(১) মাশরুম কি/কী?
আমরা জানি ছত্রাক ফসলের অনেক রোগের জন্য নারী। কিন্তু সব ছত্রাক রোগ সৃষ্টি করে না। অনেক ছত্রাক রয়েছে যারা আমাদের জন্য উপকারী। মাশরুম এমন এক ধরনের ছত্রাক যা সম্পূর্ণ খাওয়ার উপযোগী, পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ঔষধি গুণ সম্পন্ন। আসলে মাশরুম এক ধরনের মৃতজীবী ছত্রাকের ফলন্ত অঙ্গ যা ভক্ষণযোগ্য।
মাশরুম ও ব্যাঙের ছাতা এক জিনিস নয়। ব্যাঙের ছাতা প্রাকৃতিকভাবে যত্রতত্র গচ্ছিয়ে উঠা বিষাক্ত ছত্রাকের ফলন্ত অঙ্গ। আর মাশরুম টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে উৎপন্ন বীজ দ্বারা পরিচ্ছন্ন পরিবেশে চাষ করা সবজি।
ক) মাশরুম খেতে কেমন?
মাশরুম নিজে সুস্বাদু খাবার এবং অন্য খাবারের সাথে ব্যবহার করলে তার স্বাদও বাড়িয়ে দেয়। মাশরুমের স্বাদ মাংসের মতো।
খ) মাশরুম কীভাবে রান্না করে খেতে হয়?
মাশরুম দিয়ে চায়নিজ ও পাঁচতারা হোটেলে নানা রকম মুখরোচক খাবার তৈরি করা হয়। তবে দেশীয় পদ্ধতিতে মাশরুম সবজি, ফ্রাই, স্যুপ, পোলাও, বিরিয়ানি, নুডুলস, চিংড়ি ও ছোট মাছের সাথে ব্যবহার করা যায়। মাশরুম ভাজা, শুকনা বা গুঁড়া হিসেবে খাওয়া যায়।
গ) মাশরুম খেতে কেমন?
(২) মাশরুম খাওয়ার উপকারিতা
পুষ্টিমান বিচারে মাশরুম সবার সেরা ফসল। কারণ মাশরুমে অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যোপাদান, যেমন— প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজপদার্থ অতি উচ্চ মাত্রায় আছে।
প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনা মাশরুমে ২৫-৩৫ গ্রাম আমিষ, ১০-১৫ গ্রাম সব ধরনের ভিটামিন ও খনিজপদার্থ, ৪০-৫০ গ্রাম শর্করা ও আঁশ এবং ৪-৬ গ্রাম চর্বি আছে।
মাশরুমের আমিষ অত্যন্ত উন্নত মানের। এ আমিষে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় ৯টি এমাইনো এসিডই আছে। এ আমিষ গ্রহণে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও মেদভুঁড়ি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কারণ আমিষের সাথে ক্ষতিকর চর্বি থাকে না। পক্ষান্তরে মাশরুমের চর্বি হাড় ও দাঁত তৈরিতে এবং ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়তা করে।
মাশরুমের শর্করায় অনেক ধরনের রাসায়নিক উপাদান থাকে যা অনেক জটিল রোগ নিরাময়ে কাজ করে।
ভিটামিন ও মিনারেল দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। আমাদের দেহের জন্য দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ ভিটামিন ও খনিজপদার্থের চাহিদা রয়েছে। আমরা প্রতিদিন মাশরুম খাওয়ার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজপদার্থের চাহিদা মেটাতে পারি। মাশরুমে থায়ামিন (বি ১), রিবোফ্লাবিন (বি ২), নায়াসিন ইত্যাদি ভিটামিন এবং ফসফরাস, লৌহ, ক্যালসিয়াম, কপার ইত্যাদি খনিজপদার্থ প্রচুর পরিমাণে রয়েছে।
পুষ্টিগুণের কারণে মাশরুম অনেক রোগের প্রতিরোধক ও নিরাময়কারী হিসেবে কাজ করে, যেমন- ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তশূন্যতা, আমাশয়, চুল পড়া, ক্যান্সার, টিউমার ইত্যাদি।
(৩) মাশরুম চাষের পদ্ধতি ও নিয়ম
ক) মাশরুম চাষের প্রয়োজনীয়তা/গুরুত্ব
বাংলাদেশে দ্রুত চাষযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে। অধিকাংশ জমি ধান চাষে ব্যবহৃত হয়। সবজি চাষের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ানো কঠিন। এমতাবস্থায় মাশরুম হতে পারে আদর্শ ফসল।
মাশরুম এমন একটি ফসল যা চাষ করার জন্য কোনো উর্বর জমির প্রয়োজন নেই। ঘরের মধ্যে তাকের উপর রেখেও চাষ করা যায় এবং অত্যন্ত অল্প সময়ে অর্থাৎ ৭-১০ দিনের মধ্যে ফলানো যায়৷
বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু মাশরুম চাষের অত্যন্ত উপযোগী। মাশরুম চাষের উপকরণ, যেমন-খড়, কাঠের গুড়া, আখের ছোবড়া, পচা পাতা ইত্যাদি সস্তা ও সহজলভ্য৷
মাশরুম চাষ ব্যবসায়িক দিক থেকে খুবই লাভজনক। কারণ মাশরুম চাষে কম পুঁজি, কম শ্রম দরকার হয়। অল্প দিনের মধ্যে বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে আনা যায়। অন্যদিকে একক জায়গায় অধিক ফলন, লাভজনক বাজারমূল্য পাওয়া যায়।
তাই মাশরুম চাষ করে বেকার যুবসমাজ সহজেই আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। ঘরে ঘরে মাশবুম চাষ করে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা যেমন মেটানো যাবে তেমনি বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে।
খ) মাশরুম চাষের উযুক্ত সময়
বাংলাদেশে গ্রীম্মকালে চাষ করা যায় মিক্কি, খষি ও স্ট্র মাশরুম এবং শীতকালে শীতাকে, বাটন, শিমাজি ও ইনোকি মাশরুম।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি চাষ করা হয় বারোমাসি ওয়েস্টার মাশরুম। বিভিন্ন ধরনের মাশরুম চাষে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। এখানে ওয়েস্টার মাশরুম চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানব।
গ) মাশরুমের বীজ বা স্পন তৈরি
মাশরুমের বীজ ল্যাবরেটরিতে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়। ভাষি পর্যায়ে মাশরুম চাষের জন্য প্যাকেটজাত বীজ কিনতে পাওয়া যায় যাকে বাণিজ্যিক স্পন বলে। আবার খড় নিয়ে চাষিরা নিজেরাও স্পন তৈরি করে নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে চাষিদেরকে বাজার থেকে মাদার স্পন সংগ্রহ করে স্পন তৈরি করে নিতে হয়।
ঘ) চাঘঘর তৈরি
মাশরুম চাষের ঘরটিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন প্রবেশের জন্য জানালা রাখতে হবে। ঘরটিতে আবছা আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
ঘরের তাপমাত্রা ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
মাশরুম আর্দ্র অবস্থা পছন্দ করে। ঘরটিতে ৭০-৮০% আপেক্ষিক আর্দ্রতার ব্যবস্থা করতে হবে।
মাশরুম চাষঘরে অসংখ্য অনুজীবের শ্বাস-প্রশ্বাসের ফলে প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয়। কার্বন ডাই অক্সাইড ভারী বলে নিচের দিকে জয়া হয়। এজন্য বেড়ার নিচে খোলা রাখতে হয়।
ঙ) স্পন সংগ্রহ
চাষঘর তৈরির পর বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে পলি প্যাকেটে তৈরি স্পন সহ করতে হবে। ভালো স্পনের বৈশিষ্ট্য হলো প্যাকেটটি সুষমভাবে মাইসিলিয়াম দ্বারা পূর্ণ ও সাদা হবে।
স্পন সংগ্রহের পর তাড়াতাড়ি প্যাকেট কাটার ব্যবস্থা করতে হবে। কাটতে দেরি হলে বস্তা থেকে প্যাকেট বের করে আলাদা আলাদা আরগায় ঘরের ঠাণ্ডা স্থানে রাখতে হবে।
চ) প্যাকেট কর্তন
চাষঘরে বসানোর আগে স্পন প্যাকেট সঠিক নিয়মে কেটে চেঁছে পানিতে চুবিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
স্পন প্যাকেটের কোনাযুক্ত দুই কাঁধ বরাবর প্রতি কাঁথে ৫ সেমি লম্বা এবং ১ ইঞ্চি ব্যাস করে কাটতে হবে।
উত্তর পার্শ্বের এ কাটা জায়গার সাদা অংশ ব্লেড দিয়ে চেঁছে ফেলতে হবে। আবার প্যাকেটটি ৫-১৫ মিনিট পানিতে উপুড় করে চুবিয়ে নিতে হবে।
ডুবানোর পর পানি ভালোভাবে ঝরিয়ে সরাসরি চাষঘরের মেঝেতে অথবা তাকে সারি করে সাজিয়ে চাষ করতে হবে।
ছ) মাশরুম চাষে পরিচর্যা
চাষ ঘরের মেঝে বা তাকে দুই ইঞ্চি পর পর স্পন সাজাতে হবে। স্পন প্যাকেটের চারপাশের আর্দ্রতা ৭০-৮০% রাখার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী গরমে ৪-৫ বার, শীতে বা বর্ষায় ২-৩ যার পানি স্প্রে করতে হবে।
স্প্রেয়ারের নজল প্যাকেটের এক ফুট উপরে রেখে স্প্রে করতে হবে। আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্পন প্যাকেটের উপর কখনো খবরের কাগজ ভিজিয়ে, কখনো বস্তা ভিজিয়ে একটু উঁচু করে রাখতে হবে।
পরিচর্যা ঠিকমতো হলে ২-৩ দিনের মধ্যে মাশরুমের অঙ্কুর পিনের মতো বের হবে। প্রতি পার্শ্বে ৮-১২টি বড় অঙ্কুর রেখে ছোটগুলো কেটে ফেলতে হবে।
৫-৭ দিনের মধ্যে মাশরুম তোলার উপযোগী হবে। প্রথমবার মাশরুম তোলার পর একদিন বিশ্রাম অবস্থায় রাখতে হবে। পরের দিন আগের কাটা অংশে পুনরায় ব্লেড দিয়ে চেঁছে ফেলে পানি স্প্রে করতে হবে।
একটি প্যাকেট থেকে ৮-১০ বার মাশরুম সংগ্রহ করা যায়। এতে একটি প্যাকেট থেকে ২০০-২৫০ গ্রাম মাশরুম পাওয়া যাবে।
জ) মাশরুম সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
মাশরুম যথেষ্ট বড় হয়েছে কিন্তু শিরাগুলো ঢিলা হয়নি- এমন অবস্থায় হাত দিয়ে আলতো করে টেনে তুলতে হবে। পরে গোড়া কেটে বাছাই করে পলি ব্যাগে ভরে মুখ বন্ধ করে বাজারজাত করতে হবে।
মাশরুমকে ঠাণ্ডা জায়গায় ২-৩ দিন রেখে খাওয়া যায়। ফ্রিজে রাখলে ৭-৮ দিন ভালো থাকে।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।