ফল ও শাকসবজি দ্রুত পচনশীল পণ্য, এদের দেহে শতকরা প্রায় ৭০-৮০ ভাগ পানি থাকে। ফল ও শাকসবজি পঁচনের কারণ যেমন- পোকামাকাড়, রোগবালাই বা পরিবেশগত কারণে এগুলো দ্রুত পঁচে যায় এবং গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। পঁচন থেকে রক্ষা করার জন্য সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত এবং ফল ও শাকসবজি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে প্রতি বছর বাংলাদেশে শতকরা ১৫-২৫ ভাগ ফল ও সবজি নষ্ট হয়। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ফল এবং শাকসবজি প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করা গেলে একদিকে যেমন ফল ও শাকসবজির পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন থাকে তেমনি তা থেকে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করা যায়।
বর্তমানে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ যেমন-চীন, জাপান, থাইল্যান্ড ফল ও শাক-সবজি প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করছে এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন। আমাদের বাংলাদেশেও অনেক শাকসবজি ও ফল উৎপন্ন হয় এগুলোকে যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করতে পারি তাহলে একদিকে যেমন বেকার সমস্যা সমাধান হবে অন্য দিকে তেমন সারা বছর পুষ্টির চাহিদা পুরণ ও দেশের আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
এ পাঠ শেষে আপনি- ফল ও শাকসবজি পঁচনের কারণ, লক্ষণ সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন; ফল ও শাকসবজি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে উপলব্ধি করতে পারবেন।
(১) ফল ও শাকসবজি পঁচনের কারণ
ফল ও শাকসবজি দ্রুত পচনশীল খাদ্য দ্রব্য বা মাঠ থেকে সংগ্রহ করার অল্প দিনের মধ্যেই সেগুলো খেয়ে ফেলতে হয়। বেশি দিন রেখে দিলে সেগুলো পচে নষ্ট হয়ে যায়।
শাকসবজি ও ফল পচনের কারণ ও লক্ষণ গুলো নিচে আলোচনা করা হলো-
ক) পরিবেশ প্রতিকূল অবস্থা
i) তাপমাত্রা: উচ্চতাপমাত্রা শাক সবজি ও ফল পচনের জন্য দায়ী ফল ও শাকসবজির কোষ স্বাভাবিক থাকার জন্য একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা প্রয়োজন। প্রতি ১০ সে. তাপমাত্রা বেড়ে গেলে শ্বসনের মাত্রা প্রায় তিনগুণ বেড়ে যায়, ফলে আভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত ইথিলিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যা শাকসবজি ও ফলে দ্রুত পচন ঘটায়। এমতাবস্থায় রোগজীবাণুর বংশবৃদ্ধি ও সংক্রমণ বেড়ে যায় যা ফল ও শাকসবজিতে পচন ঘটায়।
ii) আর্দ্রতা: আর্দ্রতা কমে গেলে (৮৩-৮৫% এর কম) ফল ও শাক সবজি অল্প সময়ে নষ্ট হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে।
iii) বায়ুচলাচল: শাকসবজি ও ফল যেখানে সংরক্ষণ করা হয় সেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না থাকলে অক্সিজেন ও কার্বনডাই অক্সাইডের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং ফল ও শাকসবজি দ্রুত পচে যায়।
খ) শ্বসন
ফল ও শাকসবজি সংগ্রহ করার পর যে সব আভ্যন্তরীণ মেটাবলিক পরিবর্তন ঘটে শ্বসন তাদের মধ্যে প্রধান। বিভিন্ন এনজাইমে র প্রভাবে শ্বসন প্রক্রিয়া দ্রুত হয়। এতে ফলের অভ্যন্তরে যে শর্করা থাকে তা রাসায়নিক ভাবে ভেঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড ও পানি তৈরি হয় এর ফলে ফল দ্রুত পচে যায় আবার শ্বসন বাড়লে ফল ও সবজিতে ইথিলিনের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং শাকসবজি ও ফল দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়।
গ) পানির পরিমাণ কমে যাওয়া
ফল ও শাকসবজিতে জলীয় অংশ থাকে বেশি। সংগ্রহের পর শ্বসন ও প্রস্বেদনের মাধ্যমে দ্রুত পানি বের হয়ে যায় এবং এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে পানির অভাবে ফল ও শাকসবজি নেতিয়ে পড়ে, কুকড়ে যায়, দ্রুত সজীবতা হারায় ও খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে।
ঘ) রোগজীবাণু ও পোকার আক্রমণ
রোগজীবাণু ও পোকার আক্রমণে অনেক ফল ও শাকসবজি নষ্ট হয়ে যায়। ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক উচ্চতাপে এবং অধিক আর্দ্রতায় সক্রিয় হয়ে উঠে এবং দ্রুত ফল ও শাকসবজিকে সংক্রমিত করে পঁচিয়ে ফেলে।
ঙ) সংরক্ষণ জনিত ত্রুটি
সঠিক পদ্ধতিতে ফল ও সবজি সংরক্ষণ করা না হলে, সংরক্ষণ কক্ষের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ইত্যাদি উপযোগী না হলে ফল ও সবজি পচে যায়।
চ) পরিবহণজনিত ত্রুটি
পরিবহনের সময় ফল ও সবজি বাক্স বা ঝুড়িতে একটির উপর আর একটি স্তুপ করে নেয়া হয়। পরিবহনের সময় ঝাকুনি, আঘাত বা চাপে ফল বা সবজি অনেক সময় থেতলে যায় বা আঘাত প্রাপ্ত হয়। এসব পণ্য তখন দ্রুত জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় ও নষ্ট হয়ে যায়।
ছ) পরিপক্কতা এ ফলের জাত ও ধরণ
গাছ থেকে অপরিপক্ক ফল সংগ্রহ করলে দ্রুত পচে যায়। আবার বিভিন্ন ফল ও সবজির ভিন্ন ভিন্ন জাতের সংরক্ষণ গুণ ভিন্ন হয়।
জ) বাছাইজনিত ত্রুটি
ফল ও সবজি সংগ্রহের পর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাছাই করতে হয়। আঘাত প্রাপ্ত, থেতলানো বেশি পাকা ফল বা সবজি আলাদা করা না হলে অন্যান্য ফল ও সবজিও দ্রুত পচে নষ্ট হয়ে যায়।
(২) ফল ও শাকসবজি পঁচনের লক্ষণ
- ফল ও শাকসবজির গায়ে কালো, বড় দাগ হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সাদা বা ছাইয়ের মত আবরণ পড়ে।
- ফল ও শাকসবজির রং পবির্তন হয়, বিবর্ণ হয়ে যায়।
- ফল ও শাকসবজি বেশি নরম হয়ে যায়।
- অনেক সময় ফল ও সবজির গায়ে গর্ত বা ছিদ্র তৈরি হয়।
- ফল ও শাকসবজি থেকে দুর্গন্ধ বের হয় ও পঁচা রস বের হয়।
- এদের স্বাদ পরিবর্তন হয়ে বেশির ভাগ সময় তিক্ত স্বাদ যুক্ত হয়।
- ফল ও শাকসবজির ওজন বেড়ে যায়।
- ফলের সাথে খোসা আলগাভাবে লেগে থাকে।
(৩) ফল ও শাকসবজি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
কিছু কিছু সবজি ও ফল আছে যা সারা বছর পাওয়া যায়। তবে অনেক ফল ও সবজি মৌসুমে উৎপন্ন হয়। যেমন আলু, ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, আম, জলপাই, পেয়ারা ইত্যাদি। এই সমস্ত ফল ও সবজি সারাবছর বা অমৌসুমে খেতে চাইলে তাদের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের বিকল্প নাই।
আবার অনেক সময় উৎপাদন মৌসুমে কোন কোন ফল ও সবজি প্রচুর উৎপন্ন হয় যা চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থাকে। এগুলো অনেক সময় পচে নষ্ট হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ আম, টমেটোর আনারস ইত্যাদি। এই অপচয় রোধের জন্য ও মারাত্মক পুষ্টি সমস্যা সমাধানের জন্য ফল ও শাকসবজি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যে সব কারণে শাকসবজি ও ফল সংরক্ষণ করা প্রয়োজন তা নিচে আলোচনা করা হলো-
- ফল ও শাকসবজিকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তা সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
- মৌসুম ছাড়াও বছরে অন্যান্য সময় বিভিন্ন ফল ও শাকসবজির সরবরাহ করার জন্য সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
- শাক সবজি বাজারজাত কাজের সময় ও পরিধি বৃদ্ধি পায়।
- দেশের সব স্থানে সব ধরণের ফল ও শাকসবজি উৎপন্ন হয় না, ফল ও শাকসবজি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা গেলে সারাদেশের সব স্থানেই ঐ সব ফল ও সবজির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
- বিদেশে রপ্তানি করার সময় পরিবহনের সময়, অনেক ফল ও সবজি পচে যায়। সঠিকভাবে এগুলো সংরক্ষণ করে রপ্তানি করা হলে সবগুলোর গুণাগুন অক্ষুন্ন থাকবে এবং রপ্তানি আয়ও বাড়বে।
- আর্থিকভাবে বেশি লাভাবন হওয়া যায়। উৎপাদন মৌসুমে ফল ও শাকসবজির দাম কম থাকে। এগুলো সংরক্ষণ করে পরে বিক্রি করলে বেশি দাম পাওয়া যায়।
- ফল ও শাকসবজি থেকে চিপস, জুস, জ্যাম, জেলী, আচার মোরোব্বা ইত্যাদি তৈরি করে সারা বছর খাওয়া যায়।
- বিভিন্ন শিল্প কারখানায় বিভিন্ন খাদ্য পণ্য উৎপাদন করতে সারা বছর প্রচুর ফল ও শাকসবজি ব্যবহার করা যায়।
- ফল ও শাকসবজি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করলে তার পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন থাকে। ফলে সারাক্ষণ মানুষের পুষ্টির চাহিদা পুরণ হয়।
- আপদকালীন বা অসময়ের প্রয়োজন মেটানো যায়।
- অনেক সময় সংরক্ষণের অভাবে বিভিন্ন ফল ও সবজি পচে নষ্ট হয়। ফলে কৃষক আর ঐ ফসল ফলাতে আগ্রহী হয় না। সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা গেলে কৃষক ঐ সব ফসল উৎপাদনে আরও উৎসাহিত হবে।
- ফল ও সবজি সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত করণ সরবরাহ ও ক্রয় বিক্রয় প্রক্রিয়ায় অনেক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়।
- সর্বোপরি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন হবে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া শাকসবজি উৎপাদনের জন্য বেশ উপযোগী। আমাদের দেশে শীতকালে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী শাকসবজির উৎপাদিত হয়। সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাত না করার জন্য আমাদের দেশে উৎপাদিত শাকসবজির ২০-২৫% নষ্ট হয়ে থাকে। এতে আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণে যেমন ঘাটতি দেখা দেয় তেমনি আর্থিকভাবেও আমরা যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকি। তাই সারা বছর ধরে শাকসবজি উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা ফল ও শাকসবজি পঁচনের কারণ, লক্ষণ এবং ফল ও শাকসবজি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানলাম।
শাকসবজির পচনের কারন হল শাকসবজি সংগ্রহের ও পরিবহনের সময় আঘাতজনিত ক্ষত এবং শ্বসন ও প্রস্বেদন। এর মাধ্যমে পানি বেরিয়ে যাওয়ার কারনে শাকসবজি দ্রুত নেতিয়ে পড়ে, কুচকে ও শুকিয়ে যায়। ফলে শাকসবজির সজীবতা হারায় ও রং নষ্ট হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া ক্ষতস্থানের ভিতর দিয়ে রোগজীবানু প্রবেশ করে শাকসবজিকে দ্রুত পচিয়ে ফেলে।
সংগ্রহের পর শাকসবজিতে বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্খিত শারীরিক ও শারীরতাত্ত্বিক অবক্ষয় পরিলক্ষিত হয় যেমন- স্বাভাবিক সবুজ রং নষ্ট হওয়া, কান্ড ও ফল জাতীয় সবজিতে আঁশের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ও পানির পরিমাণ কমে যাওয়া, আমিষ, ফ্যাট ও ভিটামিনের পরিবর্তন হওয়া, উদ্বায়ী দ্রব্য তৈরী হওয়া ইত্যাদি।
যেসব সবজি সারা বছর উৎপাদন করা সম্ভব হয় না সেগুলো অমৌসুমে খাওয়ার জন্য সংরক্ষণের কোন বিকল্প নেই। শাকসবজি বিদেশে রপ্তানী করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। অপরদিকে দেশের বেকার যুব শ্রেণী সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ করে কুটির শিল্পের মাধ্যমে তাদের বেকারত্ব ঘূচাতে সক্ষম হবে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।