বেগুন সারা বছর পাওয়া যায়। সবজির মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদনের দিক থেকে বেগুনের স্থান উল্লেখযোগ্য। তবে শীত মৌসুমে এর ফলন বেশি হয়।
এই আর্টিকেলটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- বিভিন্ন বেগুনের জাত তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগত পাবেন। বেগুন চাষের উপযুক্ত সময় জানতে পারবেন। বেগুন চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি শিখতে পারবেন। বেগুন গাছের পরিচর্যা করতে পারেবন। সর্বপরি বেগুন চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা ও জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন।
নিম্নে সুন্দর ও সহজভাবে ‘বেগুন চাষ পদ্ধতি’ এর বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো-
(১) বেগুনের জাত
ভাল ফলন পেতে হলে উপযুক্ত জাত নির্বাচন করা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশে বেগুনের বহু জাত রয়েছে। এক জাত থেকে অন্যজাতে গাছের প্রকৃতি, ফলের রং, আকার, আকৃতি প্রভৃতি বিষয়ে বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশে প্রধানতঃ লম্বা ফল, গোলাকর ফল ও গোলাকার এই তিন ধরণের বেগুনের চাষ বেশী হয়ে থাকে।
সব জাতকে মৌসুম ভিত্তিক দুই ভাবে ভাগ করা যেতে পারে, যেমন-শীতকালীন বেগুন ও বারমাসী বেগুন।
শীতকালীন জাতের বেগুন রবি মৌসুমে চাষ করা হয় কারণ, এই জাতের বেগুন কেবলমাত্র রবি মৌসুমেই ফল দিতে পারে। আর বারমাসী বেগুন বছরের যে কোন সময় চাষ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইঅজও) কর্তৃক কিছু জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। সেগুলো হলো: বারি বেগুন-১ (উত্তরা), বারি বেগুন-২ (তারাপুরী), বারি বেগুন-৪ (কাজলা), বারি বেগুন-৫ (নয়নতারা), বারি বেগুন-৬, বারি বেগুন-৭, বারি বেগুন-৮, বারি বেগুন-৯, বারি বেগুন-১০। এছাড়াও খটখটিয়া, ইসলামপুরী, মুক্তকেশী, চিত্রা, পুরাক্রান্তি, শিংনাথ ইত্যাদি।
নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জাতের পরিচিতি দেয়া হল-
- বেগুনের জাত ‘ইসলামপুরী’: এটি শীতকালীন জাত। এ জাতের গাছে ও ফলে কাঁটা নেই। গাছের উচ্চতা মাঝারি ধরনের ও শাখা প্রশাখাযুক্ত। পাতার রং বেগুনী সবুজ। ফল গোলাকার, কচি অবস্থায় গাঢ় বেগুনী, পরিপক্ক অবস্থায় সবুজাভ বেগুনী। তবে কোন কোন সময় ত্বকে সবুজ বর্ণের ছোপ থাকতে পারে। ফলের শাঁস মোলায়েম ও সুস্বাদু, বীজের সংখ্যা কম। প্রতিটি ফলের ওজন ২০০-৪০০ গ্রাম। গড়ন ফলন ৩৬ টন/হেক্টর। গাছ প্রতি গড় ফল ধরার সংখ্যা ১৩টি।
- বেগুনের জাত ‘খটখটিয়া’: শীতকালে চাষ উপযোগী জাত। গাছ উচ্চতায় ও বিস্তৃতিতে মাঝারি, পাতা মাঝারী চওড়া। ফল দন্ডাকার ও কালচে বেগুনী। ফল লম্বায় ১৬-২০ সেমি. ও বেড়ে ৩.৫০-৫.৫০ সেমি.। প্রতিটি ফলের ওজন ১০০-১২৫ গ্রাম। গড় ফলন ২৯ টন/হেক্টর।
- বেগুনের জাত ‘লাফফা’: শীতকালীন জাত ফলের রং বেগুনী এবং গোলাকার। ফলের উপরিভাগ সামান্য খাদালো। ময়মনসিংহের গফরগাঁও এলাকার একটি জনপ্রিয় জাত।
- বেগুনের জাত ‘ঈশ্বরদি-১’: প্রধানতঃ শীতকালীন জাত। তবে অন্যান্য সময়ও চাষ করলে কিছু ফলন পাওয়া যায়। গাছ কাটাময়, পাতা খাটো ও চওড়া ধরনের। ফল বড়, গোলাকার এবং রং সবুজ ও তার উপর হালকা ডোরা। ফলে বীজ খুব ও খুব সুস্বাদু নয়। এ জাতে পোকা মাকড়ের উপদ্রব খুব কম। প্রতিটি ফলের ওজন ১৫০-২৫০ গ্রাম।
- বেগুনের জাত ‘উত্তরা’ (বারি বেগুন ১): বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি উন্নত জাত। শীতকাল এ বেগুন চাষের উপযুক্ত সময়। গাছের পাতা ও কাণ্ড হালকা বেগুনী এবং পাতার শিরাগুলো গাঢ় বেগুনী হয়। পাতার নীচের দিকে সামান্য নরম কাটা দেখা যায়। গাছ খাটো আকৃতির ও ছড়ানো হয়ে থাকে। প্রতি গুচেছ ৫-৬টি ফল ধরে। ফলের রং বেগুনী এবং ১৮-২০ সেমি. লম্বা। ফলের ত্বক খুব পাতলা, শাঁস মোলায়েম এবং খেতে সুস্বাদু। হেক্টর প্রতি গড়ে ৬৪ টন ফলন পাওয়া যায়। এ জাতটি ‘ঢলে পড়া’ নামক রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। গাছ প্রতি গড়ে ১৯৫টি ফল ধরে।
- বেগুনের জাত ‘তাল বেগুন’ বা ‘তল্লা বেগুন’:– গাছ উচ্চ, বিস্তৃতিতে কম, শাখা ও পাতার সংখ্যা কম। পাতা বড় ও চওড়া। ফল গোলাকার ও চ্যাপ্টাকৃতি। ফলের বেড় দৈর্ঘ্য অপেক্ষা বেশী। ফলের শাঁস মোলায়েম ও সুস্বাদু, বীজের সংখ্যা মধ্যম। প্রতিটি ফলের ওজন ২০০-৪০০ গ্রাম।
- বেগুনের জাত ‘নয়ন কাজল’: এটি প্রধানত শীতকালীন জাত। গাছের উচ্চতা মাঝারী ধরনের ও শাখা প্রশাখা যুক্ত। ফল বেলুনাকৃতি, লম্বা ২০ সেমি. পর্যন্ত হতে পারে, ফলের রং হালকা সবুজ, বোঁটার কাছে হালকা বেগুনী। চোখের কাজলের মত আচড় আছে। সম্ভবতঃ এ কারণে জাতটির নাম নয়ন কাজল। একটি অধিক ফলনশীল জাত, ফলে বীজের পরিমাণ কম, শাঁস মোলায়েম এবং খেতে সুস্বাদু। প্রতি ফলের ওজন ৩০০-৬০০ গ্রাম।
- বেগুনের জাত ‘কেজি বেগুন’: শীতকালীন জাত। গাছের উচ্চতা মাঝারি, পাতা চওড়া, ঢেউ খেলানো ফল বোঁটার দিক থেকে ক্রমান্বয়ে মোটা, অনেকটা লাউয়ের মত দেখতে হয়। ফলের রং হালকা সবুজ এবং গায়ে লম্বালম্বি হালকা আচড় আছে। বীজ অত্যন্ত কম, শাঁসালো, নরম এবং অত্যন্ত সুস্বাদু। বেগুন ভাজা, বেগুনী, চপ ইত্যাদি তৈরিতে এর জুড়ি নেই। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে প্রতিটি ফলের ওজন গড়ে ১ কেজি পর্যন্ত পাওয়া যায়। এ কারণে এ জাতটি এখন খুব জনপ্রিয় নয়।
- বেগুনের জাত ‘শিংনাথ’: একটি বারমাসী জাত। গাছ বেশ উঁচু, পাশেও অধিক, শাখা প্রশাখার সংখ্যা প্রচুর। পাতা সরু ধরনের। এর ফল সরু, লম্বায় প্রায় ৩০ সেমি. ও বেগুনী রংয়ের। বেগুনের মধ্যে বীজ মাঝারি সংখ্যক, খেতে সুস্বাদু। এই জাতের বেগুনের মধ্যে কতকগুলি উপজাত আছে, যেগুলি ফলের আকার, আকৃতি, বর্ণের দিক থেকে পরষ্পর থেকে ভিন্ন। প্রতিটি ফলের ওজন ৭৫-১৫০ গ্রাম। প্রতিটি গাছে গড়ে ৩৯ টি বেগুন ধরে এবং গড় ফলন ৩০ টন/হেক্টর।
- বেগুনের জাত ‘ঝুমকো’: গাছ খাটো, খুবই ফলনশীল জাত। ফল খাটো, সরু ও ৮-১০ সেমি. লম্বা। বেগুন গাছের গুচ্ছভাবে উৎপন্ন হয়। ফলের ত্বক খুব পাতলা ও শাঁস মোলায়েম। ডগা ও ফলের মাজরা পোকার আক্রমণ কম হয়।
- বেগুনের জাত ‘ডিম বেগুন’: একটি উচ্চ ফলনশীল বারমাসী জাত। এ জাতে পোকার উপদ্রব খুব কম হয়। ফল ধবধবে সাদা, আকৃতিতে প্রায় ডিমের মত। প্রতিটি ফলের ওজন ৪০-৬০ গ্রাম।
- বেগুনের জাত ‘মুক্তকেশী’: এটি বারমাসী জাত, আগষ্ট (মধ্য শ্রাবণ-মধ্য ভাদ্র) মাস থেকে বেগুন বাজারে বিক্রয়ের জন্য উঠানো যায়। গাছ মাঝারী আকৃতির, ফল উপবৃত্তাকার ও চকচকে বেগুনী। প্রতিটি বেগুনের ওজন ১৫০-২৫০ গ্রাম।
- বেগুনের জাত ‘শুকতারা’: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি হাইব্রিড জাত। সুফলা ও উত্তরা জাতের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ফল বেগুনী, গড়ে ১৯ সেমি. লম্বা ও বেড় ৪ সেমি.। উচ্চফলনশীল, প্রতিটি ফলের ওজন গড়ে ৬০ গ্রাম। প্রতি হেক্টরে গড়ে ৮০ টন ফলন পাওয়া যায়। সংকর জাতের কারণে এ জাতটি ঢলেপড়া নামক রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। কৃষকদের জমিতে উৎপন্ন বীজ থেকে বীজ সংগ্রহ করে পরবর্তী বছর বেগুন চাষ করা যাবে না। প্রতি বছরই বীজ নতুন করে সংগ্রহ করতে হবে।
- বেগুনের জাত ‘তারাপুরী’ (বারি বেগুন ২): বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাত। ইসলামপুরী ও উত্তরা জাতের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে উদ্ভাবিত, শ্রাবণ-ভাদ্র মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ফল গাঢ় বেগুনী, প্রায় ১৬ সেমি. লম্বা ও বেড় ৬ সেমি.। উচ্চফলনশীল, প্রতিটি ফলের ওজন গড়ে ৯০ গ্রাম, হেক্টর প্রতি গড় ফলন ৮০ টন। এ জাতটি ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। উৎপাদনের জন্য প্রতি বছর নতুন করে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
- বেগুনের জাত ‘কাজলা’ (বারি বেগুন ৪): এটি একটি হাইব্রিড জাত। এ জাতের ফলের আকার লম্বা, রং কালচে বেগুনি, চকচকে। গাছ মাঝারি আকৃতির ছড়ানো। গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ৭০-৮০টি, প্রতিটি ফলের ওজন ৫৫-৬০ গ্রাম। জাতটি ঢলে পড়া রোগ সহনশীল। বীজ লাগানোর ৯০-৯৫ দিন পর ফল ধরে এবং ১৯০ দিন পর্যন্ত ফল ধরে। হেক্টর প্রতি ফলন ৫৫-৬০ টন।
- বেগুনের জাত ‘নয়নতারা’ (বারি বেগুন ৫): এ জাতের ফলের আকার গোল, রং লালচে বেগুনি। গাছ খাড়া আকৃতির। গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ২৫-৩০টি, প্রতিটি ফলের ওজন ১২০-১৩০ গ্রাম। আগাম ফলন দেয়। জাতটি ঢলে পড়া রোগ ও বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ কিছুটা প্রতিরোধ করতে পারে। বীজ লাগানোর ৮০-৮৫ দিন পর ফল ধরে। হেক্টর প্রতি ফলন ৪৫-৫০ টন।
- বেগুনের জাত ‘বিজয়’: একটি হাইব্রিড জাত, সারা বৎসর চাষ করা যায়। গাছ ডালপালা বিশিষ্ট, সব শাখা প্রশাখায় বেগুন ধরে। ফল উপ গোলাকার, বেলুন আকৃতি, আকর্ষণীয় কালচে বেগুনী রং, বোঁটা সবুজ। ফলের ছাল পাতলা, খেতে সুস্বাদু। প্রচুর ফলন পাওয়া যায়। প্রতিটি বেগুনের গড় ওজন ১৭০ গ্রাম। চারা রোপণের ৪৫-৫০ দিন পর থেকে বেগুন সংগ্রহ করা যায়। অনেক দিন যাবত ফলতে থাকে। চাষের জন্য প্রতি বছর নতুন বীজ সংগ্রহ করতে হয়।
- বেগুনের জাত ‘চমক এফ-১’: এটি একটি হাইব্রিড জাত। আষাঢ় থেকে পৌষ মাসের মধ্যে চারা রোপণ করতে হয়। চারা রোপণের ৫৫-৬০ দিন পর ফল ধরে। গাছ ও পাতা বড়, অনেক ডালপালা, বেগুন লম্বায় প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার। পুতি গাছে ১৫-২০ কেজি ফল ধরে।
- বেগুনের জাত ‘কাজল এফ১’: বেগুন গোল, রং কালো, প্রতিটি বেগুনের ওজন ৩০০-৪০০ গ্রাম, গাছ বড় ও ঝোপালো।
(২) বেগুন চাষের উপযোগী মাটি
হালকা বেলে থেকে ভারী এটেল মাটি অর্থাৎ প্রায় সব ধরনের মাটিতেই বেগুনের চাষ করা হয়।
হালকা বেলে মাটি আগাম জাতের বেগুন চাষের জন্য উপযোগী। এই ধরণের মাটিতে বেগুন চাষ করতে হলে প্রচুর পরিমাণ জৈবসারসহ অন্যান্য সার ঘন ঘন প্রয়োগ করতে হবে।
বেগুন কোন মাটিতে ভালো হয়: দোআঁশ, বেলে দোআঁশ, এঁটেল দোআঁশ ও পলি দোআঁশ মাটি বেগুন চাষের জন্য উপযোগী এবং এই মাটিতে বেগুনের ফলন বেশী হয়।
বেগুন চাষের জন্য নির্বাচিত মাটি গভীর, উর্বর ও সুনিষ্কাশিত হওয়া প্রয়োজন।
(৩) বেগুন চাষের উপযুক্ত সময়
বেগুন উঞ্চ জলবায়ুর ফসল হলেও ফল ধারণের উপযুক্ত ১৫-২০ ডিগ্রি সেঃ। বাংলদেশে শীত মৌসুমে এর ফলন ভালো হয়।
বাংলাদেশের জলবায়ুতে বছরের যে কোন সময়ই বেগুনের চাষ করা যেতে পারে। তবে রবি মৌসুমে বেগুন চাষ করলে ফলন খরিপ মৌসুমের চেয়ে পাওয়া যায়।
বেগুন চাষের উপযুক্ত সময়: রবি মৌসুম অর্থাৎ শীতকালের জন্য সাধারণতঃ আগষ্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বীজ বোনার উপযুক্ত সময়। খরিপ মৌসুম অর্থাৎ বর্ষাকালীন বেগুনের জন্য জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বীজ বোনার উপযুক্ত সময়।
রবি মৌসুমে চাষের জন্য যে কোন জাতের বেগুন লাগানো যেতে পারে, কিন্তু খরিপ মৌসুমে চাষের জন্য বারমাসী জাতসমূহ লাগাতে হবে।
(৪) বেগুনের বীজ হার, বপন, বীজ থেকে চারা তৈরি
বেগুনের চারা উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শীতকালীন বেগুন চাষের জন্য জুলাই মাসের মাঝামাঝি হতে সেপ্টেম্বর মাস এবং বর্ষাকালীন বেগুন চাষের জন্য ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত বীজ বপন করা হয়।
- বেগুনের বীজ বপন: বীজতলা সমপরিমাণ বালি, কম্পোষ্ট ও মাটি মিশিয়ে ঝুর ঝুরে করে তৈরি করতে হয়। গ্রীষ্মকালীন বেগুন চাষের জন্য মার্চ-এপ্রিল মাসে বীজ বপন করা যায়।
- বেগুনের বীজতলা তৈরি: বেগুন চাষের জন্য প্রথমে বীজতলায় চারা করে তা মূল জমিতে রোপণ করতে হয়।
- বীজতলা এমন স্থানে তৈরী করতে হবে যেখানে বৃষ্টির পানি দাঁড়াবে না অর্থাৎ সুনিষ্কাশিত হতে হবে, সর্বদা আলো-বাতাস পায় অর্থাৎ ছায়ামুক্ত হতে হবে।
- বীজতলা তৈরির জন্য মাটি গভীরভাবে (অন্তত ২০ সেন্টিমিটার) চাষ দিতে হবে।
- বীজতলায় মাটি হতে হবে উর্বর। উর্বরতা কম থাকলে জৈব সার ও সামান্য পরিমাণ ফসফেট জাতীয় সার ব্যবহার করা যেতে পারে।
- প্রতি বর্গ মিটার বীজতলার জন্য ০.১০ ঘন মিটার পচা গোবর সার ও ৩০ গ্রাম টিএসপি সার ব্যবহার করা যেতে পারে।
- চাষের পর সম্পূর্ণ জমিকে কয়েকটি ছোট ছোট বীজতলাতে ভাগ করে নিতে হবে। প্রতিটি বীজতলা দৈর্ঘ্যে ৩-৫ ঘন মিটার, প্রস্থে এক মিটার ও পাশ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার ফাঁকা জায়গা রাখা উচিত।
- পাশাপাশি দুটো বীজতলার মধ্যে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার ফাঁকা জায়গা রাখা উচিত। এ ফাঁকা জায়গা থেকে মাটি নিয়ে বীজতলা উঁচু করে নিতে হবে।
- অল্প সংখ্যক চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলা হিসেবে কাঠের বাক্স, প্লাস্টিকের ট্রে অথবা বড় টব ব্যবহার করা যেতে পারে।
- বেগুনের বীজ হার: প্রতি হেক্টর (প্রায় ২৪৭ শতক) জমিতে বেগুন চাষের জন্য ২৫০-৩০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
- ৩ মিটার x ১মিটার পরিমাপের বীজ তলার জন্য ১৪-১৬ গ্রাম বীজ লাগে। তাহলে ২৫০-৩০০ গ্রাম বীজের জন্য উল্লেখিত মাপের ১৬-২০ টি বীজতলার প্রয়োজন হবে।
- ১ গ্রাম বেগুন বীজে প্রায় ২০০-২৫০ টি বীজ থাকে এবং শতকরা ৭৫-৮০টি বীজ অঙ্কুরিত হয়।
- বেগুনের বীজ থেকে চারা তৈরি: বীজতলাতে বীজ ছিটিয়ে বা সারি করে বোনা যেতে পারে। সারিতে বুনলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫ সেমি. দিতে হবে।
- বীজ বোনার পর বীজতলার মাটি হালকা করে চেপে দিতে হবে।
- বীজতলাতে চারার দূরত্ব ২-৩ সেমি. হলে চারার বৃদ্ধি ভাল হয়।
- বীজ বোনার পর ঝাঝরি দিয়ে হালকা ভাবে পানি ছিটিয়ে সেচ দেওয়া দরকার। প্রয়োজন হলে, শুকনা খড় বা পলিথিন শীট বা বস্তা দিয়ে বীজতলা ঢেকে দেওয়া যেতে পারে।
- গ্রীষ্মকালে সকালে ও সন্ধ্যায় হালকাভাবে সেচ দেওয়া প্রয়োজন। চারা গজানোর পর ২-৩ দিন অন্তর হালকা সেচ দেওয়া উচিত।
(৫) বেগুন চাষের জমি তৈরি
জমিতে ৪-৫টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুর ঝুরে করে করতে হয়। ভালো ফসল পেতে হলে জমি গভীর ভাবে চাষ করতে হবে।
(৬) বেগুন চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি
বেগুন মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উপাদান শোষণ করে। এজন্য বেগুনের সন্তোষজনক উৎপাদন সার ব্যতীত সম্ভব নয়। সারের পরিমাণ মাটির উর্বরতা শক্তির উপর নির্ভর করে। বেগুন চাষের জন্য হেক্টর প্রতি নিম্ন লিখিত পরিমাণে সার সুপারিশ করা যেতে পারে। জমিতে রস না থাকলে সার প্রয়োগের পর পরই সেচ দিতে হবে।
সারের নাম | হেক্টর প্রতি | শতক প্রতি | একক প্রতি |
ইউরিয়া | ৩৭০-৩৮০ কেজি | ১ কেজি | ১ মন ৩ সের |
টিএসপি | ১৪৫-১৫৫ কেজি | ৫০০ গ্রাম | ১ মন ৩ সের |
এমওপি | ২৪০-২৬০ কেজি | ৫০০ গ্রাম | ২ মন ৬ সের |
গোবর | ৮-১২ টন | ৪০ কেজি | ১০০-১৫০ মন |
ইউরিয়া ছাড়া সব সার জমির শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হয়। তবে গোবর জমি তৈরি প্রথম দিকে প্রয়োগ করা উত্তম। ইউরিয়া সার চারা গজানোর ৮-১০ দিন পর থেকে ১০-১২ দিন পরপর ২-৩ কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
(৭) বেগুনের চারা রোপণ পদ্ধতি বা লাগানোর নিয়ম
- বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর চারা রোপনের উপযোগী হয়। এ সময় চারাতে ৫-৬টি পাতা গজায় এবং চারা প্রায় ১৫ সেমি. লম্বা হয়।
- বেগুনের চারার বয়স একটু বেশী হলেও লাগানো যেতে পারে। প্রয়োজনে দু’মাস পর্যন্ত চারা বীজতলার রেখে দেওয়া যায়।
- চারা তোলার সময় যাতে শিকড় নষ্ট না হয সেজন্য চারা তোলার ১-২ ঘন্টা আগে বীজতলায় পানি দিয়ে মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে।
- চারা রোপণ দূরত্ব জাত, মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন মৌসুমের উপর নির্ভর করে।
- চারা কাঠির সাহায্যেে তুলতে হবে। চারা গাছের শিকড়ের যেন ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এরপর ৭৫ সেমি দূরত্বে সারিতে ৬০ সে.মি. দূরে দূরে চারা রোপণ করতে হবে।
- জমিতে লাগানোর পর পরই যাতে চারা শুকিয়ে না যায় সে জন্য সম্ভব হলে বিকালের দিকে চারা লাগানো উচিত।
(৮) বেগুন গাছের পরিচর্যা
ক) বেগুন গাছের পোকামাকড় দমন পরিচর্যা
বেগুনের সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা হল বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা। কোন কোন এলাকায় ক্ষুদ্র লাল মাকড় প্রধান শত্রু। এছাড়া কাঁটালে পোকা বা ইপলাকনা বিট্ল, জাব পোকা, ছাতরা পোকা, বিছা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, থ্রিপস, কাটুই পোকা ইত্যাদি বেগুনের ক্ষতি করে থাকে। আইপিএম পদ্ধতিতে এসব পোকা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
খ) বেগুন গাছের রোগ দমন পরিচর্যা
বাংলাদেশে বেগুনের ঢলে পড়া ও গোড়া পচা দু’টি মারাত্মক রোগ। প্রায় বেগুন ক্ষেতেই এ রোগ দেখা যায়। ফল পচা রোগেও অনেক বেগুন নষ্ট হয়। বীজতলায় ড্যাম্পিং অফ রোগ চারার মড়ক সৃষ্টি করে। এ ছাড়া মোজেইক, ক্ষুদে পাতা, শিকড়ে গিঁট ইত্যাদি রোগও বেগুন ফসলের যথেষ্ট ক্ষতি করে থাকে।
বেগুনের রোগের মধ্যে গোড়া পঁচা রোগ অন্যতম। এছাড়াও ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট ও খাটো আকৃতির পাতা রোগ দেখা যায়। গোড়া পঁচা রোগের জন্য ভিটাভেক্স-২০০ গ্রাম ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়।
যাহোক নিম্নলিখিত প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে বেগুনের বালাই (রোগ ও পোকা) দমন পরিচর্যা করা যায়-
- কলম চারা ব্যবহারের মাধ্যমে বেগুনের উইল্ট রোগ দমন করা যায়।
- শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে অর্থাৎ একই জমিতে বেগুন/টমেটো রোপন করা যাবে না।
- বেগুনের মাছি পোকা দমনের জন্য ফেরোমন ও মিষ্টি কুমড়ার ফাঁদ ব্যবহার করেত হবে।
- মুরগির পচনকৃত বিষ্ঠা ও সরিষার খৈল ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন সবজি যেমন- বেগুন, টেমেটো, শশা, বাঁধাকপি ফসলের মাটি বাহিত রোগ দমন করা যায়।
- রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে। যেমন- বারি বেগুন-১, বারি বেগুন-৫, বারি বেগুন-৬, বারি বেগুন-৭।
- পোকার আক্রমনমুক্ত চারা রোপন করতে হবে।
- সুষম সার ব্যবহার করতে হবে।
- দ্রুত আগাছা দমন ও মালচিং করতে হবে।
(৯) বেগুন কত দিনে ফল দেয়? বেগুনের ফলন
বেগুন কত দিনে ফল দেয়: বেগুন গাছের চারা রোপনের ৩০ দিন এর বেশি সময় পর ফুল আসে এবং এরও প্রায় ৩০ দিন পর বেগুন সংগ্রহ করতে হয়। অর্থ্যাৎ, ফুল ফোটার পর ফল পেতে গড়ে প্রায় ১ মাস সময় লাগে।
বেগুনের ফলন: সাধারণত হেক্টর প্রতি ৩০-৪৫ টন বেগুনের ফলন হতে পারে। বো শতক প্রতি ১২২-১৮২ কেজি বা শতক প্রতি ৩-৪.৫ মণ বেগুনের ফলন পাওয়া যায়। জাত ভেদে অঅরও কম-বেশি হতে পারে।
কোন সময় গাছ থেকে বেগুন তুলতে হয় বা বেগুন সংগ্রহ করারা উপযুক্ত সময়: বেগুন সম্পূর্ণ পরিপক্ক হওয়ার পূর্বেই সংগ্রহ করতে হবে। বেগুন যখন পূর্ণ আকার প্রাপ্ত হয় অথচ বীজ শক্ত হয় না তখন ফল সংগ্রহ করার উপযুক্ত হয়।
- সংগ্রহের সময় বেগুনের ত্বক উজ্জ্বল ও চকচকে থাকবে। অধিক পরিপক্ক হলে ফল সবুজাভ হলুদ অথবা তামাটে রং ধারণ করে এবং শাঁস শক্ত ও স্পঞ্জের মত হয়ে যায়।
- অনেকে হাতের আঙুলের চাপ দিয়ে ফল সংগ্রহের উপযুক্ত কিনা তা নির্ধারণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে দুই আঙুলের সাহায্যে চাপ দিলে যদি বসে যায় এবং চাপ তুলে নিলে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে তবে বুঝতে হবে বেগুন কচি রয়েছে আর চাপ দিলে যদি নরম অনুভূত হয়, অথচ বসবে না এবং আঙ্গুলের ছাপ থাকে তাহলে বুঝতে হবে সংগ্রহের উপযুক্ত হয়েছে।
- বেশী কচি অবস্থায় ফল সিকি ভাগ সংগ্রহ করলে ফলের গুণ ভাল থাকে, তবে ফলন কম পাওয়া যায়। ফলের বৃদ্ধি থেকে শুরু করে পরিপক্ক পর্যায়ের কাছাকাছি পৌঁছানো পর্যন- বেগুন খাওয়ার উপযুক্ত থাকে।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলেচনার মাধ্যমে আমরা বেগুনের জাত, বেগুন চাষের উপযোগী মাটি, বেগুন কোন মাটিতে ভালো হয়, বেগুন চাষের উপযুক্ত সময়, বেগুনের বীজ বপন, বেগুনের বীজতলা তৈরি, বেগুনের বীজ হার, বেগুনের বীজ থেকে চারা তৈরি, বেগুন চাষের জমি তৈরি, বেগুন চাষে সার প্রয়োগ পদ্ধতি, বেগুনের চারা রোপণ পদ্ধতি বা বেগুনের চারা লাগানোর নিয়ম, বেগুন গাছের পরিচর্যা, বেগুন কত দিনে ফল দেয়, বেগুনের ফলন প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলাম।
সবজির মধ্যে বেগুন একটি অতি পরিচিত জন প্রিয় সবজি। বেগুনের ফল ধারনের উপযুক্ত তাপমাত্রা ১৫-২০০ সে। দোঁআশ ও বেলে দোঁআশ মাটি বেগুন চাষের জন্য ভালো। প্রতি হেক্টর ১২০-১৪০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন। বেগুনের প্রধান শত্রু ডগাও ফলছিদ্রকারী পোকা। রোগের মধ্যে গোড়া পচা অন্যতম। ফলন হেক্টর প্রতি ৩০-৪৫ টন হতে পারে।
[সূত্র: কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস); ওপেন স্কুল]