বেল ফুল কে ইংলিশ এ ‘Arabian jasmine’ বলে। বেলি ফুল গাছের পাতা গাঢ়-সবুজ এবং মসৃণ।
বাংলায় বেলি ফুলকে বনমল্লিকা, মালশি, নগরা ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো ‘Jasminum sambac’।
গ্রীষ্ম ও বর্ষায় একটি থোকায় কয়েকটি ফুল ফোটে। বেলি ফুল জেসমিন গণের অন্তর্ভুক্ত এক প্রকারের সুগন্ধি সাদা ফুল। এই ফুল পছন্দ করে না এমন মানুষ খুব কমই দেখা যায়।
বেলী আমাদের দেশের অতি পরিচিতি ফুল। সুগন্ধ ও মনোমুগ্ধকর সাদা রং এর জন্য সবার কাছে প্রিয় ফুল। মেয়েরা তাদের চুলে বা খোপা সাজানোর জন্য বেলী ফুলের মালা ব্যবহার করে থাকে। এটা ঝোপালো প্রকৃতির হয়ে থাকে। বেলী ফুল থেকে সুগন্ধি দ্রব্য তৈরি হয় বলে এটি অর্থকরী ফুল।
বেল আর যূঁথী বা জুঁই একই পরিবার ও একই গণভুক্ত দুটি আলাদা উদ্ভিদ।
এই আর্টিকেলটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- বেলি ফুলের গাছ কিভাবে লাগাতে হয়, তা জানতে পারবেন। বেলি ফুলের গাছ লাগানোর পদ্ধতি শিখতে পারবেন।
নিম্নে ১০টি পয়েন্টে বেলি ফুলের গাছ কিভাবে লাগাতে হয়, বেলি ফুলের গাছ লাগানোর পদ্ধতি বর্ণনা করা হলো-
(১) বেলি ফুলের গাছ
- বেলিগাছ গুল্মজাতীয়। এই প্রজাতির গাছের উচ্চতা এক মিটার পর্যন্ত হয়। এদের কচি ডাল রোমশ।
- বেলিগাছের কাণ্ড সরু ও দুর্বল হয়। ফলে অল্পতেই হেলে পড়ে।
- গাছের পাতা উজ্জ্বল সবুজ, একক ও দেখতে ডিম্বাকার।
- বেলি ফুলের গাছ লম্বায় চার থেকে ৮ সেন্টিমিটার হয়।
- গ্রীষ্ম ও বর্ষায় পাতার মধ্যে ছোট অসংখ্য ফুল থোকায় থোকায় ফুটে বেরোয়।
- ফুলের পাপড়ি সুবিন্যস্ত। ফুলের আকার ও গড়ন অনুসারে এর কয়েকটি জাত আছে। যেমন- সিঙ্গেল ও অধিক গন্ধযুক্ত, মাঝারি ও ডাবল ধরনের এবং বৃহদাকার ডাবল ধরনের।
- বেলি ফুল সন্ধ্যায় ফোটে এবং পরদিন দুপুরে ঝরে যায়।
- বেলি ফুল বেলে ও ভারী এঁটেল মাটি ব্যতীত সব ধরনের মাটিতে চাষ করা যায়। এই ফুল টবেও চাষ করা যায়।
(২) বেলি ফুলের জাত
বেলী সাধারণত তিন শ্রেণির হয় যেমন-
- ফুল সিঙ্গেল এবং অধিক গন্ধযুক্ত।
- ফুল মাঝারী আকার এবং ডাবল ধরণের।
- ফুল বড় আকারের ডাবল ধরণের হয়।
(৩) বেলি ফুল চাষে জলবায়ু ও মাটি
বেলী উষ্ণ ও মাঝারী উষ্ণ আবহাওয়ায় এ ফুল ভাল জম্মে। প্রচুর সূর্যালোকযুক্ত জায়গায় বেলী চাষ করলে ফুল বেশি পাওয়া যায়। যে কোন মাটিতে জন্মে থাকে। তবে সুনিষ্কাশিত দোআঁশ মাটি বেলীর ফুলের জন্য উপযোগী।
(৪) বেলি ফুল গাছের বংশ বিস্তার পদ্ধতি
বেলী সাধারণতঃ শাখা কলম ও দাবা কলমের সাহায্যে বংশ বিস্তার করা হয়।
(৫) জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ
- জমি ৪-৫টি চাষ দিয়ে ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে।
- জমি তৈরির সময় জৈব বা গোবর সার, ইউরিয়া, ফসফেট এবং এমওপি প্রয়োগ করতে হবে।
- গাছের বৃদ্ধি শুরু হলে প্রতি সারি গাছ থেকে একটু দূরে মাটি আলাদা করে গাছ প্রতি ৩ কেজি গোবর সার, ১০ গ্রাম টিএসপি, ১০ গ্রাম এমওপি সার উপরি প্রয়োগ করলে ভালো ফলন দেয়।
(৬) বেলি ফুল গাছের চারা তৈরি বা কলম তৈরি ও রোপণ
- গ্রীষ্মের শেষ হতে বর্ষার শেষ পর্যন্ত বেলী ফুলের কলম বা চারা তৈরি করা যায়।
- চারা থেকে চারা ও সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সেমি হতে হবে।
- চারা লাগানোর জন্য গর্ত খুঁড়ে গর্তের মাটি রোদ লাগিয়ে, জৈব সার ও কাঠের ছাই গর্তের সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। এরপর প্রতি গর্তে বেলির কলম চারা বসাতে হবে।
- বর্ষায় বা বর্ষার শেষের দিকে কলম বসানোই ভালো। তবে সেচের ব্যবস্থা ভালো হলে বসন্তকালেও কলম তৈরি করা যায়।
- জুলাই বা আগস্ট মাসে প্রায় এক বছর বয়স্ক শাখাকে ২০-২৫ সে.মি. কেটে ২৫ সে.মি. গভীর করে ৭৫-৯০ সে.মি. লাইন থেকে লাইনে চারা থেকে চারার দূরত্ব রেখে লাগাতে হবে।
- দাবা কলম তৈরির পর কলম কেটে একই পদ্ধতিতে চারা লাগাতে হবে।
- টবের মধ্যে সব সার একসাথে মাটির সাথে মিশিয়ে টবে চারা রোপণ করা যায়।
(৭) বেলি ফুল গাছের আন্তঃপরিচর্যা
সেচ দেওয়া: বেলী ফুলের চাষে জমিতে সবসময় রস থাকা গ্রীষ্মকালে ১০-১২ দিন পরপর, শীতকালে ১৫-২০ দিন পরপর ও বর্ষাকালে বৃষ্টি সময় মতো না হলে জমির অবস্থা বুঝে ২-১ টি সেচ দেওয়া দরকার।
আগাছা দমন: জমি বা টব থেকে নিয়মিত আগাছা পরিস্কার করতে হবে। খড় কেটে কুচি করে জমিতে বিছিয়ে রাখলে সেচের প্রয়োজন কম হয় এবং আগাছাও বেশি জন্মাতে পারে না।
অঙ্গ ছাঁটাইকরণ: প্রতি বছরই বেলী ফুলের গাছের ডালপালা ছাঁটাই করা দরকার। শীতের মাঝামাঝি সময় ডাল ছাঁটাই করেত হবে। মাটির উপরের স্তর থেকে ৩০ সেমি উপরে বেলী ফুলের গাছ ছাঁটাই করতে হবে। অঙ্গ ছাঁটাইয়ের কয়েকদিন পর জমিতে বা টবে সার প্রয়োগ করতে হবে।
(৮) পোকামাকড় ও রোগ বালাই ব্যবস্থাপনা
- বেলী ফুল গাছে তেমন ক্ষতিকর পোকা দেখা যায় না। তবে মাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। এদের আক্রমণে পাতার সাদা আস্তরণ পড়ে, আক্রান্ত পাতাগুলো কুঁকড়ে যায় ও গোল হয়ে পাকিয়ে যায়।
- গন্ধক গুড়া বা গন্ধক ঘটিত মাকড় নাশক যেমন- কেলথেন পাতায় ছিটিয়ে মাকড় দমন করা যায়।
- বেলী ফুলের পাতায় হলদে বর্ণের ছিটে ছিটে দাগযুক্ত এক প্রকার ছত্রাক রোগ দেখা যায়। ট্রেসেল-২ প্রয়োগ করে এ রোগ দমন করা যায়।
(৯) বেলি ফুল গাছের পরিচর্যা
- বেলী লাগানোর প্রথম দিকে বেশি যত্নের প্রয়োজন হয়।
- প্রতি বছর ফেব্রুয়ারী মাসে ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর গ্রীষ্ম ও শীত মৌসুমে সেচ দিতে হবে।
- বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- আগাছা জম্মালে তা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
- প্রথম বছর গাছের ফুলের কুঁড়ি ভেঙ্গে দিতে হবে। এর ফলে দেখা যাবে দ্বিতীয় বছরে শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রচুর ফুল দেয়।
- প্রতি বছর শীতের শেষের দিকে কিছু ডাল পালা ছাঁটাই করতে হয়।
- বেলী ফুলের তেমন পোকা মাকড়ের আক্রমণ দেখা যায় না। তবে মাঝে মাঝে মাইটস এর প্রাদূর্ভাব দেখা যায়। এক্ষেত্রে কেলথেন প্রয়োগ করা যায়।
(১০) ফলন
সাধারণত মার্চ-আগস্ট পর্যন্ত বেলী ফুল ফোটে। কাট ফ্লাওয়ারের জন্য সাদা রং এর কুঁড়ি ফুল কুঁড়ি সন্ধ্যার আগে সংগ্রহ করে বাজারজাত করা উচিত।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা বেলি ফুলের গাছ কিভাবে লাগাতে হয়, অর্থ্যাৎ বেলি ফুলের গাছ লাগানোর পদ্ধতি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় যেমন- বেলি ফুলের গাছ, বেলি ফুলের জাত, বেলি ফুল চাষে জলবায়ু ও মাটি, বেলি ফুল গাছের বংশ বিস্তার পদ্ধতি, জমি তৈরি ও সার প্রয়োগ, বেলি ফুল গাছের চারা তৈরি বা কলম তৈরি ও রোপণ, বেলি ফুল গাছের আন্তঃপরিচর্যা, পোকামাকড় ও রোগ বালাই ব্যবস্থাপনা, বেলি ফুল গাছের পরিচর্যা, ফলন প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে পারলাম।
বেলী ফুলের সুগন্ধ ও মনোমুগ্ধ সাদা রং এর জন্য সবার কাছে প্রিয় ফুল। বেলী সাধারণত তিন শ্রেণির হয়ে থাকে। দাবা কলমের সাহায্যে বেলী ফুলের চারা করা হয়।
প্রতিবছরই এই গাছের ডালপালা ছাঁটাই করা দরকার পড়ে। শীতের মাঝামাঝি সময় ডাল ছাঁটাই করতে হয়। গুটি কলম, দাবা কলম ও ডাল কলম পদ্ধতির মাধ্যমে এদের বংশবিস্তার করা যায়।
জমি বা টব থেকে নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। খড় কেটে কুচি করে জমিতে বিছিয়ে রাখলে সেচের প্রয়োজন কম হয় এবং আগাছাও বেশি জন্মাতে পারে না।
বেলির কিছু ভেষজগুণ আছে। বেলির মূল ও কচি পাতা থেঁতো করে সিদ্ধ করে খেলে বুকে বসে যাওয়া সর্দি ভালো হয়। শ্বাসকষ্ট রোধেও কার্যকর। পেটের কৃমি দমনের জন্য বেলি ফুলের রস গরম পানির সঙ্গে খেলে উপকার পাওয়া যায়। বেলির মূলের রস আতপ চাল ধোয়া পানি ও চিনি মিশিয়ে খেলে বমি বমি ভাব দূর হয়। বেলি পাতা বেটে ক্ষতের ওপর প্রলেপ দিলে দ্রুত সেরে যায়। পাতা বেটে পানির সঙ্গে গুলিয়ে খেলে ঘুম ভালো হয়।
আলংকরিক হিসেবে বেল ফুলের ব্যবহার ব্যাপক। মূলত ফুলের তোড়া ও মালা তৈরিতে এর গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার বিস্তৃত। বেলফুলের তেল বেশ সুপরিচিত ও এটি তেল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।