রসুন একটি বহুবর্ষজীবী ফসল। মধ্য এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলই রসুনের আদি নিবাস।
রসুন (Allium Sativum) Alliacee পরিবার ভুক্ত একটি অত্যন্ত গুুুরুত্বপূর্ণ কন্দ জাতীয় মসলা ফসল। এটি রান্নার স্বাদ, গন্ধ ও রুচি বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
রসুন ব্যবহারে অজীর্ণ, পেটফাঁফা, ডিপথেরিয়া, বাতরোগ ও যে কোন রকম চর্মরোগ সারে। এছাড়া রসুন থেকে তৈরি ঔষধ নানা রোগ যেমন- ফুসফুসের রোগ, আন্ত্রিকরোগ, হুপিংকাশি, বাতরোগ, কানব্যথা প্রভৃতিতে ব্যবহৃত হয়।
পুষ্টিমানে রসুনে শতকরা ৬২.০ ভাগ পানি, ২৯.৮ ভাগ কার্বহাইড্রেট, ৬.৩ ভাগ প্রোটিন, ০.১ ভাগ তেল, ১.০ ভাগ খনিজ পদার্থ, ০.৪ ভাগ আঁশ এবং ভিটামিন সি আছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বর্তমানে ৭১.৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে রসুন আবাদ করা হয় এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৪.৬২ লক্ষ মেট্রিক টন (বিবিএস, ২০১৭)।
(বিবিএস, ২০১৭)
বাংলাদেশে রসুনের জাতীয় গড় ফলন ৬.৪৭ টন/হেক্টর। চাহিদার তুলনায় ফলন অনেক কম। নিম্ন ফলনের মূল কারণ উচ্চ ফলনশীল জাতের অপ্রতুলতা।
রসুনের জাত উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ মসলা গবেষণার বিজ্ঞানীগণ বিগত কয়েক বৎসর থেকে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে বেশ কয়েক বছর বাছাই করণের মাধ্যমে সম্প্রতি রসুনের আরো দুইটি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছেন। এ জাত দুইটি বাংলাদেশের রসুনের নতুন উদ্ভাবিত জাত। ২০১৬ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বারি রসুন-৩ ও বারি রসুন-৪ নামে দুইটি জাত চাষাবাদের জন্য মুক্তায়ন করা হয়।
(১) রসুনের জাত
ক) বারি রসুন-১
বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রসুনের উচ্চ ফলনশীল জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০০৪ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক ‘বারি রসুন-১ নামে জাতটি অনুমোদিত হয়।
- এ জাতের গাছের উচ্চতা ৬০-৬২ সেমি।
- প্রতি গাছে পাতার সংখ্যা ৭-৮টি, প্রতি কন্দে কোয়ার সংখ্যা ২০-২২টি, কোয়ার দৈর্ঘ্য ২-২.৫ সেমি, কোয়ার ব্যাস ১-১.৫ সেমি, কন্দের ওজন প্রায় ১৯-২০ গ্রাম।
- কোয়া লাগানো থেকে ফসল উত্তোলন পর্যন্ত প্রায় ১৪০-১৫০ দিন সময় লাগে।
- জাতটির ভাইরাস ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধী এবং সংরক্ষণ ক্ষমতা ভালো।
- গড় ফলন ৬-৭ টন/হেক্টর।
খ) বারি রসুন-২
রসুনের এ জাতটি বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়।
- গাছের উচ্চতা ৫৬-৫৮ সেমি।
- প্রতি গাছের পাতার সংখ্যা ৯-১০টি, প্রতি কন্দে কোয়ার দৈর্ঘ্য ২.৫-৩ সেমি, কন্দের ওজন ২২-২৩ গ্রাম।
- জাতটি ভাইরাস ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং সংরক্ষণ গুণ ভাল।
- রোপণের সময় আশ্বিনের শেষ সপ্তাহ থেকে কার্তিকের শেষ।
- বীজের হার হেক্টরপ্রতি ৩০০-৪০০ কেজি (কোয়া)।
- ০.৭৫-১.০০ গ্রাম রসুনের কোয়া বীজ হিসেবে ব্যবহার করলে ফলন বেশি পাওয়া যায়।
- জীবনকাল ১২০-১৪০ দিন।তবে আবহাওয়াভেদে কোন কোন সময় কম বেশি হতে পারে।
- ফলন হেক্টরপ্রতি ৮-৯ টন।
- জাতটি বাংলাদেশের সব এলাকায় চাষ করা যায়।
গ) বারি রসুন-৩
২০১৬ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক ‘বারি রসুন-৩’ নামে জাতটি অনুমোদিত হয়। বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়েছে।
- গাছের উচ্চতা ৭১-৭২.৩৯ সেমি।
- গাছের পাতার রং গাঢ় সবুজ।
- গাছ মাঝারী ধরনের, প্রতি গাছে পাতার সংখ্যা ১০-১০.৭টি।
- এটি শীতকালীন জাত।
- এ জাতের জীবনকাল ১৩৫-১৪০ দিন।
- প্রতি বাল্বের কোয়ার সংখ্যা ২৩-২৪.৪৫টি, কোয়ার গড় দৈর্ঘ্য ২-২.৫২ সেমি, বাল্বের গড় ওজন ১১-১২.৪৩ গ্রাম ও বাল্বের গড় দৈর্ঘ্য ৩-৩.৩৯ সেমি।
- জাতটি ভাইরাস রোগ আক্রমণ সহনশীল এবং পোকামাকড় এর আক্রমণ কম হয়। তবে মাঝে মাঝে পার্পল ব্লচ ও পাতা ঝলসানো রোগ দেখা দিতে পারে।
- জাতটির হেক্টরপ্রতি ফলন ১০.৫-১১.৩১ টন।
ঘ) বারি রসুন-৪
২০১৬ সালে জাতীয় বীজ কর্তৃক ‘বারি রসুন-৪’ নামে জাতটি অনুমোদিত হয়।
- গাছের উচ্চতা ৬৭-৬৮.৩৯ সেমি।
- গাছের পাতার রং সবুজ।
- গাছ মাঝারী ধরনের, প্রতি গাছে পাতার সংখ্যা ৭-৮.৬৩টি।
- এটি শীতকালীন জাত।
- এ জাতের জীবনকাল ১৩০-১৪০ দিন।
- প্রতি বাল্বে কোয়ার সংখ্যা ১৭-১৮.৬৬টি, কোয়ার গড় দৈর্ঘ্য ২-২.২০ সেমি, বাল্বের গড় ওজন ১০-১০.৬২ গ্রাম ও গড় বাল্বের দৈর্ঘ্য ২-২.৯৭ সেমি।
- জাতটি ভাইরাস রোগ আক্রমণ সহনশীল এবং পোকামাকড় এর আক্রমণ কম হয়। তবে কখনও কখনও পার্পল ব্লচ ও পাতা ঝলসানো রোগ দেখা দিতে পারে।
- জাতটির হেক্টরপ্রতি ফলন ৮.০-৮.৭৮ টন।
(২) রসুন চাষ পদ্ধতি
ক) রোপণের সময়
মধ্য অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রসুনের কোয়া রোপণের উপযুক্ত সময়।
খ) বীজ হার ও দূরত্ব
হেক্টরপ্রতি ১ কেজি কোয়া (১ গ্রাম/কোয়া ওজন দরকার)। সারি ⨉ চারার দূরত্ব: ১০ কেজি ⨉ ১০ কেজি।
গ) ফসল উৎপাদন
- রসুন রোপণের দুই মাস পরে কন্দ গঠিত হতে থাকে। তিন থেকে সাড়ে তিন মাস পর কন্দ পুষ্ট হতে শুরু করে। ৪-৫ মাস পরে রসুন উত্তোলন করা যায়।
- পাতার অগ্রভাগ হলদে বা বাদামী হয়ে শুকিয়ে গেলে বুঝতে হবে রসুন পরিপক্ক হয়েছে। এছাড়া কন্দের বাহিরের দিকের কোয়াগুলি পুষ্ট হয়ে লম্বালম্বিভাবে ফুলে উঠে এবং দুই কোয়ার মাঝে খাঁজ দেখা যায়। এ সময় রসুন তোলার উপযুক্ত হয়।
- গাছ হাত দিয়ে টেনে তুলে মাটি ঝেড়ে পরিষ্কার করা হয়। এরপর কন্দগুলি ৩-৪ দিন ছায়ায় রেখে শুকানোর পর গুদামজাত করা হয়।
ঘ) গুদামজাতকরণ
- শুকনো রসুন আলো বাতাস চলাচলযুক্ত ঘরের মাচায় বেনি করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এতে রসুন ভাল থাকে।
- এছাড়া হিমাগারে ০-২০ সে. তাপমাত্রায় শতকরা ৬০-৭০% আর্দ্রতায় রসুন ভালভাবে বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায়।
(৩) অন্যান্য পরিচর্যা রোগ ও পোকামাকড় দমন
রোগ:
রোগ বালাইয়ের মধ্যে ব্লাইট, সফট রট, ড্যাম্পিং অফ, ডাউনি মিলডিউ এবং পাতা ঝলসানো রোগ হয়।
পাতা ঝলসানো রোগের ফলে পাতার উপর ছোট ছোট সাদাটে গোল দাগ দেখা যায়। এ রোগের ফলে পাতা প্রথমে হলদে ও পরে বাদমী রং ধারণ করে ঝরে পড়ে ও শুকিয়ে যায়।
এসব রোগ দমনের জন্য বর্দোমিক্সার (তুঁতেঃ চুনঃপানি = ১ঃ১ঃ১) বা ডাইথেন এম-৪৫/ রোভরাল ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পর স্প্রে করে দমন করা যায়।
পুষ্টির অভাব:
অনেক সময় পটাশিয়ামের অভাবে রসুনের পাতার ডগা শুকিয়ে যায়।
এ অবস্থা দেখা দিলে প্রধান সার হিসেবে পটাশিয়াম দেওয়া ছাড়াও পরবর্তীতে পটাশিয়াম সার দিলে ডগা শুকিয়ে যাওয়া রোধ করা যায়।
পোকা:
রসুন সাধারণত থ্রিপ্স/চুঙ্গি পোকা, রেড স্পাইডার ও মাইট দ্বারা আক্রান্ত হয়।
থ্রিপ্স পাতার রস চুষে খায় ফলে পাতায় প্রথমে সাদা লম্বাটে দাগ দেখা যায় পরে পাতার অগ্র ভাগ বাদামী হয়ে শুকিয়ে যায় এবং পাতা মরে নলের মত আকার ধারণ করে।
এসব পোকা দমনের জন্য ম্যালাথিয়ন/ডাইমেক্রন/জেসিড প্রতি লিটার পানিত ১ মিলি হারে স্প্রে করে সহজেই দমন করা যায়।
[সূত্র: বিএআরআই]