(১) মিষ্টি আলু চাষ পদ্ধতি ধারাবহিক বর্ণনা
ক) জমি নির্বাচন ও তার প্রস্তুতি
- সুনিষ্কাশিত, উঁচু ও রৌদ্রজ্জ্বলসম্পন্ন জমি মিষ্টি আলু চাষের জন্য নির্বাচন করা প্রয়োজন। বেলে দোআঁশ মাটি উত্তম তবে ভাল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সব ধরনের মাটিতে মিষ্টিআলুর চাষ করা যায়।
- মাটির অম্লতা (pH) ৫.৬ থেকে ৬.০ হলে ভাল।
- মিষ্টি আলুর জন্য মাটির উপরের ৩০ সেমি পর্যন্ত গভীর করে চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করা প্রয়োজন।
- মিষ্টি আলু চাষের জন্য এঁটেল মাটি ভাল নয়। এঁটেল মাটিতে চাষ করলে কন্দ চিকন, লম্বা বা অনিয়মিত আকারের হয় ফলে বাজার মূল্য দারুণভাবে কমে যায়।
খ) বংশবিস্তারের জন্য লতা প্রস্তুতি
- মিষ্টি আলু সাধারণত লতার কাটিং এর মাধ্যমে বংশবিস্তার করা হয়। রোগ জীবাণু মুক্ত সুস্থ, সবল, পরিপক্ক লতা হতে কাটিং প্রস্তুত করা হয়।
- লতার কাটিং এর দৈর্ঘ্য ২৫-৩০ সেমি (প্রায় ১ ফুট) হওয়া উচিত যাতে ২-৩ টি পর্ব বিদ্যমান থাকে।
- মিষ্টি আলুর লতার প্রথম কাটিং সর্বোত্তম ও ফলন বেশি দেয়।
গ) মিষ্টি আলু রোপণের সময়
অক্টোবরের মাঝামাঝী থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত (কার্তিক থেকে মধ্য অগ্রহায়ণ) মিষ্টি আলুর লতা রোপণ করা যায়।
ঘ) রোপণ পদ্ধতি ও চারার সংখ্যা
- মিষ্টি আলুর লতার কাটিং সমতল বেডে বা উঁচু ভেলি পদ্ধতিতে রোপণ করা যায়। তবে উঁচু ভেলি পদ্ধতিতে ফলন বেশি হয়। সাধারণত চরাঞ্চলে এবং সেচবিহীনভাবে চাষ করলে সমতল জমিতে ফারো করে লতার কাটিং লাগানো হয়।
- সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেমি, (২ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩০ সেমি (১ ফুট)। লতার অগ্রভাগ মাটির উপরে রেখে দুই থেকে তিনটি পর্ব সমান্তরাল ভাবে মাটির ৪ থেকে ৮ সেমি নিচে পুঁতে দিতে হবে। এ পদ্ধতিতে রোপণ করলে প্রতি হেক্টর জমির জন্য প্রায় ৫৬ হাজার লতার প্রয়োজন হয়।
- জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে লতা লাগানোর পর পরই সেচ দিতে হবে এবং চারা ভালভাবে না লাগা পর্যন্ত প্রয়োজনানুসারে ১-২ দিন পর পর সেচ দেয়া উচিত।
ঙ) মিষ্টি আলু চাষে সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি
- কৃষক ভাইয়েরা মিষ্টিআলুতে সাধারণত সার দিতে চান না। তবে সর্বোচ্চ ফলনের জন্য সুষম সার সঠিক পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা অত্যাবশ্যক।
- সারের পরিমাণ নির্ভর করে মূলত মাটির প্রকৃত ও প্রকার ফসলের জাত, সেচ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির উপর মিষ্টিআলুর জন্য সারের মাত্রা সারণীতে উল্লেখ করা হলো।
মিষ্টিআলুর জন্য সারের মাত্রা:
সারের নাম | কেজি/হেক্টর | কেজি/বিঘা | কেজি/শতক |
ইউরিয়া | ২৫০-২৮০ | ৩৪.৪-৩৮.৬ | ০.১৪-০.১৬ |
টি এস পি | ১৪০-১৭০ | ১৯.৩-২৩.৪ | ০.০৮-০.১০ |
এমও পি | ২৩০-২৬০ | ৩১.৭-৩৫.৫ | ০.১৩-০.১৫ |
জিপসাম | ৬০-৮০ | ৮.২৬-১১.০ | ০.০৩-০.০৫ |
জিংক সালফেট* | ১০-১২ | ১.৩৮-১.৬৫ | ০.০০৬-০.০০৭ |
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট* | ৯০-১২০ | ১২.৪-১৬.৫ | ০.১৫-০.১৭ |
বরিক এসিড* | ৬-৮ | ০.৮৩-১.১০ | ০.০০৩-০.০০৪ |
গোবর | ১০,০০০ | ১৩৭৭ | ৫.৫৯ |
*জিপসাম, জিংক সালফেট ও বরিক এসিড এলাকাভেদে প্রয়োজন হয়।
সার প্রয়োগ পদ্ধতি:
- সম্পূর্ণ গোবর বা খামারজাত সার, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট ও বরিক এসিড এবং অর্থেক ইউরিয়া ও এমপি সার শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্থেক ইউরিয়া ও এমপি রোপণের ৩৫-৪০ দিনের মধ্যে সারির পার্শ্বে (সারি থেকে উভয় দিকে ১০ সেমি দূরে) ফারো তৈরি করে প্রয়োগ করা উত্তম।
- সারের উপরি প্রয়োগের পর পরই গাছের গোড়ায় অল্প পরিমাণে মাটি উঠিয়ে দিয়ে সেচ দেওয়া প্রয়োজন।
- চরাঞ্চলে বা সেচবিহীনভাবে চাষ করলে উপরোক্ত রাসায়নিক সার শতকরা ১০-১২ ভাগ কমিয়ে একসঙ্গে জমি প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে প্রয়োগ করতে হবে।
চ) পানি সেচ ও নিষ্কাশন
- মিষ্টিআলুর গাছ মাটিতে লেগে গেলে ৩০ দিন, ৬০ দিন ও ৯০ দিন পর ৩ বার সেচ দেয়া উচিত।
- অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে পানি নিষ্কাশনের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- সময়মতো পানি সেচ মিষ্টি আলুর ফলন এবং বাজার জাতকরণের উপযোগী কন্দমূলের সংখ্যা, ওজন ও গুণাগুণ বৃদ্ধি করে।
ছ) আগাছা ব্যবস্থাপনা
- মিষ্টি আলু দ্রুত বর্ধনশীল ফসল এবং এটি দ্রুত মাটিকে ঢেকে ফেলে ও আগাছাকে অবদমিত করে। তবুও গাছের বৃদ্ধির প্রাথমিক পর্যায়ে আগাছা দমন করা জরুরি।
- ভাল ফলনের জন্য চারা রোপণের পর এবং সারির উপরি প্রয়োগের আগে কমপক্ষে একবার আগাছা দমন করা অত্যাবশ্যক।
জ) লতা নাড়ানো
- চারা রোপণের ৫০-৬০ দিন পর থেকে মাসে অন্তত একবার লতা নেড়ে চেড়ে দিতে হবে।
- এতে মিষ্টি আলুর পর্ব থেকে শিকড় গজানো তথা বাজারজাত অনুপযোগী কন্দমূল উৎপাদন এড়ানো সম্ভব হয় এবং ফলশ্রুতিতে কন্দের আকার ও ফলন বৃদ্ধি পায়।
ঝ) মিষ্টি আলু চাষে পোকা ও দমন ব্যবস্থাপনা
মিষ্টি আলুর উইভিল বিশ্বব্যাপী পরিচিত একটি ক্ষতিকর পোকা। এটি জমিতে এবং গুদামজাত কন্দমূলে আক্রমণ করে ফলশ্রুতিতে মিষ্টি আলু খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে।
- পোকার আক্রমণমুক্ত সুস্থ্য, সবল মিষ্টি আলুর লতা বা কান্ডের অগ্রভাগ (৩০ সেমি) জমিতে লাগানো উচিত।
- মিষ্টিআলুর লতা এডমায়ার দ্রবণে (০.৫ মিলিলিটার/লিটার পানি) ২০ মিনিট ডুবিয়ে রেখে পরে রোপণ করতে হবে।
- ফেরোমোন ফাঁদ পেতে পুরুষ উইভিল মেরে ফেলা সম্ভব। এত করে নতুন উইভিলের জন্ম হতে পারে না এবং আস্তে আস্তে উইভিলের সংখ্যা কমে যাবে।
- গাছের গোড়ায় সময়মতো মাটি উঠিয়ে দিতে হবে।
- উইভিল আক্রান্ত লতা ও কন্দমূল পুড়িয়ে ফেলতে হবে অথবা গর্ত করে মাটিতে পুঁতে রাখতে হবে।
- হেক্টরপ্রতি ১৫ কেজি হারে ডায়াজিনন ১৪জি/কারবোফুরান ৫জি/ প্রয়োগ করে হাল্কা সেচ দিতে হবে।
ঞ) কন্দমূল উত্তোলন ও ফলন
- চারা রোপণের ১২০ থেকে ১৪০ দিন পর কন্দমূল উত্তোলন উপযোগী হয় তবে ১৬০ দিনের বেশি রাখলে শাঁস আঁশযুক্ত হয়।
- মাটির সাধারন ‘জো’ অবস্থায় কোদাল দ্বারা কুপিয়ে মিষ্টি আলু উত্তোলন করা হয়। উত্তম ব্যবস্থাপনায় উচ্চফলনশীল মিষ্টি আলুর জাতগুলোর ফলন ৩৫-৪০ টন/হেক্টর হয়ে থাকে।
ট) মিষ্টিআলু সংরক্ষণ
মিষ্টি আলুর সংরক্ষণ গুণ খুব একটা আশাপ্রদ নয়। বাংলাদেশে মিষ্টি আলু সংগ্রহকালীন সময় মার্চ-এপ্রিল মাসে (মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য বৈশাখ) তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, ফলে উইভিলের আক্রমণ বৃদ্ধি পায় এবং কন্দমূল সহজেই নষ্ট হয়।
মিষ্টি আলু সংরক্ষণের পূর্বে কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। যেমন-
- মিষ্টি আলু সংগ্রহের সময় মাটি সাধারণ ‘জো’ অবস্থায় অর্থাৎ মাটি যেন কাদাময় না থাকে।
- ফসল সংগ্রহের পূর্বে লতা টান দিয়ে না ছিড়ে কাঁচি দ্বারা কেটে আলাদা করতে হবে।
- সংগ্রহের পর মিষ্টি আলু ৭-১০ দিন ছায়ায় ছড়িয়ে রেখে কিউরিং করে নিতে হবে।
- রোগাক্রান্ত কাটা বা থেতলানো এবং উইভিল আক্রান্ত মিষ্টি আলু দ্রুত বাছাই করে আলাদা করে ফেলতে হবে।
- কন্দমূলের ত্বক যাতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সেজন্য ফসল সংগ্রহ থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত সকল কার্যক্রম সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এরপর কিউরিংকৃত বাছাই করা নিখুঁত মিষ্টি আলু উত্তম বায়ু চলাচলযুক্ত ঘরে শুকনা বালি বিছিয়ে তার উপর একস্তর মিষ্টি আলু (৭৫ সেমি) আবার বালুর স্তর (১০ সেমি) এভাবে ৫-৬টি স্তরে সংরক্ষণ করা হয়। বায়ু চলাচলযুক্ত ঘর যেখানে তাপমাত্রা ১৬-১৮০ স. থাকে সেখানে মিষ্টি আলু ৫-৬ মাস সংরক্ষণ করা যায়।
ঠ) চাষকৃত মিষ্টি আলুর ব্যবহার
- রুপান্তরিত কন্দমূল এবং লতার কচি ডগা মানুষের ভক্ষণযোগ্য অংশ। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মিষ্টি আলুর কচি ডগা সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। এটি একটি উপাদেয় ও পুষ্টিকর সবজি।
- মিষ্টি আলুর কন্দ সাধারনত পুড়িয়ে বা সিদ্ধ করে খাওয়া হয়।
- মিষ্টি আলুর পেকটিন হতে জ্যাম, জেলি ও মারমালেট প্রস্তুত করা যায়।
- এছাড়া স্টার্চ/শর্করা, সিরাপ, অ্যালকোহল এবং বেকিং ও কনফেকশনারী শিল্পে এটির বহুল ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে।
- এ ছাড়াও উন্নত মানের চিপস ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই তৈরি করা সম্ভব।
- অপরিনত কন্দমূল এবং লতা গোখাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
- কমলা রঙের মিষ্টি আলু সিদ্ধ করলে কিছুটা নরম হয়। সিদ্ধ মিষ্টি আলু দুধের সাথে মিশিয়ে বা পায়েশ তৈরি করে খাওয়ানো যায়।
- এছাড়া মিষ্টিআলু টুকরা টুকরা করে খিচুড়ী রান্না করে বা ময়দার সাথে মিশিয়ে রুটি তৈরি করেও শিশুদের খাওয়ানো সম্ভব।
সুতরাং ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ মিষ্টি আলু আমাদের ভিটামিন-এ চাহিদা পূরণে এবং এর বহুমুখী ব্যবহার কৃষি অর্থনীতিতে বৈচিত্রময় ভূমিকা রাখতে পারে।
ড) মিষ্টি আলুর ফলন, গুণাগুণ ও সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ
বৈশিষ্ট্য ও বিবরণ:
- হেক্টর প্রতি ৩ টন মুরগীরবিষ্ঠা অথবা ৬ টন গোবর এবং সুপারিশকৃত রাসায়নিক সারের চেয়ে কম পরিমাণ অজৈব সার (হেক্টর প্রতি যথাক্রমে ২৭০, ৭৫, ২৪০ এবং ৫৫ কেজি ইউরিয়া, টি এসপি, পটাশ এবং জিপসাম) প্রয়োগ করলে ভাল ও মান সম্মত মিষ্টি আলু পাওয়া যাবে এবং ৪৯ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করলে মিষ্টি আলুর গুণাগুণ বজায় থাকে।
- বিভিন্ন সংরক্ষণ মাধ্যমের মধ্যে “বালুতে সংরক্ষণ” করলে বেশীদিন আলু ভাল থাকে, বিশেষ করে আলুর রং মিষ্টি এবং ফাইবারমান ভাল থাকে।
এলাকা:
সকল মিষ্টি আলু জম্নানো এলাকা বিশেষ করে, জামালপুর, শেরপুর, বগুড়া, রংপুর, গাইবান্দা, দিনাজপুর, ঠাকুর গাঁও, কুমিল্লা, যশোর, কুষ্টিয়া, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর গাজীপুর ইত্যাদি।
সর্তকতা:
- জমি হতে মিষ্টি আলু উত্তোলন, পরিবহন, সংরক্ষণ প্রভৃতির সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে মিষ্টি আলু আঘত প্রাপ্ত না হয়।
- সংরক্ষণের জন্য কাটা, ছেড়া, থেতলানো মিষ্টি আলু বেছে শুধু নিখুত মিষ্টি আলু সংরক্ষণ করতে হবে।
(২) মিষ্টি আলুর রোগবালাই ও তার প্রতিকার বা দমন ব্যবস্থাপনা
মিষ্টি আলু বাংলাদেশের শর্করা সমৃদ্ধ খাদ্য ফসলের অন্যতম হলেও, পূর্বে এটি অবহেলিত ছিল। তবে বর্তমানে পুষ্টিমানের বিবেচনায় এটি, এ দেশে ধান, গম, আলুর পরই অবস্থান করছে। এতে প্রচুর শর্করা, খনিজ ও ভিটামিন বিশেষ করে ভিটামিন এ রয়েছে। এ সকল কারণে এর চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নিম্নে মিষ্টি আলুর বিভিন্ন রোগের লক্ষণ সহ এদের প্রতিকার দেয়া হল-
ক) মিষ্টি আলুর উইভিল পোকা
পোকার বৈশিষ্ট্য:
- পূর্ণ বয়স্ক উইভিল প্রায় ৬ মিমি লম্বা এবং ১.৪ মিমি চওড়া হয়ে থাকে।
- এ পোকার মাথার শুঁড়ের মতো একটি মুখাংশ আছে।
- মাথা এবং শাখার উপরিভাগ গাঢ় নীল রং এর চোখ ও পা উজ্জ্বল লাল-কমলা বর্ণের।
- কীড়া কন্দমূলের ভিতরে আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গ করে ক্ষতিকরে থাকে।
- উইভিল আক্রান্ত কন্দমূল খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে।
প্রতিকার:
- মিষ্টি আলুর লতা বা কান্ডের অগ্রভাগ (৩০ সে.মি.) জমিতে লাগানো উচিত। লতার অগ্রভাগে সাধারণত মিষ্টি আলুর উইভিলের ডিম থাকে না।
- মিষ্টি আলুর উইভিল পোকা দমনে সেক্স ফেরোমন ট্রাপ এর সাথে মাটি উঠানো (Earthing up) এবং কার্বোফুরান ৫ জি প্রয়োগের মাধ্যমে এই পোকা দমন করা যায়। সেক্স ফেরোমন ট্রাপ + মাটি উঠানো (মাটি উঠানো কমপক্ষে তিন বার-৩০, ৬০, ৯০ দিনে করতে হবে) + কার্বোফুরান ৫ জি (মিষ্টি আলুর লতা লাগানোর ৬০ দিন পর প্রয়োগ করে সেচ দিতে হবে)। মিষ্টি আলু সংরক্ষণের সময় উইভিল আক্রমণমুক্ত কন্দমূল শুকনা বালি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। মেঝেতে প্রথমে ১০ সেমি পুরু একটি শুকনা বালির স্তর সাজানো যেতে পারে। এরপর ৭৫ সেমি পুরু পর্যন্ত মিষ্টি আলুর স্তর সাজাতে হবে। মিষ্টি আলুর উপরে আবার ১০ সেমি পুরু বালির স্তর দিয়ে ঢেঁকে দিতে হবে।
খ) মিষ্টি আলুর নরম পচা রোগ (Soft Rot)
এ রোগটি রাইজোপাস রট নামেও পরিচিত। এ রোগটি প্রধানত সংরক্ষিত মিষ্টি আলুতে দেখা যায়। এটি সংরক্ষিত অবস্থায় মিষ্টি আলুর সবচেয়ে মারাত্মক রোগ।
রোগের কারণ:
রাইজোপাস নিগরিকান্স নামক এক ধরনের ছত্রাক দ্বারা এ রোগটি হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণ:
- আক্রান্ত আলু, দুপ্রান্ত হতে দ্রুত নরম ও আর্দ্র হয়ে পচে যায় যা নরম পচা রোগে আক্রান্ত সংরক্ষিত মিষ্টি আলু গাজন এর গন্ধ ছড়াতে থাকে।
- আক্রান্ত আলুর উপরিভাগে মাইসেলিয়ামের পুরু স্তর দেখা যায়। এছাড়া প্যাথোজেনের কাল বর্ণের ফ্রুটিং বডিও দেখা যায়।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনা:
- জমি হতে টিউবার উত্তোলন, পরিবহন, সংরক্ষণ প্রভৃতির সময়ে খেয়াল রাখতে হবে যাতে টিউবার আঘাত প্রাপ্ত না হয়।
- সংরক্ষণের পূর্বে টিউবার ভাল করে কিউরিং করতে হবে।
- এ রোগ কমানোর জন্য কাটা, ছেড়া থেতলানো টিউবার বেছে শুধু নিখুঁত টিউবার সংরক্ষণ করতে হবে।
গ) কালচে রোগ বা বাক রট বা চারকোল রট
এ রোগটি প্রধানত সংরক্ষিত মিষ্টি আলুতে দেখা যায়।
রোগের কারণ:
ম্যাকরোফোমিনা ফ্যাজিওলিনা / ডিপোডিয়া নাটালেনসিস নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের লক্ষণ:
- এ রোগের আক্রমণে আক্রান্ত গাছ ধীরে ধীরে কাল হয়ে যায়।
- গুদামজাত অবস্থায় টিউবারেও এ রোগ দেখা যায়। টিউবারে এ রোগের আক্রমণে কাল দাগ পড়ে।
- পরবর্তীতে পচন শুরু হয়ে পুরো টিউবারটি পচে নষ্ট হয়ে যায়।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনা:
- সংরক্ষিত টিউবারকে এ রোগের আক্রমণ হতে রক্ষা করতে টিউবারকে সংরক্ষণের পূর্বে ভালভাবে কিউরিং করে নিতে হবে।
- এ রোগ কমানোর জন্য কাটা, ছেড়া, থেতলানো টিউবার বেছে শুধু নিখুঁত টিউবার সংরক্ষণ করতে হবে।
- ফসল উঠানোর পর প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি ডায়থেন এম-৪৫ অথবা রিডোমিল গোল্ড প্রয়োগ করে তা টিউবারে স্প্র্রে করে এ রোগ দমন করা যায়।
ঘ) মিষ্টি আলুতে ফিদারী মোটল ভাইরাস রোগ
এটি এক প্রকার ভাইরাস রোগ। এ রোগের ফলে ফলন মারাত্মক হ্রাস পায়।
রোগের কারণ:
এই ভাইরাসের নাম মিষ্টি আলুর ফিদারি মোটল ভাইরাস। জাব পোকা দ্বারা এ ভাইরাসটি অসুস্থ গাছ হতে সুস্থ গাছে ছড়িয়ে পড়ে।
রোগের লক্ষণ:
- মিষ্টি আলুর পাতায় হালকা থেকে গাঢ় মোটল দাগ পড়ে।
- গাছের আকার ছোট হয়ে যায়।
- মিষ্টি আলুর রাসেট ক্রাক, ভেইন ক্লিয়ারিং, ভেইন ফিদারিং এবং ফিদারী মোটল ভাইরাস আক্রান্ত মিষ্টি আলুর গাছ ক্লোরোটিক স্পট এ রোগের অন্যতম লক্ষণ।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনা:
- রোগ মুক্ত লতা লাগানো।
- পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করলে রোগের প্রকোপ কমানো যায়।
- জাব পোকা দমনের মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার রোধের জন্য এডমায়ার নামক কীটনাশক ০.১% হারে প্রতি ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করা।
ঙ) পাতা কোকড়ানো বা লিফ কার্ল ভাইরাস
এটি এক ধরনের ভাইরাস রোগ। এ রোগের আক্রমণে ফলন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ রোগটি সাদা মাছি পোকা দ্বারা ছড়ায়।
রোগের লক্ষণ:
- এ রোগে মিষ্টি আলুর পাতা খুব ছোট হয়ে যায়।
- মিষ্টি আলুর পাতা উর্ধ্বমুখী হয়ে কুকড়িয়ে যায়।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনা:
- রোগমুক্ত লতা লাগানো।
- পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করা।
- এডমায়ার নামক কীটনাশক ০.১% হারে প্রতি ১৫ দিন পর পর স্প্রে করে সাদা মাছি পোকা দমনের মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার রোধ করা।
চ) মিষ্টি আলুর মাইল্ড্ মোটল, ক্লোরটিক ফ্লেক্স এবং লেটেন্ট ভাইরাস
একাধিক ভাইরাস এ রোগের জন্য দায়ী। এ ভাইরাসটি বাহক পোকার মাধ্যমে আক্রান্ত গাছ হতে সুস্থ গাছে ছড়িয়ে পড়ে।
রোগের লক্ষণ:
- পাতায় হালকা মোজাইক বা হালকা হলুদ রঙ ধারণ করা।
- গাছ ছোট হয়ে যাওয়া এ সব ভাইরাসের মূল লক্ষণ।
- এ রোগের ফলে মিষ্টি আলুর ফলন কিছুটা হ্রাস পায়।
রোগ দমন ব্যবস্থাপনা:
- রোগমুক্ত গাছ থেকে লতা সংগ্রহ করে ব্যবহার করতে হবে।
- এ ভাইরাস রোগের বিস্তার রোধের জন্য এদের বাহক পোকা কীটনাশকের মাধ্যমে দমন করতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]