(১) বিটি বেগুন চেনার উপায় ও এটি চাষের সুবিধা
বিটি বেগুন হল ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী বেগুন, যা বংশাণু প্রকৌশলের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। সারা বিশ্বে বেগুন এগপ্লান্ট (eggplant) বা অবারজিন (aubergine) নামে পরিচিত।
ক) বিটি বেগুন চেনার উপায়
খ) বিটি বেগুনে চাষের সুবিধা
- বেগুনের প্রধান শত্রু ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ থেকে বেগুন ফসলকে রক্ষা করে।
- কীটনাশক ব্যবহার সীমিত হওয়ায় পরিবেশ ও কৃষকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অবদান রাখে।
- উৎপাদন খরচ কম এবং কাঙ্খিত উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি করে।
গ) বিটি বেগুনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
- বেগুন ফসলের সবচেয়ে বড় শত্রু, ক্ষতিকর ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা। শুধু এই পোকার আক্রমণে বেগুনের ফলন ৩০-৭০ শতাংশ কমে যেতে পারে। এ পোকার আক্রমণ থেকে বেগুন ফসল রক্ষা করতে বিজ্ঞানীরা জনপ্রিয় কিছু বেগুনের জাতের জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করেছেন, যার ফল স্বরূপ বিটি বেগুনের জাত সৃষ্টি।
- অনেকে মনে করেন ‘বায়োটেকনোলজি’ শব্দ থেকে বিটি বেগুনের নামকরণ করা হয় যা সঠিক নয়। বিটি হল Bacillus thuringensis (বেসিলাস থুরেনজেনসিস) এর সংক্ষিপ্ত নাম।
- বেসিলাস থুরেনজেনসিস মাটিতে বসবাসকারী এক ধরনের ব্যকটেরিয়া যা বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন করতে পারে। এই ব্যকটেরিয়া শুধু মাত্র ফল ডগা ছিদ্রকারি পোকার ক্ষতি সাধন করে। এটা মানুষ বা অন্য কোন প্রাণীর জন্যে ক্ষতিকর নয়।
- সাধারন জাত্যের বেগুন চাষে ফল ডগা ছিদ্রকারি পোকার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে মৌসুমে ৭০-১০০ বার কীটনাশক ব্যবহার করতে। বিটি বেগুন প্রাকৃতিক ভাবেই ফল ডগা ছিদ্রকারি পোকা প্রতিরোধ করতে পারে এতে আলাদা করে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়না তাই বিটি বেগুন পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারি।
- বাংলাদেশ সরকার ২০১৩-১৪ সালে ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন বিটি বেগুনের নামে চারটি জাত বাংলাদেশে সীমিত আকারে চাষাবাদের জন্য অবমুক্ত করেছেন। এরপর বাংলাদেশের কৃষক বিটি বেগুনকে সাদরে গ্রহণ করেছেন এবং বর্তমানে দেশটির ৬৪ জেলাযর কৃষণগণ বিটি বেগুন চাষ করছেন।
ঘ) বিটি বেগুন চাষে আবশ্যকরণীয় বিষয়
i) বিটি বেগুনের মাঝে প্রচলিত বেগুন গাছ লাগানো
- বেগুনের ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা যাতে বিটি প্রযুক্তি সহনীয় না হতে পারে সেজন্য বিটি বেগুনের জমিতে প্রচলিত জাতের বেগুন চারা উদ্বাস্ত ফসল (Refugee Crop) হিসাবে রোপণ করা অত্যন্ত জরুরী।
- এক্ষেত্রে মোট বিটি ফসলের ৫% উদ্বাস্ত ফসল রোপণ করা সমীচীন। অর্থাৎ ২০ শতক জমিতে প্রয়োজনীয় মোট ১০০০টি বেগুনের চারা রোপণ করলে কমবেশি ৯৫০টি হবে বিটি বেগুনের চারা এবং কমবেশি ৫০টি হবে প্রচলিত একই জাতের বেগুনের চারা। তবে একই জাতের প্রচলিত বেগুনের বীজ বা চারা পাওয়া না গেলে অন্য যে কোন প্রচলিত বেগুনের চারা ব্যবহার করা যেতে পারে।
- বারি বিটি বেগুন ফসলের চারপাশে একটি সারিতে প্রচলিত বেগুন জাতের ফসল অবশ্যই রোপণ করতে হবে।
ii) দুরত্ব বজায় রাখা
বিটি বেগুনের জমি অন্যান্য বেগুনের জমি থেকে অন্তত ৩০ মিটার বা ৩৩ গজ দুরত্ব বজায় রেখে চাষ করা আবশ্যক।
iii) পোকা দমন
মনে রাখতে হবে, বিটি বেগুন কেবলমাত্র ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী। বিটি বেগুন ফসলে অন্যান্য রসচুষে খাওয়া পোকা যেমন, সাদামাছি, এফিড, স্প্রিস, হপার, কাঁটালে পোকা ও মাকড় ইত্যাদির আক্রমণ হতে পারে। এসকল পোকা/মাকড় দমনের জন্য স্বাভাবিক নিয়মে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
(২) বিটি বেগুনের জাত পরিচিতি
বারি বিটি বেগুন-১ (উত্তরা), বারি বিটি বেগুন-২ (কাজলা), বারি বিটি বেগুন-৩ (নয়নতারা) ও বারি বিটি বেগুন-৪ নামের চারটি জাত কৃষক পর্যায়ে চাষের জন্য অবমুক্ত করা হয়েছে।
নিম্নে জাতসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া হলো-
ক) বারি বিটি বেগুন-১
- এটি ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী জাত এবং এ জাতটি অনাান্য জাতের তুলনায় আগাম ফলন দেয়।
- গাছ ছড়ানো ও ঝোপালো প্রকৃতির। .
- ফল লম্বাটে ও ১৮-২০ সেমি লম্বা হয়।
- গাছ প্রতি ফলের সংখাা ৫০-৫৫টি।
- প্রতি ফলের ওজন ৮০-৯০ গ্রাম।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ৫০-৫৫ টন।
খ) বারি বিটি বেগুন-২
- এটি ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী জাত এবং এ জাতটি অন্যান্য জাতের তুলনায় আগাম ফলন দেয়।
- ফলের আকার মাঝারি লম্বাকৃতি এবং রং চকচকে কালচে বেগুনী।
- গাছ প্রতি ফলের সংখাা ৪০-৪৫টি।
- প্রতি ফলের ওজন ১০০-১২০ গ্রাম।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ৫০-৫৫ টন।
গ) বারি বিটি বেগুন-৩
- এটি ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী জাত এবং জাতটির গাছ খাড়া আকৃতির।
- এ জাতটির ফল গোলাকার এবং রং উজ্জ্বল কালচে বেগুনী।
- গাছ প্রতি ফলের সংখ্যা ২৫-৩০টি।
- প্রতি ফলের ওজন ১৬০-১৮০ গ্রাম।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ৪৫-৫০ টন।
ঘ) বারি বিটি বেগুন-৪
- এটি ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী জাত।
- ফল ডিম্বাকৃতি এবং রং হালকা সবুজ।
- গাছ প্রতি ফলের সংখাা ২০-২৫টি।
- প্রতি ফলের ওজন ২২০-২৫০ গ্রাম।
- হেক্টরপ্রতি ফলন ৫০-৫৫ টন।
(৩) বিটি বেগুন (১,২,৩,৪) চাষ পদ্ধতি বর্ণনা
ক) জলবায়ু ও মাটি
- আমাদের বাংলাদেশের সব রকমের মাটিতে বেগুন চাষ করা যায় এবং ভাল ফলনও দিয়ে থাকে। তবে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। বেলে দোআঁশ বা দোআঁশ মাটিই এর চাষের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট।
- বেগুনের জন্য ১৫০ থেকে ২০০ সে. তাপমাত্রা সবচেয়ে উপযোগী। উচ্চ তাপমাত্রায় বেগুনের ফুল ও ফল উৎপাদন বিঘ্নিত হয় এবং এসময় অনিষ্টকারী পোকার আক্রমণ বেশি হয়।
খ) চারা উৎপাদন পদ্ধতি
- শীতকালীন চাষের জন্য শ্রাবণের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করা যায়।
- বেগুন চাষের জন্য চারা উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমাদের বাংলাদেশে চাষী ভাইয়েরা সাধারণত সরাসরি বীজতলায় বীজ বপন করেন। দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করেন না। এতে বীজের পরিমাণ বেশি লাগে উপরন্তু চারার স্বাস্থ্য ভাল হয় না।
- প্রথমে বীজতলায় ঘন করে বীজ ফেলতে হয়। বীজ গজানোর ১০-১২ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করতে হয়। এতে চারা সুস্থ ও সবল হয় এবং ফলন ভাল হয়।
- বীজতলায় মাটি সমপরিমাণ বালি, কমপোস্ট ও মাটি মিশিয়ে ঝুর ঝুর করে তৈরি করতে হয়। প্রতি হেক্টরের জন্য ২০০-২৫৫ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
গ) বীজ বপন
- বীজতলায় সারি করে বা ছিটিয়ে বীজ বপন করা যায়, তবে সারিতে বপন করা উত্তম।
- সারিতে বপনের জন্য প্রথমে নির্দিষ্ট দূরত্বে (৫ সেমি) কাঠি বা টাইন দিয়ে ক্ষুদ্র নালা তৈরি করে তাতে বীজ ফেলে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
- ছোট বীজের বেলায় বীজের দ্বিগুণ পরিমাণ শুকনো ও পরিষ্কার বালু বা মিহি মাটি বীজের সাথে ভালভাবে মিশিয়ে মাটিতে বীজ বপন করতে হয়।
- শুকনো মাটিতে বীজ বপন করে সেচ দেয়া উচিত নয়, এতে মাটিতে চটা বেঁধে চারা গজাতে ও বাতাস চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।
- যেসমস্ত বীজের আবরণ শক্ত, সহজে পানি প্রবেশ করে না, সেগুলোকে সাধারণত বোনার পূর্বে ভিজিয়ে নেয়া হয়।
ঘ) বীজতলায় আচ্ছাদন
- আবহাওয়া এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে বীজতলার উপরে আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে হবে যেন বৃষ্টির পানি ও অতিরিক্ত সূর্যতাপ থেকে বীজতলাকে রক্ষা করা যায়।
- আচ্ছাদন বিভিন্নভাবে করা যায়। তবে কম খরচে বাঁশের ফালি করে বীজতলায় প্রস্থ বরাবর ৫০ সেমি পর পর পুঁতে নৌকার ‘ছৈ’ এর আকারে বৃষ্টির সময় পলিথিন দিয়ে এবং প্রখর রোদে চাটাই দিয়ে রক্ষা করা যায়।
ঙ) চারার যত্ন
- চারা গজানোর পর থেকে ১০-১২ দিন পর্যন্ত হালকা ছায়া দ্বারা অতিরিক্ত সূর্যতাপ থেকে চারা রক্ষা করা প্রয়োজন।
- পানি সেচ একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচর্যা তবে বীজতলার মাটি দীর্ঘসময় বেশি ভেজা থাকলে অঙ্কুরিত চারা রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। চারার শিকড় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেলে রোদ কোন ক্ষতি করতে পারে না, তখন এটি বরং উপকারী।
- চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর বীজতলায় প্রয়োজন মতো দূরত্ব ও পরিমাণ মত চারা রেখে অতিরিক্ত চারাগুলি যত্ন সহকারে উঠিয়ে দ্বিতীয় বীজতলায় সারি করে রোপণ করলে মূল্যবান বীজের সাশ্রয় হবে।
চ) দ্বিতীয় বীজলায় চারা স্থানান্তরকরণ
জমিতে চারা লাগানোর পূর্বে মূল বীজতলা থেকে তুলে দ্বিতীয় বীজতলায় সবজি চারা রোপণের পদ্ধতি অনেক দেশেই চালু আছে। এ পদ্ধতিকে দ্বিতীয় সবজির চারা স্থানান্তরকরণ পদ্ধতি বলে।
দেখা গেছে, ১০-১২ দিনের চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তরিত করা হলে কপিগোত্রের সবজি ও টমেটো চারার শিকড়দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তরযোগ্য চারা বিস্তৃত ও শক্ত হয়, চারা অধিক সবল ও তেজী হয়।
- চারা উঠানোর আগে বীজতলায় পানি দিয়ে এরপর সূচালো কাঠি দিয়ে শিকড়সহ চারা উঠাতে হয়।
- উঠানো চারা সাথে সাথে দ্বিতীয় বীজতলায় লাগাতে হয়।
- বাঁশের সূচালো কাঠি বা কাঠের তৈরি সূচালো ফ্রেম দ্বারা সরু গর্ত করে চারা গাছ লাগানো হয়।
- চারা লাগানোর পর হালকা পানি দিতে হবে এবং বৃষ্টির পানি ও রোদ থেকে রক্ষার জন্য পলিথিন ও চাটাই দ্বারা ঢেকে দিতে হবে।
ছ) বীজতলায় চারার রোগ দমন
- বীজতলায় বপনকৃত বীজ গজানোর পূর্বে বীজ এবং পরে কচি চারা রোগাক্রান্ত হতে পারে। অঙ্কুরোদগমরত বীজ আক্রান্ত হলে তা থেকে আদৌ চারা গজায় না। গজানোর পর রোগের আক্রমণ হলে চারার কান্ড মাটি সংলগ্ন স্থানে পচে গিয়ে নেতিয়ে পড়ে। একটু বড় হওয়ার পর আক্রান্ত হলে চারা সাধারণত মরে না, কিন্তু এদের শিকড় দুর্বল হয়ে যায়। চারা এভাবে নষ্ট হওয়াকে বলে ড্যাম্পিং-অফ। বিভিন্ন ছত্রাক এর জন্য দায়ী।
- ড্যাম্পিং অফ রোগ বাংলাদেশে চারা উৎপাদনের এক বড় সমস্যা। বীজতলায় মাটি সব সময় ভেজা থাকলে এবং মাটিতে বাতাস চলাচলের ব্যাঘাত হলে এ রোগ বেশি হয়। এ জন্য বীজতলায় মাটি সুনিষ্কাশিত রাখা রোগ দমনের প্রধান উপায়।
- প্রতিষেধক হিসেবে মাটিতে কপার ‘অক্সিক্লোরাইড বা ডায়থেন এম-৪৫ বা রিডোমিল গোল্ড’ এক থেকে দুই গ্রাম প্রতিলিটার পানিতে মিশিয়ে বীজতলার মাটি ভালকরে ভিজিয়ে কয়েকদিন পর বীজ বপন করতে হবে। ‘প্রোভেক্স ২.৫ গ্রাম’ প্রতি কেজি বীজে মিশিয়ে বীজ বপন করবেন।
জ) চারার কষ্ট সহিষ্ণুতা বর্ধন
- রোপণের পর মাঠের প্রতিকূল পরিবেশ যেমন- ঠান্ডা আবহাওয়া বা উচ্চ তাপমাত্রা, পানির স্বল্পতা, শুষ্ক বাতাস এবং রোপণের ধকল ও রোপণকালীন সময়ে চারার সৃষ্ট ক্ষত ইত্যাদি যাতে সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারে সেজন্য বীজতলায় থাকাকালীন চারাকে কষ্ট সহিষ্ণু করে তোলা হয়।
- যে কোন উপায়ে চারার বৃদ্ধি সাময়িকভাবে কমিয়ে যেমন- বীজতলায় ক্রমান্বয়ে পানি সেচের পরিমাণ কমিয়ে বা দুই সেচের মাঝে সময়ের ব্যবধান বাড়িয়ে চারাকে কষ্ট সহিষ্ণু করে তোলা যায়।
- কষ্ট সহিষ্ণুতা বর্ধনকালে চারায় শ্বেতসার (কার্বোহাইড্রেট) জমা হয় এবং রোপণের পর এই শ্বেতসার দ্রুত নূতন শিকড় উৎপাদনে সহায়তা করে। ফলে সহজেই চারা রোপণজনিত আঘাত সয়ে উঠতে পারে।
ঝ) চারা উৎপাদনের বিকল্প পদ্ধতি
প্রতিকূল আবহাওয়ায় বীজতলায় চারা উৎপাদনের জন্য বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে সবজির চারা কাঠের বা প্লাস্টিকের ট্রে, পলিথিনের ব্যাগে, মাটির টবে, গামলায়, থালায়, কলার খোলে উৎপাদন করা যায়।
ঞ) বিটি বেগুন চাষকৃত জমির নকশা
বিটি বেগুন চাষ অন্য সাধারণ বেগুন চাষের ন্যায়। তবে বিটি বেগুন চাষের জমি চার পার্শ্বে ১-২ সারি সাধারণ বেগুনের চারা উদ্বাস্ত ফসল হিসেবে রোপণ করতে হয়।
নিম্নে প্রায় ১ বিঘা জমিতে বিটি বেগুন চাষের নমুনা নকশা দেয়া হলো:
বেডের আকার: | প্রস্থ = ৭০ সেমি। দৈর্ঘ্য = জমির দৈর্ঘের ওপর নির্ভর করবে। |
দূরত্ব: | ১০০ x ৮০ সেমি। |
নালার আকার: | প্রস্থ = ৩০ সেমি। গভীরতা = ২০ সেমি। |
ট) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি (কেজি/হেক্টর)
বেগুন এমন একটি ফসল সার প্রয়োগ ব্যতীত যার সন্তোষজনক উৎপাদন চিন্তা করা যায় না। মাটি থেকে ইহা প্রচুর পরিমাণ খাদ্যোপাদান শোষণ করে। বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে খাদ্যের অভাব হলে গাছ দ্রুত বাড়ে না এবং পরবর্তী পর্যায়ে খাদ্যের স্বল্পতা ফলনের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
তাই বেগুন চাষের জন্য ‘হেক্টরপ্রতি’ নিম্নোক্ত পরিমাণ সার ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়-
সার | পরিমাণ | শেষ চাষের সময় | গর্তে প্রয়োগ | চারা লাগানোর ১৫ দিন পর | ফুল ধরা আরম্ভ হলে | ফুল ধরা আরম্ভ হলে | ফল আহরণের সময় | ফল আহরণের সময় |
গোবর/কম্পোস্ট | ১০,০০০ কেজি | ৫,০০০ কেজি | ৫,০০০ কেজি | – | – | – | – | – |
ইউরিয়া | ৩০০ কেজি | – | – | ৬০ কেজি | ৬০ কেজি | ৬০ কেজি | ৬০ কেজি | ৬০ কেজি |
টিএসপি | ২৫০ কেজি | ১২৫ কেজি | ১২৫ কেজি | – | – | – | – | – |
এমওপি | ২০০ কেজি | – | ৫০ কেজি | ৪৫.০ কেজি | ৫২.৫ কেজি | ৫২.৫ কেজি | – | – |
জিপসাম | ১০০ কেজি | সব | – | – | – | – | – | – |
বোরিক এসিড (বোরন) | ১০ | সব | – | – | – | – | – | – |
- শেষ চাষের সময় অর্ধেক গোবর বা কম্পোস্ট, টিএসপি এবং সবটুকু জিপসাম ও বোরিক এসিড সার জমিতে সমানভাবে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
- বাকি অর্ধেক গোবর বা কম্পোস্ট, টিএসপি এবং ৩৫-৪২.৫ কেজি এমপি সার চারা লাগানার ৭দিন পূর্বে গর্তে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
- সম্পূর্ণ ইউরিয়া (৫টি কিস্তিতে) ও বাকি এমপি সার (প্রথম ৩টি কিস্তিতে) যথাক্রমে চারা লাগানো ১৫ দিন পর, ফুল ধরা আরম্ভ হলে, ফল ধরা আরম্ভ হলে, ফল আহরণের সময় ২ বার সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
ঠ) চারা রোপণ
- ৩০-৩৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করা উত্তম। এ সময় প্রতিটি চারার ৫-৬টি পাতা হয়ে থাকে। অনিবার্য কারণে বেগুনের চারা ২ মাস বয়স পর্যন্ত রোপণ করা চলে।
- রোপণের দূরত্ব নির্ভর করে জাত ও মাটির ঊর্বরতার ওপর। সাধারণত ৭০ সেমি প্রশস্ত বেডে এক সারিতে চারা রোপণ করা হয়। দুটি বেডের মাঝে ৩০ সেমি প্রশস্ত নালা থাকে।
- সারিতে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৭০-৮০ সেমি রাখতে হয়।
ড) সেচ ব্যবস্থা
- বেডের দু’পাশের নালা দিয়ে জমিতে সেচ দেয়া সুবিধাজনক।
- নালায় সেচের পানি বেশিক্ষণ ধরে রাখা যাবে না, গাছের গোড়া পর্যন্ত মাটি ভিজে গেলে নালার পানি ছেড়ে দিতে হবে।
- খরিফ মৌসুমে জমিতে পানি যাতে না জমে সেজন্য পানি নিষ্কাশনের জন্য জমির চারপাশে নালা রাখতে হবে।
ঢ) ফসল সংগ্রহ
চারা লাগানোর ৫০-৬০ দিন পরই বেগুন তোলার সময় হয়। ৭-১০ দিন পরপর গাছ থেকে ধারাল ছুরির সাহায্যে বেগুন কাটা ভাল। ফলন: ৩০-৭০ টন/হেক্টর।
(৪) বিটি বেগুন চাষে পোকা মাকড় ও রোগবালাই দমন ব্যবস্থাপনা
বিটি বেগুন ডগা ও ফল ছিদ্রকার পোকা প্রতিরোধী।
ক) পাতার হপার পোকা
ক্ষতির লক্ষণ:
- আক্রান্ত বেগুনের পাতা কিনারা বরাবর উপরের দিকে বেঁকে যায়।
- পাতার কিনারে হলুদাভ হয়ে যায় অথবা গুছে যাওয়ার মত মনে হয়।
- পাতার বৃদ্ধি ব্যাহত হয় বলে পাতা ছোট থেকে যায় এবং মোজাইক ধরনের হলুদ রং পরিলক্ষিত হয়।
- আক্রান্ত গাছে ফল ধরার সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে।
পোকার বিবরণ:
- পাতার হপার পোকা প্রকৃত পক্ষে সারা বছরই বংশ বৃদ্ধি করে থাকে তবে শুষ্ক মৌসুমে এদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
- এই পোকা পাতার নিচের দিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিম পাড়ে।
- প্রাপ্ত বয়স হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্ষুদ্র নিম্ফসমূহ পাতার নিচ দিক থেকে রস চুষে খায়
- এদের জীবনকাল ৫-৭ সপ্তাহ এবং একই মৌসুমে একাধিক প্রজন্ম হয়ে থাকে।
দমন ব্যবস্থাপনা:
- প্রতিরোধী জাত যেমন, বারি বেগুন-৬ বা বিএল ১১৪ চাষ করা।
- নিমতেল ৫ মিলি + ৫ গ্রাম ট্রিকস্ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নিচের দিকে স্প্রে করা।
- এককেজি আধা ভাঙ্গা নিমবীজ ২০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি পাতার নিচের দিকে স্প্রে করা।
- পাঁচ গ্রাম পরিমাণ গুঁড়া সাবান প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নিচের দিকে স্প্রে করা।
- আক্রমণের হার অত্যন্ত বেশি হলে ম্যালথিয়ন ৫৭ ইসি জাতীয় কীটনাশক (প্রতিলিটার পানিতে ২ মিলি পরিমাণ) স্প্রে করা অথবা এডমায়ার ১০০ এমএল (প্রতিলিটার পানিতে ০.২৫ মিলি পরিমাণ) মিশিয়ে স্প্রে করা।
খ) ইপিল্যাকনা বিটল
ক্ষতির লক্ষণ:
- এই পোকা পাতার শিরাগুলোর মাঝের অংশ খেয়ে ফেলে।
- মধ্য শিরা বাদে পাতার সমস্ত অংশ খেয়ে ঝাঝরা করে ফেলতে পারে এবং ফলের উপরি ভাগের কিছু অংশ খেয়ে ফেলতে পারে অথবা ছোট ছিদ্র করতে পারে।
পোকার বিবরণ:
- প্রাপ্ত বয়স্ক ও কীড়া প্রায়শই একই সাথে দেখা যায়। প্রাপ্ত বয়স্ক পোকা সাধারণ লেডি বিটল এর মত দেখা যায় কিন্তু লেডি বিটল পোকা গাছ বা গাছের পোকা খায় না।
- ইপিল্যাকনা বিটল ডিম্বাকার এবং পিঠে কাল ফোটাযুক্ত বাদামী রঙের।
- কীড়ার রং ফ্যাকাশে হলুদ এবং পিঠের উপরিভাগে ও পাশে শাখা প্রশাখাবিশিষ্ট ছোট ছোট কাঁটা দ্বারা আবৃত থাকে।
- প্রাপ্ত বয়স্ক স্ত্রী ইপিল্যাকনা বিটল বেশির ভাগ সময়ে পাতার নিচের দিকে সিগার আকৃতির হলুদ রঙের ডিম পারে। ডিম ফুটে কাটাযুক্ত হলুদ কীড়া বের হয়ে পাতার নিচের অংশ খাওয়া শুরু করে।
- ইপিল্যাকনা বিটলের কীড়া ৪টি ধাপ অতিক্রম করে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়, পূর্ণাঙ্গ কীড়া ৬ মিমি লম্বা হয়ে থাকে। কালচে রঙের পিউপাসমূহ পাতা অথবা কান্ডে থাকতে দেখা যায়।
- ইপিল্যাকনা বিটলের জীবনচক্র ১৫-২০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে থাকে এবং একই মৌসুমে কয়েক প্রজন্ম হয়ে থাকে।
দমন ব্যবস্থাপনা:
- পোকাসহ আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পোকা মেরে ফেলা।
- নিমতেল ৫ মিলি + ৫ গ্রাম ট্রিকস প্রতিলিটার পানিতে মিশিয়ে রেখে উক্ত পানি স্প্রে করা।
- এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিমবীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি স্প্রে করা।
- আক্রমণের হার অত্যন্ত বেশি হলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি জাতীয় কীটনাশক (প্রতিলিটার পানিতে ২ মিলি পরিমাণ) স্প্রে করা।
গ) লাল মাকড়
ক্ষতির লক্ষণ:
- লাল মাকড় আক্রান্ত বেগুনের পাতায় হলুদাভ ছোপ ছোপ দাগের সৃষ্টি হয়।
- যখন এই ধরনের আক্রমণ পাতার নিচের দিকে মাঝখানে বেশি হয তখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই পাতা কুঁকড়ে যেতে দেখা যায়।
- ব্যাপক আক্রমণের ফলে সম্পূর্ণ পাতা হলুদ ও বাদামী রং ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত পাতা ঝরে পড়ে।
পোকার বিবরণ:
- লাল মাকড় পাতার নিচের পৃষ্ঠদেশে অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিম পাড়ে যা খালি চোখে দেখা যায় না। এই ডিম থেকে কমলা রঙের বাচ্চা বের হয়ে পাতার নিচের পৃষ্ঠদেশে খেতে থাকে।
- এক সপ্তাহের মধ্যেই বাচ্চাগুলো গাঢ় কমলা বা লাল রঙের পূর্ণ মাকড়ে পরিণত হয় যা দেখতে ক্ষুদ্র মাকড়সার মত।
- এদের পাতার নিচের পৃষ্ঠদেশে চলাফেরা করতে দেখা যায়
দমন ব্যবস্থাপনা:
- নিমতেল ৫ মিলি + ৫ গ্রাম ট্রিকস্ প্রতিলিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নিচের দিকে স্প্রে করা।
- এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিমবীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি পাতার নিচের দিকে স্প্রে করা।
- আক্রমণ তীব্র হলে প্রতিলিটার পানির সাথে মাকড়নাশক (যেমন- ওমাইট ৫৭ তরল ১ মিলিলিটার হারে) পাতা ভিজিয়ে স্প্রে করে মাকড়ের আক্রমণ প্রতিহিত করা সম্ভব।
- মাকড়নাশক পাওয়া না গেলে সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক (কুমুলাক্স ইত্যাদি) স্প্রে করে মাকড়ের আক্রমণ কমানো সম্ভব। লক্ষ্য রাখতে হবে, মাকড়ের সাথে অন্য পোকার আক্রমণ দেখা দিলে প্রথমে মাকড়নাশক ব্যবহার করে অতঃপর কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
ঘ) কান্ড ও ফল পচা রোগ দমন ব্যবস্থাপনা
Phomopsis vexans নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়।
- সুস্থ ও রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করা।
- সেচ বা বৃষ্টির পর গাছের গোড়ার মাটি আলগা করা।
- প্রতিকেজি বীজে ২ গ্রাম ভিটাভেক্স ২০০ দিয়ে শোধন করা; ৫০০ সে. তাপমাত্রার গরম পানিতে ১৫ মিনিট রেখে বীজ শোধন করা।
- রোগ কান্ডে দেখা দিলে গাছের গোড়াসহ মাটি প্রতিলিটার পানিতে ২ গ্রাম পরিমাণ অটোস্টিন/নোইন গুলিয়ে ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
- বীজ বেগুনে রোগ দেখামাত্র ছত্রাকনাশক স্প্রে করা।
- রোগ হয় এরূপ জমিতে কমপক্ষে ৩ বছর শস্য পর্যায় অনুসরণ করা।
- ফসল সংগ্রহের পর মুড়ি গাছ না রেখে সমস্ত গাছ, ডালপালা, পাতা ইত্যাদি একত্র করে পুড়িয়ে ফেলা।
ঙ) ঢলেপড়া রোগ দমন ব্যবস্থাপনা
- আক্রান্ত গাছ দেখলেই প্রাথমিকভাবে তা তুলে ধ্বংস করা।
- রোগ প্রতিরোধী যেমন- বারি বেগুন-৮, বারি বেগুন-১০ প্রভৃতি জাতের চাষ করা।
- বন বেগুন যথা টরভাম বা সিসিম্ব্রিফলিয়ামের সাথে জোড় কলম করা।
- রোগ প্রতিরোধী বারি বেগুন-৮ জাতকেও রুট স্টক হিসেবে ব্যবহার করে জোড় কলম করা যায়।
চ) গুচ্ছপাতা রোগ দমন ব্যবস্থাপনা
- Phytoplasma দ্বারা এ রোগ হয়। আক্রান্ত গাছ দেখলেই প্রাথমিকভাবে তা তুলে ধবংস করা।
- ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করা।
- ক্ষেতে জ্যাসিড পোকার উপস্থিতি দেখা দিলে কীটনাশক প্রয়োগ করে তা দমন করা।
[সূত্র: বিএআরআই]