(১) ভুট্টার চাষ পদ্ধতি: ভুট্টা চাষ কিভাবে করে?
ক) মাটি
বেলে-দোআঁশ ও দোআঁশ মাটি চাষের জন্য উপযোগী। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন জমিতে পানি জমে না থাকে।
খ) ভুট্টার চাষের সঠিক সময়কাল
বাংলাদেশে রবি মৌসুমে মধ্য-আশ্বিন থেকে মধ্য-অগ্রহায়ণ (অক্টোবর-নভেম্বর) এবং খরিফ মৌসুমে ফাল্গুন থেকে মধ্য-চৈত্র (মধ্য-ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ) পর্যন্ত সময় বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
গ) বীজের হার ও বপন পদ্ধতি
শুভ্রা, বর্ণালী ও মোহর জাতের ভুট্টার জন্য হেক্টরপ্রতি ২৫-৩০ কেজি, হাইব্রিড ভুট্টার বীজ হেক্টর প্রতি ২০-২২ কেজি এবং খৈ ভুট্টা জাতের জন্য ১৫-২০ কেজি হারে বীজ বুনতে হয়।
- বীজ সারিতে বুনতে হবে।
- সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৬০ সেমি।
- সারিতে ২৫ সেমি দূরত্বে ১টি অথবা ৫০ সেমি দূরত্বে ২টি গাছ রাখতে হবে।
ঘ) ভুট্টা চাষে সারের পরিমাণ ও সার প্রয়োগ
ভুট্টা চাষে হেক্টর প্রতি বিভিন্ন প্রকার সারের পরিমাণ নিচে দেওয়া হল।
সারের পরিমাণ/হেক্টর:
সারের নাম | কম্পোজিট ভুট্টা (রবি) | কম্পোজিট ভুট্টা (খরিফ) | বারি হাইব্রিড ভুট্টা (রবি) | খৈ ভুট্টা (রবি) |
ইউরিয়া | ৩২৫-৪০০ কেজি | ৩৭৫-৪৫০ কেজি | ৫৫০-৬০০কেজি | ২৬০-৩২০ কেজি |
টিএসপি | ২০০-২০০ কেজি | ১৮০-২৬০ কেজি | ২৫০-২৫০ কেজি | ১৫০-২০০ কেজি |
এমওপি | ১৬০-২০০ কেজি | ১৫০-২০০ কেজি | ২০০-২৫০ কেজি | ১৫০-২০০ কেজি |
জিপসাম | ১৭০-১৯০ কেজি | ১৩০-১৬০ কেজি | ১৭৫-২২০ কেজি | ১৪০-১৮০ কেজি |
জিংক সালফেট | ০৮-১০ কেজি | ৬-৯ কেজি | ৮-১২ কেজি | ৮-১০ কেজি |
বরিক এসিড(প্রয়োজন বোধে) | ৬-৯ কেজি | ৫-৮ কেজি | ৬-১০ কেজি | ৬-৮ কেজি |
গোবর | ৮০-১০০ টন | ৮০-১০০ টন | ১০০-১২০ টন | ১০০-১২০ টন |
ঙ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি
- জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে অনুমোদিত ইউরিয়ার এক তৃতীয়াংশ এবং অন্যান্য সারের সবটুকু ছিটিয়ে জমি চাষ ও মই দিতে হবে।
- বাকি ইউরিয়া সমান ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তি বীজ গজানোর ৩০-৩৫ দিন পর (৮-১০ পাতা পর্যায়) এবং দ্বিতীয় কিস্তি বীজ গজানোর ৬০-৬৫ দিন পর (পুরুষ ফুল আসা পর্যায়) উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
- চারা গজানোর ৩০ দিনের মধ্যে জমি থেকে অতিরিক্ত চারা তুলে ফেলতে হবে। চারার বয়স এক মাস না হওয়া পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
(২) ভুট্টা চাষের অন্যন্য নিয়ম
ক) সেচ প্রয়োগ পদ্ধতি
উচ্চ ফলনশীল জাতের ভুট্টার আশানুরূপ ফলন পেতে হলে রবি মৌসুমে সেচ প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। উদ্ভাবিত জাতে নিম্নরূপ ৩-৪টি সেচ দেওয়া যায়।
প্রথম সেচ: বীজ বপনের ২০-২৫ দিনের মধ্যে (৩-৫ পাতা পর্যায়)
দ্বিতীয় সেচ: বীজ বপনের ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে (৮-১০ পাতা পর্যায়)
তৃতীয় সেচ: বীজ বপনের ৬৫-৭০ দিনের মধ্যে (পুরুষ ফুল আসা পর্যায়)
চতুর্থ সেচ: বীজ বপনের ৯০-৯৫ দিনের মধ্যে (দানা বাঁধার পূব পর্যায়)
তবে বীজ বপনের সময় মাটিতে যথেষ্ট রস না থাকলে বপনের পরপরই একটি হালকা সেচ দিতে হবে, সেক্ষেত্রে প্রথম সেচ ৩০ দিনের মধ্যে দিলেও চলবে। ভুট্টার ফুল ও দানা বাঁধার সময় কোন ক্রমেই জমিতে যাতে পানির স্বল্পতা এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
খ) ভুট্টার মোচা সংগ্রহ
হাইব্রিড ভুট্টার মাঠ হতে সংগৃহীত দানা বীজ হিসেবে পরবর্তী বছরের জন্য কোন অবস্থাতেই সংরক্ষণ করা যাবে না। তবে মুক্ত পরাগায়িত জাতের ভুট্টার বীজ সঠিক নিয়ম মেনে লাগানো হলে বীজ হিসেবে পরবর্তী বছরে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা যাবে।
- মোচা সংগ্রহের সময় বীজে বা দানায় সাধারণত ২৫-৩৫% আর্দ্রতা থাকে। তাই সংরক্ষণের আগে দানা এমনভাবে শুকাতে হবে যেন আর্দ্রতা ১২% এর বেশি না থাকে।
- দানার জন্য ভুট্টা সংগ্রহের ক্ষেত্রে মোচা চকচকে খড়ের রং ধারণ করলে এবং পাতা কিছুটা হলদে হলে সংগ্রহের ক্ষেত্রে উপযুক্ত হয়। মোচার দানার গোড়ায় কালো দাগ দেখা গেলে ও মোচার উপরের আবরণ সম্পূর্ণ খড়ের রং ধারণ করলে এবং গাছের পাতা কিছুটা হলদে হয়ে এলে ভুট্টার মোচা সংগ্রহ করতে হবে।
- শুষ্ক আবহাওয়া ও রোদের দিন ভুট্টা সংগ্রহ করা উচিত। যদি বৃষ্টি ও খারাপ আবহাওয়ার জন্য মোচা সংগ্রহ সম্ভব না হয় তাহলে পাকা মোচার কিছুটা নিচের দিকে গাছ আলতো করে ভেঙ্গে গাছের মাথাসহ মোচা মাটির দিকে ঝুলিয়ে দিতে হবে। এতে বৃষ্টির পানি মোচার ভিতর ঢুকতে পারবে না। পরে রোদ হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে।
গ) মোচা সংগ্রহের পরবর্তী কাজ
ক্ষেত হতে মোচা বাড়িতে এনে ছায়ায় ঠান্ডা ও শুকনা স্থানে চাটাইয়ের উপর বিছিয়ে রাখতে হবে এবং খুব দ্রুত মোচার খোসা ছড়িয়ে নিয়ে ৩-৪ দিন চাটাইয়ের উপর মোচা বিছিয়ে ভালভাবে রোদে শুকাতে হবে।
ঘ) দানা ছাড়ানো
আমাদের বাংলাদেশে চাষীর হাতেই মোচার দানা ছাড়িয়ে থাকে। এতে সময় ও পরিশ্রম বেশি লাগে। তবে দানা ছাড়ানোর জন্য সস্তা হাত মাড়াই যন্ত্র পাওয়া যায়। এই মাড়াই যন্ত্র দিয়ে সহজে বেশি দানা ছাড়ানো যায়। শক্তি চালিত মাড়াই যন্ত্রের সাহায্যে অনেক সহজে ও কম সময়ে বেশি ভুট্টা মাড়াই করা সম্ভব।
ঙ) ভুট্টা দানা সংরক্ষণ, গোলাজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ
- ভুট্টার দানা গোলাজাতের পূর্বে ৪-৫ দিন রোদে ভালোভাবে শুকাতে হবে। দাঁত দিয়ে চাপ দিলে যদি ভুট্টা দানা “কট” শব্দ করে ভেঙ্গে যায়, তাহলে বুঝতে হবে দানা গোলাজাতের উপযোগী হয়েছে।
- ঘরের মেঝেতে চাটাইয়ের উপর ভুট্টা দানা ১০-১২ ঘণ্টা ঠান্ডা করে নিয়ে গোলাজাত করতে হবে।
- পরিষ্কার ও ছিদ্রমুক্ত ড্রামে অথবা মোটা পলিথিন দেয়া চটের বস্তায় দানা এমনভাবে ভরতে হবে যেন ভেতরে খালি জায়গা না থাকে।
- বস্তা ও ড্রামের মুখ বন্ধ করে ঘরের মেঝেতে বাঁশ বা কাঠের পাটাতনের উপর রাখতে হবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজারে বিক্রয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।
যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা না হলে গোলাজাত ভুট্টা দানার বিভিন্ন পোকা যেমন-ভুট্টার শুঁড় পোকা, সুরুই পোকা, চালের শুড় পোকা ইত্যাদি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে প্রচুর ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
(৩) ভুট্টার চাষ পদ্ধতি ও ফলনে রোগ বালাই দমন
ক) ভুট্টার বীজ পচা এবং চারা গাছের রোগ
- বীজ পচা এবং চারা নষ্ট হওয়ার কারণে সাধারণত ক্ষেতে ভুট্টা গাছের সংখ্যা কমে যায়। নানা প্রকার বীজ ও মাটিবাহিত ছত্রাক যেমন; পিথিয়াম, রাইজকটনিয়া, ফিউজেরিয়াম, পেনিসিলিয়াম ইত্যাদি বীজ পচা, চারা ঝলসানো, গোড়া ও শিকড় পচা রোগ ঘটিয়ে থাকে।
- জমিতে রসের পরিমাণ বেশি হলে এবং মাটির তাপমাত্রা কম থাকলে বপনকৃত বীজের চারা বড় হতে অনেক সময় লাগে। ফলে এ সময়ে ছত্রাক আক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায়।
প্রতিকার:
- সুস্থ, সবল ও ক্ষতমুক্ত বীজ এবং ভ্ট্টুার বীজ পচা রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে।
- উত্তমরূপে জমি তৈরি করে পরিমিত রস ও তাপমাত্রায় (১৩০ সে. এর বেশি) বপন করতে হবে।
- থিরাম বা প্রোভেক্স-২০০ ডাব্লিউপি (০.২৫%) প্রতি কেজি বীজে ২.৫-৩.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করলে ভুট্টার বীজ পচারোগের আক্রমণ অনেক কমে যায়।
খ) ভুট্টার পাতা ঝলসানো রোগ
- হেলমিনথোসপরিয়াম টারসিকাম ও হেলমিনথোসপরিয়াম মেইডিস নামক ছত্রাকদ্বয় এ রোগ সৃষ্টি করে। প্রথম ছত্রাকটি দ্বারা আমাদের বাংলাদেশে ভ্ট্টুার পাতা ঝলসানো রোগ বেশি হতে দেখা যায়।
- হেলমিনথোসপরিয়াম টারসিকাম দ্বারা আক্রান্ত গাছের নিচের দিকের পাতায় লম্বাটে ধূসর বর্ণের দাগ দেখা যায়। পরবর্তীকালে গাছের উপরের অংশে তা বিস্তার লাভ করে। রোগের প্রকোপ বেশি হলে পাতা আগাম শুকিয়ে যায় এবং গাছ মরে যায়।
- এ রোগের জীবাণু গাছের আক্রান্ত অংশে অনেক দিন বেঁচে থাকে। জীবাণুর জীবকণা বা কনিডিয়া বাতাসের সাহায্যে অনেক দূর পযর্ন্ত সুস্থ গাছে ছড়াতে পারে। বাতাসের আর্দ্রতা বেশি হলে এবং ১৮-১৭০ সে. তাপমাত্রায় এ রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়।
প্রতিকার:
- রোগ প্রতিরোধী জাতের ভুট্টা চাষ করতে হবে।
- আক্রান্ত ফসলে টিল্ট-২৫০ ইসি (০.০৫%) ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
- ভুট্টা উঠানোর পর জমি থেকে আক্রান্ত গাছ সরিয়ে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
গ) ভুট্টার মোচা ও দানা পচা রোগ
- মোচা ও দানা পচা রোগ ভুট্টার ফলন, বীজের গুণাগুণ ও খাদ্যমান কমিয়ে দেয়। বিভিন্ন প্রকার ছত্রাক যথা ডিপোডিয়া মেডিস, ফিউজেরিয়ম মনিলিফরমি প্রভৃতি এ রোগ ঘটায়।
- আক্রান্ত মোচার খোসা ও দানা বিবর্ণ হয়ে যায়। দানা পুষ্ট হয় না, কুঁচকে অথবা ফেটে যায়। অনেক সময় মোচাতে বিভিন্ন দানার মাঝে বা উপরে ছত্রাকের উপস্থিতি খালি চোখেই দেখা যায়।
- ভুট্টা গাছে মোচা আসা থেকে পাকা পযর্ন্ত বৃষ্টিপাত বেশি থাকলে এ রোগের আক্রমণ বাড়ে। পোকা বা পাখির আক্রমণে কান্ড পচা রোগে গাছ মাটিতে পড়ে গেলে এ রোগ ব্যাপকতা লাভ করে।
- এ রোগের জীবাণু বীজ অথবা আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশে বেঁচে থাকে। একই জমিতে বার বার ভ্ট্টুার চাষ করলে এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
প্রতিকার:
- এ রোগের প্রাদুর্ভাব এড়াতে একই জমিতে বার বার ভ্ট্টুা চাষ করা ঠিক নয়।
- জমিতে পোকা ও পাখির আক্রমণ রোধ করতে হবে।
- ভুট্টা পেকে গেলে তাড়াতাড়ি কেটে সংগ্রহ করে ফেলতে হবে।
ঘ) ভুট্টার কান্ড পচা রোগ
- বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক যথা ডিপোডিয়া মেডিস, ফিউজেরিয়াম মনিলিফরমি এর কারণে এ রোগ ঘটে থাকে।
- প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে গাছের কান্ড পচে যায় এবং গাছ মাটিতে ভেঙ্গে পড়ে।
- আমাদের বাংলাদেশে খরিফ মৌসুমে এ রোগটি বেশি হয়ে থাকে।
- জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি এবং পটাশের পরিমাণ কম হলে ছত্রাকজনিত কান্ড পচা রোগ বেশি হয়।
প্রতিকার:
- ছত্রাকনাশক প্রোভেক্স-২০০ ডাব্লিউপি দিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে।
- সুষম হারে সার ব্যবহার করতে হবে, বিশেষ করে নাইট্রোজেন ও পটাশ পরিমিত মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।
- ভুট্টা সংগ্রহের পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- শিকড় ও কান্ড আক্রমণকারী পোকান্ডমাকড় দমন করতে হবে।
- আক্রান্ত জমিতে অনুমোদিত ছত্রাক নাশক ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
(৪) মাঠে ভুট্টার অনিষ্টকারী পোকা দমন
মাঠ পর্যায়ে বেশ কিছু কীট-পতঙ্গ ভুট্টা ফসলকে আক্রমণ করে। এর মধ্যে কাটুই পোকা, গোলাপী মাজরা পোকা, মাজরা পোকা, পাতা খেকো লেদা পোকা, জাব পোকা ও মোচার পোকা অন্যতম। এছাড়া গোলাজাত ভুট্টার দানায় কিছু পোকা আক্রমণ করে থাকে। এগুলোর মধ্যে চালের শুঁড় পোকা, ভুট্টার শুঁড় পোকা ও সুরুই পোকা অন্যতম।
ক) কাটুই পোকা
- ভুট্টার অন্যতম ক্ষতিকর পোকা হলো কাটুই পোকা। দিনের বেলা কাটুই পোকার কীড়া মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে এবং রাতের বেলা বের হয়ে ভুট্টার চারাগাছ কেটে ফেলে।
- সকাল বেলা ক্ষেতে কাটুই পোকা দ্বারা কাটা ভুট্টার চারাগাছ দেখা যায় এবং কাটা গাছের কাছে মাটি খুঁড়লে কাটুই পোকার কীড়া পাওয়া যায়।
- এ পোকার আক্রমণে জমিতে গাছের সংখ্যা কমে যায় বলে ফলনও স্বাভাবিকভাবে কম হয়।
দমন ব্যবস্থাপনা:
- কাটুই পোকা দমনের জন্য ভোর বেলা কাটা চারা গাছের গোড়া খুড়ে কীড়াগুলো মেরে ফেলতে হবে।
- তাছাড়া হালকা সেচ দিলে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা কীড়া মাটির উপরে আসবে, ফলে সহজে পাখি এদের ধরে খাবে বা হাত দ্বারা মেরে ফেলা যাবে।
- আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি কীটনাশক (ক্যারেট ২.৫ ইসি বা ফাইটার ২.৫ ইসি) মিশিয়ে গাছের গোড়ার চারদিকে বিকেল বেলায় ভালভাবে স্প্রে করে দিতে হবে।
খ) গোলাপী মাজরা পোকা
- চারা অবস্থায় ভুট্টা গাছের কান্ড যখন কচি থাকে তখন এ পোকার আক্রমণ দেখা যায়। রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমেই এ পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়।
- ডিম ফুটে কীড়া বের হয়ে গাছের কচি কান্ড ছিদ্র করে ঢুকে ভেতরের অংশ কুড়ে কুড়ে খায়। ফলে গাছের মধ্য ডগা বা মাইজ ডগা মরে যায় এবং ডগা উপরের দিকে টানলে উঠে আসে।
- আক্রান্ত গাছটি লম্বালম্বি চিরে পরীক্ষা করলে তাতে পোকার কীড়া দেখা যায়।
দমন ব্যবস্থাপনা:
- আলোক ফাঁদ পেতে মথ ধ্বংস করতে হবে।
- চারা অবস্থায় ফেরোমন ফাঁদ ১০ বর্গ মিটার দূরত্বে স্থাপন করে এ পোকা দমন করা যায়।
- আক্রান্ত মাঠে বায়োকীটনাশক যেমন স্পিসোসেড (ট্রেসার অথবা সাকসেস) প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৪ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি মার্শাল ২০ ইসি অথবা ডায়াজিনন ৬০ ইসি ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করলে এই পোকা দমন করা যায়।
- ফুরাডান ৫ জি প্রতি হেক্টরে ২০ কেজি হারে অথবা ৩/৪ টি দানা প্রতি গাছের উপরিভাগে এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে যেন দানাগুলো কান্ড এবং পাতার মাঝে থাকে।
গ) মাজরা পোকা
- রবি ও খরিফ উভয় মৌসুমে ভুট্টা গাছের শক্ত কান্ডে মাজরা পোকার আক্রমণ দেখা যায়।
- ডিম ফুটে কীড়া বের হয়ে গাছের কান্ড ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে টিস্যুসমূহ খেতে থাকে। আক্রান্ত গাছে পোকার কীড়া দ্বারা সৃষ্ট ছিদ্র এবং ছিদ্রপথে বের হয়ে আসা মল দেখা যায়। কান্ডের উপরের দিক আক্রান্ত হলে টাসেল, মোচা কিংবা গাছের মাইজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
- এরূপ আক্রান্ত গাছে মাইজ মরা লক্ষণ দেখা যায়। ফলে গাছে মোচা হয় না এবং ফলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়।
দমন ব্যবস্থাপনা:
- ডিমের গাদা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে, পা দিয়ে পিষে বা মাটির নিচে পুঁতে রেখে ধ্বংস করতে হবে।
- চারা অবস্থায় ফেরোমন ফাঁদ ১০ বর্গ মিটার দূরত্বে স্থাপন করে এ পোকা দমন করা যায়।
- আক্রান্ত মাঠে বায়োকীটনাশক যেমন স্পিসোসেড (ট্রেসার অথবা সাকসেস) প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৪ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি মার্শাল ২০ ইসি অথবা ডায়াজিনন ৬০ ইসি ভালোভাবে মিশিয়ে স্প্রে করলে এই পোকা দমন করা যায়।
- ফুরাডান ৫ জি প্রতি হেক্টরে ২০ কেজি হারে অথবা ৩/৪ টি দানা প্রতি গাছের উপরিভাগে এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে যেন দানাগুলো কান্ড এবং পাতার মাঝে থাকে।
ঘ) পাতা খেকো লেদা পোকা
ভুট্টা গাছের চারা অবস্থায় লেদা পোকা পাতা খেয়ে ক্ষতি করতে পারে। পূর্ণবয়স্ক ভুট্টা গাছে পাতা খেকো লেদা পোকার আক্রমণে ক্ষতি হবার সম্ভাবনা কম।
দমন ব্যবস্থাপনা:
পাতা খেকো লেদা পোকা দ্বারা আক্রান্ত গাছে প্রতি লিটার পানির সাথে ১ গ্রাম কীটনাশক (প্রোক্লেইম ৫ এসজি বা ইমাকর ৫ এসজি) মিশিয়ে গাছের উপরিভাগে ভালোভাবে স্প্রে করে ভিজিয়ে দিতে হবে।
ঙ) জাব পোকা
অনেকগুলি পূর্ণাঙ্গ এবং বাচ্চা পোকা একটি ভুট্টা গাছের পাতা, টাসেল এবং মোচায় অবস্থান করে সেখান থেকে রস চুষে খেয়ে গাছের ক্ষতি করে।
দমন ব্যবস্থাপনা:
- জাব পোকা দমনের জন্য প্রতি লিটার পানির সাথে ৫ গ্রাম ডিটারজেন্ট বা সাবানের গুঁড়া মিশ্রিত করে আক্রান্ত গাছে প্রয়োগ করতে হবে।
- এছাড়া প্রতি লিটার পানির সাথে বায়োনিম-১ ইসি বা ফাইটোম্যাক্স-৩ ইসি (১ মিলি) অথবা মেলাডান-৫৭ ইসি (২ মিলি) হারে ভালোভাবে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করে জাব পোকা দমন করা যায়।
চ) মোচার পোকা
ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ভুট্টার মোচার সিল্ক এর ভিতর দিয়ে ঢুকে কচি দানা খেয়ে নষ্ট করে। এ পোকা দ্বারা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলে ভুট্টার ফলন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
দমন ব্যবস্থাপনা:
- উত্তমরূপে জমি চাষ করা, এতে পুত্তলিগুলো বের হয়ে পড়ে এবং পরভোজী পোকা ও পাখি এদের খেয়ে ফেলে।
- আক্রান্ত মোচা হতে কীড়া সংগ্রহ করে মেরে ফেলা।
- চারা অবস্থায় ফেরোমন ফাঁদ ১০ বর্গ মিটার দূরত্বে স্থাপন করে এ পোকা দমন করা যায়।
- আক্রান্ত মাঠে বায়োকীটনাশক যেমন স্পিসোসেড (ট্রেসার অথবা সাকসেস) প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৪ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১ মিলি হারে সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড ১০ ইসি/ফেনম ১০ ইসি) মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
(৫) গোলাজাত ভুট্টা দানার পোকা দমন
ক) গোলাজাত ভুট্টা পোকাসমূহ
চালের শুঁড় পোকা:
স্ত্রী-শুঁড় পোকা ছুঁচালো মুখের সাহায্যে ভুট্টা দানায় ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে কীড়া বের হয়ে দানার ভিতর খেয়ে বড় হয়ে এবং পরে দানা ফুটো করে পূর্ণাঙ্গ পোকা বেরিয়ে আসে। এরা কীড়া অবস্থায় বেশি ক্ষতি করে এবং পূর্ণাঙ্গ পোকাও শস্য দানা খেয়ে নষ্ট করে।
ভুট্টার শুঁড় পোকা:
এ পোকা শুঁড় পোকার মতই তবে দেখতে কিছুটা কাল এবং লম্বায় বড়। এই পোকার আক্রমণ লক্ষণ, ডিম, কীড়া, পুত্তলি ও পূর্ণাঙ্গ পোকার বৈশিষ্ট্যসমূহ চালের শুঁড় পোকার অনুরূপ।
সুরুই পোকা:
ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ভুট্টার দানা ছিদ্র করে ভিতরে প্রবেশ করে। দানার ভিতর কীড়া অবস্থায় কাটায় এবং কুড়ে কুড়ে খেয়ে বড় হতে থাকে এবং দানা নষ্ট করে ফেলে। এ পোকা শুধু কীড়া অবস্থায় ক্ষতি করে থাকে।
খ) গোলাজাত ভুট্টার পোকা দমন ব্যবস্থাপনা
সতকর্তা অবলম্বন:
- ভুট্টা দানা গোলাজাত করার পূর্বে ৩-৪ বার ভালোভাবে রোদে শুকাতে হবে।
- ভুট্টা দানার আর্দ্রতা শতকরা ১০-১২ এর মধ্যে রাখতে হবে।
- দানা গোলাজাত করার পূর্বে গোলাঘরের দেয়ালে বা মেঝেতে কোন রকম ফাটল থাকলে তা বন্ধ করতে হবে। গোলা ঘর ও তার আশপাশ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
- গোলাজাত করার পূর্বে গোলাঘর, ভুট্টা দানা রাখার পাত্র অথবা ছালার ব্যাগ/বস্তা ভালোভাবে পরিষ্কার করে সেভিন বা ম্যালাথিয়ন ১০% পাউডার দ্বারা শোধন করা যেতে পারে।
- গোলা ঘরে প্রয়োজনমতো আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে এবং বৃষ্টির দিনে যেন পানি প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- মেটালিক ড্রাম, ছোট মুখযুক্ত উন্নতমানের টিন এবং ভেতরে পলিথিন দেয়া মাটির মটকায় ভুট্টার দানা সংরক্ষণ করা উত্তম। দানা রাখার পর পাত্রগুলো অবশ্যই ঢেঁকে রাখতে হবে।
- মাঝে মাঝে ভুট্টা দানা রোদে শুকাতে হবে। এতে ভেতরের কীড়া মারা যায়।
কীটনাশক প্রয়োগ:
- প্রতি কেজি শস্য বীজে এক গ্রাম সেভিন বা ম্যালাথিয়ন ১০% পাউডার ব্যবহার করতে হবে।
- গুদামঘরে স্তূপীকৃত প্রতি টন শস্যের জন্য ৩-৬ টি ফসটকসিন ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে।
- গুদামঘরে বস্তায় রাখা স্তূপীকৃত প্রতি ১,০০০ ঘনফুট দানার জন্য ১৫-২৫ টি ফসকটসিন ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে।
ন্যাপথেলিন বলের ব্যবহার:
গোলাজাত করার পূর্বে যে কোন আবব্ধ পাত্রে প্রতি কেজি বীজে ২ গ্রাম ওজনের ৪টি ন্যাপথেলিন বল ১৫-২০ দিন পর্যন্ত রেখে, পরবর্তীতে তা বের করে নিয়ে উক্ত বীজ ভুট্টাকে পুনরায় আবদ্ধ অবস্থায় রেখে ৯ মাস পর্যন্ত পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায়।
নিম তেলের ব্যবহার:
প্রতি কেজি ভুট্টা বীজে ১০ মিলি হারে নিম তেল ব্যবহার করে শুঁড় পোকা দমন করা যেতে পারে।
[সূত্র: বিএআরআই]