বন একটি দেশের মূল্যবান সম্পদ। আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
২০২০ সালের একটি সরকারি হিসাব মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট বনভূমির আয়তন প্রায় ২২.৫ লক্ষ হেক্টর। বনভূমির এ পরিমাণ বাংলাদেশেরদেশের মোট ভূমির শতকরা ১৭ ভাগ। এ বন সারাদেশে সমানভাবে বিস্তৃত নয়। অধিকাংশ বনভূমি দেশেরপূর্ব, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বনভূমির পরিমাণ খুবই কম।
এই আর্টিকেলটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- বন কত প্রকার ও কি কি তা জানতে পারবেন। বাংলাদেশের বনাঞ্চলের বিস্তৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে পারবেন। বাংলাদেশের বনাঞ্চলের নাম উল্লেখ করতে পারবেন। বিভিন্ন বনের বৈশিষ্ট্য চিনতে পারবেন। বাংলাদেশের বন সংরক্ষণ বিধি সম্পর্কে জানতেপারবেন। বন সংরক্ষণ বিধির প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন পারবেন। বন সংরক্ষণ নিয়মাবলি সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন। বন সংরক্ষণের উপযোগিতা বিশ্লেষণ করতে পারবেন।
(১) বন কত প্রকার ও কি কি?
অবস্থান ও বিস্তৃতিভেদে বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে প্রধানত ৫ প্রকার। এ প্রকারগুলো হলো-
- পাহাড়ি বন;
- সমতলভূমির বন;
- ম্যানগ্রোভ বন;
- সামাজিক বন;
- কৃষি বন।
নিচের ছকে, ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, অবস্থান ও বিস্তৃতিভেদে, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বনভূমির পরিমাণ (লক্ষ হেক্টর) দেখানো হলো-
বনের ধরন | প্রাকৃতিক বন | কৃত্রিম বা সৃজিত বন | মোট |
পাহাড়ি বন | ১১.০৬ | ২.১০ | ১৩.১৬ |
ম্যানগ্রোভ বন | ৬.১৬ | ১.৩৪ | ৭.৫০ |
সমতল ভূমির বন | ০.৮৭ | ০.৮৭ | ১.২৩ |
গ্রামীণ বন | – | ২.৭০ | ২.৭০ |
ক) পাহাড়ি বন
ক্রান্তীয় আর্দ্র চিরসবুজ পাহাড়ি বন-
- ক্রান্তীয় আর্দ্র চিরসবুজ বন সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য এ বনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ বনে কিছুটা আধা চিরসবুজ ও পত্রমোচী বৃক্ষও থাকে, কিন্তু তাতে বনের চিরসবুজ প্রকৃতি বদলায় না।
- চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কক্সবাজার ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মৌলভীবাজার জেলায় পাহাড়ি বনভূমি রয়েছে।
- বৃক্ষসমূহ ৪৫-৬২ মিটার পর্যন্ত হতে পারে।
- আর্দ্র ছায়া ঢাকা স্থানে পরাশ্রয়ী অর্কিড, ফার্ন ও ফার্নজাতীয় উদ্ভিদ, লতা, মস, কচু, বেত ইত্যাদি প্রায় সর্বত্রই জন্মে।
- গুল্ম, বীরুৎ ও তৃণ কম, এ জাতীয় বনে প্রায় ৭০০ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ রয়েছে।
- কালিগর্জন, ধলিগর্জন, সিভিট, ধুপ, কামদেব, রক্তন, নারকেলি, তালী, চুন্দাল, ডাকিজাম ইত্যাদি সাধারণ চিরহরিৎ বৃক্ষ প্রজাতি যেগুলি সর্বোচ্চ ছাউনি সৃষ্টি করে।
- চাঁপা, বনশিমুল, চাপালিশ, মাদার ইত্যাদি আধাচিরহরিৎ ও চিরহরিৎ বৃক্ষ বিক্ষিপ্তভাবে জন্মে।
- পিতরাজ, চালমুগরা, ডেফল, নাগেশ্বর, কাউ, গোদা, জাম, ডুমুর, করই, ধারমারা, গামার, তেজবল মদনমাস্তা, আসার, মুস, ছাতিম, তুন, অশোক, বড়মালা, ডাকরুম, বুরা ইত্যাদি দ্বিতীয় স্তরের ছাউনি সৃষ্টি করে।
ক্রান্তীয় আধা-চিরসবুজ পাহাড়ি বন-
- ক্রান্তীয় আধা-চিরসবুজ বন বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সাধারণত চিরহরিৎ, কিন্তু পত্রমোচী বৃক্ষেরও প্রাধান্য রয়েছে।
- এ বনভূমি সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিনাজপুরের পাহাড়ি এলাকা নিয়ে গঠিত।
- প্রধানত এখানে জুমচাষ করা হয়।
- এখানে আট শতাধিক প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ রয়েছে। চিরসবুজ বন অপেক্ষা এ জাতীয় বনে গাছতলায় উদ্ভিদ অধিক জন্মে।
- এখানে জন্মানো উঁচু আচ্ছাদন সৃষ্টিকারী বৃক্ষ ২৫-২৭ মিটার উঁচু হয়ে থাকে।
- নাগেম্বর, উড়িআম, নালিজাম, গোদাজাম, পীতজাম, ঢাকিজাম ইত্যাদি মধ্যমাঞ্চলে ছাউনি সৃষ্টিকারী বৃক্ষ।
- ডেফল বনশিমুল, শিমুল, শিলকরই, চুন্দুল, গুজা বাটনা, কামদেব, বুরা গামারি, বহেড়া ও মুস উপরের ছাউনি অশোক, জলপাই ও দারুম নিচু ছাউনি সৃষ্টি করে।
- সাধারণ চিরসবুজ উদ্ভিদ প্রজাতিগুলি হলো গর্জন, শিমুল, বনশিমুল, বাটনা, চাপালিশ, তুন, করই, জলপাই।
- এ বনভূমির উদ্ভিদের উত্তরাংশের সঙ্গে পূর্ব-হিমালয় ও দক্ষিণাংশের সঙ্গে আরাকানের উদ্ভিদের সাদৃশ্য রয়েছে।
- এ বনগুলির মোট আয়তন প্রায় ৬,৪০,০০০ হেক্টর যা বাণিজ্যিক কাঠের ৪০% যোগায়।
খ) সমতলভূমির বন
বৃহত্তর ঢাকা, টাঙ্গাইল, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী ও কুমিল্লা অঞ্চলের বনকে সমতল ভূমির বন বলে। এ বনের প্রধান প্রধান বৃক্ষ শাল ও গজারি; এছাড়া কড়ই, রেইনটি, জারুল ইত্যাদি বৃক্ষও এ বনে জন্মে থাকে।
- সমতলভূমির প্রাকৃতিক বনের কাছাকাছি বসতি থাকায় এ বনের উপর মানুষের চাপ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক বনের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক স্থান বনশূন্য হয়ে পড়েছে। সরকারিভাবে এসব এলাকায় সামাজিক বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। জনগনের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কোনো কোনো স্থানে সামাজিক বনায়ন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
- এ বনের শাল কাঠ খুবই উন্নতমানের হয়ে থাকে। গৃহ নির্মাণ, আসবাবপত্র তৈরি ও অন্যান্য নির্মাণ কাজে শাল কাঠের ব্যবহার করা হয়।
- এ বনের বন্য প্রাণী প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমানে কোথাও কোথাও অল্প সংখ্যক নেকড়ে, হরিণ, বানর, সাপ, ঘুঘু, দোয়েল ও শালিক দেখা যায়।
গ) ম্যানগ্রোভ বন
খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার দক্ষিণের বিস্তৃত এলাকা ম্যানগ্রোভ বলে পরিচিতি। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এ বন অবস্থিত। প্রত্যহ সামুদিক জোয়ারের পানিতে এ বন প্লাবিত হয় বলে একে লোনা পানির বনও বলা হয়।
- জোয়ার ধৌত বন খুলনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের এ উপকূলীয় বনগুলি বাংলাদেশের সর্বাধিক উৎপাদনশীল বনভূমি।
- প্রতিবার জোয়ারের সময় এ বনভূমি সমুদ্রের পানিতে প্লাবিত হয়। এখানকার চিরসবুজ গাছগুলির আছে বায়ুমূল এবং বংশবিস্তার জরায়ুজ ধরনের।
- সুন্দরী ছাড়াও পশুর, গেওয়া, কেওড়া, কাঁকড়া, বাইন, ধুন্দুল, আমুর ও ডাকুর দলবদ্ধভাবে জন্মে। উপকূলীয় পানির ঘোলাটে ভাব ও লবণাক্ততা সেখানকার প্রজাতিগুলির বিন্যাস ও বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে।
- নদীর পলি জমে ওঠা তীর ও ফাটলেই এসব প্রজাতি দ্রুত বেড়ে ওঠে। নদী ও খালের পাড়ে ঠেসমূলীয় প্রজাতির প্রাধান্য দেখা যায়। সুন্দরী বৃক্ষের নামানুসারে এ বনের নামকরণ করা হয়েছে সুন্দরবন।
- সুন্দরবন ছাড়াও গাঙ্গেয় বদ্বীপের অনেকগুলি চরই ম্যাগ্রোভের গভীর বনে ঢাকা, নেই শুধু সুন্দরী।
- এ বনের অধিকাংশ উদ্ভিদের উর্ধ্বমুখী বায়বীর মূল রয়েছে। যার সাহায্যে এরা শ্বসন ক্রিয়ার জন্য অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে। কারণ জলাবদ্ধ মাটি থেকে সাধারণ মূলের পক্ষে অক্সিজেন গ্রহণ সম্ভব নয়।
- বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার এ বনে বাস করে। চিতাবাঘ, হরিণ, বানর, অজগরসহ বিচিত্র রকমের পাখি ও কীট-পতঙ্গ এ বনে বাস করে। সুন্দর বনের নদী ও খালে কুমির ও অন্যান্য জলজ প্রাণী বাস করে।
- প্রতি বছর সুন্দরবন থেকে প্রচুর মধু ও মোম পাওয়া যায়।
- সুন্দর বন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বন। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বড় ও সম্পদশালী ম্যানগ্রোভ বন হলো এ সুন্দরবন। এবনের মোট আয়তন ৬০০০ বর্গ কিলোমিটার।
ঘ) সামাজিক বন
সামাজিক বনায়ন ব্যবস্থাপনায় জনসাধারণ সরাসরি সম্পৃক্ত থাকে। জনগণের স্বত্বঃফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক কল্যাণে যে বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়, তাকেই সামাজিক বনায়ন বলা হয়।
- সামাজিক বনায়ন হলো এমন বন ব্যবস্থাপনা বা কর্মকান্ড যার সাথে পল্লির দরিদ্র জনগোষ্ঠী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর মাধ্যমে উপকারভোগী জনগন জ্বালানী, খাদ্য, পশুখাদ্য ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পেয়ে থাকে।
- বাংলাদেশ সরকার জন্মা লগ্ন থেকেই সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এতে জনসাধারণ সরাসরি অংশগ্রহণ করছে এবং উপকৃত হচ্ছে।
- বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় সকল সড়ক, মহাসড়ক ও রেল লাইনের পাশে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়েছে। বৃক্ষরোপন ও সংরক্ষণের ব্যাপারে সমবায় ভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রধানত উঁচু ও মাঝারি উঁচুজমিতে সামাজিক বন প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
সামাজিক বনায়নের প্রয়োজনীয়তা-
- জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা।
- দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো এবং দারিদ্য্র বিমোচন।
- পতিত জমি, বসতভিটা, সড়ক, রেলপথ, বাঁধ, খাল বিল ও নদীর পাড়ে, বিভিন্ন রকম প্রতিষ্ঠানের বনায়নও পরিবেশ সংরক্ষণ করা।
- পশুখাদ্য, শাকসবজি, ফলমূল, ভেষজ ও বিনোদনের জন্য বন সৃজনকরা।
- বন উৎপাদিত কাঁচামাল গ্রামীণ কুটির শিল্পে সরবরাহ করা ও জনগণের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
- প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ,ভূমিক্ষয় রোধ করা ও মরুবিস্তার রোধ করা।
- গৃহনির্মাণ ও আসবাবপত্রের জন্য কাঠের জোগান দান ও জ্বালানি কাঠের ঘাটতি পূরণকরা।
ঙ) কৃষি বন
কৃষি বনায়ন হলো কোন জমি থেকে একই সময়ে বা পর্যায়ক্রমিকভাবে বিভিন্ন গাছ, ফসল ও পশুপাখি উৎপাদন ব্যবস্থা।
সাধারণভাবে কৃষি বনায়ন হচ্ছে এক ধরনের সম্মতি ভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি। এতে কৃষি ফসল, পশু, মৎস্য এবং অন্যান্য কৃষি ব্যবস্থা সহযোগে বহু বর্ষজীবী কাষ্ঠল উদ্ভিদ জন্মানোর ব্যবস্থা করা হয়।
অর্থাৎ কৃষি বনায়ন হচ্ছে একই ভূমি/ভূখন্ড থেকে কৃষি ফসল এবং বনজ দ্রব্য যুগপৎ কিংবা পর্যায়ক্রমিকভাবে উৎপাদন করা।
পরিবেশ বাঁচানো, জ্বালানি সরবরাহ, কাঁঠ ও শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাপী কৃষি বনের প্রসার ঘটছে। আমাদের দেশেও বর্তমানে কৃষি বনায়ন পদ্ধতির যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটছে।
কৃষি বনায়নের বৈশিষ্ট্য-
- বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ ও ফসলের সমাহার ঘটে বিধায় উৎপাদন ঝুঁকি কমে যায়।
- একই জমি বারবার ব্যবহার করে অধিক উৎপাদনের ব্যবস্থা করা যায়।
- সামাজিক ও পরিবেশগত গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।
- ফসল খামার মালিক, মিশ্র খামার মালিক ও বন বাগান মালিকের চাহিদা পূরণ হয়।
- প্রান্তিক ভূমিজ সম্পদ ব্যবহার হয়।
- স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারে সুযোগ থাকে।
- খামারের উৎপাদন স্থায়িত্বশীল হয় ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে।
কৃষি বনায়নের পদ্ধতি ও প্রকার-
- কৃষি তৃণবন: ফসলের জোড় চাষ হয় ও মাঝে মাঝে বনজ গাছের উৎপাদন করা যায়।
- তৃণবন: মিশ্র খামার হয়ে থাকে। প্রধান উদ্দেশ্য পশুখাদ্য উৎপাদনকরা।
- ফসল-বন: বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গাছ ও আন্তঃফসল সমম্বয়ে গঠিত। প্রধান উদ্দেশ্য খাদ্য ও পশুখাদ্য উৎপাদনকরা।
- কৃষিবন মৎস্য খামার: মিশ্র খামার করা যায়। উঁচু নিচু সমন্বয়ে খামার স্থাপন করতে হয়। ফসল উৎপাদনকারী উদ্ভিদ ও মৎস্য উৎপাদন করা যায়।
কৃষিবনের প্রয়োজনীয়তা-
- ফসলি জমির বহুবিধ ব্যবহার করে উৎপাদন ঝুঁকি কমিয়ে আনা।
- এলাকা ভিত্তিক কৃষি বাজার তৈরি করে গ্রামীণ জনজীবনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়ন।
- কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
- মাটির-উর্বরতা বৃদ্ধি করা এবং মাটিক্ষয় রোধ করা।
- পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করা।
- উন্নত কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার করা।
- বিরাট জনগোষ্ঠীর কাজের ব্যবস্থা করা ও দারিদ্র্য্র হটানো
- কৃষি গবেষণার ফলাফলভিত্তিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করা।
- পশুখাদ্য উৎপাদন এবং পশু পাখি ও উপকারী কীট পতঙ্গের নিরাপদ আবাস তৈরি করা।
- খাদ্যের চাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক মুর্দ্রা অর্জন করা।
(২) বাংলাদেশের ‘বন সংরক্ষণ বিধি’
বন সংরক্ষণ বিধির পরিচিতি-
বনভূমির সকল লতাগুল্ম, বৃক্ষরাজি ও বন্যপ্রাণী নিয়ে বনজ সম্পদ গঠিত। এ বনজ সম্পদ একটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
বনভূমির এসব গাছপালা ও বন্য প্রাণীর মধ্যে নিবিড় আন্তঃসর্ম্পক বিরাজমান। কোনো কারণে এর যে কোনো একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যগুলো আপনা-আপনি ধ্বংস হয়ে যায়।
কোনো অঞ্চলে নতুন বনাঞ্চল সৃষ্টি বা সরকারি বনাঞ্চলে থেকে গাছ কাটা, অপসারণ, পরিবহন ইত্যাদি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন বা বিধান রয়েছে। এসব আইন বা বিধানকে বন বিধি বা বন আইন বলা হয়।
বনভূমির সকল সম্পদ সংরক্ষণ ও ব্যাবস্থাপনার জন্য ভারত উপমহাদেশে ১৯২৭ সালে বন সংরক্ষণ আইন করা হয় যা বন “আইন, ১৯২৭” নামে পরিচিতি। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে এ আইনের বিভিন্ন সংশোধনী আনয়ন করে যা “বন আইন (সংশোধন), ১৯৯০” নামে পরিচিতি। এ আইনের পর অবৈধ বন ধ্বংসের প্রবণতা কমে বটে কিন্তু পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব হয় না। সুতরাং ১৯৯০ সালের এ আইনকে সময় উপযোগী করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলশ্রুতিতে ১৯৯৬ সালে এ আইনের আরও কিছু সংশোধনী আনা হয়। এ আইন বলে বনজ সম্পদ সংরক্ষণের জন্য কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এসব বিধিনিষেধ লঙ্গনের জন্য শান্তির বিধান রয়েছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার বনবিধি বলে আরও যা করতে পারবেন তা হলো।
- সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে কোন বনভূমিতে সংরক্ষিত বন গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন।
- এ প্রজ্ঞাপন বলে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি বা অন্যকোনো দাবিদার প্রজ্ঞাপন প্রকাশের তারিখ হতে নূন্যতম তিনমাস এবং অনধিক চার মাসের বন কর্মকর্তার নিকট লিখিতভাবে নিজে হাজির হয়ে ক্ষতির বিস্তারিত উল্লেখ করে আবেদন করতে পারবেন।
- সরকার একইভাবে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট তারিখ হতে সংরক্ষিত কোনো বন বা তার অংশ বিশেষ সংরক্ষিত, রহিত এ মর্মে নির্দেশ প্রদান করতে পারবেন।
বনবিধির বর্ণনা-
চলুন আমরা এবার বন সংরক্ষণের প্রচলিত আইনের উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ জেনে নেই। এ বিধি বলে নিম্নলিখিত কাজসমূহ দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে।
- অনুমতি ব্যতীত আধাসরকারি বা স্থানীয় সরকারি জমি বা স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা বা কোনো ব্যক্তির নিজস্ব জমি বা বাগান হতে কাঠ বা অন্যান্য বনজ সম্পদ সংগ্রহ করে নিজ জেলার যে কোনো স্থানে প্রেরণ।
- যথাযথ কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে সরকারি বনাঞ্চলে প্রবেশ করা, বনভূমিতে ঘরবাড়ি ও চাষাবাদ করে বনাঞ্চলের ক্ষতিসাধন করা।
- বনে শিকার করা, গুলি করা, মাছ ধরা, জল বিষাক্ত করা অথবা বনে ফাঁদ পাতা।
- যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত সরকারি বনভূমি থেকে গাছপালা ও অন্যান্য বনজ সম্পদ আহরণ করা।
- প্রয়োজনীয় অনুমতি ব্যতীত বনের গাছ কাটা, অপসারণ ও পরিবহন করা।
- যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ব্যতীত অন্য সময়ে আগুন জ্বালানো, আগুন রাখা বা বহন করা।
- বনের কাঠ কাটার অথবা কাঠ অপসারণের সময় অসাবধানতাবশত বনের ক্ষতিসাধন করা, গাছ ছেটে ফেলা, ছিদ করা, বাকল তোলা, পাতা ছেড়া, পুড়িয়ে ফেলা অথবা অন্য কোনো প্রকারে বৃক্ষের ক্ষতিসাধন করা।
- বিভাগীয় বন কর্মকর্তার পূর্বানুমতি ব্যতীত কোনো সংরক্ষিত বনে আগ্নেয়াস্ত্রসহ প্রবেশ করা।
- বনাঞ্চলে গবাদিপশু চরানো।
- যথাযথ অনুমতি ব্যতীত বনের মধ্যে খাদ খোড়া, চন বা কাঠ কয়লা পোড়ানো অথবা কাঠ ব্যতীত অন্য কোনো বনজাত পণ্য সংগ্রহ করা অথবা শিল্পজাত দ্রব্য প্রক্রিয়াজাত করা, অপসারণ করা।
- বনজ দ্রব্যাদি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অপসারণ, পরিবহন ও হস্তান্তর করা।
- বন কর্মকর্তা অথবা বন রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত ব্যক্তির কাজে বাধা প্রদান করা।
বন আইন লঙ্ঘণের শাস্তির বিধান-
বন আইন লঙ্ঘণের বিভিন্ন ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে।
বন আইন ভঙ্গের জন্য নূন্যতম ছমাসের জেলসহ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেলসহ পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা বিধান রয়েছে।
বন আইন লঙ্ঘণের এসব অপরাধের বিচার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্টেট আদালতে হয়ে থাকে।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিধি-
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সনে একটি আইন প্রণয়ন করেন যা বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ), অধ্যাদেশ, ১৯৭৩ নামে অভিহিত। এ আইন বলে বিনা অনুমতিতে যে কোনো উপায়ে বনাঞ্চলে বন্যপ্রাণী শিকার বা হত্যা করা, বন্যপ্রাণী প্রজননে বিঘ্ন সৃষ্টি, জাতীয় উদ্যানের সীমানার একই মাইলের মধ্যে কোনো প্রাণী শিকার, বিদেশি প্রাণী আমদানি বা বিদেশে রপ্তানি করা প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ আইন লঙ্ঘণ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিধি লঙ্ঘণকারীকে আদালত ছয়মাসের জেলসহ পাঁচশত টাকা জরিমানা এবং সর্বোচ্চ দুই বৎসরের জেলসহ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন। এ আইন ভঙ্গকারীকে আর্থিক জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে মানুষের জীবন বাঁচাতে, ফসলের ক্ষতি রোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী শিকার বা হত্যা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়।
বন সংরক্ষণ বিধির প্রয়োজনীয়তা-
দেশের বিরাজমান বন সংরক্ষণ ও নতুন বন সৃষ্টি করে দেশের বনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা এখনকার সময়ের দাবি। কারণ বন পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। এ অধিক জনসংখ্যা মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য সীমিত বনজ সম্পদের উপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে। প্রাত্যহিক চাহিদা মেটানোর জন্য মানুষ বনের বৃক্ষরাজি ও বন্য প্রাণী উজাড় করছে।
বন ধ্বংস হওয়ার কারণে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, প্রজনন বিঘ্নিত হচ্ছে, খাদ্য সংকট হচ্ছে। অবৈধ শিকারীর কবলে পড়েও বন্য প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। বনে অবৈধ অনুপ্রবেশ বাড়ছে। বনজ সম্পদ চুরি ও পাচার করেও এক শ্রেণির অসাধু লোক বন ধ্বংস করছে। বনের নিকটবর্তী এলাকাবাসী ধীরে ধীরে বন দখল করছে। বন এলাকায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করছে। অসাধু চক্র পার্বত্য এলাকায় পাহাড় কেটে, কাঠ পাচার করে পাহাড়ি বন ধ্বংস করছে। এ ছাড়াও সামাজিক বনের বৃক্ষরাজি আত্মসাৎ করছে। এর ফলে ভূমিক্ষয়, ভূমিধসসহ নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। দেশ পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বনজসম্পদকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে বনসংরক্ষণ বিধি প্রণীত হয়েছে। বনবিধি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জনসংযোগ বাড়াতে হবে। বন সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিধি বাস্তবায়িত হলে অনেক সুফল পাওয়া যেতে পারে।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলেচনার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের বন কত প্রকার ও কি কি? বাংলাদেশের বন সংরক্ষণ বিধি সম্পর্কে জানতে পারলাম।
বন নানান ধরনের হতে পারে। প্রধানত একে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন-পাহাড়ি বন, সমতলভূমির বন, ম্যানগ্রোভ বন, সামাজিক বন, কৃষি বন। তবে প্রত্যেক প্রকার বনের প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও সরকার নিয়ন্ত্রিত দেশের বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রনাধীন অশ্রেণিভূক্ত বন রয়েছে।
বন ও বন্য প্রাণী রক্ষার ক্ষেত্রে আইনের বাস্তবায়নের ভূমিকা সর্বাধিক। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের ভূমিকা সমানভাবে অগ্রাধিকার। বন রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারিভাবে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি কাজ করতে হবে- বনদস্যুদের প্রতিহত করতে হবে। জনগণকে বনের গুরুত্ব বোঝাতে হবে। সামাজিক বন সৃষ্টিতে সবাইকে অংশ নিতে হবে।
[সূত্র: ওপেন স্কুল]