মুখী কচু একটি সুস্বাদু সবজি। এ সবজি খরিফ মৌসুমের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এর চাষ হয়।
মুখী কচু বাংলাদেশে গুঁড়া কচু, কুঁড়ি কচু, ছড়া কচু, দুলি কচু, বিন্নি কচু ইত্যাদি নামেও পরিচিত।
মুখীর ছড়া বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মুখী কচুর গাছ হলদে হয়ে শুকিয়ে গেলে এ কচু তুলতে হয়। এতে ৬-৭ মাস সময় লাগে।
(১) মুখী কচুর জাত পরিচিতি
ক) বিলাসী মুখী কচু
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত ১৮০টি জার্মপ্লাজম হতে গবেষণার মাধ্যমে ‘বিলাসী’ নামে একটি উফশী জাত উদ্ভাবন করা হয় এবং ১৯৮৮ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
- বিলাসী গুণে উৎকৃষ্ট ও উচ্চ ফলনশীল। এর গাছ সবুজ, খাড়া, মাঝারী লম্বা। এর মুখী খুব মসৃণ, ডিম্বাকার হয়।
- সিদ্ধ মুখী নরম ও সুস্বাদু। সিদ্ধ করলে মুখী সমানভাবে সিদ্ধ হয় ও গলে যায় এবং গলা চুলকানীমুক্ত অর্থাৎ এ কচুতে ক্যালসিয়াম অক্সালেট এর পরিমাণ কম থাকায় গলা চুলকায় না।
- জীবনকাল ২১০-২৮০ দিন।
- সাধারণ অবস্থায় এর ফলন হেক্টরপ্রতি প্রায় ২৫-৩০ টন।
- উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৪০ টন পর্যন্ত ফলন হয়ে থাকে।
খ) বারি মুখী কচু-২
দেশিয় জার্মপ্লাজম থেকে উপযোগিতা যাচাইয়ের মাধ্যমে ২০১৩ সালে এ জাতটি অবমুক্ত করা হয়েছে।
- গাছ খাড়া, মাঝারী আকৃতির এবং সবুজ বর্ণের। পাতা সবুজ ও Peltate আকৃতির। বোঁটা ও পত্র ফলকের সংযোগস্থল সবুজ রঙের। মুখী ধূসর রঙের এবং ফ্লেস সাদা।
- মুখী সহজে সমানভাবে সিদ্ধ হয় এবং গলা চুলকানীমুক্ত।
- সাধারণ অবস্থায় এর ফলন হেক্টরপ্রতি প্রায় ৩৫ টন। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এর চাষ করা যায়।
(২) মুখী কচু চাষ পদ্ধতি বর্ণনা
ক) মাটি
দোআঁশ মাটি মুখী কচুর জন্য উত্তম। বর্ষাকালে পানি দাঁড়ায় না এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।
খ) রোপণের সময়
মধ্য-মাঘ থেকে মধ্য-ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি)।
গ) রোপণ পদ্ধতি
একক সারি পদ্ধতি: সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬০ সেমি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৩৫ সেমি।
ডাবল সারি পদ্ধতি: এ পদ্ধতিতে ৭৫ সেমি ⨉ ৬০ সেমি দূরত্ব বেশি উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে। ৭৫ সেমি দূরে দূরে লম্বালম্বি দাগ টানতে হয়। এই দাগের উভয় পাশে ১০ সেমি দূর দিয়ে ৬০ সেমি পর পর বীজ লাগিয়ে যেতে হয়। এতে দুই সারির মধ্যে দূরত্ব ৫৫ সেমি এবং এক সারির দুই লাইনের মধ্যে দূরত্ব হয় ২০ সেমি। এই পদ্ধতিতে বীজ লাগালে ফলন প্রায় ৪০-৫০% বেড়ে যায়। দুই সারির ৩টি বীজ সমদ্বিবাহু ত্রিভূজ উৎপন্ন করবে।
ঘ) বীজের হার
মুখীর ছড়া ৪৫০-৬০০ কেজি/হেক্টর (১৫-২০ গ্রাম ওজনের মুখী)।
ঙ) সার প্রয়োগ পদ্ধতি
সম্পূর্ণ গোবর বা খামারজাত সার, টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট ও বরিক এসিড এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি জমি প্রস্তুতির শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক এমওপি চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর এবং বাকি ইউরিয়া সমান দুই কিস্তিতে বীজ গজানোর ২০-২৫ দিন এবং ৪০-৫০ দিন এর মধ্যে পার্শ্ব প্রয়োগ পদ্ধতিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
চ) সারের নাম ও পরিমাণ
মুখী কচুর চাষে নিম্নলিখিত হারে সার ব্যবহার করতে হয়।
সারের নাম | কেজি/হেক্টর | কেজি/বিঘা | কেজি/শতক |
গোবর | ১০,০০০ | ১৩৭৭ | ৫.৫৯ |
ইউরিয়া | ২৫০-৩৩০ | ৩৪.৪৪-৪৫.৪৫ | ০.১৪-০.১৮ |
টিএসপি | ১৫০-২০০ | ২০.৬৬-২৭.৫৫ | ০.০৮-০.১১ |
এমওপি | ২৫০-৩৫০ | ৩৪.৪৪-৪৮.২১ | ০.১৪-০.২০ |
জিপসাম | ১০০-১৩০ | ১৩.৭৭-১৭.৯১ | ০.০৬-০.০৭ |
জিংক সালফেট* | ১০-১৬ | ১.৩৮-২.২ | ০.০১ |
বরিক এসিড* | ১০-১২ | ১.৩৮-১.৬৫ | ০.০১ |
*এলাকাভেদে প্রয়োজন হয়।
ছ) আগাছা দমন
- মুখী কচু ৬ থেকে ৯ মাসের ফসল। গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় জমিতে প্রচুর আগাছা জন্মে।
- মুখী কচুর পুরো উৎপাদন মৌসুমে ৪-৬ বার আগাছা দমনের প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে সারের উপরি প্রয়োগের আগে আগাছা দমন অত্যাবশ্যক। নচেৎ উপরি প্রয়োগের সার ফসলের চেয়ে আগাছাই বেশি গ্রহণ করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে এবং মুখীর ফলন দারুণভাবে হ্রাস করবে।
- অঙ্কুরোদ্গম পূর্ব আগাছানাশক ম্যাগনাম গোল্ড বীজ রোপণের পরপর বা পরের দিন প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলি ঔষধ মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- চারা লাগানোর দুই মাস পর হতে এক মাস অন্তর অন্তর চার বার নিড়ানী দ্বারা আগাছা দমন করতে হবে।
জ) সেচ নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা
- মুখীকচু খরা মৌসুমে লাগানো হলে বীজ অঙ্কুরোদগমের জন্য তো বটেই প্রাথমিক বৃদ্ধি পর্যায়ে মাটির প্রকারভেদে ১০-২০ দিন পর পর সেচ দেয়া প্রয়োজন হয়।
- বর্ষাকালে সেচ দেওয়ার দরকার পড়ে না তবে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি দ্রুত নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে মুখী কচুর উচ্চ ফলনের জন্য প্রয়োজনীয় সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা যথাসময়ে গ্রহণ করতে হবে।
ঝ) রোগ ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
পানি কচুুর অনুরূপ।
ঞ) অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা
গাছের গোড়ায় মাটি তোলা: রোপণের ৪০-৪৫ দিন পর এবং ৯০-১০০ দিন পর দুই সারির মাঝের মাটি কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে কচু গাছের গোড়ায় উঠিয়ে দিতে হবে।
ট) ফসল সংগ্রহ
বীজ রোপণের ছয় মাস পর আগাম ফসল সেপ্টেম্বর (মধ্য-ভাদ্র) মাস থেকে মুখী সংগ্রহের উপযোগী হয় এবং ঐ সময় গাছের পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করতে থাকে এবং ধীরে ধীরে মারা যায়। কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে মুখী সংগ্রহ করা হয়।
ঠ) ফলন
উচ্চ ফলনশীল বিলাসী জাতে গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৩০-৩৫ টন। মোট ফলনের ৭৫- ৮৫% মুখী এবং বাকিটা গুঁড়িকন্দ।
[সূত্র: বিএআরআই]