বাণিজ্যিক পোল্ট্রি পালন করতে হলে পোল্ট্রির জন্য ভালো বাসস্থান প্রয়োজন। বাণিজ্যিক খামার উঁচু জায়গায় করতে হয় যাতে বৃষ্টির পানি না জমে। আমিষের চাহিদা পূরণে পোল্ট্রির কোনো বিকল্প নেই।
এ পাঠ শেষে আপনি- খামার পরিকল্পনা বলতে কি বোঝায় তা ব্যাখ্যা করতে পারবেন। খামারের প্রয়োজনীয় উপকরণের তালিকা তৈরি করতে পারবেন। ব্রয়লার মুরগির খামার পরিকল্পনার একটি ধারণা পাবেন।
(১) খামার পরিকল্পনা কি?
খামার পরিকল্পনা কি: খামার পরিকল্পনা বলতে খামার তৈরির পূর্বের কিছু বিষয়ে ধারণা থাকা অর্থ্যাৎ কি করা হবে, কিভাবে করা হবে, এতে কারা জড়িত থাকবে এবং এর ফলাফল কি হবে, মোট কথা কিভাবে খামারকে লাভজনক করা যায় তার নিয়ে আগে থেকেই চিন্তা করা। যে কোন কাজের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে সুষ্ঠু পরিকল্পনার উপর।
পোল্ট্রি খামার অর্ধ্যাৎ ব্রয়লার মুরগির খামার পরিকল্পনায় যেসব বিষয় গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন তা নিম্নরুপ-
- স্থান নির্বাচন
- মূলধন
- পোল্ট্রির বাসস্থান নির্মাণ
- উন্নত জাত নির্বাচন
- পোল্ট্রির খাদ্য, ভ্যাকসিন ও ঔষধ
- বাজারজাতকরণ
- পোল্ট্রি পালনের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ
পোল্ট্রি পালন আদিকালে খামার হিসাবে না থাকলেও পারিবারিক ভাবে এর লাল-পালন হবে। তবে এর সংখ্যা খুবই নগন্য। সময়ের সাথে প্রাণীজ আমিষের ঘাটতি পুরনের লক্ষ্যে পোল্ট্রি খামার এখন একটি শিল্প হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এর জন্য কিছু উপকরন আবশ্যক। আমাদের লাভ-লোকসান ব্যায়ের সাথে সরাসরি জড়িত। খামারের ব্যয় কমলে আয় বাড়বে। ব্রয়লায় খামার থেকে ৩৫ দিনে আয় হলেও লেয়ার খামার থেকে আয় পেতে বেশী সময় লাগে। খামারে মুরগির সংখ্যা যত বেশি হবে আয় তত বেশি হবে।
(২) ব্রয়লার মুরগির খামার পরিকল্পনা
ক) ব্রয়লার মুরগির খামার স্থাপন
আলোচনার এ অংশে আমরা ব্রয়লার মুরগির খামার পরিকল্পনার বিষয়সমূহ সম্পর্কে ধারণা লাভ করব। ব্রয়লার খামার স্থাপনের সুবিধাদি সম্পর্কে অবগত হব। ব্রয়লার মুরগির খামার পরিকল্পনায় বিবেচ্য বিষয়সমূহ সসম্পর্কে জানব।
ব্রয়লার হলো বিশেষ ধরনের মুরগির বাচ্চা যা অল্প সময়ের (৪-৫ সপ্তাহ) মধ্যে গড়ে ১.৫-২.০০ কেজি মাংস উৎপাদনে সক্ষম।
ব্রয়লার মুরগির খামার স্থাপনের সুবিধা-
- অল্প পূঁজি দিয়ে এ খামার স্থাপন করা সম্ভব।
- অল্প সময়ে অর্থ্যাৎ ৪-৫ সপ্তাহের মধ্যে লাভসহ মূলধন ফেরত পাওয়া যায়।
- অন্যান্য খামারের তুলনায় জমির পরিমাণ কম লাগে।
- তুলনামূলকভাবে অন্যান্য খামারের তুলনায় ঝুঁকি কম।
- বছরে অনেক কয়টি ব্যাচ পালন করা সম্ভব।
- দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না।
- পারিবারিক আমিষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।
- কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
ব্রয়লার মুরগির খামার পরিকল্পনার সময় নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো সহজলভ্য আছে কি-না তা অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। যথা-
- মূলধন
- জমি
- উৎপাদিত ব্রয়লারের বাজার
- ব্রয়লার স্ট্রেইনের বাচ্চা
- খাদ্য
- পানি
- বিদ্যুৎ
- সহজলভ্য শ্রমিক
- প্রতিষেধক ওষুধপত্র
- যোগাযোগের রাস্তাঘাট ইত্যাদি
ব্রয়লার খামার ব্যবস্থাপনায় তিনটি মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করতে হয়। যথা-
- মুরগির খাদ্য
- বাসস্থান ও
- রোগ দমন
খাদ্য খরচ মোট উৎপাদন ব্যয়ের প্রায় ৬০-৬৫% এবং খাদ্যের গুণাগুণ ও মূল্যের ওপর লাভ-লোকসান নির্ভর করে। সেজন্য ব্রয়লার খামার ব্যাবস্থাপনায় খাদ্যের গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু বাসস্থানের পরিবেশ অনুকূল ও আরামদায়ক না হলে শুধু খাদ্য দিয়ে তার অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। তেমনি খামার রোগমুক্ত না হলেও তা লাভজনক হবে না।
খ) ব্রয়লার মুরগির খামারের বাসস্থান তৈরি
ভালো উৎপাদনের জন্য মুরগিকে আরামদায়ক ঘরে রাখা প্রয়োজন। গ্রীষ্মের সময় যাতে অতিরিক্ত গরম না লাগে এবং শীতকালে ঘর গরম থাকে তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাসস্থানের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো তাদের শত্রু যেমন- সাপ, শিয়াল, বিড়াল, কুকুর, কাক, অন্যান্য পোকামাকড় ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা করা।
i) প্রতিটি ব্রয়লার মুরগির জায়গার পরিমাণ
বিক্রি করার বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ব্রয়লারের জন্য ১ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন। উৎপাদনকারীর প্রাথমিক মূলধন বিনিয়োগের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে ঘর নির্মাণ করতে হবে।
থাকার ঘরের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও নির্মাণসামগ্রীর ওপর নির্ভর করে চাল তৈরি করতে হয়। ব্রয়লার পালনকালে এদেরকে বাজারজাত করার বয়স পর্যন্ত একই ঘরে রাখা হয়।
বাসস্থানের অভ্যন্তরীণ চাহিদা, যেমন- ব্রয়লারের জন্য পরিমাণমতো থাকার জায়গা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক খাদ্য ও পানির পাত্র, তাপ ও আলো এবং বায়ু চলাচলের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। নিম্নে এগুলো বিশদভাবে বর্ণনা করা হলো।
ii) পোল্ট্রির ঘরের ধরন
আয়তাকার ঘর মুরগি পালনের জন্য ভালো। মুরগির ঘর পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা হওয়া উত্তম। ঘর উত্তর অথবা দক্ষিণমুখী হলে এরকম ঘরে বাতাস চলাচল ও সূর্যের আলো দুটিই পাওয়া যায়।
১। চালের প্রকৃতি: থাকার ঘরের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও নির্মাণসামগ্রীর ওপর নির্ভর করে চাল তৈরি করতে হয়।
পোল্ট্রি খামার কিংবা ব্রয়লার খামারে নিম্নবর্ণিত চাল তৈরির প্রচলন আছে। যথা-
- একক চালা বা শেড টাইপ
- দোচালা বা গেবল টাইপ
- মনিটর
- সেমি-মনিটর টাইপ
- কম্বিনেশন টাইপ
২। ছাদ: পোল্ট্রির ঘরের ছাদ সাধারণত ছন, খড়, গোলপাতা, সিমেন্ট, অ্যাসবেস্টস, ডেউটিন, স্টিলের পাত ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয়। আমাদের দেশের বেশিরভাগ ঘরই ছন, খড় বা টিন দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে। ছন ও খড় দিয়ে ঘর তৈরি করলে ৩ বছর পর পর তা পরিবর্তন করে দিতে হয়। অন্যদিকে, টিন দিয়ে ঘর তৈরি করতে খরচ একটু বেশি হলেও টেকসই বেশি হয়। তবে ছন দিয়ে তৈরি ঘর মুরগির জন্য আরামদায়ক। অন্যদিকে, টিন দিয়ে তৈরি ঘর তাড়াতড়ি গরম হয়ে যায়। তবে গরম দূর করার জন্য টিনের নিচে পাতলা করে ছন বা খড় দিয়ে ঠান্ডা রাখা যায়।
৩। মেঝে: ডিমপাড়া মুরগির ঘরের মেঝে আর্দ্রতামুক্ত হতে হয়। মেঝে মসৃণ হওয়া উচিৎ; এতে তা সহজেই পরিষ্কার করা যায় এবং ইঁদুদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
মেঝে নানা প্রকার হয়ে থাকে। যথা-
- পাকা মেঝে
- মাঁচা মেঝে
- কাঁচা মেঝে
৪। দেয়াল: পোল্ট্রিকে রোদ, বৃষ্টি, ঝড় ইত্যাদি থেকে রক্ষা করতে ঘরে দেয়াল দেওয়া প্রয়োজন। পোল্ট্রির দেয়াল দুই-তৃতীয়াংশ খোলা রাখতে হয়। যাতে পোল্ট্রি পর্যাপ্ত বায়ুপ্রবাহ ও অক্সিজেন পায়। দেয়ালের খোলা অংশ সাধারণত জি.আই. পাইপ বা জি.আই. তার দ্বারা আবৃত অথবা বাঁশের চটা ফাঁক ফাঁক করে দেওয়া হয়।
৫। ঘরের দরজা: পোল্ট্রি শেডের দরজা অবশ্যই দক্ষিণমুখী করতে হবে। ঘরের দরজা এমনভাবে করতে হবে যেন পোল্ট্রির শেডের কর্মচারী সহজেই পোল্ট্রির যত্ন নেওয়ার জন্য যাওয়া আসা করতে পারে।
৬। জানালা: সমতল ঘরে প্রতি ১০ স্কয়ার ফিট মেঝের জন্য কমপক্ষে ১.৫ স্কয়ার ফিট জায়গা প্রয়োজন। তবে অত্যন্ত শীতে রোদ্রে জানালা চট দিয়ে ঢেকে দিতে হয়।
৭। বেড়ার প্রকৃতি: ব্রয়লারের পুরো পালনকালে বাজারজাত করার বয়স পর্যন্ত এদেরকে একই ঘরে রাখা হয়। কিন্তু লালন পালনের সুবিধার্থে প্রথম ৪ সপ্তাহ ঘরের তাপমাত্রায় ৩৫০ সে. (৯৫০ফা.) থেকে কমাতে কমাতে ২৬.৭০ সে. এ (৮০০ ফা.) নামিয়ে আনার জন্য বেড়ায় বেশি ফাঁকা জায়গা রাখা যাবে না। কিন্তু প্রয়োজনীয় বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অন্যদিকে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা কমিয়ে বাতাস চলাচল বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হয় বিধায় বেড়ার উচ্চতার ৬০% তারজালি দিয়ে তৈরি করা ভালো।
খ) ব্রয়লার মুরগির খামারের পরিবেশের তাপমাত্রা
ব্রয়লারের বাচ্চা বা যে কোনো মুরগির বাচ্চা প্রতিপালনে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের তাপমাত্রার যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। সারণি ১০-এ বয়স বাড়ার সঙ্গে ব্রয়লারের ঘরে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা দেয়া হয়েছে।
বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে ব্রয়লারের ঘরের প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা সারণিতে উপস্থাপন করা হলো-
বয়স | গ্রীষ্মকাল | শীতকাল |
১ম সপ্তাহ | ৮৬০ ফা. (৩০০ সে.) | ৯৫০ ফা. (৩৫ সে.) |
২য় সপ্তাহ | ৮২০ ফা. (২৭০. ৭০ সে.) | ৯০০ ফা. (৩২.২০ সে.) |
৩য় সপ্তাহ | ৭৫০ ফা. (২৩. সে.) | ৮৫০ ফা. (২৯.৪০ সে.) |
৪র্থ সপ্তাহ | – | ৮০০ ফা. (২৬.৬০ সে.) |
৫ম সপ্তাহ | – | ৭৫০ ফা. (২৩.৯০ সে.) |
৬ষ্ঠ সপ্তাহ | – | ৭০০ ফা. (২০.১০ সে.) |
*তাপমাত্রা: সে.= সেলসিয়াস, ফা.= ফারেনহাইট।
গ) ব্রয়লার মুরগির খামারে আলোক ব্যবস্থাপনা
প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যে কোনো উৎস থেকেই ব্রয়লার গৃহে আলোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রথম সপ্তাহে ব্রয়লার গৃহে খাবার ও পানি দেখার জন্য সারারাত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে রাতের বেলায় মাঝে মাঝে আলো নিভিয়ে আবার জ্বালাতে হবে এবং এভাবে সারারাত মৃদু আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে।
ঘ) ব্রয়লার মুরগির খামারে খাদ্য ব্যবস্থপনা
যেহেতু পোল্ট্রি বা ব্রয়লার পালনে মোট উৎপাদন খরচের ৬০-৬৫% খাদ্য খরচ এবং খাদ্যের গুণগত মানের ওপর তাদের প্রয়োজনীয় শারীরিক বর্ধন নির্ভর করে, সেজন্য এদের খাদ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব বেশি।
খাদ্যের গুণগত মান, খাদ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা, খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ, প্রতি কেজি খাদ্যের দাম, খাদ্য খাওয়ানোর দক্ষতা প্রভৃতি খাদ্য ব্যবস্থাপনার অন্র্তভুক্ত। কাজেই ব্রয়লারের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে খাদ্য ও পানির পাত্র এবং অন্যান্য জিনিসপত্রের সংখ্যা ও পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
ঙ) মোট খাদ্য পাত্রের সংখ্যা নির্ণয়
বয়সভেদে ব্রয়লারের জন্য ২.৫-১০ সে.মি. লম্বা খাদ্যের পাত্র বা ফিড ট্রাফের প্রয়োজন। কাজেই বয়সের ভিত্তিতে ও সংখ্যা অনুযায়ী হিসেব করে ব্রয়লারের ঘরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক খাদ্যের পাত্র সরবরাহ করতে হবে।
চ) মোট পানির পাত্রের সংখ্যা নির্ণয়
বয়সের ওপর নির্ভর করে একটি ব্রয়লারের জন্য লম্বালম্বি পানির পাত্রের জায়গার প্রয়োজন হবে। সাধারণভাবে দেখা যায় নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্রয়লারের জন্য মোট খাদ্যের পাত্রের অর্ধেক সংখ্যক পানির পাত্র হলেই চলবে।
উপরোক্ত দ্বারা আমরা ব্রয়লার মুরগির খামার পরিকল্পনা বিষয়ে একটা ধারণা অর্জন করলাম।
ব্রয়লার মুরগি মাংস উৎপাদনের জন্য পালন করা হযে থাকে। এজন্য খামার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে খাদ্য ও বাসস্থান গুরুত্বপূর্ণভাবে বিবেচনা করতে হবে। মোট উৎপাদন খরচের শতকরা ৬০-৭৫ ভাগ খাদ্য খরচ। বাসস্থান এমনভাবে তেরী করতে হবে যাতে গরমকালে পর্যাপ্ত বাতাস ও শীতকালে ঘর গরম রাখার ব্যবস্থা থাকে। এজন্য ঘরের দরজা, জানালা, ভেন্টিলেশন ও দেয়াল তৈরি সঠিক পরিমাপ অনুযায়ী করতে হবে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।