বাংলাদেশে মিষ্টি আলু আজও অবহেলিত, তাই একে গরীবের ফসল বলা হয়। কিন্তু এর পুষ্টিমান বিবেচনা করে বর্তমানে কেউ আর এটাকে অবহেলিত বা গরীবের ফসল বলছেন না। কারণ, এতে প্রচুর পরিমাণ শর্করা, খনিজ ও ভিটামিন আছে। এটি বিশ্বের অন্যতম শর্করা সমৃদ্ধ ফসল। এক একক জমি থেকে মিষ্টি আলু যে পরিমাণ শর্করা উৎপন্ন করে তা অন্যান্য ফসল থেকে অনেক বেশি।
- এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ আছে। এই ভিটামিন-এ এর অভাবে আমাদের বাংলাদেশের অনেক শিশু রাতকানা রোগে ভোগে এবং আস্তে আস্তে অনেকে অন্ধত্ব বরণ করে। এক পরীক্ষায় দেখা গেছে , রঙিন শাঁস যুক্ত ১২৫ গ্রাম মিষ্টি আলু প্রতিদিন খেলে একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের ‘ভিটামিন-এ’ চাহিদা পূরণ হয়।
- মিষ্টি আলুতে Glycemic index (GI) অনেক কম থাকার কারণে ডায়বেটিস রোগীরাও সহজে খেতে পারেন। কাঁচা মিষ্টি আলুর এও মান ৪১। এটি ৩০ মিনিট সিদ্ধ করার পর এর এও মান দাঁড়াই ৪৪-৪৬ যাহা ৫৫ এর নীচে। যে সকল খাবাবেরর এও মান ৫৫ এর নীচে সেকল খাবার ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য মোটামুটি নিরাপদ।
- মিষ্টি আলুর ভিটামিন ই৬ রক্তনালীকে স্বাভাবিক রেখে হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করে।
বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই মিষ্টি আলুর চাষ হয়। এ ফসলের স্থানীয় জাতগুলো গুণেমানে ও ফলনে উৎকৃষ্ট নয়। স্থানীয় জাতগুলোর গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ১০ টনের কম কিন্তু উচ্চফলনশীল মিষ্টি আলুর জাতের ফলন প্রায় ৩০-৪০ টন/হেক্টর। প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে উৎকৃষ্ঠমানের হালুয়া, চিপস, জ্যাম, জেলী ইত্যাদি মিষ্টি আলু থেকে তৈরি করা যায়।
কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, দীর্ঘ দিন যাবৎ এ ফসলের উন্নয়নের জন্য কাজ করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ দিন গবেষণার পর বেশ কয়েকটি উচ্চ ফলনশীল ও গুণাগুণ সমৃদ্ধ মিষ্টি আলূর জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতগুলি হলো বারি মিষ্টি আলু-১ (তৃপ্তি), বারি মিষ্টি আলু-২ (কমলাপুরী), বারি মিষ্টি আলু-৩ (দৌলতপুরী), বারি মিষ্টি আলু-৪, বারি মিষ্টি আলু-৫, বারি মিষ্টি আলু-৬, বারি মিষ্টি আলু-৭, বারি মিষ্টি আলু-৮, বারি মিষ্টি আলু-৯, বারি মিষ্টি আলু-১০, বারি মিষ্টি আলু-১১, বারি মিষ্টি আলু-১২, বারি মিষ্টি আলু-১৩, বারি মিষ্টি আলু-১৪, বারি মিষ্টি আলু-১, বারি মিষ্টি আলু-১৬ ইত্যাদি।
নিম্নে উদ্ভাবিত লাগসই ও সম্ভাবনাময় মিষ্টি আলুর জাতের নাম ও তাদের প্রধান বৈশিষ্ট গুলো বর্ণনা করা হল-
(১) বারি মিষ্টি আলু-২ (কমলা সুন্দরী)
১৯৮০ সালে এশীয় সবজি গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র, তাইওয়ান থেকে লাইনটি এনে অন্যান্য জার্মপ্লাজমের সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে উপযোগিতা যাচাই করে ১৯৮৫ সালে জাতটি কমলা সুন্দরী নামে কন্দাল ফসল অনুমোদিত হয়।
- এ জাতের কান্ড সবুজ, পাতা কচি অবস্থায় বেগুনী, কান্ডের অগ্রভাগ বেগুনী ও পাতা সবুজ। কন্দমূল লাল, শাঁস কমলা বর্ণের। কন্দমূলের আকৃতি উপ বৃত্তাকার হয়। কন্দমূলের ওজন ১৮০-২২০ গ্রাম। শাঁস নরম। প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে প্রায় ৭,৫০০ আ.ইউ. ভিটামিন ‘এ’ আছে।
- এ জাতের কান্ডের অগ্রভাগ বেগুনী ও পাতার উল্টো দিকের শিরা বর্ণহীন। জীবনকাল ১৩৫-১৪০ দিন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৪০-৪৫ টন ফলন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ আলুর চাষ করা যায়।
(২) বারি মিষ্টি আলু-৪
কমলা সুন্দরী, তৃপ্তি, দৌলতপুরী ও এস পি-০২৯ এর সাথে উন্মুক্ত পরাগায়নের মাধ্যমে উদ্ভাবিত ক্লোন থেকে বাছাই করে জাতটি বারি মিষ্টিআলু-৪ নামে ১৯৯৪ সালে অনুমোদন লাভ করে।
- কন্দমূল ও শাঁস ঘি বর্ণের। কন্দমূলের ওজন ১৭৫-১৯৫ গ্রাম ও আকৃতি উপ বৃত্তাকার। প্রতি গ্রাম শাঁসে প্রায় ১০৫০ আ.ইউ. ভিটামিন ‘এ’ আছে।
- জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন। উন্নত পদ্ধেিত চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ফলন হয় ৪০-৪৫ টন। উইভিলের আক্রমণ কম হয়। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই বিশেষ করে যশোর ও খুলনায় এ জাতটি আগাম চাষ করা যায়।
- বারি মিষ্টিআলু-৪ একটি উচ্চ ফলনশীল, ক্যারোটিন সমৃদ্ধ ও মাঝারী শুষ্ক শাঁসযুক্ত জাত। এ জাতের কান্ড সবুজ, কান্ডের অগ্রভাগ বেগুনী, পাতা সবুজ, কচি পাতা বেগুনী।
(৩) বারি মিষ্টি আলু-৫
কমলা সুন্দরী, তৃপ্তি, দৌলতপুরী ও এস পি-০২৯ এর সাথে উন্মুক্ত পরাগায়ণের মাধ্যমে উদ্ভাবিত ক্লোন থেকে বাছাই করে জাতটি বারি মিষ্টিআলু-৫ নামে ১৯৯৪ সালে অনুমোদন লাভ করে।
- কন্দমূল লম্বাটে উপ বৃত্তাকার, বর্ণ ঘিয়ে, শাঁস হলুদাভ। কন্দমূলের ওজন ১৮০-২২০ গ্রাম। প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে প্রায় ১০০০ আ.ইউ. ভিটামিন ‘এ’ আছে।
- জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ফলন হয় ৩৫-৪৪ টন। উইভিলের আক্রমণ কম হয়। বিশেষ করে যশোর ও খুলনায় এ জাতটি আগাম চাষ করা যায়।
- বারি মিষ্টিআলু-৫ একটি উচ্চ ফলনশীল, ক্যারোটিন সমৃদ্ধ ও শুষ্ক শাঁসযুক্ত জাত। এ জাতের কান্ড ও কান্ডের অগ্রভাগ সবুজ ও কান্ড রোমশ হয়। পাতা সবুজ ও সামান্য খাঁজ কাটা। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এ আলুর চাষ করা যায়।
(৪) বারি মিষ্টি আলু-৮
আন্তর্জাতিক আলু গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে ২০০২ সালে কয়েকটি মিষ্টি আলুর লাইন সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর সিআইপি-৪৪০০২৫ লাইনটি খুবই প্রতিশ্রুতিশীল প্রতীয়মান হওয়ায় ২০০৮ সালে উক্ত লাইনটি বারি মিষ্টি আলু-৮ নামে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
- এ জাতের লতা ও পাতার বর্ণ সবুজ। কন্দমূলের চামড়ার বর্ণ লাল, শাঁসের বর্ণ হলুদ। কন্দমূলের গড় ওজন ১৬০ গ্রাম। শুষ্ক বস্তুর পরিমাণ শতকরা ৩৫.৩ ভাগ। প্রতি ১০০ গ্রামে ৬৫০ আ.ইউ ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে।
- জীবনকাল ১২০-১৩৫ দিন। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৪০-৪৫ টন ফলন পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতের চাষ করা যায়। এ জাতটি খরা সহিষ্ণু। এ জাতে উইভিলের আক্রমণ কম হয়।
(৫) বারি মিষ্টি আলু-১১
বারি মিষ্টি আলু-৭ সিআইপি-৪৪০০২৫ এবং সিআইপি-৪৪০০৭৫-২ এর সাথে ২০০৬ সালে উন্মুক্ত পরাগায়ণের মাধ্যমে উ দ্ভাবিত ক্লোন এসপি-৬১৩ কে বাছাই করে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর এ জাতটি বারি মিষ্টি আলু-১১ নামে ২০১৩ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
- লতার কান্ড বেগুনী ও পাতা সবুজ। কন্দমূলের চামড়া লাল ও শাঁস হালকা হলুদ, কন্দমূলের গড় ওজন ১৮০-২০০ গ্রাম, শুষ্ক বস্তুর পরিমাণ ৩৫.৪৪%, ভিটামিন-এ ৫০০ আ.এ/১০০ গ্রাম।
- জীবনকাল ১২০-১৩০ দিন। সাধারন অবস্থায় এর ফলন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৩৫-৪০ টন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতের চাষ করা যায়। জাতটিতে উইভিলের আক্রমণ কম হয়।
(৬) বারি মিষ্টি আলু-১২
আন্তর্জাতিক আলু গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে ২০০৬ সালে কয়েকটি মিষ্টি আলুর লাইন সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর সিআইপি-৪৪০০০১ লাইনটি খুবই প্রতিশ্রুতিশীল প্রতীয়মান হওয়ায় উক্ত লাইনটি বারি মিষ্টি আলু-১২ নামে ২০১৩ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
- লতার কান্ড ও পাতা সবুজ। কন্দমূলের চামড়া হলুদ ও শাঁস কমলা রঙের, কন্দমূলের গড় ওজন ১৬০-১৮০ গ্রাম, শুষ্ক বস্তুর পরিমাণ ২৯.৪৬%, ভিটামিন-এ ৫৮০০ আ.এ/১০০ গ্রাম।
- সাধারন অবস্থায় এর ফলন হেক্টর প্রতি প্রায় ৩৫-৪০ টন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতের চাষ করা যায়। জাতটিতে উইভিলের আক্রমণ কম হয়।
(৭) বারি মিষ্টি আলু-১৩
আন্তর্জাতিক আলু গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে ২০০৬ সালে কয়েকটি মিষ্টি আলুর লাইন সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর সিআইপি-৪৪০০১৪ লাইনটি খুবই প্রতিশ্রুতিশীল প্রতীয়মান হওয়ায় উক্ত লাইনটি ‘বারি মিষ্টি আলু-১৩’ নামে ২০১৩ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
- লতার কান্ড ও পাতা সবুজ এবং খাঁজকাটা, কন্দমূলের চামড়া গাঢ় হলুদ ও শাঁস কমলা রঙের, কন্দমূলের গড় ওজন ১৬০-১৮০ গ্রাম, শুষ্ক বস্তুর পরিমাণ ২৮.৯৩%, ভিটামিন-এ ১৩,২০০ আ.এ/১০০ গ্রাম।
- সাধারন অবস্থায় এর ফলন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৩৫-৪০ টন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাতের চাষ করা যায়। জাতটিতে উইভিলের আক্রমণ কম হয়।
(৮) বারি মিষ্টি আলু-১৪
কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক আলু গবেষণা কেন্দ্র হতে কিছু উন্নত লাইন পাওয়া যায় যা কন্দাল ফসল গবেষণা কেন্দ্র হতে মূল্যায়িত হয়েছে। এর মধ্যে “বারি মিষ্টি আলু-১৪” জাতটি খুবই প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। নিম্নে বর্ণিত জাতটির উদ্ভিদতাত্ত্বিক বিবরণ ও চাষাবাদ পদ্ধতি সংক্ষেপে দেয়া হলো।
- কান্ড মধ্যম পুরু এবং সবুজ বর্ণের। পাতা খাঁজ কাটা, মধ্য শিরা পর্যন্ত পৌঁছায়। কচি ও বয়ষ্ক পাতার বর্ণ সবুজ কিন্তু কিনারা বেগুনী। পাতার উল্টা দিকের শিরা বেগুনী বর্ণের। কান্ডের অগ্রভাগ কিছুটা রোমশ। কন্দমূল লম্বাটে ও অনিয়মিত।
- কন্দমূলের বর্ণ হালকা গোলাপী ও শাঁস কমলা বর্ণের, শাঁসের শুস্ক পদার্থের পরিমাণ ২৪.১২±১ %।
- আন্তর্জাতিক আলু গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত কালার চার্ট অনুযায়ী প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে বিটা ক্যারোটিনের পরিমান ৪.৯২ মিলিগ্রাম (আনুমানিক)।
(৯) বারি মিষ্টি আলু-১৫
“বারি মিষ্টি আলু-১৫” জাতটি খুবই প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। নিম্নে বর্ণিত জাতটির উদ্ভিদতাত্ত্বিক বিবরণ ও চাষাবাদ পদ্ধতি সংক্ষেপে দেয়া হলো।
- কান্ড মধ্যম পুরু এবং সবুজ বর্ণের। পাতা খাঁজ কাটা নয়। কচি ও বয়ষ্ক পাতার বর্ণ সবুজ। পাতার উল্টা দিকের শিরা বেগুনী বর্ণের। কান্ডের অগ্রভাগ কিছুটা রোমশ। কন্দমূল লম্বাটে ও অনিয়মিত।
- কন্দমূলের বর্ণ হালকা গোলাপী ও শাঁস কমলা বর্ণের, শাঁসের শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ ২২.৩৯±১ %।
- আন্তর্জাতিক আলু গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত কালার চার্ট অনুযায়ী প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে বিটা ক্যারোটিনের পরিমাণ ৪.৪১ মিলিগ্রাম (আনুমানিক)।
(১০) বারি মিষ্টি আলু-১৬
- কান্ড মধ্যম পুরু এবং সবুজ বর্ণের। পাতা খাঁজ কাটা নয়। কচি ও বয়ষ্ক পাতার বর্ণ সবুজ। কন্দমূল উপবৃত্তাকার।
- কন্দমূলের বর্ণ হালকা গোলাপী ও শাঁস কমলা বর্ণের, শাঁসের শুস্ক পদার্থের পরিমাণ ২৮.৯৭±১%।
- আন্তর্জাতিক আলু গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত কালার চার্ট অনুযায়ী প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে বিটা ক্যারোটিনের পরিমান ১.১৫ মিলিগ্রাম (আনুমানিক)।
[সূত্র: বিএআরআই]