Skip to content

 

লিচুর চারা লাগানোর নিয়ম, লিচু গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি ও লিচু গাছের পরিচর্যা

লিচুর চারা লাগানোর নিয়ম, লিচু গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি ও লিচু গাছের পরিচর্যা

প্রিয় পাঠক বন্ধু আজকে আমরা পোষ্টতিতে লিচুর জাত সমূহ, লিচুর চারা লাগানোর নিয়ম ও লিচু গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি, লিচু গাছের পরিচর্যা, লিচু কোন মাসে পাকে? ইত্যাদি বিষয়গুলো জানব।

আশা করি শেষ অবধি সাথেই থাকবেন ও লিখনীটি ভালো লাগলে অবশ্য কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে আপনার মূল্যায়ন জানাবেন।

চলুন শুরু করা যাক-

(১) লিচুর জাত সমূহ

বাংলাদেশের রাজশাহী ও দিনাজপুরে লিচুর ভালো ফলন হয়। লিচুর আনিনিবাস চীনে।

  • বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট লিচুর তিনটি জাত বের করেছে: বারি লিচু-১, বারি লিচু-২, বারি লিচু-৩ অন্য জাতসমূহ হলো: বোম্বাই, মাদ্রাজি, চায়না-৩, মঙ্গলবাড়ি, মোজাফফরপুরী, বেদানা লিচু।
  • বোম্বাই লিচু টকটকে লাল, মাদ্রাজি আগাম জাত, সবচেয়ে ভালো জাত চায়না-৩। এই জাতের গাছে প্রতিবছরই ভালো ফল ধরে।
  • বেদানা নাবি জাত। বারি লিচু-১ আগাম জাত, বারি লিচু-৩ মাঝ মৌসুমি জাত। কিন্তু বারি লিচু-২ নাবি জাত। লাগানোর জন্য এসব জাত থেকে যে কোনো জাত নির্বাচন করা যেতে পারে।

লিচু গাছে তিন থেকে ছয় বছর পর ফল ধরে। তবে ২০-৩০ বছর বয়স পর্যন্ত পিচু গাছে ফলন বাড়তে থাকে। প্রতিটি গাছ থেকে বছরে ৮০-১৫০ কেজি বা ৩২০০-৬০০০টি লিচু পাওয়া যায়।

চিত্র- লিচু
চিত্র- লিচু

(২) লিচুর চারা লাগানোর নিয়ম ও লিচু গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি

উপযোগী জলবায়ু ও মাটি: আর্দ্র আবহাওয়ায় লিচুর বৃদ্ধি ভালো হয়। পানি নিষ্কাশনের সুবিধা থাকলে লিচু গাছ সব ধরনের মাটিতেই জন্মাতে পারে। তবে উর্বর বেলে দো-আঁশ মাটি লিচুর জন্য উত্তম।

জমি তৈরি: উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে। চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল এবং আগাছামুক্ত করে নিতে হবে। বসতভিটায় দুইএকটি গাছ রোপণ করলে জমি তৈরি না করে সরাসরি গাছ রোপণের জন্য মানা করলেই হবে।

বংশবিস্তার: লিচুর অযৌন বংশবৃদ্ধির জন্য গুটিকলম একটি উত্তম পদ্ধতি হিসেবে সর্বত্রই স্বীকৃত। রোগ ও পোকামাকড়মুক্ত সুস্থ গাছের এক বছর বয়সের ডালে গুটিকলম করা হয়। মে-জুন মাস পিচুর গুটিকলম বাঁধার উপযুক্ত সময়। শিকড় আসতে প্রায় দুই মাস সময় নেয়।

চারা কলম: বীজ থেকেও অঙ্গজ পদ্ধতিতে লিচুর চারা তৈরি করা যায়। কিন্তু বীজ থেকে উৎপাদিত গাছে ফল ধরতে ৭-১২ বছর সময় লাগে। এ জন্য বীজ থেকে সাধারণত চারা উৎপাদন করা হয় না। চারা উৎপাদনের জন্য গুটিকলম লিচুর ক্ষেত্রে সর্বাধিক উপযোগী। তবে এ পদ্ধতি ছাড়া জোড়কলম, কুঁড়ি সংযোজন, ছেদ কলম প্রভৃতির মাধ্যমে সফলভাবে চারা উৎপাদন করা যায়।

See also  লিচু চাষ পদ্ধতি ও নিয়মসমূহ

চারা নির্বাচন: এক বছর বয়ষ্ক সুস্থ ও সবল গুটিকলমের চারা বাছাই করতে হবে। বড় চারা রোপণ না করাই শ্রেয়।

চারা রোপণের সময়: মধ্য-মে থেকে মধ্য-জুলাই এবং মধ্য-আগস্ট থেকে মধ্য-সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত চারা রোপণ করা যেতে পারে।

লিচু গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতি ও চারা রোপণ:

  • চারা রোপণের ১০-১৫ দিন পূর্বে গর্ত করতে হবে এবং সার ও মাটি মিশিয়ে গর্ত ভর্তি করতে হবে।
  • চারা রোপণের সময় সাবধানে চারাটি গোড়ার মাটির বলসহ গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে লাগাতে হবে।
  • চারা রোপণের পর পানি, খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • প্রতি গাছেই ইটের বা বাঁশের ঘের দেওয়া প্রয়োজন।
  • রোপণের ৬ মাস পরে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

লিচুর চারা লাগানোর নিয়ম:

  • পরিকল্পিতভাবে লিচুবাগান করতে পরিচ্ছন্নভাবে জমি তৈরি করে জমি সমান করতে হবে। মে-জুন মাসে জমি তৈরি করা ভালো।
  • জমিতে বর্গাকার বা ষড়ভূজি রোপণ প্রণালি অনুসরণ করে ১০ মিটার দূরে দূরে ১ মিটার x ১ মিটার × ১ মিটার আকারের গর্ত খনন করতে হবে।
  • রোপণের কয়েক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ জুন-জুলাই মাসে গর্ত করা উচিত।
  • গর্ত করার পর গর্তের উপরের মাটির সাথে গর্তপ্রতি ২০-২৫ কেজি জৈবসার, ২ কেজি হাড়ের গুঁড়ো বা ৫ কেজি কাঠের ছাই মিশিয়ে গর্ত ভরে দিতে হবে। তারপর তাতে পানি দিয়ে কিছু দিন রেখে দিতে হবে।
  • এরপর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের দিকে গর্তের মাটির সাথে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও এমওপি মিশিয়ে গর্ভের মাঝখানে লিচুর চারা বা গুটিকলম লাগাতে হবে।
  • চারা রোপণের পর পানি, খুঁটি ও বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • রোপণের ৬ মাস পরে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
  • প্রতি গাছেই ইটের বা বাঁশের ঘের দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনবোধে কিছু পাতা ছাঁটাই করা ভালো।
  • প্রতিবছর তিনবার অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি, মে ও অক্টোবর-নভেম্বরে সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • রোপণের বছর সার কম দিলেও বয়স বাড়ার সাথে সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

লিচু গাছে সার প্রয়োগের পরমিাণ:

  • এক থেকে তিন বছর বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ১০- ২০ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি ১৫০-২০০ গ্রাম।
  • চার-ছয় বছর বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ২০-৩০ কেজি ইউরিয়া ৬০০ গ্রাম, টিএসপি ৫০০ গ্রাম, এমওপি ২৫০-৩০০ গ্রাম।
  • ৭-১০ বছর বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ৩০-৪৫ কেজি ইউরিয়া ৭৫০ গ্রাম, টিএসপি ৭০০ গ্রাম, এমওপি ৫০০ গ্রাম।
  • ১০ বছরের বেশি বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ৫০-৬০ কেজি ইউরিয়া ১০০০ গ্রাম, টিএসপি ৭৫০ গ্রাম, এমওপি ৬০০ গ্রাম।

লিচু চাষে সেচ ব্যবস্থাপনা:

  • আবহাওয়া ও মাটির ধরন অনুসারে শীতকালে ১০-১২ দিন ও গ্রীষ্মকালে ৭-১০ দিন অন্তর সেচ দিতে হয়। তবে সারা বছর ১২৫ সেন্টিমিটারের বেশি সুষমভাবে বৃষ্টিপাত হলে সেচ না দিলেও চলে।
  • ফল ধরার পর নিয়মিত পানি সেচ দিলে ফলন বেড়ে যায়। ফল না ধরা পর্যন্ত লিচু বাগানে খরিপ ঋতুতে শসা, কুমড়া, ঝিঙ্গা, উচ্ছে বা করলা, মাষকলাই, গো মটর প্রভৃতি এবং রবি ঋতুতে বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন সবজি চাষ করা যায়। ফলসা, আনারস, পেঁপে প্রভৃতি ফলও আস্ত শস্য হিসেবে চাষ করা যায়।
See also  আধুনিক পদ্ধতিতে লিচু চাষে সেচ পদ্ধতি

(৩) লিচু গাছের পরিচর্যা

সঠিক সময়ে পরিচর্যা করলে লিচু গাছের যেমন- সুষম বৃদ্ধি হয়, তেমনি ফলনও বেশি পাওয়া যায়। লিচুগাছের পরিচর্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো আগাছা দমন, পানি সেচ, ডাল ছাঁটাই, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, রোগ-পোকা ও বাদুড় দমন ইত্যাদি।

ক) আন্তঃপরিচর্যা

আগাছা দমন: ভালো ফলনের জন্য লিচু বাগানে অন্তত বছরে দুইবার জাভীর চাষ নিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।

ডালপালা ছাঁটাই: পূর্ণবয়স্ক গাছে পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশের জন্য অপ্রয়োজনীয় ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। গাছের শুকনো ও রোগাক্রান্ত শাখা এবং পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত ডালও হেঁটে দিতে হবে। পুরনো শাখা ছেঁটে দিলে গাছে নতুন শাখা বের হয়, নতুন শাখায় ফুল আসে। তবে লিচুর ডাল ছাঁটাইয়ের বেশি প্রয়োজন হয় না। কারণ গাছ থেকে ফল সংগ্রহের সময় যেসব ছোট ছোট ডাল ভাঙা হয় তাতেই অনেকটা ডাল ছাঁটাইয়ের কাজ হয়ে যায়।

খ) পোকামাকড় দমন

লিচুর পোকামাকড়ের মধ্যে ফল ছিদ্রকারী পোকা ও লিচুর মাকড়ই বেশি ক্ষতি করে থাকে। ফল ছিদ্রকারী পোকা ফল পরিপক্ক হওয়ার সময় এ পোকা ফলের বোঁটার কাছ দিয়ে ভিতরে ঢুকে বীজ খেতে থাকে। এরা ফলের শাঁস খায় না তবে বোঁটার কাছে বাদামি রঙের একধরনের করাতের গুঁড়ার মতো পদার্থ উৎপন্ন করে। এতে ফলের বাজারমূল্য কমে যায়। এ পোকা দমনের জন্য অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। তবে ফল সংগ্রহের ১৫ দিন আগে স্প্রে করার কাজ শেষ করতে হবে।

লিচুর মাকড়: মাকড় লিচু গাছের পাতা, ফুল ও ফল আক্রমণ করে। আক্রান্ত পাতা কুঁকড়ে যায় এবং পাতার নিচের দিক লাল মখমলের মতো হয়। পরে পাতা দুর্বল হয়ে মরে যায় এবং ডালে ফুল, ফল ও নতুন পাতা হয় না।

দমনব্যবস্থা: ফল সংগ্রহের পর আক্রান্ত অংশ ভেঙে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এ পোকা দমনের জন্য অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। তবে ফল সংগ্রহের ১৫ দিন আগে স্প্রে করার কাজ শেষ করতে হবে।

গ) লিচুর রোগবালাই দমন

লিচুর বেশ কয়েকটি রোগের মধ্যে পাউডার মিলডিউ এবং অ্যানথ্রাকনোজ বা ফল পচা রোগই প্রধান। 

See also  লিচু চাষ পদ্ধতি ও নিয়মসমূহ

পাউডার মিলডিউ: লিচুর মুকুলে সাদা বা ধূসর বর্ণের পাউডারের আবরণ দেখা যায়। আক্রান্ত মুকুল নষ্ট হয় এবং করে পড়ে। রোগ দমনের জন্য গাছে মুকুল আসার পর অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক নিয়মে স্প্রে করতে হবে। 

অ্যানথ্রাকনোজ বা ফল পচা রোগ: এ রোগের আক্রমণে প্রথমে ফলের বোঁটার দিকে পানি ভেজা পচা দাগের সৃষ্টি হয়, যা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেয়ে সব ফল পচিয়ে ফেলে এবং একসময় ফল শুকিয়ে ঝরে পড়ে। এ রোগ দমনের জন্য লিচু বাগান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। নিচের মরা পাতা, আক্রান্ত ফল ও আগাছা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ফল গাছে থাকা অবস্থায় নিয়মিত অনুমোদিত ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে। ফল ঝরা ফল করা লিচুর একটি প্রধান সমস্যা। 

ফল ঝড়া: ফল ঝড়ে যাওয়া লিচু গাছের প্রধান একটি সমস্যা। পরাগায়ন ও গর্ভধারণে ব্যর্থতা, পুষ্টির অভাব, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, মাটিতে রসের অভাব, বাতাসে কম আর্দ্রতা, ঝড়ো বাতাস, পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের আক্রমণ এবং বেশি গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ার জন্যও লিচু করে যেতে পারে। গুটি বাঁধার সময় প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ১ গ্রাম জিংক সালফেট মিশিয়ে গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। সে সঙ্গে সেচ ও রোগ-পোকা দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

ফেটে যাওয়া: দীর্ঘ খরার পর হঠাৎ বৃষ্টি, শুষ্ক ও গরম হাওয়া, রোগ-পোকার আক্রমণে ফল ফেটে যেতে পারে। মাটিতে বোরন বা ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দিলে এবং আগাম জাতে এ সমস্যা দেখা দিতে পারে। মাটিতে জৈবসার ও সেচ দিতে হবে। বর্ষার শুরুতে ও শেষে গাছের গোড়ায় ক্যালসিয়ামজাতীয় সার যেমন- ডলোচুন গাছপ্রতি ১০০ গ্রাম করে ব্যবহার করতে হবে অথবা ফলের কচি অবস্থায় চক পাউডার ২ গ্রাম ও বোরিক এসিড প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। সেই সঙ্গে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে।

বাদুড় দমন: বাদুড়ের আক্রমণের কারণেও পিচুর ফলন হ্রাস পেতে পারে। বাদুড় দমনের জন্য ফল পাকার সময় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রচলিত ও সহজ উপায়গুলোর মধ্যে ঢোল-টিন পেটানো, বাঁশ ফোটানো, পটকা ফোটানো, বাগানের চারপাশে জাল পেতে রাখা, জাল দিয়ে ফল ঢেকে রাখা ইত্যাদি।

(৪) লিচু কোন মাসে পাকে?

ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে লিচু গাছে ফুল আসে ও মে-জুন মাসে পাকা ফল সংগ্রহ করা হয়। এ সময় ফলের খোসা লালচে রং ধারণ করে। কয়েকটি পাতাসহ গোছা ধরে পিচু সংগ্রহ করা হয়। এতে ফল বেশি দিন ধরে ঘরে রাখা যায়।

লিচু গাছে তিন থেকে ছয় বছর পর ফল ধরে। তবে ২০-৩০ বছর বয়স পর্যন্ত লিচু গাছে ফলন বাড়তে থাকে। প্রতিটি গাছ থেকে বছরে ৮০-১৫০ কেজি বা ৩২০০-৬০০০টি লিচু পাওয়া যায়।

[সূত্র: এনসিটিবি]

Leave a Reply

nv-author-image

inbangla.net/krisi

Everything related to animal and plants in the Bangla language!View Author posts

You cannot copy content of this page