সাধারণত পিএইচ মান ৩ এবং ১০ এর মধ্যে পড়ে অথবা ৭ নিরপেক্ষ থাকে। অ্যাসিড বা অম্লীয় মৃত্তিকার ৭ এর নিচে পিএইচ থাকে এবং ক্ষারীয় মৃত্তিকার ৭ এর উপরে পিএইচ থাকে। আল্ট্রা-অ্যাসিডিক মৃত্তিকা (পিএইচ <৩.৫) এবং খুব দৃঢ়ভাবে ক্ষারীয় মাটি (পিএইচ >৯) বিরল।
সহজ ভাষায়, কোন মৃত্তিকা দ্রবণে হাইড্রোজেন আয়নের (H⁺) পরিমাণ বেশি হলে তাকে অম্লীয় মৃত্তিকা বলে।
অপরদিকে, কোন মৃত্তিকা দ্রবণে যদি হাইড্রোক্সিল আয়নের (OH⁻) গাঢ়ত্ব বেশি হয় তাকে ক্ষারীয় মৃত্তিকা বলে।
এই দুটি বিষয় নিয়েই আজকের এই আলোচনা।
এই পাঠটি শেষ অবধি পড়লে আপনি-
মৃত্তিকা বা মাটির অম্লত্ব কি, মাটির অম্লত্ব কাকে কলে তা বলতে পারবেন; মৃত্তিকার অম্লত্বের প্রকারভেদ জানতে পারবেন; pH সমীকরণ বুঝতে পারবেন; মাটির অম্লত্ব বৃদ্ধি পায় কেন তার কারণগুলো ও মাটির অম্লত্ব দূর করার উপায় সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন; pH ভিত্তিক অম্লত্বের শ্রেণীবিন্যাস করতে পারবেন; মাটির অম্লত্বের গুরুত্ব বুঝতে পারবেন।
মৃত্তিকা বা মাটির ক্ষারত্ব কী, মাটির ক্ষারত্ব কাকে বলে তা বলতে পারবেন; ক্ষারকীয় মৃত্তিকা ও লবণাক্ত মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য জানতে পারবেন; মাটির ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায় কেন তার কারণ সমূহ সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন; ক্ষার মাটি ও গাছপালার যে ক্ষতি সাধন করে তা উপলব্ধি করতে পারবেন; মাটির ক্ষারত্ব দূর করার উপায় বা মাটির ক্ষারত্ব দূর করতে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তা বুঝতে পারবেন; ক্ষার মাটি পূণরুদ্ধার পদ্ধতি শিখতে পারবেন।
মৃত্তিকা অম্লত্ব ও মৃত্তিকা ক্ষারত্বের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারবেন।
লিটমাস পেপারের সাহায্যে মাটির অম্লতা ও ক্ষারত্ব শনাক্তকরণ পরীক্ষা ও pH মিটারের সাহায্যে মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা শিখতে পারবেন।
(১) মাটির অম্লত্ব কী বা কাকে বলে? মাটির অম্লত্ব বৃদ্ধি পায় কেন? মাটির অম্লত্ব দূর করার উপায়
ক) মাটির অম্লত্ব কী বা কাকে বলে?
মাটির অম্লত্ব কী: মৃত্তিকা দ্রবণের (pH) পিএইচ দ্বারা মৃত্তিকা অম্লত্ব জানা যায়। মৃত্তিকা অম্লীয় হলে তখন মৃত্তিকা পিএইচ (pH) এর মান ৭ এর কম হবে। হাইড্রোজেন আয়নের ঘনত্ব বা গাঢ়ত্ব দ্বারা পিএইচ সনাক্ত করা যায়। মৃত্তিকার (pH) পিএইচ কে মৃত্তিকা বিক্রিয়াও বলা হয়। সুতরাং মৃত্তিকা পিএইচ হলো হাইড্রোজেন আয়ন ঘনত্বের (H⁺) ঋণাত্মক লগারিদম।
মাটির অম্লত্ব কাকে বলে: মৃত্তিকা দ্রবণে হাইড্রোজেন আয়ন ঘনত্বের (H⁺) পরিমাণ বেশি হলে তাকে অম্লীয় মৃত্তিকা বলে। মৃত্তিকা পিএইচ (pH) হলো মৃত্তিকা দ্রবনের হাইড্রোজেন আয়ন ঘণত্বের বিপরীত রাশির লগারিদম। অর্থ্যাৎ pH = log (1 ÷ [H⁺])।
হাইড্রোজেন আয়ন ঘণত্বের বা গাঢ়ত্বের একক হলো গ্রাম/লিটার তবে pH এর কোন একক নেই। মৃত্তিকার pH দ্বারা মৃত্তিকার অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব নির্দেশ করে। হাইড্রোজেন আয়নের [H⁺] সক্রিয়তাই মৃত্তিকা অম্লত্বের জন্য দায়ী।
খ) অম্লীয় মাটির বৈশিষ্ট্য
নিচে অম্লীয় মাটির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো-
- অম্লীয় মাটির পিএইচ ৭ এর কম হবে।
- মাটির অম্লত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে মাটিস্থ অণুজীব যেমন ছত্রাকের কার্যাবলী বেড়ে যায়।
- অম্লত্ব বৃদ্ধি পেলে অণুজীব ব্যাকটেরিয়ার কার্যাবলী কমে যায়।
- অম্লীয় মাটিতে নাইট্রোজেনের অপচয় কম হয়।
- এ মাটিতে ফসল চাষ করতে হলে চুন প্রয়োগ করতে হয়।
- অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও লৌহ এর আধিক্যেও মাটি বিষাক্ত হতে পারে।
- মাটিতে ফসফরাজ, জিংক ও কোবাল্টের সহজ লভ্যতা কমে যায়।
- অম্ল মাটিতে বীজের অঙ্গুরোদগম হয় না অথবা ভাল হয় না।
- তবে অম্ল সহনশীল ফসল যেমন আনারস, লেবু, চা, কফি ইত্যাদি অম্লীয় মাটিতে ভাল জন্মে।
গ) মাটির অম্লত্বের শ্রেণীবিভাগ
মাটির অম্লত্বকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
- সক্রিয় অম্লত্ব: সক্রিয় অম্লত্ব হলো মৃত্তিকা দ্রবণে যে পরিমাণ হাইড্রোজেন আয়ন pH মুক্ত অবস্থায় থাকে।
- পটেনসিয়াল বা প্রছন্ন অম্লত্ব: পটেনিয়িাল বা প্রছন্ন অম্লত্ব হলো কর্দম কণা বা কলয়েডে যে পরিমাণ হাইড্রোজেন আয়ন (H⁺) আবদ্ধ বা শোষিত অবস্থায় থাকে।
সুতরাং আমরা বলতে পারি, মোট অম্লত্ব = সক্রিয় অম্লত্ব + প্রছন্ন অম্লত্ব।
পিএইচ (pH) মানভিত্তিক মাটির অম্লত্বের শ্রেণীবিন্যাস পিএইচ (pH) মান অনুযায়ী মাটি ৩ ধরনের হয়ে থাকে। যথা-
- অম্লীয় মাটি → পিএইচ (pH) ৩.৫-৬.৫;
- ক্ষারীয় মাটি → পিএইচ (pH) ৬.৬-৯.০; ও
- নিরপেক্ষ বা প্রশম মাটি → পিএইচ (pH) ৬.৬-৭.৩।
পিএইচ মান ভিত্তিক মাটির অম্লত্বের শ্রেণীবিভাগ-
মাটির অম্লত্ব | পিএইচ (pH) মান |
১। খুব বেশি অম্লীয় | ৪.০ এর কম |
২। বেশি অম্লীয় | ৪.০-৪.৯ |
৩। অম্লীয় | ৫.০-৫.৯ |
৪। সামান্য অম্লীয় | ৬.০-৬.৯ |
ঘ) পিএইচ সমীকরণের গাণিতিক ব্যাখ্যা
নিম্নের সমীকরণের সাহায্যে পিএইচ নির্ণয় করা যায়-
পিএইচ pH = -log[H⁺] বা, log (1 ÷ [H⁺])
এখানে, [H⁺] হাইড্রোজেন আয়নের ঘনত্ব/গাঢ়ত্ব (গ্রাম/লিটার)।
কোন দ্রবণে সক্রিয় হাইড্রোজেন আয়নের ঘনত্ব [H⁺] যত বেশি হবে তার পিএইচ (pH) মান তত কম হবে এবং অম্লত্ব তত বৃদ্ধি পাবে। উদাহরণস্বরূপ কোন দ্রবণের pH এর মান ৪ হলে সে দ্রবণের pH ৪ এর [H⁺], pH ৫ এর তুলনায় দশগুণ বেশি হবে এবং pH ৩ এর চেয়ে দশগুণ প্রত্যেক ছোট এককের [H⁺] তার পরবর্তী বড় এককের [H⁺] দশগুণ বেশি। তাই অম্লত্ব দশগুণ বেশি হয়।
কোন দ্রবণের পিএইচ এর মান ১,২,৩,৪ ………………… ১৪ হলে সে দ্রবণে সক্রিয় হাইড্রোজেন আয়নের গাঢ়ত্ব যথাক্রমে ১০⁻¹, ১০⁻², ১০⁻³, ১০⁻⁴ …………. ১০⁻¹⁴ হবে।
পিএইচ [pH] অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব নির্দেশক স্কেলের সাহায্য নির্ণয় করা যায়। অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব স্কেল ১ থেকে ১৪ একক নির্দিষ্ট থাকে।
ঙ) মাটির অম্লত্ব বৃদ্ধি পায় কেন?
- মৃত্তিকায় বিদ্যমান অণুজীব ও উদ্ভিদ মূলের শ্বসনের ফলে CO2 উৎপন্ন হয়। পরে এই CO2 মৃত্তিকার পানির সাথে বিক্রিয়া করে H+ আয়ন উৎপন্ন করে H2O+CO2 → H++ HCO3- মৃত্তিকায় বায়ুর CO2 কম বাফার সম্পন্ন মাটির পিএইচ উপরোক্ত বিক্রিয়ার মাধ্যমে কমিয়ে দেয়।
- মাটিতে প্রধানত এমোনিয়াম সার যেমন এমোনিয়াম সালফেট, এমোনিয়াম নাইট্রেট ও অম্ল উৎপাদনকারী সার যেমন ফেরাস সালফেট প্রয়োগ করে তা মাটিতে আর্দ্র বিশ্লেষিত হচ্ছে। সালফিউরিক এসিড উৎপন্ন করে যার ফলে মৃত্তিকায় অম্লত্ব বৃদ্ধি পায়।
- কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রিক অক্সাইড প্রভৃতি যৌগ বায়ুতে মিশে থাকে এবং বৃষ্টির পানিতে দ্রবীভূত হয়ে মাটিতে নেমে আসে ফলে এসিডের উৎস হিসাবে কাজ করে।
- অধিক বৃষ্টিপাত সম্পন্ন বৃষ্টির পানি ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম লবণের ক্ষয় বা অপচয় ঘটায়। মৃত্তিকা পানিতে কার্বন ডাই অক্সাইড দ্রবীভূত হয়ে কার্বনিক এসিড উৎপন্ন করে ফলে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম লবণের ক্ষয় ঘটে এটি অম্লত্ব সৃষ্টির অন্যতম কারণ হয়।
- গ্রানাইট, রায়োলাইট, বালি, পাথর ও এসব অম্লীয় শিলায় ক্ষারীয় উপাদানের চেয়ে সিলিকার পরিমাণ বেশি থাকে।
- প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে এসব শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে দ্রবণে সিলিসিক এসিড উৎপন্ন করে ফলে মাটির অম্লত্ব বৃদ্ধি পায়।
- জৈব পদার্থের বিয়োজনের ফলে মাটিতে প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয় যা আদ্রবিশ্লেষিত হয়ে H+ আয়ন উৎপন্ন করে যা অম্লত্ব বাড়ায়। CO2+ H2O → H2CO3H⁺+ CO3-।
- কোন জমিতে ফসল উৎপাদনের তীব্রতা যতই বাড়ে ক্ষারের পরিমাণ ততই কমে এবং অম্লত্বা বৃদ্ধির আশংকা বাড়ে। আবার ঋতু অনুযায়ী অম্লত্ব সামান্য বাড়ে বা কমে।
- বিজারিত সালফার ও নাইট্রোজেন যৌগ অক্সিজেন ও বিচূর্ণীভবনের মাধ্যম সালফিউরিক ও নাইট্রিক এসিড উৎপন্ন করে যা H⁺ আয়ন উৎপন্ন করে ফলে অম্লত্ব বৃদ্ধি পায়।
- আমাদের বাংলাদেশের অনেক উঁচু ও মাঝারি উঁচু পলিমাটি অম্লীয় ধরনের হয়।
অত্যাধিক অম্লতা ফসল উৎপাদনের জন্য ক্ষতিকর। মাটির বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ভিন্ন ভিন্ন পিএইচ এ গাছের জন্য সহজ লভ্য হয়। সেজন্য ফসল উৎপাদনের জন্য মাটির একটি উপযোগী অম্লত্ব নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। অধিক অম্লীয় মাটি বিভিন্ন কৌশল ও পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে সংশোধন করা যায়।
চ) মাটির অম্লত্ব দূর করার উপায়
অম্লীয় মাটি সংশোধনের বা মাটির অম্লত্ব দূর করার উপায়সমূহ নিম্নরূপ-
i) চুন প্রয়োগের মাধ্যমে মাটির অম্লত্ব দূর করা
মাটি থেকে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম অপসারিত হলে মাটিতে অম্লত্ব সৃষ্টি হয়। জমির অম্লীয় মাটি চুন প্রয়োগ করে তাকে ফসল উৎপাদনের জন্য উপযোগী করা যায়।
জমিতে বিভিন্ন চুন জাতীয় পদার্থ যেমন-কুইকলাইম (CaOMgO), ক্যালসাইট (CaCO3), ডলোমাইট [CaMgCO3)2], ম্যাগনেসাইট (MgCO3) কালিচুন Ca(OH)2, Mg (OH)2], ইত্যাদি প্রয়োগ করা হলে এগুলো বিয়োজিত হয়ে Ca++ বা Mg++ উৎপন্ন করে যা আয়ন বিনিময় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃত্তিকা কলয়েডের H+ কে প্রতিস্থাপন করে মাটির অম্লতা কমায়।
ii) জৈব সার ব্যবহার করে মাটির অম্লত্ব দূর করা
মাটিতে নিয়মিত বিভিন্ন জৈব সার, যেমন-গোবর সার, সবুজ সার, কম্পোস্ট, খামার জাত সার, কেঁচো সার, অণুজীব সার, ট্রাইকোডার্মা, বায়োপেস্টিসাইড ইত্যাদি প্রয়োগ করলে মাটির বাফার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং অম্লত্ব হ্রাস করে। মাটির বাফারিং ক্ষমতা মাটির pH পরিবর্তনে বাধা প্রদান করে এবং pH মানকে স্থির রাখে।
জৈব সারের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম থাকে যা মৃত্তিকা দ্রবণের H⁺ আয়নকে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মাটির অম্লত্ব হ্রাস করে।
অম্লত্ব দূরীকরণে কয়েকটি জৈব সারের ভূমিকা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
- সবুজ সার ব্যবহার: সবুজ সার শস্য যেমন- ধৈঞ্চা, আলফা, শন, ছোলা, বরবটি, সয়াবিন ইত্যাদি নির্দিষ্ট বয়সে সবুজ অবস্থায় অম্লীয় মাটিতে মিশিয়ে দিলে জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা মাটির বাফার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সাধারণত লিগিউম জাতীয় উদ্ভিদ সবুজ সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ সকল উদ্ভিদের শিকড়ে রাইজোরিয়াম ব্যাকটেরিয়া নডিউল সৃষ্টি করে যা বায়ুমন্ডলের মুক্ত নাইট্রোজেনকে সংবদ্ধ করে। মাটির নাইট্রোজেনের পরিমাণ ও বৃদ্ধি পায় এবং জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয় না। এ সকল কারণে সবুজ সার ব্যবহারে মাটির অম্লত্ব হ্রাস পায়।
- বায়োফার্টিলাইজার বা অণুজীব সার ব্যবহার: বিভিন্ন প্রকার অণুজীর সার যেমন- রাইজোবিয়াম, অ্যাজোলা, অ্যাজোটোব্যাক্টার, ইত্যাদি অম্লীয় মাটিতে ব্যবহার করার ফলে মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমানে হিউমাস উৎপন্ন হয় এবং মাটির বাফার ক্ষমতা উন্নত হয়। আবার, অনুজীব সারসমূহ বায়ুমন্ডল থেকে প্রচুর পরিমানে মুক্ত নাইট্রোজেন মাটিতে ও উদ্ভিদের শিকড়ে যুক্ত করে। কাজেই, মাটিতে অম্লত্ব বৃদ্ধিকারী নাইট্রোজেন ঘটিত রাসায়নিক সার যেমন- ইউরিয়া, অ্যামোনিয়াম সালফেট, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ইত্যাদি প্রয়োগের মাত্রা কমে যায়। ফলে মাটির অম্লত্ব দূর হয়।
- ট্রাইকোডার্মা ব্যবহার: ট্রাইকোডার্মা পরিবেশ বান্ধব উপকারী ছত্রাক। এটি মাটি বাহিত রোগ দমন ও মাটির গুণাগুন বৃদ্ধির জন্য বিশ্বব্যাপী সরাসরি মাটিতে ব্যবহার করা হয়। এটি মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করে এবং ক্ষতিকারক রোগের জীবাণু ধ্বংস করে। ট্রাইকোডার্মা জৈব পদার্থ দ্রুত পঁচিয়ে জৈব সার তৈরি করে যা মাটিতে মিশে মাটি অম্লত্ব হ্রাস করে।
iii) বায়োপেস্টিসাইড বা জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে মাটির অম্লত্ব দূর করা
শস্য উৎপাদনে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পেষ্টিসাইড ব্যবহার করা হয়।
এগুলো ব্যয়বহুল পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক এবং মাটিতে অম্লত্বের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ হতে প্রাপ্ত বিভিন্ন জৈব বালাই নাশক যেমন-নিমপাতা, তামাক, নীম বীজ, আতাপাতা, ও খেজুর পাতার নির্যাস ইত্যাদি মাটিতে ও ফসলে স্প্রে করলে মাটিবাহিত ও উদ্ভিদের পোকামাকড় দমন হয় এবং মাটির সক্রিয় H⁺, Al³⁺ এর পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে মাটির অম্লত্ব কমে যায়।
iv) সেচের পানির মান উন্নয়ন করে মাটির অম্লত্ব দূর করা
সেচের পানির অম্লতের কারণেও মাটির অম্লতা বৃদ্ধি পায়। সেজন্য ফসলের জমিতে সেচের পানি প্রয়োগ করার পূর্বে পানির গুণগত মান পরীক্ষা করে সেচ দিতে হবে যাতে অম্লীয় মাটি সৃষ্টি হওয়া রোধ করা যায়। এক্ষেত্রে সেচের পানিতে যাতে অ্যালুমিনিয়াম (Al), আয়রন (Fe) প্রভৃতি খনিজ লবণ না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
v) অম্লীয় সারের ব্যবহার কমিয়ে মাটির অম্লত্ব দূর করা
অম্লত্ব সৃষ্টিকারী রাসায়নিক সার বিশেষ করে নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ সার যেমন- ইউরিয়া, অ্যামোনিয়াম সালফেট প্রভৃতি জমিতে প্রয়োগ করলে মাটির অম্লত বৃদ্ধি পায়। সুতরাং এর বিকল্প হিসেবে ক্ষারীয় সার যেমন- সোডিয়াম নাইট্রেট [NaNO3], ক্যালসিয়ামনাইট্রেট [Ca(NO3)2], বেসিক স্ল্যাগ ইত্যাদি জমিতে ব্যবহার করে অম্লত্ব যায়।
vii) কাঠের ছাই প্রয়োগ করে মাটির অম্লত্ব দূর করা
মাটিতে পরিমাণ মত কাঠের ছাই প্রয়োগ করলে অম্লত্ব দূর হয়। কাঠের ছাইয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম বিদ্যমান থাকায় মৃত্তিকার অম্লতা হ্রাস পায়।
ছ) মাটির অম্লত্বের গুরুত্ব
- মৃত্তিকার অম্লমানের সাহায্যে মাটির উর্বরতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়।
- অম্লীয় মৃত্তিকায় বীজের অংকুরোদগম ভালো হয় না এবং ফসলের বেড়ে ওঠার উপর প্রভাব ফেলে।
- মৃত্তিকার পিএইচ এর সাহায্যে কোন জমিতে কোন ফসল ভালো জন্মে এবং কোন সার কতটুকু পরিমাণ দিতে হবে তা জানা যায়।
- অম্ল মাটিতে চা, কফি, আনারস, ব্লুবেরী ইত্যাদি ফসলের বৃদ্ধি ভালো হয়।
- মৃত্তিকায় বিদ্যমান অণুজীবের কার্যাবলী, রাসায়নিক সারের রূপান্তর ও জৈব পদার্থের বিয়োজন অম্লত্বের কারণে হ্রাস পায়।
- মৃত্তিকার অম্লত্ব ক্যাটায়ন বিনিময় ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে।
- মৃত্তিকার অম্লতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, সালফার এর দ্রবণীয়তা হ্রাস পায়।
- শীত প্রধান দেশে মৃত্তিকার pH এর মান ৪ এর কম হলে সে জমি চারন ভূমি হিসাবে ব্যবহার করা হয় কারণ সেখানে অধিকাংশ গাছ পালা জন্মায় না অথবা দূর্বল গাছ পালা জন্মায় সেখানে উৎপাদনের হার খুবই কম।
(২) মাটির ক্ষারত্ব কী বা কাকে বলে? মাটির ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায় কেন? মাটির ক্ষারত্ব দূর করার উপায়
ক) মাটির ক্ষারত্ব কী বা কাকে বলে? ও লবণাক্ততা সংঙ্গা
আমরা পূর্বের পাঠ থেকে জানতে পেরেছি কোন মৃত্তিকা দ্রবণে হাইড্রোজেন আয়নের (H⁺) পরিমাণ বেশি হলে তাকে অম্লীয় মৃত্তিকা বলে।
মাটির ক্ষারত্ব কী বা কাকে বলে: কোন মৃত্তিকা দ্রবণে যদি হাইড্রোক্সিল আয়নের (OH⁻) গাঢ়ত্ব বেশি হয় তাকে ক্ষারীয় মৃত্তিকা বলে। ক্ষারীয় মৃত্তিকার পিএইচ (pH) মান সবসময় ৭ এর চেয়ে বেশি। ক্ষার জাতীয় লবণ যেমন সোডিয়াম কার্বনেট, ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেট ও পটাসিয়াম কার্বনের হাইড্রোক্সিল আয়নের সাথে একত্রিত হয়ে ক্ষারত্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
মাটির লবণাক্ততা কী বা কাকে বলে: মৃত্তিকা লবণাক্ততা হচ্ছে যখন মৃত্তিকা দ্রবণে দ্রবণীয় লবণের পরিমাণ বিশেষ করে সোডিয়াম কে ক্লোরাইডের পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে যায় তাকে লবণাক্ত মৃত্তিকা বুঝায়। অর্থ্যাৎ, যে মৃত্তিকা সোডিয়াম লবণের তড়িৎ বিশ্লেষণের ফলে উৎপন্ন হয় তাকে লবণাক্ত মৃত্তিকা বলে।
খ) ক্ষারীয় মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য
- পিএইচ (pH) মান ৮.৫-১০।
- বিনিময়যোগ্য সোডিয়ামের পরিমাণ ১৫% এর বেশি থাকে।
- জৈব পদার্থ পরিমাণে কম থাকে।
- শুকনো মৌসুমে মাটির উপরের আবরনে কালো চাপ বাঁধা স্তর দেখা যায়। এজন্য একে কালো ক্ষার বলে।
- বার্লি, খেজুর-বাবলা বিশেষ করে যে সকল ফসল লবণ সহ্য করতে পারে সেসব ফসল ভালো জন্মে।
- সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে, কিন্তু দ্রবণীয় লৌহ ও ম্যাঙ্গানিজের পরিমাণ কম থাকে।
গ) লবণাক্ত মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য
- পিএইচ (pH) মান ৭-৮.৫।
- শুকনো মৌসুমে মৃত্তিকার উপরের আবরনে সাদা চাপা বাধা স্তর দেখা যায়। এজন্য একে সাদা ক্ষার বলে।
ঘ) মাটির ক্ষারত্বের শ্রেণীবিভাগ
সাধারনত ক্ষারীয় মাটি তিন প্রকারের হতে পারে-
- ক্ষার মাটি (Alkaline soil)
- লোনা বা লবণাক্ত মাটি (Saline soil)
- চুনা মাটি (Calcarious soil)
পিএইচ মান ভিত্তিক মাটির ক্ষারত্বের শ্রেণীবিভাগ-
মাটির ক্ষারত্ব | পিএইচ (pH) মান |
১। সামান্য ক্ষারীয় | ৭.১-৮.০ |
২। মধ্যম ক্ষারীয় | ৮.১-৯.০ |
৩। বেশি ক্ষারীয় | ৯.১-১০.০ |
৪। খুব বেশি ক্ষারীয় | ১০.০ এর বেশি |
ঙ) মাটির ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায় কেন? ও লবণাক্ততার কারণ
মৃত্তিকার ক্ষারত্ব ও লবণাক্ততা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। তবে ক্ষারত্বের ও লবণাক্ততা প্রায় একটি কারণে হয়ে থাকে। কেননা মাটিতে লবণের পরিমাণ বেশি হলে মাটির ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায়। কারণসমূহ নিম্নরূপ-
- লোনা পানিতে লবণের পরিমাণ এবং সোডিয়াম কার্বনেটের পরিমাণ খুব বেশি থাকে। সমুদ্রের লোনা পানি দিয়ে জমি নিয়মিত প্লাবিত হলে সে জমির লবণাক্ততা বেড়ে যায় যার ফলে মাটি ক্ষারীয় হয়।
- ক্ষারীয় শিলার চূর্ণবিচুর্নের ফলে মৃত্তিকা ক্ষারীয় হয়। ক্ষারীয় শিলা হতে গঠিত মৃত্তিকা ক্ষারীয় বিক্রিয়া প্রদর্শন করে। উদহারণস্বরূপ ডলোমাইট চুন, চুনাপাথর কুইকলাইম হতে গঠিত মৃত্তিকায় চুনের আধিক্য বেশি থাকে।
- অধিক লবণযুক্ত পানি দিয়ে ক্রমাগত জমিতে সেচ দিলে সে মাটির লবণাক্ততা ও ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায়।
- অবিরাম ঘেরে চিংড়ি মাছ চাষের ফলে সে জমির মাটিতে ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায়।
- জলবায়ুর প্রভাবে শুস্ক ও অবশুস্ক এলাকায় বৃষ্টিপাত খুব কম হয় বলে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম আয়নের চুয়ানি অনেকাংশে কমে যায় যার ফলে মৃত্তিকার উপরের স্তরে লবণের পরিমাণ বেশি থাকে এবং ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায়।
চ) মাটির ক্ষারত্ব দূর করার উপায়
নিম্নলিখিত উপায়ে মাটির ক্ষারত্ব দূর করা যেতে পারে-
i) জিপসাম প্রয়োগ করে মাটির ক্ষারত্ব দূর করা
জিপসাম হল ক্যালসিয়াম ও সালফার সমৃদ্ধ রাসায়নিক সার। এটি প্রয়োগ করে মাটির ক্ষারত্ব দূর করা যায়। মাটির ক্ষারত্বের প্রধান কারণ হল সোডিয়াম (Na⁺) আয়নের আধিক্য। জিপসামের ক্যালসিয়াম আয়ন (Ca⁺) মাটির কলয়েড থেকে সোডিয়াম আয়নকে অপসারিত করে এবং সোডিয়াম আয়ন দ্রবণে চলে এসে সোডিয়াম সালফেট (Na2SO4) নামক যৌগ উৎপন্ন করে। এ যৌগটি পানিতে দ্রবীভূত হয়ে লিচিং এর মাধ্যমে জমির ক্ষারত্ব কমায়।
Na⁺ + CaSO4 Ca++ + Na2SO4
ii) সালফার বা গন্ধক ব্যবহার করে মাটির ক্ষারত্ব দূর করা
জমিতে সালফার (S) ব্যবহার করলে তা মাটিস্থ বায়ু দ্বারা জারিত হয়ে এবং পানির সাথে বিক্রিয়া করে সালফিউরিক এসিড (Na2SO4) তৈরি করে। সালফিউরিক এসিড সোডিয়াম যৌগের সাথে বিক্রিয়া করে সোডিয়াম সালফেট (Na2SO4) তৈরি করে এবং মাটি থেকে লিচিং হয়ে ক্ষারত্ব কমায়।
S+O2 SO2 | SO2+H2O → + H2SO4
H2SO4 +Na2CO3 → Na2SO4+H2O+ CO2
iii) জৈব সার ব্যবহার করে মাটির ক্ষারত্ব দূর করা
জমিতে পরিমাণমত জৈব সার যেমন- বায়োফাটির্ লাইজার অনুজীব সার, ট্রাইকোডার্মা, বায়োপেস্টিসাইড, সবুজ সার, কম্পোস্ট ইত্যাদি ব্যবহার করে মাটির ক্ষারত্ব কমানো যায়। বিভিন্ন অনুজীবসার যেমন রাইজোবিয়াম, মাইকোরোইজা, ট্রাইকোডার্মা, ফসফেট ব্যকটেরিয়া ইত্যাদি প্রয়োগ করলে জৈব পদার্থের বিয়োজনে জৈব এসিড উৎপন্ন হয় যা মাটির সোডিয়াম আয়নকে অপসারিত করে দ্রবণে নিয়ে আসে। ফলে মাটির ক্ষারত্ব দূর হয়।
iv) সেচ ও নিকাশ এর মাধ্যমে মাটির ক্ষারত্ব দূর করা
মাটির ক্ষারত্ব কমানোর জন্য মাটি থেকে লবণ সরিয়ে দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন লবণমুক্ত পানি সেচ এবং নিষ্কাশন। এ পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণ পানি দিয়ে জমিকে প্লাবিত করা হয়। এতে জমির ক্ষারীয় লবণ পানির সাথে দ্রবীভূত হয়। পরে পানি নিষ্কাশন করলে মাটির ক্ষারত্ব কমে।
v) সহনশীল ফসলের চাষ করে মাটির ক্ষারত্ব দূর করা
যেসব জমিকে ক্ষারমুক্ত করা যায় না, সেখানে ক্ষার সহনশীল ফসলের চাষ করেও মাটির ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ক্ষার সহনশীল উদ্ভিদ হলো-সুগারবীট, খেজুর, নারিকেল, গাজর, বার্লি, টমেটো, তুলা, ধান, গম, ভুট্টা, ইত্যাদি।
ছ) মাটির ক্ষারত্ব ও লবণাক্ততার কারণে ফসল উৎপাদনে বাধাসমূহ
- শুকনো মৌসুমে মানসম্পন্ন পানির অভাব দেখা দেয়।
- লবণের গাঢ়তা বা ক্ষারের আধিপত্য বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বিনষ্ট করে দেয়।
- গাছপালার সুষম বৃদ্ধিতে বিঘ্ন সৃষ্টি দেয়।
- লবণের বা ক্ষারের তীব্রতায় শিকড়ের বিস্তার বাধাপ্রাপ্ত হয় এমনকি চারাগাছ মরে যায়।
- সোডিয়ামের প্রাচুর্যে মাটিতে বিষাক্ততা দেখা যায়।
- ক্ষারের তীব্রতা সহ্য করতে না পারায় গাছের পাতা পুড়ে যায়।
- পানি নিস্কাশনের অভাবে সারা বছর জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে।
- নিষ্কাশন বিলম্বিতত হওয়ায় রবি শস্য চাষাবাদ ব্যাহত হয়।
জ) মাটির ক্ষারত্ব পুনরুদ্ধার পদ্ধতি
ক্ষার মাটিতে বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে পুনরুদ্ধার সম্ভব। যথা-
- পানি নিস্কাশন;
- লোনা পানির প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের জন্য বাধ ও সুইচ গেট নির্মাণ করা;
- সোডিয়ামের পরিমাণ কমানোর জন্য ক্যালসিয়াম সালফেট বা জিপসাম প্রয়োগ করা;
- সেচ দিয়ে প্লাবিত করা;
- উপরে মাটি চাচিয়া পরিস্কার করা;
- বাস্পায়ন কমাবার ব্যবস্থা করা, যেমন: মালচিং প্রয়োগ করা;
- সেচ খাল ও নালা পাকা করা;
- পর্যাপ্ত পরিমাণে জৈব ও সবুজ সার প্রয়োগ;
- অন্য স্থান থেকে উবরর্ মাটি আনয়ন করে তা ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে;
- গভীর সেচ ও স্বাদু পানি দিয়ে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে;
- লবণ ও ক্ষার সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন করতে হবে;
- উপযুক্ত চাষাবাদ পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
(৩) মাটির অম্লত্ব ও মাটির ক্ষারত্বের মধ্যে পার্থক্য
মাটির অম্লত্ব | মাটির ক্ষারত্ব |
১। মৃত্তিকা দ্রবণে হাইড্রোজেন (H⁺) আয়নের পরিমাণ বেশি থাকে। | ১। মৃত্তিকা দ্রবণে হাইড্রোক্সিল (OH⁻) আয়নের পরিমাণ বেশি থাকে। |
২। পিএইচ (pH) মান ৭ এর কম | ২। পিএইচ (pH) মান ৭ এর বেশি |
৩। পিএইচ (pH) মান বাড়ার সাথে সাথে অম্লত্ব কমতে থাকে। | ৩। পিএইচ (pH) মান বাড়ার সাথে সাথে ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। |
৪। সোডিয়ামের পরিমাণ খুব বেশি থাকে না। | ৪। সোডিয়ামের পরিমাণ খুব বেশি থাকে। |
৫। মৃত্তিকা অম্লত্ব কমানোর জন্য চুন প্রয়োগ করতে হয়। | ৫। মৃত্তিকা ক্ষারত্ব কমানোর জন্য ছাই জিপসাম ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হয়। |
৬। চা-কফি, ব্লুবেরী ইত্যাদি ফসল ভাল জন্মে। | ৬। বার্লি-খেজুর নারিকেল ইত্যাদি ফসল ভাল জন্মে। |
(৪) লিটমাস পেপার ও pH মিটারের সাহায্যে মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব চিহ্নিতকরণ পরীক্ষা
ক) লিটমাস পেপারের সাহায্যে মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব চিহ্নিতকরণ পরীক্ষা
তত্ব: তৈরিকৃত মৃত্তিকা দ্রবণের হাইড্রোজেন আয়ন (H⁺) ও হাইড্রোক্সিল আয়ন (OH⁻) এর সাথে লিটমাস পেপারের বিক্রিয়ার রঙ পরিবর্তন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব নির্ণয় করা যায়। তবে এ পদ্ধতিতে মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্বের মাত্রা নির্ণয় করা যায় না।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- নমুনা মাটি
- লাল ও নীল লিটমাস পেপার
- ৩। বিকার
- পানি ভর্তি ওয়াস বোতল
- ৫। কাঁচ দন্ড
কার্যপ্রণালি:
- নির্বাচিত মাঠ থেকে নমুনা সংগ্রহ করুন।
- সংগৃহীত মাটিগুলো পরীক্ষাগারে শুকিয়ে গুঁড়া করুন।
- ৫০ গ্রাম নমুনা মাটি একটি পরিষ্কার বিকারে নিন।
- বিকারে ১২৫ থেকে ১৫০ মিলি পানি অল্প অল্প করে ঢালুন আরা নাড়ানী কাঠি বা কাচ দন্ড দিয়ে ৩০ মিনিট বিরতিহীনভাবে ভালোভাবে নাড়তে থাকুন। এক্ষেত্রে নাড়ানী যন্ত্র (Shaker) ব্যবহার করাই ভাল।
- এবার লাল ও নীল লিটমাস পেপার মৃত্তিকা দ্রবণের ভেতর ৩০ সেকেন্ড ডুবিয়ে রাখুন এবং লিটমাস পেপারের রং পরিবর্তন লক্ষ্য করুন।
পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত:
ক্রমিক নং | পর্যবেক্ষণ | সিদ্ধান্ত |
১। | মৃত্তিকা দ্রবণে নীল লিটমাস পেপার লাল হল এবং লাল লিটমাস পেপারের রং অপরিবর্তিত থাকল | অম্লীয় মাটি |
২। | মৃত্তিকা দ্রবণে লাল লিটমাস পেপার নীল হল এবং নীল লিটমাস পেপারের রং অপরিবর্তিত থাকল | ক্ষারীয় মাটি |
৩। | মৃত্তিকা দ্রবণে উভয় (লাল ও নীল লিটমাস পেপারের রং অপরিবর্তিত থাকল) | নিরপেক্ষ মাটি |
ফলাফল: প্রদত্ত নমুনাটি অম্লীয়/ক্ষারীয়/নিরপেক্ষ মাটি।
সতর্কতা:
- মৃত্তিকা দ্রবণ তৈরির জন্য নিরপেক্ষ মানের পানি ব্যবহার করতে হবে।
- লিটমাস পেপারের রং ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
খ) pH মিটারের সাহায্যে মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব চিহ্নিতকরণ পরীক্ষা
মূলনীতি: মৃত্তিকার অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব বিভিন্নভাবে নির্ণয় করা যায়। তবে সবচেয়ে সহজ হল pH মিটার পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে অম্লত্ব ও ক্ষরত্বের মান বা pH নির্ণয় করা যায়। pH মিটার ব্যবহার করে খুব সহজে এবং দ্রুততার একসাথে অনেকগুলো নমুনা মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব পরিমাপ করা যায়।
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- pH মিটার
- নমুনা মাটি
- বাফার দ্রবণ
- পরিশোধিত পানি
- ওয়াশ বোতল
- বিকার ও গ্লাস রড
- ৫০ মিলি পরিমাপক সিলিন্ডার
কার্যপ্রণালি:
- ৫০ মিলি মাপের একটি পরিষ্কার বিকার নিন।
- প্রদত্ত নমুনা মাটি থেকে ১:২.৫ অনুপাতে মাটি ও পানি নিতে হবে। যেমন ১০ গ্রাম মাটি নিয়ে ২৫ মিলি পানি ঢালুন।
- কিছুক্ষণ পর পর কাঁচের দন্ড দিয়ে ২০-৩০ মিনিট ধরে মাটি ও পানির দ্রবণ নাড়নী।
- মাটির দ্রবণসহ বিকারটি ১ ঘন্টা টেবিলের উপর রাখুন যাতে নিচে মাটির তলানি জমে।
- বাফার দ্রবণ দিয়ে pH মিটারের মান ঠিক করে নিন।
- এবার pH মিটার দিয়ে দ্রবণের রিডিং নিন। প্রাপ্ত রিডিং ই হবে মাটির pH বা অম্লমান।
- এবার pH মানের উপর ভিত্তিতে মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব নির্ণয় করুন।
ফলাফল: নমুনা মাটির pH মান ৭ এর কম হলে এটি অম্লীয়, pH এর মান ৭ এর বেশি হলে হবে ক্ষারীয় এবং pH মান ৭ হলে নমুনা হবে নিরপেক্ষ।
সতর্কতা:
- মাটি ও পানির অনুপাত ঠিক রাখতে হবে।
- বাফার দ্রবণ দিয়ে pH মিটার ভালোভাবে ঠিক করতে হবে। ৩। pH মিটার খুব সাবধানের ব্যবহার করতে হবে।
প্রিয় পাঠক, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা মাটির অম্লত্ব কী বা কাকে বলে, মাটির অম্লত্ব বৃদ্ধি পায় কেন, মাটির অম্লত্ব দূর করার উপায়, মাটির ক্ষারত্ব কী বা কাকে বলে, মাটির ক্ষারত্ব বৃদ্ধি পায় কেন, মাটির ক্ষারত্ব দূর করার উপায়, মাটির অম্লত্ব ও মাটির ক্ষারত্বের মধ্যে পার্থক্য, লিটমাস পেপার ও pH মিটারের সাহায্যে মাটির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব চিহ্নিতকরণ পরীক্ষাসহ এ সম্পর্কি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম।
মৃত্তিকা অম্লত্ব মৃত্তিকার একটি রাসায়নিক ধর্ম। মৃত্তিকা অম্লত্ব প্রকাশের একক হচ্ছে pH (পিএইচ)। মৃত্তিকার অম্লত্ব ১-১৪ সংখ্যা দ্বারা উল্লেখ করা হয়। কোন মৃত্তিকার অম্লত্ব মান ৭ এর নিচে হলে অম্লীয় মৃত্তিকা বলা হয়। মৃত্তিকা অম্লত্বের কমবেশির জন্য মৃত্তিকায় উপস্থিত উদ্ভিদ পানি ও অণুজীবসমূহের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়।
মৃত্তিকার ক্ষারত্ব ও লবণাক্ততা মৃত্তিকার রাসায়নিক ধর্ম। মৃত্তিকার ক্ষারত্ব ও লবণাক্ততার বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি ব্যবস্থাপনা ও শস্য বিন্যাসে। ফলে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বিলুপ্তের পথে রয়েছে কয়েক’শ প্রজাতির শস্য। কৃষি অলাভজনক হওয়ায় কৃষকরা লবণাক্ত মাটিতে আবাদ করতে আগ্রহ পাচ্ছে না। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে মৃত্তিকার ক্ষারত্ব ও লবণাক্ততা দূর করতে হবে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।