(১) ইঁদুর দমন পদ্ধতি
ইঁদুর দমন পদ্ধতি সমূহকে আমরা সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি।
- পরিবেশসম্মত ভাবে ইঁদুর দমন
- বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইঁদুর দমন বা রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুুর দমন।
ক) পরিবেশসম্মতভাবে দমন
কোন রকম বিষ ব্যবহার না করে অর্থাৎ পরিবেশের কোন ক্ষতি না করে ইঁদুর দমনই হলো পরিবেশ সম্মতভাবে ইঁদুর দমন। বিভিন্ন ভাবে এটা করা যায়। যেমন-
i) পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা
বিভিন্ন পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইঁদুরের ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়।
- ইঁদুর নোংরা স্থান পছন্দ করে বিধায় বাড়িঘর, ক্ষেত খামার, পুকুরপাড়, বন্যানিয়ন্ত্রন বাঁধ, নদীর পাড় ইত্যাদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- খাদ্য গুদাম এবং খড়ের গাদা মাটির সাথে তৈরি না করে, প্রায় ৬০-৭৫ সেমি উঁচু মাচা তৈরি করে তার উপর করতে হবে এতে ইঁদুরের উপদ্রব কম হবে।
- ক্ষেতের আইল মোটা হলে ইঁদুর গর্ত করে, তাই আইল ছেঁটে চিকন করতে হবে।
- বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বাড়ী বা গুদাম ঘরে ইঁদুর যাতে প্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
- অনুরূপভাবে নারিকেল বা সুপারি গাছে মাটি থেকে ৫-৬ ফুট উঁচুতে ও ২.৫ ফুট চওড়া মসৃণ টিনের পাত লাগিয়ে ইঁদুর প্রতিরোধ করা যায়।
ii) নিবিড়ভাবে ফাঁদ পাতা
- বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ইঁদুর দমন করা যায়। যেমন বাঁশ, কাঠের, টিন ও লোহার তার দ্বারা তৈরি ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে।
- ফাঁদ সাধারণত ২ প্রকার, জীবিত অবস্থায় ধরা ফাঁদ এবং মৃত্যু ফাঁদ।
- মৃত্যু ফাঁদে সরাসরি ইঁদুর যাতাকলে আটকিয়ে মারা যায়। জীবিত ফাঁদে ইঁদুর আটকা পরে কিন্তু মারা যায় না।
- নতুন গর্তের মুখে ইঁদুর চলাচলের রাস্তায়, ক্ষেতের আইলে বা ঘরের দেয়াল ঘেসে ফাঁদ ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
- লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ফাঁদ প্রতিদিন পরিষ্কার করা হয় এবং নতুন খাবার/টোপ দেয়া হয়। ফাঁদে টোপহিসাবে শুটকীমাছ, নারিকেল পাউরুটি বেশী কার্যকর।
iii) পরভোজী প্রাণি সংরক্ষণ
পেঁচা, গুইসাপ, বেজী, শিয়াল, বিড়াল ইত্যাদি প্রাণির প্রধান খাদ্য ইঁদুর। এ প্রাণি গুলোকে সংরক্ষণ করলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ ইঁদুর সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।
খ) রাসায়নিক পদ্ধতি
বিভিন্ন ধরনের বিষ ব্যবহার করে ইঁদুর দমনকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর দমন বলে।
দুই ধরনের বিষ সাধারণত পাওয়া যায়। তীব্র বা তাৎক্ষনিক বিষ এবং দীর্ঘস্থায়ী বিষ।
তাৎক্ষনিক বিষ খাওয়ার ১-২ ঘণ্টার মধ্যেই ইঁদুর মারা যায়। এই বিষটোপ ব্যবহারের পূর্বে ১-২ দিন বিষহীন টোপ ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। তাৎক্ষনিক বিষ হিসাবে জিংক ফসফাইড বিষটোপ ব্যবহƒত হয়, যা বিভিন্ন নামে বাজারে বিক্রি হয়। জিংক ফসফাইড মিশ্রিত গম বিষটোপ গর্তের ভিতর প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
দীর্ঘস্থায়ী বিষটোপ খাওয়ার ৬-৭ দিন পর ইঁদুর মারা যায়। তাই অন্যান্য জীবিত ইঁদুর বুঝতেই পারে না যে, এই বিষটোপই তাদের সঙ্গিদের মৃত্যুর কারণ। ফলে ইঁদুর দমনের সফলতা বেশি আসে।
- অবশ্যই সরকার অনুমোদিত পেস্টিসাইড ডিলারের নিকট থেকে বিষটোপ কিনতে হবে।
- বাড়িঘর, ক্ষেত খামার যেখানেই ইঁদুরের আক্রমণ হোক না কেন, এক স্থানে অনেকগুলো বিষটোপ না রেখে ৪/৫ স্থানে বিষটোপ ইঁদুরের গর্ত ও চলাচলের রাস্তার আশে পাশে রাখা উচিত।
- বিষটোপ প্রস্তুত বা ব্যবহারের সময় খুব সতর্কতা অবলম্বন করা একান্ত দরকার। বিষটোপ ছোট ছেলে মেয়েদের ও গৃহপালিত পশু পাখির নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
- মৃত ইঁদুর গুলো একত্রিত করে গর্তে পুঁতে ফেলতে হবে।
বিষটোপ ছাড়া এক প্রকার গ্যাস বড়ি এ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড দিয়েও ইঁদুর দমন করা যায়।
- প্রতিটি সতেজ গর্তে একটি ট্যাবলেট দিয়ে গর্তের সব মুখ ভাল ভাবে বন্ধ করতে হবে।
- শুকনা মাটির চেয়ে একটু আর্দ্র মাটিতে যেন কোন ফাটল না থাকে গর্তের মুখ খোলা থাকলে বা মাটিতে ফাটল থাকলে গ্যাস বেরিয়ে যাবে এবং ইঁদুর মারা যাবে না।
ইঁদুর দমনের সফলতা নির্ভর করে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার উপর।
গ) ধাতব পাত দ্বারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির মাধ্যমে ফল গাছে ইঁদুর দমন
ইঁদুর সর্বভুক প্রাণি। এরা ঘরের ও মাঠের ফসল খেয়ে ও কেটে নষ্ট করে ক্ষতি করে থাকে।
ইঁদুরের ছেদন দাঁত গজানোর পর হতে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পায়। কাটাকুটি না করতে পারলে দাঁত বেড়ে চোয়াল দিয়ে বের হয়ে যায় ফলে ইঁদুর মুখ বন্ধ করতে না পারায় খাওয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। তাই দাঁত ঠিক রাখার জন্য ইঁদুর সর্বদা শক্ত জিনিস কাটাকাটি করে থাকে।
ইঁদুর বৎসরে প্রায় ৪-৫ লক্ষ মেট্রিকটন ফসল নষ্ট করে যার মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা (২০২৩ খ্রিঃ)। তাছাড়া ইঁদুর প্লেগসহ প্রায় ৪০ প্রকার রোগ বিস্তার করে।
ইঁদুর দানাশস্য ও গুদামে ক্ষতি ছাড়াও বিভিন্ন প্রকার ফল খেয়ে ও কেটে ক্ষতি করে থাকে যেমন নারিকেল, সুপারি, আম, লেবু, পেয়ারা, সফেদা, কাঠাল, কলা, কুল ইত্যাদি ফল খেয়েও গাছে বাসা তৈরি করে ক্ষতি করে থাকে।
সাধারণত ফল গাছে Rattus rattus প্রজাতির ইঁদুর ক্ষতি করে থকে। এরা কিছুটা বাদামী বর্ণের। এরা নারিকেল গাছে উঠে বাসা তৈরি করে এবং কচি ডাবের অগ্রভাগে ছিদ্র করে ডাবের পানি ও শাস খেয়ে ক্ষতি করে থাকে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের এক জরিপে দেখা যায় প্রতি বছর গাছ প্রতি ১০-১২ টি কচি নারিকেল ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয়। যার আনুমানিক মূল্য ৩০০-৪০০ টাকা (২০২৩ খ্রিঃ)। তাই এদের দমন করা অত্যন্ত জরুরি।
নারিকেল গাছ সহ অন্যান্য গাছে ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে ধাতব পাত দ্বারা সাফল্যজনকভাবে ইঁদুর দমন করা যায়।
- এ ক্ষেত্রে টিনের পাত লাগানোর পূর্বে গাছকে ইঁদুর মুক্ত করতে হবে।
- অপ্রয়োজনীয় মরা ডাল পালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে। এবং অন্য গাছের সাথে লেগে থাকা ডালপালা ছেটে দিতে হবে।
- বিশেষ করে গাছ থেকে গাছের দূরত¦ কমপক্ষে ৬ ফুট বা ২ মিটার ব্যবধান হতে হবে। যাতে ইঁদুর অন্য গাছ থেকে ডাল বেয়ে টিন লাগানোর গাছে না আসতে পারে।
- নারিকেল, সুপারি গাছসহ ফল উৎপাদনকারী গাছের গোড়া হতে ২ মিটার উপরে গাছের খাড়া কান্ডের চারিদিকে ৫০-৬০ সেমি প্রশস্ত টিনের পাত শক্তভাবে আটকিয়ে দিতে হয়। ফলে ইঁদুর গাছের গোড়া (নিচ) থেকে উপরে উঠতে যেয়ে টিনের পাত কিছুটা মসৃন হওয়ার বাধা প্রাপ্ত হয়। ফলে উপরে উঠতে পারেনা।
- এই পদ্ধতি অরাসায়নিক হওয়ায় পরিবেশ দূষণমুক্ত, অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী ও লাভজনক। সাধারণত এ পদ্ধতি ব্যবহারে ১টি নারিকেল গাছে ১০০-১৫০ টাকা (২০২৩ খ্রিঃ) খরচ হয়।
- একবার টিনের পাত লাগালে ৪-৫ বৎসর পর্যন্ত কার্যকর থাকে। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে নারিকেল সহ অন্যান্য ফল গাছে ইঁদুর ও কাঁঠবিড়ালী সফলভাবে দমন করা যায়।
(২) চকচকে ফিতা দিয়ে পাখি তাড়ানো
আমাদের বাংলাদেশে নানা জাতের পাখি আছে। এরা বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গ ও ক্ষতিকারক পোকান্ডমাকড় খেয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। তবে কিছু কিছু পাখি আছে যেগুলো উপকারের পাশাপাশি কিছু অপকার করে থাকে। যেমন বাবুই, কাক, টিয়া, শালিক, এসব পাখি ফসলের ক্ষতি করে থাকে।
- গম ক্ষেতে শালিক পাখির উপদ্রব হয়। বীজ বোনার ৫/৬ দিন পর গমের অঙ্কুর বের হয়। কোন কোন এলাকায় শালিক পাখি এ অংকুরিত গম ক্ষেতের বীজ তুলে খেয়ে ফেলে। এতে আশানুরুপ ফলন হয় না।
- পাকা টমেটো ক্ষেতেও পাখির উপদ্রব হয়।
- ভুট্টা ক্ষেতে টিয়া ও কাকের উপদ্রব হয়। এরা ভুট্টার মোচা খেয়ে ফেলে ফসলের ক্ষতি করে।
- তেমনি ভাবে সূর্যমুখী ক্ষেতেও কাক ও টিয়া পাখি পরিপক্ক বীজ খেয়ে ফেলে।
যেহেতু এসব পাখি ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি যথেষ্ট উপকার করে থাকে তাই এগুলো একবারে মেরে ফেলে উচিত নয়। পাখিকে না মেরে ফসলের ক্ষেত থেকে তাড়িয়ে দেয়াই উত্তম।
পাখি তাড়ানোর উল্লেখযোগ্য পদ্ধতিগুলো হলো-ঢিল ছোড়া, বাশেঁর ডুগডুগি বাজানো, কাক তাড়ুয়া ব্যবহার করা, বাজি ফুটানো চকচকে ফিতা ব্যবহার করা, জাল পাতা ইত্যাদি। এসব পদ্ধতির মধ্যে চকচকে ফিতার ব্যবহার বেশি কার্যকর।
(৩) পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ এবং শুকনা মরিচের গুড়ার মাধ্যমে কাঠবিড়ালী দমন
পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ এবং শুকনা মরিচ গুড়া এর মিশ্রণ স্প্রের মাধ্যমে সবজি, ফল এবং মাঠের অন্যান্য ফসল থেকে কাঠবিড়ালী সফলভাবে ৪ থেকে ৫ দিন অবধি বিতারণ সম্ভব। এটি একটি সহজ পদ্ধতি, কৃষকভাই ও বোনেরা খুব সহজে নিজ বাড়ীতে এই মিশ্রণটি তৈরি করে তাদের মাঠের কাঠবিড়ালী বিতাড়ণ করতে পারবেন।
মিশ্রণ তৈরির পদ্ধতি:
- প্রথমে, ৫০ গ্রাম পেঁয়াজ, ১০ গ্রাম কাঁচামরিচ এবং ১০ গ্রাম শুকনা মরিচ গুড়া মেপে নিতে হবে।
- এরপর পিয়াজগুলো ছিলে নিতে হবে।
- তারপর পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ চাকু দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে নিতে হবে।
- এরপর একটি সসপেনে ২ লিটার পানির মধ্যে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ এবং শুকনা মরিচ গুড়া নিয়ে মিশ্রণটি চুলায় ৩০ মিনিট ফুটাতে হবে।
- মিশ্রণটি ঠান্ডা হলে, তা একটি পাত্রে ছেঁকে নিতে হবে।
- এরপর ছেঁকে নেওয়া মিশ্রণটি স্প্রে মেশিনে ঢেলে নিতে হবে।
- ফল গাছের সংখ্যা ও জমির পরিমাণ অনুযায়ী সঠিক পরিমাণ মিশ্রণ তৈরি করে নিতে হবে।
স্প্রে পদ্ধতি:
ফল গাছে ফুটপাম্প স্প্রে মেশিন এবং ফসলের মাঠের জন্য ন্যাপস্যাক স্প্রেয়ার ব্যবহার করে গাছের ক্যানোপি ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে। এভাবে ৪ থেকে ৫ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]