Skip to content

লটকন চাষের পদ্ধতি ও নিয়ম

লটকন চাষের পদ্ধতি ও নিয়ম

লটকন বাংলাদেশের একটি সুপরিচিত অপ্রধান ফল। প্রধান কান্ড ও ডালপালা থেকে সরাসরি ফুলের মঞ্জরী বের হয়। ছড়া জাতীয় মঞ্জরীতে এক লিঙ্গিক ফুল উৎপন্ন হয় অর্থাৎ স্ত্রী ও পুরুষ গাছ আলাদা।

ফলসহ লটকন গাছ
ফলসহ লটকন গাছ

বাংলাদেশে নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোণা ও সিলেট এলাকায় উল্লেখযোগ্যভাবে এর চাষাবাদ হয়। বিভিন্ন দেশে সীমিত আকারে লটকন রপ্তানি হচ্ছে।

(১) লটকনের জাত পরিচিতি

বারি লটকন-১:

লটকন বাংলাদেশে অত্যন্ত মধুর স্বাদযুক্ত একটি সুপরিচিত ফল। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০০৮ সালে ‘বারি লটকন-১’ জাতটি উদ্ভাবন করা হয়।

বারি লটকন-১
বারি লটকন-১
  • হেক্টরপ্রতি ফলন ১৮ টন।
  • ফল গোলাকৃতির, রং হালকা হলুদ থেকে বাদামী বর্ণের, শাঁস নরম, রসালো ও সুগন্ধযুক্ত।
  • ফলের গড় ওজন ১৫ গ্রাম।
  • এতে ৪-৫টি কোষ থাকে।
  • টিএসএস ১২.০০-১২.৫% জাতটি বাংলাদেশের সব এলাকায় চাষোপযোগী।

(২) লটকন চাষের পদ্ধতি ও নিয়ম

মাটি:

সুনিষ্কাশিত প্রায় সব ধরনের মাটিতেই লটকনের চাষ করা যায়। তবে বেলে দোআঁশ মাটি লটকন চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। লটকন গাছ স্যাঁত স্যাঁতে ও আংশিক ছায়াযুক্ত পরিবেশে ভাল জন্মে কিন্তু জলাবধদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।

জমি তৈরি:

চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল এবং আগাছামুক্ত করে নিতে হবে।

গর্ত তৈরি:

  • চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে ৭ ⨉ ৭ মিটার দূরত্বে ১ ⨉ ১ ⨉ ১ মিটার আকারের গর্ত করতে হবে।
  • প্রতি গর্তে ১৫-২০ কেজি জৈব সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি ও ২৫০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করে মাটির সঙ্গে ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে।
  • মাটি শুকনা হলে গর্তে পানি দিয়ে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে। এভাবে ১০-১৫ দিন গর্ত ভরাট করে রেখে দিতে হবে। তারপর ভালভাবে আবার কুপিয়ে চারা/কলম লাগাতে হবে।

লটকন গাছের চারা রোপণ:

গর্ত করার ১০-১৫ দিন পর নির্বাচিত চারা গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে লাগাতে হবে। চারা লাগানোর পরপরই পানি ও খুঁটি দিতে হবে। প্রয়োজনে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

লটকন এর চারা রোপণের সময়:

বৈশাখন্ডজ্যৈষ্ট (এপ্রিল-মে) মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে বর্ষার শেষের দিকে অর্থাৎ ভাদ্র-আশ্বিন (সেপ্টেম্বর) মাসেও গাছ রোপণ করা যেতে পারে।

সারের পরিমাণ:

প্রত্যাশিত ফলন ও গুণগত মানসম্পন্ন ফল পেতে হলে লটকন গাছে নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমাণও বাড়াতে হবে।

বিভিন্ন বয়সের গাছের জন্য প্রয়োজনীয় সারের পরিমাণ নিচের ছকে দেয়া হল।

সারের নামগাছের বয়স ১-৪ (বছর)গাছের বয়স ৫-১০ (বছর)গাছের বয়স ১১-১৫ (বছর)গাছের বয়স ১৫+ (বছর)
গোবর (কেজি)১০২০৩০৩০-৪০
ইউরিয়া (গ্রাম)৩০০৫০০৮০০১০০০
টিএসপি (গ্রাম)২০০৩০০৪০০৫০০
এমওপি (গ্রাম)২০০৩০০৪০০৫০০
জিপসাম (গ্রাম)১০০২০০২৫০৩০০

সার প্রয়োগ পদ্ধতি:

  • গাছের গোড়ার ০.৫-১.০ মিটার দূর থেকে যতটুকু জায়গায় দুপুর বেলা ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় সার ছিটিয়ে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে অথবা চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • মাটিতে রস কম থাকলে সার প্রয়োগের পরপরই পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • উল্লিখিত সার সমান তিন কিস্তিতে (১ম কিস্তি ফল সংগ্রহের পরপর, ২য় কিস্তি বর্ষার শেষে এবং ৩য় কিস্তি শীতের শেষে) প্রয়োগ করা যেতে পারে।

সেচ প্রয়োগ:

চারা রোপণের প্রথমদিকে ঘন ঘন সেচ দেয়া দরকার। ফল ধরার পর শুকনো মৌসুমে শীতের শেষে গাছে ফুল আসার পর ২/১টি সেচ দিতে পারলে ফলের আকার বড় হয় ও ফলন বাড়ে।

ডাল ছাঁটাই:

গাছের মরা ডাল এবং রোগ ও পোকা আক্রান্ত ডাল ছাঁটাই করে দিতে হবে।

ফল সংগ্রহ:

শীতের শেষে গাছে ফুল আসে এবং জুলাই-আগস্ট মাসে ফল পাকে। ফলের রং হালকা হলুদ থেকে ধূসর বর্ণ ধারণ করলে ফল সংগ্রহের উপযুক্ত সময়।

ফলন:

কলমের গাছে সাধারণত ৪ বৎসর বয়স থেকে ফল আসা শুরু হয় এবং সাধারণত ২০-২৫ বছরের গাছে সর্বোচ্চ ফলন হয়ে থাকে। অবস্থাভেদে গাছের বয়সের উপর ভিত্তি করে গাছপ্রতি ৪ কেজি থেকে ১২০/১৩০ কেজি পর্যন্ত ফলন হয়ে থাকে।

(৩) লটকন চাষে পোকা ও রোগ ব্যবস্থাপনা

ক) ফল ছিদ্রকারী পোকা

পোকা আক্রান্ত লটকন ফল
পোকা আক্রান্ত লটকন ফল

ফল ছোট অবস্থায় যখন ফলের খোসা নরম থাকে তখন এই পোকা ফলের খোসা ছিদ্র করে ডিম পাড়ে। পরবর্তীকালে ডিম থেকে কীড়া উৎপন্ন হয় এবং ফল পাকলে ফলের নরম শ্বাস খেয়ে থাকে।

প্রতিকার:

  1. আক্রান্ত ফল পোকাসহ নষ্ট করে ফেলতে হবে।
  2. প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে পারফেকথিয়ন বা লেবাসিড ৫০ ইসি মিশিয়ে ১৫
  3. দিন অন্তর ২-৩ বার ফল ছোট থাকা অবস্থায় গাছে স্প্রে করতে হবে।

খ) চেফার বিটল

চেফার বিটল
চেফার বিটল

এই পোকা পাতার নিচে ডিম পাড়ে এবং ডিম থেকে কীড়া উৎপন্ন হওয়ার পর কীড়া পাতা খেয়ে ছিদ্র করে ফেলে এবং আস্তে আস্তে সমস্ত পাতা খেয়ে জালের মতো করে ফেলে।

প্রতিকার:

সুমিথিয়ন/ডেবিকুইন ৪০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়।

গ) স্কেল পোকা

এই পোকা প্রথমে পাতার নিচে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বাচ্চা বের হলে এরা পাতার রস শোষণ করে খেতে থাকে। আস্তে আস্তে এরা কচি ডালেও আক্রমণ করে অবশেষে সমস্ত গাছকে মেরে ফেলে।

প্রতিকার:

এই পোকার আক্রমণ দেখা যাওয়া মাত্র ব্রাশ দিয়ে ঘষে মেরে ফেলতে হবে অথবা সাবানের পানি দিয়ে স্প্রে করলেও প্রাথমিকভাবে দমন করা যায়। আক্রমণ বেশি হল ট্রেসার/০.২ এমএল/লিটার) অথবা ফিপ্রোনিল (১ এমএল/লিটার) অথবা একতারা (০.৫ গ্রাম/লিটার) হারে স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।

ঘ) এ্যানথ্রাকনোজ

কলেটোট্রিকাম সিডি নামক ছত্রাক লটকনের এ্যানথ্রাকনোজ রোগের কারণ। গাছের পাতা, কান্ড, শাখা-প্রশাখা ও ফল এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। ফলের গায়ে ছোট ছোট কাল দাগ এ রোগের প্রধান লক্ষণ। ফল শক্ত, ছোট ও বিকৃত আকারের হতে পারে। ফল পাকা শুরু হলে দাগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে থাকে এবং ফলটি ফেটে বা পচে যেতে পারে।

প্রতিকার:

  1. গাছের নিচে ঝরে পড়া পাতা ও ফল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  2. গাছে ফল ধরার পর টপসিন-এম অথবা নোইন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম অথবা টিল্ট-২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর ২-৩ বার ভালভাবে স্প্রে করে এ রোগ দমন করা যায়।

ঙ) হঠাৎ করে গাছ মারা যাওয়া (উইল্ট)

ফিউজেরিয়াম নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ সমস্যা হয়। প্রথমে পাতা হলুদ হয়ে আসে এবং পরে শুকিয়ে যায়। এভাবে পাতার পর শাখা-প্রশাখা এবং ধীরে ধীরে সমন্ত গাছ ৮-১০ দিনের মধ্যে নেতিয়ে পড়ে ও মারা যায়।

প্রতিকার:

এ রোগের কোন প্রতিকার নেই। তবে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো নেয়া হলে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়।

  1. দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
  2. রোগের প্রাথমিক অবস্থায় বর্দোমিক্সার অথবা কুপ্রাভিট অথবা কপার অক্সিক্লোরাইড প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।
  3. বাগানের মাটির অম্লত্ব কমানোর জন্য জমিতে চুন প্রয়োগ করতে হবে (২৫০-৫০০ গ্রাম/গাছ)।
  4. রোগ প্রতিরোধী আদিজোড়ের উপর কলম করতে হবে।

[সূত্র: বিএআরআই]

Leave a Reply

nv-author-image

ইন বাংলা নেট কৃষি

পশু-পাখি পালন ও চাষাবাদ সম্পর্কিত যা কিছু বাংলাতে।View Author posts