মৌরি বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় মসলা জাতীয় ফসল।
কনফেকশনারী ও রন্ধনশালার দৈনন্দিন বিভিন্ন রকম খাবার তৈরিতে মৌরি ব্যবহার হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মৌরি সস হিসাবে দেশের ছোট, বড়, মাঝারী সকল রেস্টুরেন্টে বহুল প্রচলিত একটি নাম।
মৌরি সস হিসেবে ব্যবহারের প্রধান কারণ এর গন্ধ। খাবার পর মৌরি খেলে মুখে খাওয়ার গন্ধ দূর হয়ে যায়।
মৌরির বীজ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঔষধ তৈরি করা হয়।
(১) মৌরির জাত পরিচিতি
দেশ ও বিদেশ থেকে মৌরির ১০টি Germplasm সংগ্রহ করে ২০০৯ সাল হতে ২০১০ সাল পর্যন্ত ২ বছর মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বগুড়ায় উক্ত Germplasm সমূহের ফলনসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করা হয়। এর পর ২০১১ সাল থকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রথমিক ফলন পরীক্ষার মাধ্যমে কিছু উচ্চ ফলনশীল মৌরির লাইন বাছাই করা হয়।
পরবর্তীতে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত স্থানীয় মৌরির সাথে Check হিসাবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের লালমনিরহাট, বগুড়া, মাগুড়া, রাজশাহী, ফরিদপুর, গাজীপুর, কুমিল্লা, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম-এ আঞ্চলিক ফলন পরীক্ষা করা হয়। এতে FN01 ও FN06 লাইন ২টির ফলনসহ সকল বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করে জাত হিসেবে অনুমোদনের জন্য ২০১৬ সালে জাতীয় বীজ বোর্ডে আবেদন করা হয় এবং ২০১৬ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড FN01 লাইনটিকে বারি মৌরি-১ জাত হিসাবে এবং FN06 লাইনটিকে বারি মৌরি-২ জাত হিসাবে অনুমোদন প্রদান করা হয়।
ক) বারি মৌরি-১
- মৌরি গাছ উচ্চতায় ১০০-১৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
- প্রতি গাছে গড় শাখা-প্রশাখা ৬-৭ টি, আম্বেল ৩৯ টি, প্রতি আম্বেলে আম্বেললেটের সংখ্যা প্রায় ২৭ টি এবং প্রতি আম্বেললেটে বীজের সংখ্যা প্রায় ১২ টি।
- প্রতি ১,০০০ বীজের গড় ওজন ৫-৬ গ্রাম।
- বীজ এর ফলন প্রতি হেক্টরে ১.৫৩-২.০৫ টন।
- এজাতের জীবনকাল ১৪০-১৫০ দিন এবং বীজ সংগ্রহের সময় ২-৩ ধাপে ফসল সংগ্রহ করতে হয়।
খ) বারি মৌরি-২
- মৌরি গাছ উচ্চতায় ১০০-১২৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
- প্রতি গাছে গড় শাখা-প্রশাখা প্রায় ৬টি, আম্বেল ৩০ টি, প্রতি আম্বেলে আম্বেললেটের সংখ্যা প্রায় ২২টি এবং প্রতি আম্বেললেটে বীজের সংখ্যা প্রায় ১৩-১৪ টি।
- প্রতি ১০০০ বীজের গড় ওজন ৫.২ গ্রাম।
- বীজ এর ফলন প্রতি হেক্টরে ১.৬-১.৮ টন।
- এজাতের জীবনকাল ১৩০-১৪০ দিন যা বারি মৌরি-১ থেকে প্রায় ১০-২০ দিন আগেই পাকে এবং কাটার সময় প্রায় ৮৫-৯০ ভাগ গাছের ফল একসাথে কাটা যায়।
(২) মৌরি চাষ পদ্ধতি
ক) মাটি ও আবহাওয়া
- প্রায় সব রকমের মাটিতেই মৌরির চাষ করা যায়। তবে বেলে দোআঁশ থেকে এঁটেল দোআঁশ মাটি মৌরি চাষের জন্য উপযোগী।
- মৌরি জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না বিধায় জমিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- ঠান্ডা আবহাওয়া মৌরির বীজ উৎপাদনের জন্য অনুকূল বলে রবি মৌসুমে এর চাষ করা হয়ে থাকে। উচ্চ তাপমাত্রায় ও খরায় মৌরি বীজের ফলন ভাল হয় না।
- ফুল ফোটার সময় বৃষ্টি এবং অতিরিক্ত কুয়াশা হলে মৌরির ফলন কমে যায় এবং বীজের মান খারাপ হয়ে যায়।
খ) বপন সময়
- কার্তিক (মধ্য অক্টোবর-মধ্য নভেম্বর) মাস বীজ ফসলের জন্য উত্তম।
- মরিচ, শাক-সবজি, আখ, আলু, ডাল, মসলা জাতীয় অন্য ফসলের জমিতে সাথী ফসল হিসাবে মৌরির চাষ করা যায়।
- অতিরিক্ত সূর্যালোকে বীজ বপন করলে অঙ্কুরোদ্গমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।
- মৌরি বীজের জন্য বিলম্বে বীজ বপনে এর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং বিভিন্ন রোগবালাই এর আক্রমণ বেড়ে যায় ও বীজের মান খারাপ হয়ে ফলন কমে যায়।
গ) জমি তৈরি
- মাটির প্রকারভেদে ৪-৬ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হবে।
- পরে জমিতে ১.৫ মিটার থেকে ২.০ মিটার চওড়া ও প্রয়োজনমতো লম্বা বেড তৈরি করতে হবে।
- পানি নিষ্কাশনের জন্য দু’বেডের মাঝে ৩৫-৪০ সেমি নালা রাখতে হবে।
ঘ) বীজের হার
সারিতে হেক্টরপ্রতি ৭-৯ কেজি এবং ছিটিয়ে বোনার ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ৯-১২ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
ঙ) বীজ বপন
- মৌরির বীজ বোনার আগে পানিতে ১২-২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে বুনলে তাড়াতাড়ি অঙ্কুরোদ্গম হয়।
- সারিতে বোনার ক্ষেত্রে মাটির ২-৩ সেন্টিমিটার গভীরে বীজ বপন করে, সারি থেকে সারির দূরত্ব ৪০ সেন্টিমিটার, গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ১০ সেন্টিমিটার বজায় রাখতে হবে।
- বপনকৃত বীজ অঙ্কুরোদ্গম হতে সাধারণত ৮-১৫ দিন সময় লাগে। কোন কোন ক্ষেত্রে এর চাইতেও বেশি সময় লাগতে পারে।
- জমির আর্দ্রতার উপর নির্ভর করে বীজ বপনের পর পরই হালকা সেচ দিতে হবে। তাতে অঙ্কুরোদগম বৃদ্ধি পাবে।
চ) সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
মৌরি চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি নিচের হারে সার প্রয়োগ করতে হয় জমি তৈরির সময় সমস্ত গোবর, এমওপি ও টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
ইউরিয়া ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। চারা গজানোর ২৫ দিন পর ১ম কিস্তি এবং ফুল ফোটার পর পর বাকি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
সার | মোট পরিমাণ | শেষ চাষের সময় প্রয়োগ | পরবর্তী পরিচর্যা হিসেবে: ১ম কিস্তি | পরবর্তী পরিচর্যা হিসেবে: ২য় কিস্তি |
গোবর | ৫ টন | সব | – | – |
ইউরিয়া | ১৮০ কেজি | – | ৯০ কেজি | ৯০ কেজি |
টিএসপি | ১৭৫ কেজি | সব | – | – |
এমওপি | ১৪০ কেজি | সব | – | – |
জিপসাম | ১১০ কেজি | সব | – | – |
জিংক সালফেট | ৮ কেজি | সব | – | – |
বোরিক এসিড | ১০ কেজি | সব | – | – |
ছ) আন্তঃপরিচর্যা
- বীজ বপনের ১৫-২০ দিনের মধ্যে প্রথম নিড়ানী দিতে হবে। একই ভাবে একই সময়ের ব্যবধানে পরবর্তীতে আরো ২-৩ টি নিড়ানী দিতে হবে।
- প্রতিবার সেচের পর জমির ’জো’ আসা মাত্র মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে।
- চারা গজানোর পর থেকে ২/৩ ধাপে ৪-৫ দিন পরপর নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চারা পাতলা করে দিতে হবে।
জ) সেচ
- মৌরির ফসলে ৪-৫ টি সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
- গজানোর সময় হালকা সেচ, এ ছাড়া গাছের ৪-৫ পাতা অবস্থায়, শাখা বের হওয়া, ফুল আসার ও দানা গঠনের সময় মাঝারী সেচ দিতে হবে। এতে বীজ পুষ্ট ও ফলন বেশি হয়। সেচের অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে।
ঝ) পোকামাকড়
- কীটপতঙ্গের মধ্যে মৌরিতে জাব পোকার আক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। কালচে রঙের ছোট পোকা গাছের কান্ডসহ বীজের উপর বসে রস চুষে খায়। আক্রমণ বেশি হলে বীজ কালো হয়ে গাছ শুকিয়ে যাওয়ার মতো মনে হয়।
- গাছে ফুল ও ফল ধরার সময় জাব পোকার আক্রমণ বেশি হয়।
ঞ) দমন
প্রতি লিটার পানিতে ১-২ মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন-১০০ ইসি বা ১ মিলিলিটার কনফিডর-২৫ ইসি ভালোভাবে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।
ট) মৌরির ব্লাইট রোগ
- অলটারনারিয়া ব্রাসিসিকোলা (Alternia brassicola) নামক জীবাণু দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। গাছে ফুল আসার সময় এ রোগ দেখা যায়।
- প্রথমে পাতার উপর ছোট ছোট কালো কালো দাগ পড়ে। পরে এ দাগসমূহ সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। তারপর কান্ড ও শাখা প্রশাখায় ছড়িয়ে পড়ে। কুয়াশাচ্ছন্ন ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এক সপ্তাহের মধ্যে সমস্ত গাছ কালো হয়ে ঝলসে যায় ও গাছ মারা যায়।
ঠ) দমন ব্যবস্থাপনা
প্রতি বীজে ৩ গ্রাম হারে বীজ শোধন করতে হবে এবং এই রোগ দেখা দিলে এমিস্টার টপ প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার গাছে স্প্রে করতে হবে।
ঢ) ফসল সংগ্রহ
- বপনের ১৪০-১৫০ দিন পর মৌরি পাকে। পাকলে বীজগুলো হালকা হলদে হয়ে পাতা শুকিয়ে যায়।
- সাধারণত খুব ভোরে অর্থাৎ সূর্যের আলোর প্রখরতা বৃদ্ধির পূর্বে শাখা কেটে নিতে হবে।
- মৌরির বীজ হালকা সবুজ অবস্থায় থাকতেই গাছ থেকে বীজসহ তুলতে হবে। এভাবে ২-৩ ধাপে বীজ সংগ্রহ করতে হবে নতুবা বীজের মান ভাল হয় না বীজ কালো হয়ে নষ্ট হযে যায়।
- মৌরি বীজ সাধারণত রৌদ্রাঁজ্জ্বল দিনে সংগ্রহ করতে হবে।
- বীজ সংগ্রহের পর এক জায়গায় গাদা করে রাখা যাবে না কারণ গাদা করে রাখলে বীজ কালচে হয়ে যায়।
- বীজ রোদে শুকিয়ে মাড়াই-ঝাড়াই করে পৃথক করা হয়। বীজে আর্দ্রতার পরিমাণ ৮-১০% রেখে শুকিয়ে ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
[সূত্র: বিএআরআই]