োগ
নিচে উল্লিখিত সার সমান ৩ কিস্তিতে শীতের শেষে (ফেব্রুয়ারি), বর্ষার আগে (এপ্রিল-মে) ও বর্ষার শেষে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) গাছের গোড়া থেকে সামান্য দূরে প্রয়োগ করে হালকা করে কুপিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
বয়স অনুপাতে গাছপ্রতি সারের পরিমাণ:
গাছের বয়স | পচা গোবর (কেজি) | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমওপি (গ্রাম) |
১-২ বছর | ৬ | ১৫০ | ১৫০ | ১৫০ |
৩-৫ বছর | ৮ | ৩০০ | ৩০০ | ৩০০ |
৬-৯ বছর | ১০ | ৪৫০ | ৪৫০ | ৪৫০ |
১০ বছর ও তদুর্ধ্ব | ১৫ | ৬০০ | ৪৫০ | ৬০০ |
চ) আগাছা দমন
গাছের পর্যাপ্ত বৃদ্ধি ও ফলনের জন্য সবসময় জমি পরিষ্কার বা আগাছামুক্ত রাখতে হবে। বিশেষ করে গাছের গোড়া থেকে চারদিকে এক মিটার পর্যস্ত জায়গা সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
ছ) সেচ ও নিষ্কাশন
- চারা রোপণের পর বেশ কিছু দিন পর্যন্ত নিয়মিত সেচ দিতে হয়।
- সর্বোচ্চ ফলনের জন্য ফুল আসা ও ফলের বিকাশের সময় মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকা আবশ্যক। এ জন্য খরা মৌসুমে প্যাশন ফলে সেচ দেওয়া প্রয়োজন।
- বর্ষাকালে গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমতে না পারে সেজন্য নিষ্কাশনের সুবন্দোবস্ত করতে হবে।
জ) ডাল ছাঁটাইকরণ
- গাছের গোড়া থেকে ১.৫- ২.০ মিটার পর্যস্ত কোন ডালপালা রাখা হয় না তাই এ সমস্ত ডালা সব সময় কেটে দেওয়া ভাল।
- যেহেতু নতুন শাখায় বেশি ফুল ও ফল উৎপন্ন হয় তাই প্রতি বছর নিয়মিত কিছু শাখা প্রশাখা কেটে দিলে ভাল ফলন পাওয়া যায়।
- মাঝে মাঝে পুরাতন ও মরা ডাল কেটে দিতে হয়। শীতকালই ডাল ছাঁটাইকরণের উপযুক্ত সময়।
ঝ) মাচা তৈরি
- লতা জাতীয় গাছ হওয়ায় প্যাশন ফলে মাচা দেয়া আবশ্যক। প্যাশন ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য বিভিন্ন ধরনের মাচা তৈরি করা হয়ে থাকে।
- জিআই তার দিয়ে স্থায়ীভাবে মাচা তৈরি করা যায়। তবে অস্থায়ীভাবে বাঁশ দ্বারাও মাচা তৈরি করা যায়।
- চারা লাগানোর পর যখন চারা বাড়তে শুরু করে অর্থাৎ ৩-৪ মাস পর মাচা তৈরি করতে হয় যাতে গাছের লতা সহজেই মাচায় উঠতে পারে।
- মাচার উচ্চতা ১.৫ মিটার হলে ভাল হয় যাতে সহজে ফল আহরণ করা যায় ও অন্যান্য পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়।
- প্রতি ১/২ সারিতে ১টি করে মাচা তৈরি করা যায়।
ঞ) ফল সংগ্রহ
- প্যাশন ফলে ফুল আসার প্রধান মৌসুম হল মার্চ মাস এবং তা থেকে জুলাই-আগস্ট মাসে ফল আহরণ করা হয়।
- আবার অনেক সময় আগস্ট মাসেও কিছু ফুল আসে তা থেকে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে ফল আহরণ করা যায়।
- ফল সংগ্রহ করার পর প্রথমে সর্টিং এর মাধ্যমে ভাল ও ত্রুটিপূর্ণ (বাজারজাতকরণের অনুপযোগী) ফলগুলো আলাদা করা হয়। তারপর ভাল ফলগুলো গ্রেডিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন সাইজ অনুপাতে ভাগ করে বাজারজাত করা হয়।
(৪) প্যাশন ফল চাষে পোকা ও রোগ দমন ব্যবস্থা
ক) মাছি পোকা দমন
ফলের মাছি পোকা বা ফ্রুট ফ্লাই অনেক সময় কচি ফলের গায়ে ছিদ্র করে ডিম পাড়ে এবং তাতে ফল কুচকে যায় ও অপরিপক্ক অবস্থায় ফল ঝরে পড়ে।
সেক্স ফেরোমন ফাদ ব্যবহার করে মাছি পোকা সাফল্যজনক ভাবে দমন করা যায়।
খ) উডিনেস রোগ দমন
অনেক সময় উডিনেস (Woodiness) নামক একটি রোগ নাশপাতি গাছে দেখা যায় যা কিউকাম্বার মোজাইক ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়।
এ রোগ আক্রান্ত পাতা বিবর্ণ হয়ে আকারে ছোট হয়। ফলের খোসা মোটা ও শক্ত হয় এবং অল্প পাল্প উৎপন্ন হয়।
জাব পোকা (Aphid) দ্বারা এ রোগ ছড়ায়। এ রোগের প্রতিকারের জন্য বাহক পোকা দমন করতে হয়।
[সূত্র: বিএআরআই]