মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে এদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে স্থলভাগে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে সেচ ছাড়াই অনেক ফসল চাষ করা যায়। বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের ফলে খালবিল, নদী নালা, পুকুর ডোবা পানিতে ভরে যায় এবং প্রচুর মাছ জন্মায়।
আর্টিকেলটি শেষ অবধি পড়লে আপনি- মৌসুমী বায়ু কাকে বলে, তা অবগত হতে পারবেন; বাংলাদেশের কৃষিতে মৌসুমি জলবায়ুর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন; বাংলাদেশের কৃষিতে মৌসুমি জলবায়ুর উপযোগিতা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
(১) মৌসুমী বায়ু কাকে বলে?
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। আর এদেশের কৃষিতে মৌসুমি বায়ুর গুরুত্ব অপরিসীম।
মৌসুমী বায়ু কাকে বলে: “মৌসিম” একটি আরবী শব্দ। এর অর্থ ঋতু। বাংলা মৌসুমি শব্দটি এসেছে এই মৌসিম শব্দ থেকেই এসেছে। বিভিন্ন ঋতুতে জলবায়ুর যে পরিবর্তন তাকে বলা হয় মৌসুমি বায়ু।
বাংলাদেশ মৌসুমি জলবায়ুর দেশ। দু’ধরনের মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যথা-
- একটি দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এবং
- অপরটি উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু।
গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম এবং শীতকালে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ বায়ুর উৎপত্তির কারণ পানি ও স্থলের উষ্ণতার তারতম্য।
গ্রীষ্মকালে অধিক তাপের জন্য উত্তর গোলার্ধের কোন কোন স্থানে নিম্ন চাপের সৃষ্টি হয়। এ সময় দক্ষিণ গোলার্ধে সূর্যতাপ কম হওয়ায় উচ্চ চাপের সৃষ্টি হয়। তখন দক্ষিণের উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়ে উত্তরের নিম্ন চাপ অঞ্চলের দিকে যায়। দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হতে এ বায়ু বাংলাদেশে আসে বলে একে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বলা হয়। কিন্তু শীতকালে এ বায়ু আসে উত্তর-পূর্ব দিক হতে, তাই একে বলা হয় উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু।
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু জলভাগের দিক থেকে স্থল ভাগের দিকে আসে বলে এতে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকে। তাই এই বায়ুতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দুটি শাখায় বিভক্ত-একটি বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে, অপরটি আরব সাগরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বঙ্গোপসাগর হতে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় তা হিমালয় পর্বতে বাধা পেয়ে বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়।
পক্ষান্তরে উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু স্থল ভাগ থেকে জলভাগের দিকে প্রবাহিত হওয়ায় এতে জলীয় বাষ্প প্রায় থাকেই না। তাই এই বায়ু দ্বারা শীতকালে এদেশে অতি সামান্য বৃষ্টি হয়। সিলেটে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সর্বাধিক।
মৌসুমি জলবায়ুর একটি বৈশিষ্ট্য হল এই যে, এতে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অত্যাধিক। কিন্তু এখানে নিরক্ষীয় অঞ্চলের মত সারা বছরব্যাপী বৃষ্টিপাত না হয়ে অধিকাংশ বৃষ্টিপাত কেবলমাত্র গ্রীষ্মকালেই হয়। এ জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে অধিক গরম এবং শীতকালে বেশ শীত পড়ে। এই জলবায়ুর অন্য এর একটি বৈশিষ্ট্য হল উপকূল থেকে দেশের অভ্যন্তরের দিকে বৃষ্টিপাত ক্রমশ কম।
সাধারণত মৌসুমি জলবায়ু এলাকায় ৩টি ঋতু সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়। এগুলি হলো-
- শীতল ও শুষ্ক শীতকাল,
- উষ্ণ ও শুষ্ক গ্রীষ্মকাল
- ও আদ্র বর্ষাকাল।
মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে বর্ষাকালে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়।
(২) বাংলাদেশের কৃষিতে মৌসুমি জলবায়ু গুরুত্ব
বাংলাদেশের কৃষিতে মৌসুমি জলবায়ুর গুরুত্ব: বাংলাদেশের কৃষি একান্তভাবেই মৌসুমি জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। কৃষিকার্যের জন্য প্রচুর পানি প্রয়োজন। অথচ আমাদের দেশে পানি সেচের পর্যন্ত ব্যবস্থা নেই। কজেই কৃষি উৎপাদনের জন্য মৌসুমি জলবায়ু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিচে বাংলাদেশের কৃষিতে মৌসুমি জলবায়ু গুরুত্ব বর্নণা করা হলো-
১। জমি তৈরী, বীজবপন, বীজ গজানো, চারা রোপন, ফসলের পরিচর্যা ইত্যাদির জন্য মাটিতে রসের প্রয়োজন। মৌসুমি বৃষ্টির মাধ্যমে মাটিতে যে পানি যুক্ত হয় তা দ্বারা এ সকল কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা যায়।
২। বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলসমূহ যেমন- পাট, চা, আখ ইত্যাদির উৎপাদন মৌসুমি জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। সময়মত ও পরিমাণমত বৃষ্টিপাত না হলে এই সকল কাঁচামালও ঠিকমত জন্মাবেনা। ফলে কৃষির সাথে সাথে শিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
৩। বর্ষা মৌসুমে মৎস্য চাষীরা মাছ আহরণ করে থাকেন। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এতে নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হাওর-বাওর প্রভৃতি পানিতে ভরে যায়। ফলে এসব জলাশয়ে প্রচুর মাছ জন্মায়।
৪। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ হলো বনজসম্পদ যা গড়ে উঠেছে মৌসুমি বায়ুর কল্যাণে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে পাহাড়িয়া অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ার ফলে এ বনজ সম্পদ গড়ে উঠেছে।
৫। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ভারসাম্য একান্তভাবেই বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল। মৌসুমি বায়ু অনুকূলে থাকলে কৃষিজাত দ্রব্য অধিক পরিমাণে উৎপন্ন হয়। ফলে রপ্তানি বাণিজ্যেরও উন্নতি ঘটে।
৬। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সময়মত ও পরিমিত বৃষ্টিপাত হলে ধান, পাট, তামাক, আখ, চা প্রভৃতি ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এর ফলে কৃষকের হাতে টাকা আসে ও সরকারের রাজস্ব, রেল ও অন্যান্য পরিবহন কোম্পানির আয় বাড়ে ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধি ঘটে।
৭। মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে দেশে সমভাবাপন্ন জলবায়ু অর্থাৎ পরিমিত তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা বিরাজ করে যা কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
৮। মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে নদ-নদী পানিতে ভরে যাওয়ার ফলে নৌকা ল স্টিমার প্রভৃতি চলাচলে সুবিধা হয়। ফলে কৃষিপণ্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অনায়াসে পরিবহন করা যায়।
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশের অর্থনীতি একান্তভাবেই মৌসুমি জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। মৌসুমি বায়ু প্রতিকূল হলে আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। তাই আমাদের দেশের কৃষির উপর মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাব বিদ্যমান থাকায় বাংলাদেশের কৃষিকে মৌসুমি জলবায়ুর নির্ভর কৃষি বলা হয়।
(৩) বাংলাদেশের কৃষিতে মৌসুমি জলবায়ুর উপযোগিতা
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রকই হল কৃষি। ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের জনগণের প্রায় ৫২% প্রত্যক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল এবং জাতীয় আয়ের ২১.৮৪% সরাসরি কৃষি থেকে আসে। আবার এদেশের বনজসম্পদ মৎস্য সম্পদ, শিল্প ও বাণিজ্য সরাসরি কৃষির সাথে সম্পর্কযুক্ত। এ দেশ কৃষি প্রধান দেশ হলেও অনুন্নত সেচ ব্যবস্থার কারনে এখনও এখানের কৃষি মৌসুমি জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। কৃষি ক্ষেত্রের সাফল্য অনেকাংশেই মৌসুমি জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশে দুই ধরণের মৌসুমি জলবায়ু রয়েছে। যথা-
- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি জলবায়ু যা গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হতে প্রবাহিত হয়।
- উত্তর-পূর্ব মৌসুমি জলবায়ু যা শীতকালে উত্তর-পূর্ব দিক হতে প্রবাহিত হয়।
বাংলাদেশের কৃষিতে মৌসুমি জলবায়ুর উপযোগিতা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১। মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে এদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। গ্রীষ্মকালে সমুদ্র হতে আগত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুুমি জলবায়ু স্থলভাগে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। ফলে সেচ ছাড়াই এদেশে কৃষিকাজ করা যায়। গ্রীষ্মকালীন কৃষিজ ফসলগুলোর মধ্যে পাট, ধান, শাক-সব্জি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আবার ফলের মধ্যে রয়েছে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, ডাল, নারিকেল ইত্যাদি।
২। শীতকালে উত্তর-পূর্ব শুষ্ক মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে তীব্র শীতপড়ে এবং স্বল্প বৃষ্টিপাত হয়। এই শুষ্ক আবহাওয়ায় প্রচুর শীতকালীন ফসল উৎপন্ন হয়। যেমন- ধান,গম, তামাক, সরিষা, ডাল, গোল আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া ইত্যাদি।
৩। শীতকালে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বিভিন্ন ধরনের শাক-সব্জি যেমন- লালশাক, পালংশাক্, মুলা, শিম, শালগম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, গাজর ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে জন্মে।
৪। মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে এদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে এদেশ নদী-নালা, খাল-বিল, পানিতে ভরে যায়। শীতকালে এসব জলাভূমি থেকে পানি সেচের মাধ্যমে প্রচুর ধান, গম, রবিশস্য জন্মানো হয়।
৫। মৌসুমি জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশে বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। নদনদীগুলো পানিতে ভরে যায়। ফলে নদীবাহিত পলিমাটি দ্বারা জমিগুলোর উর্বরতা বৃদ্ধি পায় যা প্রচুর ফসল উৎপাদন করতে সাহায্য করে।
৬। বর্ষাকালে মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওর, পুকুর-ডোবা পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এ জলাশয়গুলোতে এসময়ে প্রচুর মাছ জন্মায়। নদীগুলোতে প্রচুর ইলিশ ও গলদা চিংড়ি জন্মায়। ইলিশ মাছ উৎপাদনের জন্য মৌসুমি জলবায়ু অতুলনীয়।
৭। চা ও রাবার বাগান গড়ে উঠার জন্য বৃষ্টিপাত প্রয়োজন। চা ও রাবার আমাদের অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়িয়া এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে সেখানে চা ও রাবার শিল্প সমৃদ্ধি লাভ করেছে।
৮। দেশের পাট শিল্প, চা শিল্প, তামাক শিল্প ইত্যাদি শিল্পগুলোর পরিচালনার জন্য প্রচুর কাঁচামালের প্রয়োজন। বাংলাদেশে মৌসুমি জলবায়ু বিরাজ করায় এ সকল কৃষিজ পণ্য প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়।
৯। বাংলাদেশে বনভূমি গড়ে উঠার জন্য মৌসুমি জলবায়ুর অবদান অনেক বেশী। বাংলাদেশে উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু বিরাজ করায় চট্টগ্রাম, সিলেট, গাজীপুর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলাতে এদেশের বনভূমি গড়ে উঠেছে। এসব বনাঞ্চল থেকে প্রচুর বনজসম্পদ সংগ্রহ করা হয়।
১০। বাংলাদেশ উষ্ণমন্ডলে অবস্থিত হলেও মৌসুমি জলবায়ুর প্রভাবে এখানে সমভাবাপন্ন জলবায়ু বিরাজ করে। যা কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত সহায়ক।
প্রিয় পাঠক বন্ধু, উপরোক আলোচনার মাধ্যমে আমরা মৌসুমী বায়ু কাকে বলে? বাংলাদেশের কৃষিতে মৌসুমি জলবায়ুর গুরুত্ব ও উপযোগিতা সম্পর্কে জানতে পারলাম।
বাংলাদেশের কৃষি একান্তই জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল যেমন ফসল, মৎস্য চাষ কৃষিজ শিল্প, কৃষি পণ্য বাজারজাত করণ ইত্যাদি। শীতকালে উত্তরপূর্বে শুষ্ক মৌসুম বায়ুর প্রভাবে শীত পড়ে ফলে প্রচুর শীতকালীন ফসল জন্মে। গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি হয় ফলে আম, জাম, কাঠাল, লিচু, পাট, ধান শাকসবজি জন্মে। চা ও রাবার পাহাড়িয়া এলাকায় জন্মে কারণ এর জন্য বৃষ্টিপাত প্রয়োজন। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুর বিরাজ করায় বনভূমি গড়ে উঠেছে।
[তথ্য সূত্র: ওপেন স্কুল]