ফিরিঙ্গি (Trigonella corniculata L.) Fabaceae গোত্রের একটি অপ্রধান মসলা ফসল। ভারত ও পাকিস্তানে এ মসলা ফসলটিকে ‘কাসুরী মেথী’ (Kasuri methi) বলা হয়। বাংলাদেশে এটি ফিরিঙ্গি নামে পরিচিত হলেও প্রথিবীর বিভিন্ন স্থানে এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত।
ফিরিঙ্গি ফসলটি অনেকটা মেথী ফসলের মতো। কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন গাছের বৃদ্ধি এবং পডের আকৃতির কারনে এই প্রজাতি দুটোতে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। এর পডের আকৃতি অপেক্ষাকৃত ছোট এবং চন্দ্রাকৃতি (Sickle shape) হওয়ায় ইংরেজীতে এটি Sickle shaped fenugreek/ Sickle fruit fenugreek নামে পরিচিত।
ফিরিঙ্গি গাছের পাতা এবং ফল মেথীর মতোই ব্যবহৃত হয়। তবে আমাদের বাংলাদেশে এর পডসহ বীজ পাঁচফোরনের মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভারতবর্ষে ও পাকিস্তানে এর পাতা শুকিয়ে বাজারজাত করনের জন্য বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয়।
ফিরিঙ্গি বীজ নানা প্রকার তরকারী, আচার, চাটনী ইত্যাদি স্বাদ ও সুগন্ধ বৃদ্ধির উপকরণ হিসাবে বেশ জনপ্রিয়।
ফিরিঙ্গির যথেষ্ট ঔষধি মূল্য রয়েছে। বহুমুত্র রোগ নিয়ন্ত্রনে এটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দুর করে এবং হজম শক্তি ও রুচি বৃদ্ধি করে।
বাংলাদেশে এই ফসলটি এখনো বানিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা হয় না। তবে অল্প পরিসরে দেশের অভ্যন্তরীন চাহিদা মেটানোর জন্যে ফিরিঙ্গি চাষ করা হয়ে থাকে।
(১) ফিরিঙ্গির জাত ও বৈশিষ্ট্য
বারি ফিরিঙ্গি-১:
- চর ও বরেন্দ্র অঞ্চলসহ জাতটি সারা দেশে চাষ করা যায়।
- গাছের উচ্চতা ২২-৩৫ সেন্টিমিটার।
- প্রাথমিক শাখার সংখ্যা ৫-৬ টি।
- প্রতি গাছে পডের সংখ্যা ৩৬০-৪৬০ টি।
- প্রতিটি পডে ৮-১০ টি বীজ থাকে।
- বীজগুলো শুষ্ক ও হলুদাভ বাদামী বর্ণের।
- এই জাতে রোগ বালাই নেই বললেই চলে।
- প্রতি ১০০০ বীজের ওজন ১.১-১.২ গ্রাম।
- এই জাতেটির জীবনকাল ৯০-১০০ দিন।
- প্রতি হেক্টরে এর পডের ১.৬-১.৯ টন এবং বীজের ফলন ০.৪-০.৫ টন।
(২) ফিরিঙ্গি মসলার চাষ পদ্ধতি
ক) মাটি
প্রায় সব প্রকার মাটিতে ফিরিঙ্গি চাষ করা যায়। তবে পলি দো-আঁশ থেকে বেলে দোঁআশ মাটি ফিরিঙ্গি চাষের জন্য অধিক উপযুক্ত। ফিরিঙ্গি গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য মাটির পিএইচ ৬-৭ হলে ভাল হয়।
খ) জমি তৈরী
মাটি ও জমির প্রকার ভেদে ৪-৬ টি চাষ ও মই দিয়ে ঝুরঝুরে করে জমি তৈরী করতে হবে।
গ) বীজ বপন ও বীজের হার
ভালভাবে তৈরীকৃত জমিতে সারি থেকে দূরত্ব ২৫ সেন্টিমিটার বজায় রেখে বীজ ১-১.৫ সেন্টিমিটার গভীরতায় সারিতে করা হয়।
বীজ ৪-৬ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে বপন করতে হবে। বীজ বপনের পরপরই প্রয়োজনীয় সেচ প্রদান করতে হব।
সারিতে বপনের প্রতি হেক্টর জমিতে ৩-৪ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়।
ঘ) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
সারের মাত্রা জমির উর্বরতার উপর নির্ভরশীল। সাধারণত প্রতিহেক্টরে নিম্নোক্ত পরিমাণ সারের প্রয়োজন হয়।
সার | মোট পরিমাণ | শেষ চাষের সময় প্রয়োগ | বীজ বপনের ১০-১৫ দিন পর | বীজ বপনের ৩০ দিন পর |
গোবর | ৫ টন | সব | – | – |
ইউরিয়া | ১২৫ কেজি | – | ৬৫ | ৬০ |
টিএসপি | ১২৫ কেজি | সব | – | – |
এমওপি | ১০০ কেজি | ৫০ | – | ৫০ |
জিপসাম | ৮০ কেজি | সব | – | – |
সম্পূর্ন গোবর, টিএসপি, জিপসাম এবং অর্ধেক এমপি সার শেষ চাষের সময় দিতে হবে। বাকী এমপি সার বীজ বপনের ৩০ দিন পর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
ইউরিয়া সার বীজ বপনের ২০-২৫ দিন পর এবং ৫০-৫৫ দিন পর জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
ঙ) আন্তঃপরিচর্যা
গাছের সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। গাছের প্রাথমিক বৃদ্ধির সময় নিড়ানী দিয়ে আগাছা পরিস্কার ও মাটি ঝুরঝুরা করে দিতে হবে। এভাবে ১০-১৫ দিন পর পর ২-৩ বার নিড়ানী দিতে হবে।
প্রতিবার সেচের পর ‘জো’ আসা মাত্র মাটির উপরের চটা ভেঙ্গে দিতে হবে। মাটির প্রকার ভেদে জমিতে সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
জমির অতিরিক্ত পানি নালা দিয়ে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
চারা গজানোর ১০ দিন পর থেকে ২/৩ ধাপে ৪-৫ দিন পর পর নির্দিষ্ট দূরত্বে রেখে চারা পাতলা করে দিতে হবে।
চ) ফসল সংগ্রহ
বীজ বপনের পর থেকে ৯০-১০০ দিনের মধ্যেই ফসল সংগ্রহ করা যায়। সাধারণত যখন পড সমূহ হলদে বাদামী বর্ণ ধারণ করে তখন গাছ কাটা হয়।
ছ) মাড়াই-ঝাড়াই ও সংরক্ষণ
গাছ মাড়াই করার স্থানে ছড়িয়ে দিয়ে ৪-৫ দিন রৌদ্রে শুকানোর পর ফসল মাড়াই করা হয়। মাড়াই করা বীজ ভালভাবে ২-৩ দিন রোদে শুকিয়ে বাতাসমুক্ত টিন, মাটির পট, পলিব্যাগ ইত্যাদিতে সংরক্ষণ করা হয়।
জ) ফলন
হেক্টর প্রতি ফিরিঙ্গি বীজের ফলন ০.৪-০.৫ টন।
(৩) ফিরিঙ্গি চাষে রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
‘বারি ফিরিঙ্গি-১’ এ মারাত্বক কোন রোগ হয় না বললেই চলে। তবে সেচের তারতম্যের কারণে গোড়া পঁচা রোগ দেখা দিতে পারে।
দমন: রোগের লক্ষণ দেখা মাত্র প্রতি লিটার পানির সাথে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ২ গ্রাম অটোস্টিন মিশিয়ে সমস্ত গাছে ৫-৭ দিন পর পর ২-৩ বার বিকালে স্প্রে করতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]