কৃষক তার ফসলের মাঠে কী কী ফসল ফলান তা আমরা দেখেছি কি? ফসলের মাঠ পরিদর্শন কালে আমরা দেখতে পাবো কোন মাঠ ধানভিত্তিক, কোনটা ইক্ষুভিত্তিক, কোনটা তুলাভিত্তিক আর কোনটা পাটভিত্তিক।
(১) শস্য বহুমুখীকরণ কি?
মাঠ ফসলের বহুমুখীকরণ বলতে কোনো একক ফসল বা একক প্রযুক্তির উপর নির্ভর না করে ফসল বিন্যাস, মিশ্র ও সাথি ফসলের চাষ ও খামার যান্ত্রিকীকরণকে বোঝায়।
(২) শস্য বহুমুখীকরণের উদ্দেশ্য
নিচে শস্য বহুমুখীকরণের উদ্দেশ্যসমূহ উল্লেখ করা হলো-
- কাঙ্ক্ষিত ফসল বিন্যাস, শস্যের আবাদ বাড়ানো এবং কৃষকের আয় ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা
- খামারের কর্মকাণ্ড সমন্বয় করা এবং কৃষি পরিবেশের উপর প্রতিকূল প্রভাব কমিয়ে আনা।
- প্রচলিত শস্যবিন্যাসে উন্নত ফসলের জাত ও কলাকৌশলের সংযোগ ঘটানো।
- বীজের সাশ্রয় করা এবং উৎপাদন খরচ কমানো।
- প্রযুক্তি গ্রহণে কৃষকদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা ও সমাধান করা
ক) ফসলবিন্যাস
বাংলাদেশের ভূমি নানা জাতের ফসল চাষের উপযোগী। তবে প্রতিটি কৃষকই ফসলের বিন্যাস করে আবাদ করেন। ফসলবিন্যাস অর্থ হচ্ছে কৃষক সারা বছর বা ১২ মাস তার জমিতে কী কী ফসল ফলাবেন তার একটা পরিকল্পনা করা।
ফসলবিন্যাস করা হয় মাটির গুণাগুণ, পানির প্রাপ্যতা, চাষ পদ্ধতি, শস্যের জাত, ঝুঁকি, আয় এসব বিষয় বিবেচনা করে। ফসলবিন্যাসে একটি শিম জাতীয় ফসল অর্ন্তভুক্ত করে সারের চাহিদা হ্রাস করা সম্ভব এবং তাতে মাটির উর্বরতাও বৃদ্ধি পাবে।
খ) মিশ্র ও সাথি ফসলের চাষ
মিশ্র ও সাথি ফসলের চাষ বলতে একাধিক ফসল যা ভিন্ন সময়ে পাকে, ফলবৃদ্ধির ধরন ভিন্ন এবং মাটির বিভিন্ন স্তর থেকে খাদ্য আহরণ করে এরূপ ফসলের একত্রে চাষকে বোঝায়। মিশ্র ও সাথি ফসলে পোকামাকড়, রোগবালাই এবং আবহাওয়াজনিত ঝুঁকি হ্রাস পায়।
মিশ্র ফসলে একাধিক ফসলের বীজ একসাথে মিশিয়ে জমিতে বপন করা হয়। কিন্তু সাথি ফসলের ক্ষেত্রে প্রতিটি ফসলের বীজ আলাদা সারিতে বপন করা হয় বা আলাদা সারিতে ফসলের চারা রোপণ করা হয়।
গ) শূন্য চাষ পদ্ধতি
শূন্য চাষ অর্থ হচ্ছে বিনা চাষে ফসল ফলানো। বন্যাকবলিত এলাকায় ধানভিত্তিক ফসল বিন্যাসে শূন্য চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যেমন, বন্যার পানি নেমে গেলে মাটিতে রস থাকা অবস্থায় মসুর, ভুট্টা, রসুন ইত্যাদি রোপণ বা লাগানো যায় এবং ভালো ফলনও পাওয়া যায়। এতে কৃষকের ৩-৪ সপ্তাহ সময় বাঁচে।
ঘ) রিলে চাষ
কৃষকেরা একটি শস্যে ফুল আসার পর, কিন্তু অন্য শস্য কর্তনের প্রায় এক সপ্তাহ আগে কতিপয় সুবিধা পাওয়ার জন্য শিম জাতীয় বীজ বপন করেন। একেই রিলে চাষ বলা হয়। রিলে চাষের উদ্দেশ্য হলো সেচের সীমাবদ্ধতা, শ্রম ঘাটতি এবং সময়ের অভাব দূর করা। আমাদের কৃষকেরা সাধারণত খানের ক্ষেতে রিলে চাষ করে থাকেন। রিলে চার দ্বারা মাটির গঠন উন্নত হয় এবং উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।
ঙ) সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার
মাঠ ফসল বহুমুখীকরণের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে- অধিক উৎপাদন এবং অধিক আয়। জমি, সময়, বীজ, সার, সেচের পানি, কৃষি যন্ত্রপাতি, কৃষি প্রযুক্তি এগুলো হচ্ছে কৃষকের কৃষি সম্পদ। কৃষকের আয় নির্ভর করে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের উপর। যেমন- মিশ্র বা সাথি ফসলের চাষ হতে কৃষক অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারেন। আবার বিনা চাষে ফসল ফলালে সময় ও অর্থ উভয়ের সাশ্রয় হয়। আবার ফসল বিন্যাসে শিম জাতীয় শস্য আবাদের ব্যবস্থা থাকলে সারের চাহিদা হ্রাস পাবে।
(৩) মাঠ ফসলের বহুমুখীকরণের ব্যবহার
বাংলাদেশের জলবায়ু আর্দ্র ও উষ্ণভাবাপন্ন। এখানে মৌসুমি বায়ু প্রবাহের প্রাধান্য আছে। ফলে সারা বছরই এখানে তিনটি মৌসুমে নানাবিধ ফসল উৎপাদন করা যায়। এগুলো হলো রবি, খরিপ-১, খরিপ-২।
প্রতি মৌসুমে কৃষক তার ফসলবিন্যাসে সেসব ফসল অন্তর্ভুক্ত করেন। ফসলের উৎপাদন সময়, মাটির উর্বরতা, সেচের সুবিধা এসব বিষয় বিবেচনায় এনে ফসল নির্বাচন করেন।
নিচে মাঠ ফসলের বহুমুখীকরণের ব্যবহার হিসেবে কয়েকটি নমুনা উল্লেখ করা হলো-
ক) আলুর সাথে রিলে ফসল হিসেবে পটলের চাষ
এটি শস্য বহুমুখীকরণের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। কৃষক নিজেদের আর্থিক উন্নতির লক্ষ্যে চাষাবাদে অনেক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। এই চেষ্টার মধ্যে আলুর সাথে রিলে ফসল হিসাবে পটলের চাষ বেশ জনপ্রিয়।
রিলে ফসল অর্থ হচ্ছে একটি ফসলের শেষ পর্যায়ে আরেকটি ফসলের চাষ শুরু করা। এক্ষেত্রে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কৃষকেরা আগাম আলু চাষ করেন। ৫৫ সেমি দূরত্বে সারি করে আলু লাগানো হয়। প্রতি তৃতীয় সারি ফাঁকা রেখে সে সারিতে ডিসেম্বরে পটলের ডগা রোপণ করা হয়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে আলু উত্তোলন শেষ হয় পটল গাছ বড় হতে থাকে এবং মার্চ মাস থেকে পটল ধরতে থাকে এবং নভেম্বর মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়।
এ প্রযুক্তিতে পটলের জন্য আর সার প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়ে না। আর একই জমি হতে এভাবেই বাড়তি আয় সম্ভব।
অনুরূপভাবে আলুর সাথে রিলে ফসল হিসেবে করলার চাষ করা যায়।
খ) মিশ্র ফসল হিসাবে আলু ও লালশাকের চাষ
লালশাক স্বল্পমেয়াদি কিন্তু দ্রুত বর্ধনশীল। আলুর সাথে লাল শাকের চাষ একটি ভালো মিশ্র চাষ আগেই বলা হয়েছে যে, সারিতে আলুর চাষ করা হয়।
যখন আলু গাছের উচ্চতা ৫-৬ সে.মি. হয় তখন সারি বরাবর প্রথম মাটি তোলা হয়। এই তোলা মাটিতে লাল শাকের বীজ বপন করা হয়। আলু ও লাল শাক দুইটাই সমান সমান বাড়তে থাকে। লাল শাক দ্রুত বর্ধনশীল তাই কয়েক দফা শাক উঠানো হয়। ডিসেম্বর পর্যন্ত লাল শাক উঠানো যায়। লাল শাক তোলার পরও আলু বড় হতে থাকে। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে আলু তোলা হয়।
উল্লিখিত শস্যবহুমুখীকরণ পদ্ধতি ছাড়াও সাথি ফসল হিসাবে-
- আখের সাথে টমেটোর চাষ হয়।
- আখের সাথে সরিষার চাষ হয়।
- আখের সাথে মসুরের চাষ হয়।
মিশ্র ফসল হিসাবে-
- মসুরের সাথে সরিষার চাষ হয়।
- আউশের সাথে তিলের চাষ হয়।
- কলা বাগানে আউশের চাষ হয়।
কৃষি সম্পর্কিত যে কোন বিষয়ে জানতে– ‘ইন বাংলা নেট কৃষি’ (inbangla.net/krisi) এর সাথেই থাকুন।