Skip to content

 

বীজ কী? ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য

বীজ কী, ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য

এখানে আমরা জানব বীজ কী, বীজ কত প্রকার ও ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব ও বীজ ব্যবস্থাপনা সমপর্কে। আপনি এর বিষয়ৈ জানতে আগ্রহী হলে শেষ অবধি পড়বেন তাহেল আশা করি ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য ও তার উৎপাদন প্রণালী সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা প্রাপ্ত হবেন।

চলু শুরু থেকে শুরু করা যাক-

(১) বীজ কী?

গাছের যে অংশ বা অঙ্গ বংশবিস্তারের জন্য তথা নতুন আরেকটি গাছ জন্মানোর কাজে ব্যবহার করা হয় তাই বীজ। যেমন- ধান গাছের ধান, আখ গাছের কাণ্ড, পাথরকুচির পাতা ইত্যাদি বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এমনিভাবে কোনো গাছের ফল, কোনো গাছের কাও, কোনো গাছের পাতা বা কোনো গাছের মূল বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

(২) বীজ কত প্রকার?

বীজকে বিভিন্নভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা যায়।

কৃষিকাজে ব্যবহৃত বীজ সাধারণভাবে নিম্নোক্ত দুইভাবে ভাগ করা যায়-

ক) উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজ (Botanical Seed): নিষিক্ত ও পরিপক্ক ডিম্বককে উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজ বলে, অর্থাৎ ফুলের স্ত্রী অঙ্গ ও পুরুষ অঙ্গের মিলনের ফলে এ বীজ উৎপাদিত হয়। যেমন- তৈল বীজ (সরিষা, তিল, তিসি), ডাল বীজ (মসুর, মুগ, মাষকালাই, খেসারি, ফেলন), দানা শস্য বীজ (ধান, গম, ভুট্টা, চিনা, কাউন, বার্লি) ইত্যাদি।

খ) কৃষি বীজ (Agricultural Seed): উদ্ভিদ বা গাছের যে কোনো অংশ বা অঙ্গ যেমন- ফল, বীজ, কাণ্ড, পাতা, শিকড় ইত্যাদি যা উপযুক্ত স্থানে অনুকুল আবহাওয়ায় বা পরিবেশে নতুন গাছের জন্ম দিতে সক্ষম তাই কৃষি বীজ। যেমন- ধান, গম, ভুট্টা, সরিষা, মুসুর, মুগ কাও (আখ, গোলআলু), পাতা (পাথরকুচি), শিকত্ব (মিষ্টি আলু, কাকরোল) ইত্যাদি।

(৩) ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ

ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত কৃষি উপকরণগুলো হলো- বীজ, সার, সেচ, বালাইনাশক ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে একমাত্র বীজই জীবন্ত উপকরণ এবং বীজই কৃষি উৎপাদনের চাবিকাঠি। বীজ ভালো না হলে অন্য সকল উপকরণ পরিমিতভাবে প্রদান করা হলেও কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যাবে না।

আমরা সাধারণভাবে উদ্ভিদতাত্ত্বিক বীজকে বীজ হিসেবে বুঝে থাকি। ভালো ফলন পেতে হলে অবশ্যই ভালো বীজ চিনতে হবে এবং কৃষি উৎপাদনে ভালো বীজ অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে।

ভালো বীজের বৈশিষ্ট্যাবলি নিম্নরূপ-

ক) জাতের বিশুদ্ধতা: বীজের জাত বিশুদ্ধতা বলতে বংশগত বিশুদ্ধতা (Genetical Purity) বোঝায়। অর্থাৎ বীজের এক জাতের সাথে অন্য জাতের মিশ্রণ থাকবে না। বীজের প্রত্যেক জাতের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে যা কেবল মাঠ পর্যায়ে ফসলের বিভিন্ন বৃদ্ধি পর্যায়ে পরিলক্ষিত হয়। মাঠ পর্যায়েই বীজের জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ দূরত্ব, রগিং ও অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। বীজ পরীক্ষাগারে বীজের জাত বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করা যায় না।

খ) বীজ বিশুদ্ধতা: বীজ বিশুদ্ধতা বলতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ধুলাবালিবিহীন, আগাছা বা অন্য ফসলের বীজমুক্ত এবং জড় পদার্থমুক্ত বীজকে বোঝায়। সব ফসলের বীজের বিশুদ্ধতার শতকরা হার সমান নয়। জাতীয় বীজ বোর্ড (NSB) এর বীজ মান অনুযায়ী বীজের প্রত্যায়িত শ্রেণির ধান, গম, পাট, বাদাম, মসুর, মাষকলাই বীজের বিশুদ্ধতা কমপক্ষে ৯৬%, সরিষা, ছোলা, মুগ বীজের ৯৭% থাকতে হবে।

গ) অঙ্কুরোদগম (গজানো) ক্ষমতা: বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বলতে অনুকূল পরিবেশে ১০০টি বপন করলে কতটি সুস্থ চারা জন্মায় তাকে বোঝায়। ভালো বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা অধিক হতে হবে। অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বেশি হলে মাঠে প্রয়োজনীয় সংখ্যক চারা পাওয়া যাবে। ফসলের প্রকার ভেদে প্রত্যায়িত বীজের অনুমোদিত অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা সাধারণত ৬০-৮০%। জাতীয় বীজ বোর্ড (NSB) এর বীজমান অনুযায়ী ধান, গম বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা সর্বনিম্ন ৮০%, গাজর, লালশাক, ডাঁটাশাক বীজের সর্বনিম্ন অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা ৬০%।

ঘ) বীজের আর্দ্রতা: বীজের মধ্যে শতকরা যে পরিমাণ পানি থাকে তাই বীজের আর্দ্রতা। বীজের আর্দ্রতা ওজনভিত্তিক শতকরা হারে প্রকাশ করা হয়। বীজের আর্দ্রতা যত বেশি হবে বীজের গজানো ক্ষমতা ও তেজ তত দ্রুত কমে যায়। বিভিন্ন বীজের অনুমোদিত আর্দ্রতা বিভিন্ন রকমের, সাধারণত প্রত্যায়িত বীজের সর্বোচ্চ অনুমোদিত আর্দ্রতা ৬-১২%। জাতীয় বীজ বোর্ড (NSB) এর বীজমান অনুযায়ী ধান ও গম বীজের সর্বোচ্চ আর্দ্রতা ১২%, বাঁধাকপি বীজের সর্বোচ্চ আর্দ্রতা ৭%, শালগম বীজের সর্বোচ্চ আর্দ্রতা ৬%।

ঙ) উজ্জ্বল রং: বীজের রং জাতের বৈশিষ্ট্যানুসারে স্বাভাবিক উজ্জ্বল থাকতে হবে। বীজ ফ্যাকাসে কিংবা ময়লাযুক্ত হতে পারবে না।

See also  বীজ কি/বীজ কাকে বলে? ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য এবং বীজ কত প্রকার? বীজের প্রকারভেদ

চ) রোগ ও পোকামাকড়মুক্ত: ভালো বীজ রোগ ও পোকামাকড়মুক্ত হতে হবে। অর্থাৎ বীজ পোকা কাটা হতে পারবে না, রোগাক্রান্ত হতে পারবে না। এক কথায় বীজ সুস্থ হতে হবে। বীজ পোকাক্রান্ত বা রোগাক্রান্ত হলে উক্ত বীজ থেকে চারা গজানোর নিশ্চয়তা থাকে না।

ছ) বীজের আকার: সব বীজের আকার সমান হয় না। সাধারণত বড় আকারের বীজ থেকে সুস্থ সবল চারা এবং ভালো ফসল পাওয়া যায়। একই আকারের বীজ থেকে মাঠে একই আকার ও আকৃতির (সাইজের) চারা পাওয়া যায়। বীজ একই আকারের হলে যান্ত্রিকভাবে বীজ বপন সহজ হয়।

জ) বীজের তেজ: যে বীজের তেজ (Vigour) যত বেশি উক্ত বীজ মাঠের প্রতিকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে সুস্থ চারা দিতে সক্ষম হয়। যে বীজের তেজ যত কম উক্ত বীজ তত তাড়াতাড়ি গজানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। বীজের তেজ চারা বৃদ্ধির দ্রুততা প্রকাশ পায়। নির্দিষ্ট সময়ে চারার দৈর্ঘ্য পরিমাণ করে বীজের তেল নির্ণয় করা যায়।

ঝ) বীজের সুপ্ততা: উপযুক্ত পরিবেশে কোনো জীবিত/সজীব বীজের অঙ্কুরোদগম না হওয়াকেই বীজের সুপ্ততা বলে। বীজ উৎপাদনের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সকল বীজেরই সুপ্ততা থাকা আবশ্যক। কিছু ফসলের বীজ পরিপক্ক হওয়ার পরপরই সুপ্ততা ভেঙে যায় এবং কিছু ফসলের বীজের সুপ্ততা নির্দিষ্ট সময়ের পরে ভঙ্গ হয়। বীজের সুপ্ততা প্রয়োজনে বিভিন্ন উপায়ে ভঙ্গ করা যায়। বীজ ভেদে তাপ প্রয়োগ করে, ভিজিয়ে অথবা বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করে বীজের সুপ্ততা ভঙ্গ করা যায়।

(৪) ভালো বীজের গুরুত্ব

ভালো বীজ যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ-

  • ভালো বীজ গজায় তাড়াতাড়ি।
  • ভালো বীজের চারা বাড়ে তাড়াতাড়ি
  • জমিতে পরিমিত সংখ্যক চারা জন্মায়
  • শিষ বড় হয়, নানা বড় হয় অথবা ফল বড় হয় ও ফলন বেশি হয়
  • ফসলের মান ভালো হয়
  • কৃষি উৎপাদন ব্যয় কম হয়।
  • কৃষক লাভবান হয়।

(৫) ভালো বীজের বৈশিষ্ট্য রক্ষায় ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুত প্রণালী

বীজ ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে পরবর্তী বপন মৌসুমে কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত সকল কর্মকাণ্ডই বীজ ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত।

বীজ ব্যবস্থাপনা প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত-

  1. বীজ উৎপাদন,
  2. বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ,
  3. বীজ বিপণন।

ক) বীজ উৎপাদন

ফসল উৎপাদন ও বীজ ফসল উৎপাদন এক নয়। বীজ উৎপাদন একটি সম্পূর্ণ কারিগরি প্রক্রিয়া। বীজ উৎপাদনের জন্য কিছু বিশেষ সতর্কতামূলক কর্মকাণ্ড অবশ্যই পালনীয় যা ফসল উৎপাদনের জন্য পালন না করলে ফসলের ফলনে কোনো প্রভাব পড়ে না। কিন্তু বীজ উৎপাদনে বিশেষ কারিগরি প্রক্রিয়াসমূহ পালন করা না হলে বীজের গুণগতমান অবশ্যই নিম্নমানের হবে। ফলে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি থেকে বীজের প্রত্যয়ন পাওয়া যাবে না। ফলে এ বীজ আর বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

বীজ ফসল উৎপাদনের প্রক্রিয়া বা ধাপসমূহ নিম্নরূপ-

i) জমি নির্বাচন: বীজ ফসলের চাহিদা মোতাবেক সবচেয়ে উর্বর, বন্যামুক্ত, সেচ ব্যবস্থাযুক্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো এমন জমি বীজ ফসলের জন্য নির্বাচন করতে হবে।

ii) বীজতলা তৈরি: অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বীজতলায় চারা উৎপাদন ও মাঠে চারা রোপণ করে বীজ ফসল উৎপাদন করা হয়। চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলাকে ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে।

iii) বীজ বপন: বীজতলার আকার অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিমাণ বীজ বীজতলায় সমদূরত্বে বপন করতে হবে। প্রয়োজন হলে বীজ বপনের পর বীজতলা ঢেকে দিতে হবে।

iv) জমি তৈরি: বীজ ফসল উৎপাদনের জন্য জমিকে ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে। জমি তৈরির সময় ফসলভিত্তিক অনুমোদিত পরিমাণ সার জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।

v) চারা রোপণ: ফসলভিত্তিক নির্দিষ্ট বয়সের চারা জমিতে নির্ধারিত দূরত্বে সারি করে লাগাতে হবে। চারা থেকে চারা এবং সারি সারির দূরত্ব যেন সমভাবে হয় তার দিকে বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে। এতে ফসল পরিচর্যার কাজ সহজ হয়।

vi) ফসল পরিচর্যা: ফসল মাঠে থাকা অবস্থায় সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠার জন্য যে সকল কাজ করা হয় তাই ফসল পরিচর্যার অন্তর্ভুক্ত। ফসল মাঠে থাকা অবস্থায় সাধারণত সেচ প্রয়োগ, সার প্রয়োগ, আগাছা দমন, রোগবালাই দমন ইত্যাদি কাজ করা হয়। তাছাড়া বিশেষ বিশেষ ফসলের জন্য গাছের সারিতে বা গাছের গোড়ায় মাটি ভুলে দেওয়া হয়।

vii) নিরাপদ দূরত্ব: বীজ ফসল উৎপাদনের জন্য অবশ্যই নিরাপদ দূরত্ব (Isolation Distance) বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ কোনো বীজ ফসল অন্য জাত থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বের পরেই কেবল উৎপাদন করা যাবে। ধান ও গম বীজের ৩ মিটার, আলু বীজের ক্ষেত্রে ১৫-৩০ মিটার এবং সরিষার ক্ষেত্রে ২০০-৫০০ মিটার নিরাপদ দূরত্ব (Isolation Distance) বজায় রাখা হয়।

See also  পিঁয়াজ ও সরিষার বীজ উৎপাদন পদ্ধতি

viii) রগিং: বীজ ফসলের মাঠের মধ্যে এমন কোনো গাছ যা অন্য সকল গাছের চেয়ে আলাদা বা রোগাক্রান্ত পরিলক্ষিত হলে তা তুলে ফেলে দেয়াই হলো রগিং। সাধারণত গাছের বিভিন্ন বৃদ্ধি পর্যায়েই ভালো বীজ উৎপাদনের জন্য রগিং করা হয়।

ix) সঠিক সময়ে ফসল কর্তন: ভালো বীজের জন্য অবশ্যই সময়মতো বীজ ফসল কর্তন করতে হবে। সাধারণত ৮০% ফসল পরিপক্ক ও পুষ্ট হলেই দ্রুততার সাথে কর্তন করতে হবে। বীজ ফসল কর্তনের সাথে সাথেই মাড়াই করতে হবে। সে জন্য প্রতিদিন যতটুকু ফসল মাড়াই করা যাবে ঠিক ততটুকু ফসল কর্তন করা হয়।

x) মাঠ পরিদর্শন: মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনের জন্য মাঠ পরিদর্শন অত্যাবশ্যক। সঠিক সময়ে সেচ, সার প্রয়োগ, বালাইনাশক প্রয়োগ, রগিং ও যথাসময়ে ফসল কর্তনের জন্য অবশ্যই গাছের বিভিন্ন বৃদ্ধি পর্যায়ে মাঠ পরিদর্শন করা বাঞ্ছনীয়।

খ) বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ

বীজ ফসল কর্তনের পর বীজের মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মাড়াই অঙ্গনে এবং গুলামে নিম্নোক্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়।

i) মাড়াইকরণ: কর্তনকৃত বীজ ফসলের বীজকে গাছের অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় অংশ থেকে আলাদা করাই হলো মাড়াই। বীজ ফসল কর্তনের পরপরই দ্রুততার সাথে মাড়াই করতে হবে। খাবার ফসলের ন্যায় বীজ ফসল কর্তনের পর গাদা বা পালা করে রাখা উচিত নয়। গাদা বা পালা করে বীজ ফসলকে রাখা হলে গাদার তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বীজের তেজ/জীবনীশক্তি দ্রুত কমে গিয়ে বীজ গজানো ক্ষমতা লোপ পাবে। বীজ ফসল গরু বা মহিষ দিয়ে মাড়াই করা যাবে না। এতে গরু বা মহিষের পায়ের চাপে বীজের ভ্রূণ নষ্ট হয়ে এর গজানো ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। সাধারণত বীজ ফসল হাত দিয়ে ড্রাম বা কাঠের তক্তার উপর বীজের আঁটি পিটিয়ে, প্যাডেল বা পাওয়ার ড্রেসারের অথবা কম্বাইন্ড হারভেস্টরের মাধ্যমে মাড়াই করতে হবে। বর্তমানে বীজ ফসল অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের মাড়াই যন্ত্র পাওয়া যায়।

ii) প্রাথমিক পরিষ্কারকরণ: বীজ মাড়াই করার পর বীজের সাথে খড়কুটা, চিটা, অপুষ্ট দানা, অন্যান্য জড়পদার্থ মাটির দানা, পাথরকণা ইত্যাদি থেকে যায়। এই সকল অপ্রয়োজনীয় পদার্থকে বীজ থেকে অপসারণকেই পরিষ্কারকরণ বোঝায়। এগুলো বীজের সাথে থাকলে বীজ শুকানোতে সমস্যা হয় এবং রোগ পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে যাবে। এ সকল অপ্রয়োজনীয় পদার্থ হাত দ্বারা, কুলা দ্বারা এবং বর্তমানে শক্তিচালিত বিভিন্ন ক্লিনার মেশিন দ্বারা সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করা যায়। বীজ ফসল অনুসারে বিভিন্ন প্রকারের প্রিক্লিনিং মেশিন বাজারে পাওয়া যায়।

iii) গ্রেডিংকরণ: এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বীজকে সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কারকরণ এবং বীজের আকার-আকৃতি অনুসারে বীজকে আলাদাকরণ করা হয়। সম বা একই আকারের (Uniform Size ) বীজের বাজারমূল্য তুলনামূলক বেশি। তাছাড়া একই আকারের বীজ যন্ত্র দ্বারা সহজে মাঠে বপন করা যায়। সাধারণত ক্লিনার-কাম-প্রোডার মেশিন দ্বারা বীজ গ্রেডিং করা হয়। বাজারে বিভিন্ন ধরনের ক্লিনার-কাম-গ্রেডার মেশিন পাওয়া যায়।

iv) শুকানো: বীজ মাড়াইয়ের পর বীজে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। বীজ ফসল ভেদে বীজে পানির পরিমাণ বিভিন্ন হয়ে থকে। ধান বীজের ক্ষেত্রে কর্তনের পর পর বীজ মাড়াই করলে আবহাওয়া ভেদে বীজে ১৬-২৩% আর্দ্রতা থাকে। বীজের এ অতিরিক্ত আর্দ্রতা বা পানি তাড়াতাড়ি শুকিয়ে না নিলে বীজের তেজ (Vigour) কমে যাবে বা বীজ মরে গিয়ে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে। সুতরাং বীজ মাড়াইয়ের পর পরই বীজ রোদে বা মেশিনের সাহায্যে শুকানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ফসলভিত্তিক বীজ শুকানোর আলাদা ধরনের ড্রাইং মেশিন রয়েছে।

v) বীজের গুণগত মান পরীক্ষণ: বীজ শুকানোর পর বীজ গুদামে লট আকারে রাখার আগে বীজের মান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। বীজের আর্দ্রতা, বিশুদ্ধতা ও অঙ্কুরোদগমক্ষমতা পরীক্ষা করে বীজের মান নিশ্চিত হয়ে বীজ গুদামজাত করতে হবে।

vi) সংরক্ষণ: বীজের গুণগতমান সন্তোষকজনক হলেই কেবল বীজ গুদামে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সংরক্ষণাগার ব্যবহার করা যায়। যেমন- সাধারণ গুদাম, ডিইিইমিডিফাইড গুদাম এবং কোল্ড স্টোরেজ। সাধারণত ধান, গম বীজের জন্য সাধারণ গুদাম, সবজি বীজের জন্য ডিইিইমিডিফাইড গুদাম এবং আলু বীজের জন্য কোল্ড স্টোরেজ ব্যবহার করা হয়। ধান, গম বীজও ডিহিইমিডিফাইড গুলামে সংরক্ষণ করা যায়। ডিহিইমিডিফাইড গুদাম ও কোল্ড স্টোরেজে বীজ সংরক্ষণ খরচ অনেক বেশি।

See also  বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতি

vii) বীজ লটকরণ: বীজ গুদামে বীজ একই গাদায় নির্দিষ্ট পরিমাণ বীজ বস্তায় ভর্তি করে লট আকারে সাজিয়ে রাখা হয়। বীজ ফসল অনুযায়ী বীজ লটের বীজের পরিমাণের ভিন্নতা রয়েছে। ধান ও গম বীজের ক্ষেত্রে বীজ লটের আকার হলো ৩০ মে. টন। প্রত্যেকটি বীজ লটকে নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করতে হবে। লটে কোন জাতের কী পরিমাণ বীজ রয়েছে, উৎপাদনকারী, উৎপাদন বর্ষ এবং বীজের গুণগত মান সম্পর্কিত তথ্যাদি সংবলিত লেবেলকার্ড লটে লগিয়ে দিতে হবে।

viii) পাক্ষিক পরীক্ষণ: বীজের মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য পাক্ষিকভাবে বীজের গুণগত মান বিশেষ করে বীজের আর্দ্রতা ও অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। বীজের আর্দ্রতা বেড়ে গেলে সাথে শুকানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে বীজের তেজ কমে গিয়ে দ্রুত অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা লোপ পাবে।

ix) পোকামাকড় দমন: প্রতিদিন কমপক্ষে একবার বীজ গুদামের প্রতিটি লট নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে কোনো লটে পোকা বা পাউডার জাতীয় কোনো কিছু আছে কিনা। দেখা গেলে প্রয়োজন অনুযায়ী স্প্রে বা ফিউমিগেশনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

x) চূড়ান্ত পরীক্ষণ: বীজ বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে বীজ প্যাকেট করার পূর্বে অবশ্যই গুণগত মান চূড়ান্তভাবে নিজের পরীক্ষাগারে এবং নিম্নমানুসারে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা করে নিতে হবে। পরীক্ষার ফলাফল সন্তোষজনক হলেই কেবল বীজ প্যাকেটজাত করতে হবে।

xi) বীজ প্যাকেটকরণ: বীজ প্যাকেট করার পূর্বে গুণগত মান নিশ্চিত হয়ে বীজ প্যাকেট করতে হবে। বীজে আর্দ্রতা বেশি থাকলে বীজ শুকিয়ে ঠাণ্ডা করে বীজ প্যাকেট করতে হবে। বীজে পোকামাকড় নেই তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বীজ প্যাকেটের পূর্বে ফিউমিগেশন করে নেওয়া ভালো। ফসলভিত্তিক বাজারের চাহিদা মোতাবেক বীজ প্যাকেটের সাইজ নির্ধারণ করতে হবে।

গ) বীজ বিপণন

বীজ বপন মৌসুমে বিক্রয়ের জন্য বিক্রয়কারীর নিকট বীজ প্রেরণ, বিক্রয়োত্তর সেবা/পরামর্শ প্রদান, বিক্রয়কারীর মতামত গ্রহণ এ সবই হলো বীজ বিপণন বা বীজ বাজারজাতকরণের অন্তর্ভুক্ত। কোনো পণ্য বাজারজাতকরণের আগেই ঐ পণ্যের গুণাবলি, মূল্য, বিক্রয়ের স্থান, বিক্রয়ের সময়, ভোক্তা, বাজারের বর্তমান চাহিদা, বিগত কয়েক বছরে বাজারে উক্ত পণ্য কী পরিমাণ বিক্রয় হয়েছে তা যথাযথভাবে বিচার বিশ্লেষণপূর্বক পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সময় স্থান, মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। সাধারণত প্রচারেই প্রসার। সুতরাং বীজ বিক্রয়ের জন্য অবশ্যই প্রচারের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে সকল ধরনের চাষি মৌসুমের আগেই তার প্রয়োজনীয় বীজের প্রাপ্যতা সম্পর্কে অবহিত হতে পারে।

বীজ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত সতর্কতা:

  1. বীজ ফসল উৎপাদনের সময় অবশ্যই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা।
  2. সময়মতো রগিং করা।
  3. সময়মতো বীজ কর্তন করা।
  4. অমসৃণ জায়গার বীজ মাড়াই, ক্লিনিং, গ্রেডিং না করা। এক জাতের বীজ মাড়াই করার পর মাড়াই স্থান এবং মাড়াই মেশিন, ক্লিনিং মেশিন, গ্রেডিং মেশিন ভালোভাবে (১০০%) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার পর অন্য জাতের বীজ মাড়াই করা।
  5. কোনো অবস্থায়ই অতিরিক্ত আর্দ্রতাসম্পন্ন বীজ (ধান বীজের ক্ষেত্রে ১৪% এর বেশি) প্রখর রোদে বা অধিক তাপে ড্রায়ারে না শুকানো। প্রয়োজনে ছায়াযুক্ত পরিবেশে শুকিয়ে বীজের আর্দ্রতা প্রথমে কমিয়ে নেওয়া।
  6. প্রখর রোদে পাকা মেঝের উপর বীজ না শুকানো।
  7. এক জাতের বীজ শুকানোর পর শুকানো স্থান এবং ড্রাইং চেম্বার বা মেশিন ভালোভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না করে অন্য জাতের বীজ না শুকানো।
  8. বীজ গুদাম, বীজ গুদামের চারপাশ সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। প্রয়োজনে মাঝে মাঝে আশেপাশে কীটনাশক স্প্রে করা। তাছাড়া বীজ গুদাম প্রতিবছর একবার রং করা।
  9. রুটিন অনুযায়ী প্রতিদিনই বীজ লট পরিদর্শন করা। অর্থাৎ প্রতিটি বীজ লট প্রতিদিনই নজরে রাখা।
  10. পাক্ষিকভাবে বীজ পরীক্ষণ কার্যসমূহ সম্পাদন করা। পরীক্ষণ ফলাফল বীজ লটসহ সংশ্লিষ্ট রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা।
  11. বীজের গুণগত মান নিশ্চিত হয়ে সরবরাহের জন্য বীজ প্যাকেট করা। কোনো অবস্থায়ই বেশি আর্দ্রতাযুক্ত বীজ, পোকাযুক্ত বীজ প্যাকেট না করা। প্রয়োজনে বীজ প্যাকেটের পূর্বে একবার বীজ ফিউমিগেশন করা।
  12. প্রতিটি বীজ প্যাকেট সঠিকভাবে ওজন করা।
  13. এক জাতের বীজ প্যাকিং শেষ হওয়ার পর অন্য জাতের প্যাকিং করার পূর্বে অবশ্যই বীজ প্যাকিং স্থান, প্যাকিং মেশিন ভালোভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নেওয়া।
  14. বীজ সরবরাহকারী ট্রাক ত্রিপল দিয়ে ঢেকে নেওয়া এবং প্রাপক অনুযায়ী ট্রাকে পরিচালন সরবরাহ করা।

[সূত্র: এনসিটিবি]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts

You cannot copy content of this page