Skip to content

 

মুরগি পালন পদ্ধতি ও মুরগির খাদ্য তালিকা

মুরগি পালন পদ্ধতি ও মুরগির খাদ্য তালিকা

আলোচ্য বিষয়:

বর্তমানে এদেশে মুরগি পালন একটি লাভজনক ব্যবসা। অতীতকাল থেকে গ্রামের সাধারণ জনগণ চিরাচরিত নিয়মে হাঁসমুরগি পালন করে আসছে। বর্তমানে উন্নত মুরগি পালন পদ্ধতির ফলে ডিম ও মাংস উৎপাদন বেড়েছে।

বিজ্ঞানের এই যুগে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে পরিশ্রম ও সময় দুটোই কম লাগে সেই সাথে মাংস ও ডিমের উৎপাদন বাড়ছে এবং আমাদের বাংলাদেশে আমিষের চাহিদা অনেকটাই পূরণ হচ্ছে।

মুরগি পালনের জন্য একজন খামারির বিভিন্ন মুরগি পালন পদ্ধতি জানার সাথে সাথে মুরগি পালনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, মুরগির খাদ্য তালিকা ও রোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। উপর্যুক্ত বিষয়াদি সমন্ধে জ্ঞান থাকলে একাজন খামারি তার নিজের জন্য কোন পদ্ধতিটি সবচেয়ে ভালো তা নির্ধারনের পাশাপাশি কিভাবে অল্প খরচে খামার থেকে অধিক উৎপাদন পাওয়া যায় তা জেনে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারবেন।

এই পাঠটি সম্পূর্ণ মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করলে আপনি- মুরগি পালন পদ্ধতি ও মুরগির খাদ্য তালিকা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাবেন। মুরগি পালনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সম্পর্কে জানেতে পারবেন। ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির দানাদার খাদ্য তৈরি করতে পারবেন। মুমুরগির রোগের লক্ষণ ও মুরগির রোগ প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে অবগত হতে পারবেন।

(১) মুরগি পালন পদ্ধতির বিভিন্ন পর্ব

আলোনার এই অংশে আমরা মুরগি পালন পদ্ধতির বিভিন্ন পর্ব সম্পর্কে অবগত হব। মুরগি পালনের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করব। লিটার ও খাঁচা বা ব্যাটারি পদ্ধতিতে মুরগি পালনের পার্থক্যগুলো জানব।

প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম যে পদ্ধতিতেই ডিম ফোটানো হোক না কেন মুরগি থেকে সঠিক উৎপাদন পেতে হলে এদেরকে সঠিকভাবে লালন-পালন করতে হবে।

খামারে একদিন বয়সের বাচ্চা তোলার পর থেকে উৎপাদন শেষে বাতিল করা পর্যন্ত এদের পুরো লালন-পালনকালকে দুটো প্রধান পর্বের  ভাগ করা যায়। যেমন-

  1. বাচ্চা পালন পর্ব  ও
  2. বয়ষ্ক পোল্ট্রি পালন পর্ব।

ক) বাচ্চা পালন পর্ব

এ পর্ব টিকে দুটো উপপর্বের  ভাগ করা যায়। যেমন-

  1. ব্রুডিং পর্ব: এ পর্ব টি মুরগির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ের সঠিক যত্নের ওপরই এদের ভবিষ্যত জীবনের উৎপাদন নির্ভর করে। এ পর্ব টির স্থিতিকাল ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির যথাক্রমে ০-৪ ও ০-৫/৬ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত।
  2. গ্রোয়িং বা বৃদ্ধি পর্ব: যেহেতু এটি বৃদ্ধি পর্ব  তাই এ পর্বের র সঠিক যত্নের ওপর এদের বৃদ্ধি ও ভবিষ্যত উৎপাদন অনেকাংশে নির্ভর করে। ব্রয়লার ও ডিমপাড়া বা লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে এর স্থিতিকাল যথাক্রমে ৫-৬/৮ ও ৪/৫-১৮/২০ সপ্তাহ পর্যন্ত।

খ) বয়ষ্ক পোল্ট্রি পালন পর্ব

এ পর্ব টি ডিমপাড়া বা লেয়ার মুরগির ক্ষেত্রে ১৮/২০-৭২ সপ্তাহ পর্যন্ত। লেয়ার বা ডিমপাড়া মুরগির জীবনে সবগুলো পর্ব  আসলেও ব্রয়লার মুরগির পালন শুধু ব্রুডিং ও গ্রোয়িং পর্বের ই সীমাবদ্ধ।

(২) বিভিন্ন ধরণের মুরগি পালন পদ্ধতি

আমাদের দেশে সাধারণত মুরগি পালন পদ্ধতি তিনভাবে রকমের হয়। যথা-

  1. মুক্ত পদ্ধতি/ছেড়ে পালন।
  2. আধাছাড়া বা অর্ধ-আবদ্ধ অবস্থায় পালন।
  3. আবদ্ধ অবস্থায় পালন।

ক) মুক্ত/ছেড়ে পালন পদ্ধতি

এ পদ্ধতিতে সাধারণত গ্রামীণ পরিবেশে মুরগি পালন করতে দেখা যায়। এ মুরগি পালন পদ্ধতিতে মুরগি দিনের বেলায় বাড়ির আঙ্গিনায় চারিদিক থেকে খাবার খুঁজে খায় এবং রাতের বেলায় ঘরে ফেরে। এই পদ্ধতি বাণিজ্যিকভাবে মুরগি পালনের উপযোগী নয়। এই পদ্ধতির সুবিধা হলো ফেলে দেওয়া এঁটো ভাত, চালের খুদ, পোকামাকড়, কচি ঘাস, লতাপাতা ইত্যাদি খায় ফলে খরচ নেই বললেই চলে।

খ) অর্ধমুক্ত/অর্ধছাড়া পদ্ধতি

একটি নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে মুরগির চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত থাকে এই মুরগি পালন পদ্ধতিতে। মুরগি ঘরের সামনে ১.৫-২.০ ফুট উঁচু বাঁশ অথবা তারের জালি দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়। এই ঘেরা জায়গার মধ্যে খাদ্য ও পানি সরবরাহ করা হয়। মুক্ত পদ্ধতির তুলনায় এই পদ্ধতিতে উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে।

গ) আবদ্ধভাবে পালন পদ্ধতি

এক্ষেত্রে মুরগি সম্পূর্নভাবে ঘরে রেখে পালন করা হয়। এই মুরগি পালন পদ্ধতিতে জায়গা কম লাগে, খাদ্য খরচ বেশি হলেও লাভজনক। খামারিরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে লাভবান হতে পারেন।

আবদ্ধভাবে পালনের আবার তিনটি পদ্ধতি রয়েছ। যথা-

  1. লিটার পদ্ধতি
  2. মাচা পদ্ধতি
  3. খাঁচা/ ব্যাটারি পদ্ধতি।

i) লিটার পদ্ধাতি

এ মুরগি পালন পদ্ধতিতে মুরগির পালনকালের প্রতিটি পর্বই ডিপ লিটারের উপর অতিবাহিত হয়। লিটার হলো ঘরের মেঝের উপর কাঠের ছিলকা, করাতের গুড়া, তুষ, বালি, ছাই ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা বিছানা।

লিটার মলমূত্র শোষণ করে এবং মুরগির জন্য আরামদায়ক হয়। এই পদ্ধতিতে ৫.০ সেমি পুরু করে বিছানা তৈরি করতে হয়। বিছানা বেশি নোংরা বা স্যাঁতসেঁতে হলে তা সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিবর্তন করে দিতে হয়। ২-৩ মাস পরপর মুরগির ঘরের লিটার পরিবর্তন করতে হয়।

এ পদ্ধতিতে জায়গা বেশি লাগে। ব্রয়লার পালনের জন্য এটি ভালো পদ্ধতি। তবে, লেয়ার পালনের জন্যও এটি বহুল প্রচলিত। প্রতিটি পূর্ণবয়ষ্ক মুরগির জন্য ১.২-১.৫ বর্গফুট জায়গা দিতে হবে। লিটারের উপর খাবার ও পানির পাত্রে খাবার ও পানি সরবরাহ করা হয়। এই পদ্ধতিতে মুরগির ঘরে আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছণীয়।

ii) মাচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন

এই মুরগি পালন পদ্ধতিতে ঘরের মধ্যে মেঝে থেকে ১.০-১.৫ ফুট উপরে বাঁশ বা কাঠ দিয়ে মাচা তৈরি করতে হয়। মাচার দুটি বাঁশ বা কাঠের প্লেটের মধ্যে ০.৫-১.০ ইঞ্চি র বেশি ফাঁক হলে মুরগির পা ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মাচা এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে শুধু মুরগির মল নিচে পড়তে পারে।

See also  মুরগি পালন পদ্ধতি

খাবার ও পানির পাত্র মাচার উপরে দিতে হবে। ডিম পাড়ার বাসা মাচার একপাশে নিরিবিলি স্থানে দিতে হবে। এই পদ্ধতিতে ঘর পরিষ্কার থাকে এবং মুরগির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। সমন্বিত পদ্ধতিতে চাষের ক্ষেত্রে পানির উপর এভাবে ঘর তৈরি করে মুরগি পালন করা যায়।

iii) খাঁচায় পালন

চিত্র- মাচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন
চিত্র- মাচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন
চিত্র- খাঁচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন
চিত্র- খাঁচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন

এই পদ্ধতিতে এদের ব্রুডিং, গ্রোয়িং ও ডিমপাড়া প্রতিটি পর্বই বিশেষভাবে তৈরি খাঁচার ভিতর সম্পন্ন করা হয়। এ খাঁচাটি মুরগিা সংখ্যা ওপর নির্ভর করে ছোট বা বড় এবং একতলা বা বহুতলাবিশিষ্ট হতে পারে।

খাঁচা পদ্ধতিতে তুলনামূলকভাবে জায়গা বেশ কম লাগে। তাছাড়া এই পদ্ধতিতে রোগজীবাণুর আক্রমণ কম হয়। ডিমপাড়া মুরগি পালনের জন্য এটি আদর্শ পদ্ধতি। নিচে খাঁচা পদ্ধতিতে মুরগি পালন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

খাঁচার ধরন তিনটি। যথা-

  1. এক তলাবিশিষ্ট খাঁচা: যেসব জায়গায় গরম বেশি সেখানে একতলাবিশিষ্ট খাঁচা তৈরি করা ভালো। মুরগির সংখ্যা বেশি হলে এ ধরনের খাঁচা ব্যবহারে জায়গা বেশি লাগে। একটি টিন/ খড়ের চালার নিচে এই খাঁচা স্থাপন করতে হয়। এতে খাদ্য ও পানি প্রদান, ডিম সংগ্রহ এবং ময়লা পরিষ্কার তুলনামূলক সহজ।
  2. দুই তলাবিশিষ্ট খাঁচা: এক্ষেত্রে একটি খাঁচার উপর অন্য একটি খাঁচা এমনভাবে বসাতে হবে যাতে ময়লা সরাসরি নিচের তলার মেঝেতে পড়ে। উভয় তলার মধ্যবর্তী স্থানে টিনের বা প্লাস্টিকের ট্রে দেয়া হয়। ময়লা ট্রের উপর জমা হয়। সপ্তাহে কমপক্ষে তিনদিন ট্রে পরিষ্কার করতে হয়। এক তলাবিশিষ্ট খাঁচার তুলনায় দুই তল বিশিষ্ট খাঁচায় মুরগি পালনে জায়গা কম লাগে।
  3. তিল তলাবিশিষ্ট খাঁচা: এক্ষেত্রে একটি খাঁচার উপর অন্য একটি খাঁচা এমনভাবে বসাতে হবে যেমনটি সিঁড়ির ক্ষেত্রে দেখা যায়। এতে প্রতি তলার মুরগির মলমূত্র সরাসরি মেঝেতে পড়বে। বানিজ্যিকভাবে মুরগি পালনের ক্ষেত্রে এই খাঁচা অত্যন্ত জনপ্রিয়। যাদের জায়গার অভাব কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে মুরগি পালন করতে চান তারা এই পদ্ধতিতে মুরগি পালন করতে পারেন।

পারিবারিকভাবে বাড়িতে প্রচলিত পদ্ধতিতে ছেড়ে মুরগি পালনে ডিম উৎপাদন খুবই কম হয়। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে খামারভিত্তিতে বাণিজ্যিকভাবে মুরগি পালনের ফলে ডিমের উৎপাদন বহুলাংশে বেড়ে গেছে। বর্তমানে আবদ্ধ ঘরে লিটার এবং ব্যাটারি বা খাঁচা পদ্ধতিতে আরামদায়ক জায়গায় মুরগি পালন করা হচ্ছে। যে কোন মুরগি পালন পদ্ধতিতে পালন করা হোক না কেন মুরগির ঘর হবে আরামদায়ক ও ডিম উৎপাদরেন জন্য উপযুক্ত।

(৩) মুরগি পালনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম

আলোচনার এই অংশে আমরা মুরগি পালনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলোর নাম জানতে পারব। মুরগিকে কি খাওয়াতে হবে এবং কতটুকু খাওয়াতে হবে তা শিখতে পারব।

প্রাকৃতিক পরিবেশে মুরগি তার নিজের তত্ত্বাবধানের রেখে বাচ্চা পালন করে এবং পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়ানো ও পরিবেশে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার শিক্ষা দেয়। খাদ্য সংগ্রহ ও শিকারী জন্তুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাচ্চারা সম্পূর্ণভাবেই তার মায়ের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া মুরগি বাচ্চাদের তাপ ও আশয় প্রদানের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখে এবং এদের বৃদ্ধির জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে।

কিন্তু কৃত্রিম পরিবেশে আবদ্ধ পদ্ধতিতে খামারে পালিত বাচ্চাগুলো তাদের মা মুরগির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ পাওয়ার সুযোগ থেকে সম্পূর্ণ  বঞ্চিত। তাই এগুলো শেখার জন্য এদেরকে নিজেদের ওপরই নির্ভর করতে হয়। এদেরকে একসঙ্গে একই বয়সের শত শত বা হাজার হাজার বাচ্চার সঙ্গে থাকতে হয় যাদের সকলেই আনাড়ি। তাই স্বভাব শেখার বিষয়টি নিজেদেরই সম্পন্ন করতে হয়। সৌভাগ্যবশত মুরগির বাচ্চাগুলো অত্যন্ত ইঁচড়ে পাকা বা অকালপক্ক এবং মায়ের সাহায্য ছাড়াই সবকিছু শিখে নিতে পারে। কাজেই মুরগি থেকে ডিম ও মাংসের ভালো উৎপাদন পেতে হলে এদেরকে উপযুক্ত ও আরামদায়ক পরিবেশে পালন করতে হবে।

মুরগি পালনের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দরকার। আবদ্ধ অবস্থায় পালনের ক্ষেত্রে এ দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। 

মুরগির প্রয়োজনীয় উপকরনের একটি তালিকা দেয়া হল-

  1. থাকার জন্য ঘর (ঘরে অবশ্যই প্রয়োজনীয় আলো ও বাতাস চলাচল থাকতে হবে)
  2. ফ্যান
  3. লাইট
  4. ডিম পাড়ার বাক্স- ডিম উৎপাদনকারী মুরগির ক্ষেত্রে
  5. থার্মোমিটার
  6. হাইগ্রোমিটার
  7. খাবার পাত্র
  8. চিক গার্ড (ছোট বাচ্চার ব্রুডিং-এর সময়)
  9. ব্রুডার গার্ড (ছোট বাচ্চার ব্রুডিং-এর সময়)
  10. ভ্যাকসিন প্রয়োগ এর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি
  11. লিটার, যেমন- তুষ, বালি, শুকনো পাতা/খড়, কাঠের গুড়া ইত্যাদি
  12. ডিম সংগ্রহ করার ট্রে
  13. ঝাঁড়ু- ময়লা পরিষ্কার করার জন্য
  14. প্রয়োজনীয় পানির লাইন

(৪) মুরগির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা

প্রচলিত মুরগি পালন পদ্ধতিতে মুরগি পালনের ক্ষেত্রে খাদ্যেও জন্য কৃষক বা খামারি তেমন কোন খরচ করে না। কারণ মুক্তভাবে পালন পদ্ধতিতে এঁটো ভাত, চালের খুদ, পরিত্যক্ত অন্যান্য খাদ্যসামগ্রি মুরগিকে খাওয়ানো হয়। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে মুরগি পালনের ক্ষেত্রে খামারের মোট খরচের ৬০-৭০ ভাগই খাদ্যবাবাদ হয়। তাই উন্নত পদ্ধতিতে মুরগি পালনের উদ্দেশ্য হলো পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ করে উৎপাদন বজায় রেখে খাদ্য খরচ কমানো। খাদ্য অবশ্যই সুষম হতে হবে। কারণ পুুষ্টির চাহিদা পূরণ না হলে নানাবিধ রোগ দেখা দিতে পারে।

ক) খাদ্য

মুরগির খাদ্য কাকে বলে: যেসব উপাদান খাওয়ার পর হজম ও বিশেষিত হয়ে দেহে তাপ উৎপাদন করে শক্তি যোগায়, শরীর বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণ করে, রোগ প্রতিরোধ করে এবং ডিম ও মাংস উৎপাদন করে থাকে তাকে খাদ্য বলে।

সুষম খাদ্য কাকে বলে: যে খাদ্য প্রয়োজনীয় মাত্রায় আমিষ, শর্করা, তেল/চর্বি, ভিটামিন, খণিজপদার্থ, ভিটামিন ও পানি থাকে তাকে সুষম খাদ্য বলে।

খাদ্যের গুরুত্ব: 

খাদ্যের গুরুত্ব নিম্নরূপ-

  1. মুরগির দৈহিক বৃদ্ধি ও ক্ষয়পুরণ করে
  2. মুরগিকে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে সাহায্য করে
  3. রোগ প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে।

খ) খাদ্যোপাদান

খাদ্যের উপাদান প্রধানত ৬টি। এগুলো হলো-

  1. শকর্রা
  2. আমিষ
  3. চর্বি/ তেলজাতীয় খাদ্য
  4. খণিজপদার্থ
  5. ভিটামিন
  6. পানি

i) শকর্রা

শকর্রাজাতীয় খাদ্য প্রধানত শক্তি যোগায়। খাদ্যের ৬টি উপাদানের মধ্যে এটি তুলনামূলক বেশি প্রদান করতে হয় যা প্রায় ৭০-৮০ ভাগ।

See also  মুরগির বৈশিষ্ট্য ও মুরগির জাতের নাম

মুরগির দেহে শকর্রার প্রধান কাজ:

  1. দেহে তাপ উৎপাদনের মাধ্যমে শক্তি যোগায়
  2. শক্তি যোগানোর পর অতিরিক্ত শকর্রা মুরগির দেহে চর্বি হিসাবে জমা হয়

শকর্রার উৎস: চাল, চালের খুদ, গম, বার্লি, ভুট্টা, যব ইত্যাদি।

ii) আমিষ

আমিষজাতীয় খাদ্য দেহের দৈহিক বৃদ্ধি ও পুষ্টি সাধনের পাশাপাশি ক্ষয়পূরণ করে থাকে।

মুরগির দেহে আমিষের প্রধান কাজ:

  1. শরীরে নতুন কোষ তৈরি করে
  2. শরীরের গঠন ও দৈহিক বৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য
  3. ভেঙ্গে যাওয়া ও পুরাতন কোষের পুনঃগঠনে সাহায্য করে
  4. শরীরে পাচক রস, হরমোন এবং রক্তের লোহিত কনিকা তৈরি করে
  5. উৎপাদন বৃদ্ধি করে

আমিষের উৎস: আমিষ পাওয়া যায় ২টি প্রধান উৎস থেকে। যেমনপ্রাণিজ আমিষ- শুঁটকি মাছের গুঁড়া, শুকনো মাংস ও হাড় গুঁড়া, শুকনো রক্তে গুঁড়া ইত্যাদি উদ্ভিজ্জ আমিষ- সরিষার খৈল, তৈল খৈল, সয়াবিন মিল, নারিকেল খৈল ইত্যাদি।

iii) চর্বি

চর্বি মুরগির দেহে শক্তি যোগায় ও মাংসকে সুস্বাদু করে।

মুরগির দেহে চর্বির প্রধান কাজ:

  1. দেহে শক্তি যোগায়
  2. দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে
  3. দেহে সি ত খাদ্যের উৎস হিসাবে থাকে ও প্রয়োজনের সময় শক্তি যোগায়
  4. মাংসের স্বাদ বৃদ্ধি করে

চর্বির উৎস: সয়াবিন তেল, সরিষার তৈল, নারিকেল তৈল, গরুর চর্বি, মাছের তেল ইত্যাদি

iv) খনিজ পদার্থ

খনিজ পদার্থের মধ্যে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস প্রধানত দেহের অস্থি ও হাড় গঠনে সাহায্যে করে।

মুরগির দেহে খনিজ পদার্থের প্রধান কাজ:

বিভিন্ন খনিজ পদার্থের দেহের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে, যেমন-

  1. শরীরের হাড় ও ডিমের খোসা গঠন করে
  2. দেহের অম্লত্ব ও ক্ষারত্বের ভারসাম্য বজায় রাখে

খনিজ পদার্থের উৎস: হাড়ের গুঁড়া, মাছের কাটার গুঁড়া, ডিমের খোসার গুঁড়া, শামুক-ঝিঁনুকের গুড়া, লবণ, চুনা পাথর ইত্যাদি।

v) ভিটামিন

ভিটামিন-এর অপর নাম খাদ্যপ্রাণ। এটি দেহে খুবই সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন, কিন্তু এর অভাবে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়।

ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ হলো জৈব খাদ্য উপাদান যা সাধারণত খাদ্যে অতি অল্প পরিমাণে থেকে দেহের স্বাভাবিক পুষ্টি ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে। দেহে ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণের অভাবে বিভিন্ন রোগ বা সমস্যার প্রাদুর্ভাব হয়।

মুরগির দেহে ভিটামিনের প্রধান কাজ:

  1. শরীরকে সুস্থ্য রাখে
  2. শক্তি পরিবহনে সাহায্য করে
  3. পুষ্টিহীনতা দুর করে
  4. ধকল প্ররিরোধ করে
  5. উৎপাদন বৃদ্ধি করে

ভিটামিনের উৎস: উদ্ভিজ্জ তেল, শস্য দানা, যকৃতের তৈরি খাবার, হাঙর মাছের তেল, সবুজ ঘাস ইত্যাদি।

vi) পানি

পানির অপর নাম জীবন। ছোট বাচ্চার দেহের ৮০ ভাগই পানি। মুরগির দেহে ৫৫ ও ডিমে ৬৫ ভাগ পানি থাকে। দেহের পানির পরিমাণ ২০ ভাগের বেশি কমে গেলে মুরগির মৃত্যু হতে পারে।

পানির কাজ:

  1. পানি দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে
  2. দেহ থেকে বর্জ্য পদার্থ বের হতে সাহায্য করে
  3. রক্তের জলীয় পদার্থের মাধ্যমে পুষ্টি উপাদান শরীরের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন করে
  4. খাদ্য উপাদান শোষণ সাহায্য করে
  5. দেহের প্রয়োজনীয় পানির চাহিদা পূরণ করে

পানির উৎস: ভূগর্ভ।

প্রাকৃতিকভাবে মুরগি যেভাবে তার বাচ্চাদের যত্ন ও খাদ্যের ব্যবস্থা করে আধুনিক পদ্ধতিতে খামারভিত্তিতে পালনের ক্ষেত্রে এসব প্রয়োজনীয় উপকরণ ও খাদ্য খামারিকে কৃত্রিমাভাবে সরবরাহ করতে হয়। এতে মুরগি থেকে বেশি উৎপাদন পাওয়া যায়। পারিবারিক মুরগি পালনের জন্য আমরা মুরগিকে আলাদাভাবে তেমন কোন খাদ্য প্রদান করি না। কারণ মুক্তভাবে পালনের ক্ষেত্রে এঁটো ভাত, চালের খুদ, পরিত্যক্ত অন্যান্য খাদ্যসামগি মুরগিকে খাওয়ানো হয়। কিন্তু বানিজ্যিকভাবে মুরগি পালনের ক্ষেত্রে খাদ্যবাবদ প্রায় ৬০-৭০ ভাগ খরচ হয়। তাই উন্নত মুরগি পালন পদ্ধতির উদ্দেশ্য হল পর্যাপ্ত পুষ্টি সরবরাহ করে উৎপাদন বজায় রেখে খাদ্য খরচ কমানো। খাদ্য অবশ্যই সুষম খাদ্য হতে হবে। পুুষ্টির চাহিদা পূরণ না হলে নানাবিধ রোগ দেখা দিতে পারে।

(৫) ডিম পাড়া মুরগির খাদ্য তালিকা

এখন আমার ডিম পাড়া মুরগির খাদ্য তালিকা বা রেশন তৈরি করতে শিখব। ভিন্ন ভিন্ন বয়সের ডিম পাড়া মুরগির খাদ্য তালিকা দেখব।

লেয়ার বা ডিম পাড়া মুরগির খাদ্য তালিকা সুষম খাদ্যতালিকা (প্রতি ১০০ কেজি সুষম রেশন তৈরির সূত্র)-

খাদ্যদ্রব্যস্টার্টার (০-৮) সপ্তাহগ্রোয়ার (৯-১৭) সপ্তাহলেয়ার (১৮-৭২) সপ্তাহ
১। গম ভাঙ্গা/ভুট্টা৫৩.২৫ কেজি৫২.০০ কেজি৪৪.৭৫ কেজি
২। চালের গুঁড়া১৮.০০ কেজি২২.০০ কেজি২৪.০০ কেজি
৩। সয়াবিন মিল১৭.০০ কেজি১১.০০কেজি১৩.০০ কেজি
৪। মাছের গুঁড়া/ প্রোটিন কনসেনট্রেট১০.০০ কেজি১০.০০ কেজি১০.০০ কেজি
৫। ঝিনুকের গুঁড়া১.০০ কেজি৪.২৫ কেজি৭.৫০ কেজি
৬। লবণ (সর্বোচ্চ)০.৫০ কেজি০.৫০ কেজি০.৫০ কেজি
৭। ভিটামিন-মিনারেল প্রিমিক্স০.২৪ কেজি০.২৪ কেজি০.২৪ কেজি
৮। লাইসিন৫০ গ্রাম৫০ গ্রাম৫০ গ্রাম
৯ মিথিওনিন৫০ গ্রাম৫০ গ্রাম৫০ গ্রাম
মোট =১০০.০০ কেজি১০০.০০ কেজি১০০.০০ কেজি

(৬) ব্রয়লার মুরগির খাদ্য তালিকা

আলোচরা এর অংশে আমার ব্রয়লার মুরগির খাদ্য তালিকা বা রেশন তৈরি করতে শিখব। ভিন্ন ভিন্ন বয়সের ব্রয়লার মুরগির খাদ্য তালিকা দেখব।

ব্রয়লার মুরগির সুষম খাদ্যতালিকা (প্রতি ১০০ কেজি সুষম রেশন তৈরির সূত্র)-

খাদ্যদ্রব্যস্টার্টার (০-১৪) দিনফিনিশার (১৫ দিন থেকে বিক্রি পর্যন্ত)
১। গম ভাঙ্গা/ভুট্টা৪৭.০০ কেজি৫২.০০ কেজি
২। চালের গুঁড়া২০.০০ কেজি১৮.০০ কেজি
৩। তিলের খৈল১৩.০০ কেজি১২.০০ কেজি
৪। শুটকি মাছের গুঁড়া১৮.০০ কেজি১৫.০০ কেজি
৫। ঝিনুকের গুঁড়া১.২৫ কেজি
৬। হাড়ের গুড়া১.২৫ কেজি১.০০ কেজি
৭। লবণ (সর্বোচ্চ)০.৫০ কেজি০.৫০ কেজি
ভিটামিন-মিনারেল প্রিমিক্স০.২৫ কেজি০.২৫ কেজি
মোট১০০.০০ কেজি১০০.০০ কেজি

(৭) মুরগির রোগের লক্ষণ ও মুরগির রোগ প্রতিরোধের উপায়

আলোচনার এ অংশে আমরা সুস্থ ও অসুস্থ মুরগির বৈশিষ্ট্য জানতে পারব। বিভিন্ন রকমের মুরগির রোগের লক্ষণ ও মুরগির রোগ প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে অবগত হব।

রোগব্যাধি মুরগির জন্য এক বিরাট হুমকি। মুরগি খামারে লোকসানের যতগুলো কারণ রয়েছে রোগব্যাধি তার অন্যতম। রোগব্যাধি থেকে মুরগিকে রক্ষা করতে না পারলে খামার থেকে লাভ তো দূরের কথা খামারের

See also  ডিম সংগ্রহ ও বাছাই করার নিয়ম

অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। কাজেই মুরগির রোগব্যাধি সম্পর্কে  খামারিদের প্রাথমিক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। তবেই এ ব্যাপারে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবেন। সুস্থ ও অসুস্থ মুরগির লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো জানা থাকলে খামারিরা তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

ক) সুস্থ ও অসুস্থ মুরগি চেনার উপায়

সুস্থ ও অসুস্থ মুরগি চেনার উপায় হলো-

  1. সুস্থ মুরগি সব সময় সতর্ক  ও সক্রিয় থাকবে। অসুস্থ মুরগি দীর্ঘক্ষণ ধরে চুপ করে ঝুমতে থাকবে।
  2. সুস্থ মুরগি স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়াবে। অসুস্থ মুরগি দল থেকে আলাদা হয়ে মাথা দেহের ভিতরে গুঁজে থাকবে।
  3. সুস্থ মুরগির মাথার ঝুঁটি উজ্জ্বল লাল হবে। তবে অসুস্থ মুরগির মাথায় ঝুঁটি নীলচে বর্ণের হতে পারে।
  4. সুস্থ মুরগির পালক চকচকে হবে। অসুস্থ মুরগির পালক উসকো-খুসকো থাকবে।
  5. সুস্থ মুরগির পায়ের আঁইশগুলো মসৃণ হবে। আঁইশ ঝুলে পড়া মুরগি মাইট আক্রান্ত।
  6. সুস্থ মুরগির চোখ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকবে। অসুস্থ মুরগির চোখ ও নাক দিয়ে কোন তরল পদার্থ নিংসৃত হবে।
  7. সুস্থ মুরগির পায়ের আঙুল সোজা থাকবে। মুরগির উপর ও নিচের ঠোঁট মাঝখানে মিলিত হবে। ঠোঁট দুটি কখনো ও পরস্পর ছেদ করবে না।
  8. সুস্থ মুরগির পায়ুপথের চারিদিকের পালক পরিষ্কার থাকবে।
  9. সুস্থ মুরগি স্বাভাবিকভাবে খাবার গ্রহণ করবে। অসুস্থ হলে খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে চাইবে।
  10. সুস্থ মুরগির দেহের তাপমাত্রা ১০৬-১০৭ ফারেনহাইটের মধ্যে থাকবে। কম বা বেশি হলে বুঝতে হবে মুরগিটি অসুস্থ।

খ) মুরগির রোগব্যাধির শ্রেণি বিভাগ

মুরগি নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। রোগ সৃষ্টিকারী কারণের উপর ভিত্তি করে মুরগি রোগ নিম্নলিখিত ভাবে ভাগ করা হয়েছে। যথা-

  1. ভাইরাসঘটিত রোগসমূহ: ভাইরাসঘটিত রোগগুলোর মধ্যে রাণীক্ষেত, বসন্ত, গামবোরো, ইনফেক্শাস বার্সাইটিস, সংক্রামক ক্লোমনালী প্রদাহ, মারেক-এর রোগ, লিউকোসিস, এনসেফালোমাইয়েলাইটিস, বৃক্ক প্রদাহ, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইতাদি অন্যতম।
  2. ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগসমূহ: ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগগুলোর মধ্যে পুলোর, কলেরা, টাইফয়েড, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বা সি.আর.ডি., ক্ষতসৃষ্টিকারী অস্ত্রপ্রদাহ, করাইজা, যক্ষা, বটুলিজম, ই.কলাই ইনফেকশান ইত্যাদি অন্যতম।
  3. ছত্রাকঘটিত রোগসমূহ: ছত্রাকঘটিত রোগগুলোর মধ্যে ব্রুডার নিউমোনিয়া, আফলাটক্সিকোসিস, মাইকোটক্সিকোসিস ইত্যাদি অন্যতম।
  4. মাইকোপ্লাজমাঘটিত রোগসমূহ: মাইকোপ্লাজমাঘটিত রোগগুলোর মধ্যে মাইকোপ্লাজমোসিসই প্রধান।
  5. পরজীবীঘটিত রোগসমূহ: পরজীবীঘটিত রোগগুলোর বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন- ক. প্রোটোজোয়াঘটিত: প্রোটোজোয়াঘটিত রোগগুলোর মধ্যে ককইসডিওসিসই প্রধান। খ. অন্তঃপরজীবী বা কৃমি: বিভিন্ন কৃমি, যেমন- গোলকৃমি, সিকাল কৃমি, গেপ কৃমি, ফিতা কৃমি প্রভৃতির মাধ্যমে সৃষ্টি রোগগুলোই প্রধান। গ. বহিঃপরজীবী: বহিঃপরজীবীগুলোর মধ্যে উকুন, আটালি, মাইট ইত্যাদির কারণে সৃষ্টি রোগগুলোর প্রধান।
  6. অপুষ্টিজনিত রোগসমূহ: অপুষ্টিজনিত রোগগুলোর মধ্যে নিউট্রিশনাল রোপ, রিকেট, কার্লড টো প্যারালাইটিস, চিক ডার্মাটাইটিস, এনসেফালোম্যাসিয়া ইত্যাদি অন্যতম।

গ) মুরগির সাধারণ রোগ বালাই

উপরে উল্লেখিত বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধির মধ্যে কয়েকটি সাধারণ রোগ যা সবসময়ই মুরগি খামারে দেখা যায়, সেগুলো নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।

i) রাণীক্ষেত/চুনা হাগা রোগ

এটি একটি মারাত্মক ছোঁয়াছে রোগ। এ রোগ এক মুরগি থেকে অন্য মুরগিতে খুব দ্রুত ছড়ায়। এ রোগ মুরগি থেকে মানুষ বা মানুষ থেকে মুরগিতে ছড়াতে পারে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে চোখে সমস্যা দেখা যায়। সাধারণত অতিরিক্ত গরম/ঠান্ডা পড়লে এ রোগ দেখা যায়। ছোট বাচ্চা এবং বড় মুরগি উভয়ই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এতে মৃত্যুর হার ১০০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে।

লক্ষণ:

  1. সাদা চুনের মতো পায়খানা করে। সবুজ ও হলুদ পায়খানাও হতে পারে।
  2. ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে মাথা দুই পায়ের ভিতরে ঢুকাতে দেখা যায়।
  3. ডানা নিচের দিকে ঝুলে পড়ে।
  4. শ্বাসকষ্ট হয় এবং ঘড় ঘড় শব্দ করে।
  5. কাশি হয়, নাক দিয়ে পানি পড়ে।

প্রতিরোধের উপায় ও চিকিৎসা: সময় অনুযায়ী টিকা দিলে এ রোগ ৯০% প্রতিরোধ করা যায়। আক্রান্ত মুরগি দ্রুত পৃথক করে ফেলতে হবে। খামারে বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। দক্ষ প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।

ii) ফাউল পক্স বা মুরগির বসন্ত

এটি একটি ছোঁয়াছে রোগ। কোন মুরগি আক্রান্ত হলে তাকে আলাদা না করলে সব মুরগিতে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত তিন সপ্তাহ বয়সের বাচ্চার এ রোগ হয়। তবে যে কোনো বয়সের মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

লক্ষণ:

  1. পালকবিহীন জায়গা, যেমন- চোখ, মাথার ঝুঁটি, কানের লতি, পা-এর খালি জায়গায় ছোট ছোট গুটি দেখা যায়।
  2. শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং খাবার খেতে চাইবে না।
  3. ডিম পাড়া কমে যায়।

প্রতিরোধের উপায় ও চিকিৎসা: প্রতিরোধের জন্য ৪০ দিন বয়সের বাচ্চাকে ফাউল পক্সের টিকা দিতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে খামার পরিচালনা করলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। দক্ষ প্রাণী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। তবে প্রাথমিকভাবে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট/ডেটল/সেভলনমিশ্রিত পানি দিয়ে আক্রান্ত স্থান দিনে ৩-৪ বার পরিষ্কার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

iii) মুরগির কলেরা রোগ

মানুষের মতো মুরগিরও কলেরা রোগ হয়। যে কোনো বয়সের মুরগি এতে আক্রান্ত হতে পারে। তবে বাড়ন্ত বয়সের মুরগি অর্থাৎ ১২ সপ্তাহ বা তার বেশি বয়সের মুরগিতে এ রোগ হয়ে থাকে।

লক্ষণ:

  1. অধিক পানিযুক্ত অর্থাৎ ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হয়। পায়খানার রং সবুজ ও দূর্গন্ধযুক্ত হয়।
  2. আক্রান্তের মাত্রা বেশি হলে হঠাৎ মারা যায়।
  3. খাদ্য গ্রহণে অনিহা ও ওজন দ্রুত কমে যায়।
  4. শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়।

প্রতিরোধের উপায় ও চিকিৎসা: নয় সপ্তাহ বয়সের মুরগিকে কলেরা প্রতিরোধক টিকা বুকে বা রানের মাংসে প্রয়োগ করতে হবে। পরিষ্কার খাবার ও পানি সরবরাহ করতে হবে। ভেটেরিনারি সার্জনের পরামর্শ অনুযায়ী।

iv) মুরগির অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগ

এ রোগ ভাইরাস দ্বারা ঘটে যা বার্ড ফ্লু নামে পরিচিত। এটি মুরগি থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। বন্য পাখি ও পরিযায়ী পাখি এ রোগের প্রধান বাহক। এ রোগে আক্রান্ত মুরগির মৃত্যু হার বেশি।

লক্ষণ:

  1. আক্রান্ত মুরগির আকস্মিক মৃত্যু হয়।
  2. মাথার ঝুঁটি ও কানের লতি নীলাভ বর্ণ ধারণ করে।
  3. নাক ও মুখ দিয়ে পানি ঝরে।
  4. পায়ের ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ হয় এবং প্যারালাইসিসও হতে পারে।
  5. ক্ষুধামান্দ হয় ও ডিমপাড়া বন্ধ হয়ে যায়।

প্রতিরোধের উপায় ও চিকিৎসা: বন্যপ্রাণী ও পাখির সংস্পর্শ থেকে মুরগিকে মুক্ত রাখতে হবে। এ রোগে আক্রান্ত হলে সমস্ত মুরগি মেরে ফেলতে হবে এবং উপযুক্ত সৎকার করতে হবে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পালনের মাধ্যমে এ রোগ দমন করা যায়। এ রোগের সুনির্দিষ্ট কোর চিকিৎসা নেই।

আমাদের বাংলাদেশে সাধারনত মুরগির রানীক্ষেত, বসন্ত, কলেরা ও অ্যভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদি রোগ হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে মুরগির রোগ বালাই কম হয়ে থাকে। রোগ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম।

উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা মুরগি পালন পদ্ধতির বিভিন্ন পর্ব, বিভিন্ন ধরণের মুরগি পালন পদ্ধতি, মুরগি পালনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, মুরগির খাদ্য ও খাদ্য ব্যবস্থাপনা, ডিম পাড়া মুরগির খাদ্য তালিকা, ব্রয়লার মুরগির খাদ্য তালিকা, মুরগির রোগের লক্ষণ ও মুরগির রোগ প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে জানলাম।

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে হাঁস-মুরগির গুরুত্ব অপরিসীম। তুলনামূলক স্বল্প বিনিয়োগ এবং অল্প ভূমিতে বাস্তবায়নযোগ্য বিধায় জাতীয় অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাঁস-মুরগি পালন, বেকার যুব সমাজ, ভূমিহীন কৃষক এবং দুস্হ গ্রামীন মহিলাদের আত্ম-কর্মসংস্হানের একটি উল্লেখযোগ্য উপায়।

দেশের অধিকাংশ মানুষ পুষ্টি সমস্যায় আক্রান্ত। হাঁস-মুরগির মাংস ও ডিম উন্নতমানের প্রাণিজ আমিষের উৎস। মাংস ও ডিমের মাধ্যমে প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণ করে এই সমস্যা সমাধান করা যায়।

আদিকাল থেকে গ্রাম বাংলার মহিলারা বাড়তি আয়ের উৎস হিসাবে হাঁস-মুরগি পালন করে আসছে। বর্তমানে মুরগি পালন পদ্ধতিতে প্রযুক্তি ও উন্নয়নের ছোঁয়াতে বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে।

হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা উন্নতমানের জৈব সার যা ব্যবহার করে কৃষি ফসল উৎপাদনে লাভবান হওয়া যায়। হাঁস-মুরগির পালক দ্বারা খেলার সামগ্রী, ঝাড়- ইত্যাদি এবং রক্ত ও নাড়িভূড়ি প্রক্রিয়াজাত করে পশু-পাখীর খাদ্য তৈরীর জন্য আলাদা শিল্প গড়ে উঠেছে। পোল্ট্রির বর্জ্য এবং লিটার ব্যবহার করে বায়োগ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব যা ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানী সাশ্রয় করে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা যায়।

[সূত্র: ওপেন স্কুল]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts

You cannot copy content of this page